নিরাকারের আবির্ভাব অথবা বীভৎস রসের কাহিনী

ইজেল

07 November, 2020, 12:45 pm
Last modified: 07 November, 2020, 06:45 pm
পুনরাবৃত্তি করিতেছি। লাকাঁ মহাশয় এই মরণেরই অপর নাম রাখিয়াছিলেন ‘নিরাকার’। মনে রাখিবেন, মরণের অপর নাম যদিও ঘুম, তাই বলিয়া ঘুমের অপর নাম কিন্তু মরণ নহে--ঘুম জীবনেরই অপর ক্রোড়। হেমাঙ্গিনী ঘুমায় কারণ তাহার জীবন আছে...

দুনিয়া বদলাইয়া ফেলা

দর্শনের দায় নয়

দর্শন বদলাইয়া ফেলাই

দুনিয়ার দায় বরং

আমি তাই হইয়াছি

মার্কস অব্যবসায়ী

--পেন্টি সারিকস্কি (২০০৩: ১৫)

 সেলিম মোরশেদের নাম আমি পহিলা শুনিয়াছিলাম বিদেশে বিভুঁইয়ে -খ্যাতনামা চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের জবানে। তিনি জানাইয়াছিলেন, এই লেখক প্রতিশ্রুতি দেখাইতেছেন -- তাঁহার বড় লেখক হইবার সম্ভাবনা। ইহা ইংরেজি ১৯৮৮ সাল কি ৮৯ সালের কথা। আমি একপ্রকার দেশ ছাড়িয়াছিলাম ১৯৮৬ সালের মধ্যভাগে। দেশে তখন সেনাপতি হোসেন মোহাম্মদ এরশাদের রাজত্ব। দেশে যাহাকে বলে দুর্নীতি ও স্বৈরতন্ত্র তাহার জয়জয়কার। অনেকটা আজিকার মত। অনেকদিন পর দেখা হওয়ার কারণে তারেক মাসুদকে প্রশ্ন করিয়াছিলাম -- সাহিত্যের খবর? তারেক মাসুদ ছবির খবর রাখিতেন, সুরের জগতেও তাঁহার আত্মীয়তা ছিল। বলা বাহুল্য সাহিত্যেরও তিনি মস্ত সমজদার। অনেকেই জানেন তিনি ছড়াও লিখিতেন আবু তারেক মাসুদ নামে। তিনি 'গাণ্ডীব' নামক একটি ছোট কাগজ বা লিটল ম্যাগাজিন আর সেলিম মোরশেদ নামক নতুন এক গল্পলেখকের কথা উচ্চারণ করিয়াছিলেন। জানাইয়াছিলেন, এই লেখক প্রতিশ্রুতিশীল -- তাঁহার বড় লেখক হইবার সম্ভাবনা আছে।

অনেকদিন পর দেশে ফিরিয়াছিলাম। ততদিনে এরশাদবিরোধী দুই জোটের রাজত্ব একবার করিয়া হইয়া গিয়াছে। সেলিম মোরশেদের দেখা পাইলাম আরও অনেকদিন পর। শুনিলাম, তিনি লিটল ম্যাগাজিন বা ছোট কাগজ ছাড়া অন্য কোথায়ও রচনাবলি প্রকাশ করেন না। দুর্ভাগ্যের মধ্যে, যে সকল ছোট কাগজে তিনি লিখিতেন সেগুলির সহিত আমার চেনা-পরিচয় ছিল স্বল্প। এতদিনে তাঁহার একটি গল্প সংকলন -- 'শ্রেষ্ঠ গল্প'--হাতে পাইলাম। ইহাতে দেখিলাম গল্প আছে এক ডজন। স্থির করিয়াছি, এই সংকলনের পহিলা গল্পটি --'কাটা সাপের মুণ্ডু' -- লইয়া সামান্য আলোচনা করিব। আরও কয়েকটি গল্প পড়িয়াছি। কিন্তু সময়ের অভাবে -- কিংবা বলিতে পারেন সাহসের অভাবে -- অধিক লিখিতে পারিলাম না। বলিয়া রাখিতে হইবে--কয়েক বছর আগে তাঁহার রচনা সংগ্রহের প্রথম খণ্ড হাতে পাইয়াছিলাম কিন্তু আজ পর্যন্ত পড়িবার অবকাশ কিংবা সাহস হয় নাই। শুনিয়াছি, তিনি যে ধরনের গদ্য লেখেন তাহাই এখন আদর্শ। আমি একটু পিছাইয়া আছি। সন্দেহ নাই, আমাদের ভাষায় প্রগতি সাধিত হইতেছে। আমার মত কোন কোন অভাজন কিছু পিছাইয়া পড়িলেও কোন মানুষ ঠাহর করিতে পারিবেন না। প্রগতির জয় অনিবার্য। সেনাপতি এরশাদের জমানায় আমাদের সাহিত্য যেমন আজও তেমন প্রগতির সাধনা করিতেছে। 

 ১

আশা করি একটি প্রশ্নে সকলেই একমত হইবেন যে কবিতা বা উপন্যাস -- এমনকি গল্পও -- শেষ পর্যন্ত ভাষায় লিখিতে হয়। ভাষা পদার্থটা যদি আমার অজানা থাকে তো সেই গল্প উপন্যাস যতই মহাকাব্য হয় আমার কিছু আসে যায় না। লু সুনের গল্প ভাল কি মন্দ বিচার করিবার আগে আমাদের নতুন বা পুরাতন চীনের ভাষায় কিছুটা জ্ঞান তো অর্জন করিতে হইবে। আমি এখানে অন্য ভাষায় অনুবাদের কথাটা হিশাবে লইতেছি না। এক্ষণে পিছন ফিরিয়া দেখি, যে সকল ছোট কাগজে সেলিম মোরশেদ লিখিতেছিলেন সেগুলির সহিত আমার কোন আত্মীয়তা হয় নাই --মানে পড়িতে পারি নাই -- বলিয়াই আমি তাঁহার লেখার রসাস্বাদনে বঞ্চিত হইয়াছিলাম। শুদ্ধ বঞ্চিত কেন, সত্যের দোহাই বলিতে হইবে মধ্যে মধ্যে লাঞ্ছিতও হইয়াছি। শুনিয়াছি, কোন এক অভাগা বলিয়াছেন, আহমদ ছফার পরে নাকি আর বুদ্ধিজীবী নাই আর রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর পর কবি জন্মে নাই। এই রকম অকথ্য কথা যিনি বলিতে পারেন তিনি তো ঊনবিংশ শতাব্দীতেই থাকিবেন -- ইহাই প্রাকৃতিক। এই কথাটা বেরহম কিন্তু বারো আনা সত্য। বাবা সরকারি চাকরিজীবী থাকিলে, বহু শহরে ঘুরিতে হইলে, কিংবা অনেক স্কুল-কলেজে পড়িতে হইলেও অনেকে সেলিম মোরশেদের মতন গল্পকার হইতে পারিবেন না। তাঁহার মনীষা আছে, তিনি সাধনা করিয়াছেন। তিনি গল্প ও উপন্যাস লিখিয়াছেন। দুঃখের মধ্যে, তাঁহার ভাষায় আমার অধিকার নাই। তিনি আমাদের দেশের বড় গল্প ও উপন্যাসকার। কিন্তু হামারি দুঃখের নাহি ওর -- তিনি আমার লেখক নহেন।

ভাষা বিষয়ে আমার সংস্কার আছে -- একথা স্বীকার করিতে দোষ কি! ফলে ভারতবর্ষের পরীক্ষক সুবিমল মিশ্রের গল্পে – উদাহরণস্বরূপ-- আমার অধিকার নাই। কিংবা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় নামক লেখকেও। এ বিষয়ে আমি ঊনবিংশ না হইলেও আদিবিংশ শতাব্দীর অনুসারী। এমন কি অকালপ্রয়াত শহীদুল জহিরের গল্প পড়ার ক্ষমতাও আমার জন্মায় নাই। সম্প্রতি অনেক সাধনা করিয়া আমাকে সেলিম মোরশেদের কয়েক পাতা পড়িতে হইল। পড়িয়া বড় লাভ হইয়াছে। সেই সংবাদটা জানাইবার জন্য এই কয়েক ছত্র লেখা। একদা 'জোড়াসাঁকোর ধারে' নামক স্মৃতিকথাযোগে ঠাকুরবাড়ির মনীষী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার মনের কথাটাই লিখিয়াছিলেন। উদ্ধৃতি খানিক চওড়া হইবে। আগাম প্রার্থনা করি, পাঠক ও পাঠিকা অপরাধ মার্জনা করিবেন।

ওরিয়েন্টাল সোসাইটির একজিবিশন হচ্ছে কর্পোরেশন স্ট্রীটের একতলা ঘরে। ভালো ভলো ছবি টাঙানো হয়েছে -- লাটবেলাট, সাহেবসুবো, বাবুভায়া, কেরানি, ছাত্র, মাস্টার, পণ্ডিত, সব ঘুরে ঘুরে দেখছেন। আমিও ঘুরছি বন্ধুদের সঙ্গে। কয়েকটি পাঞ্জাবি ট্যাক্সি-ড্রাইভার রাস্তা থেকে উঠে এসে ঘুরে ঘুরে ছবি দেখতে লাগল। আমাদের ড্রাইভারটাও ছিল সেইসঙ্গে। কৌতুহল হল, দেখি, এরা ছবি সম্বন্ধে কী মন্তব্য করে! জিজ্ঞেস করলুম, 'কী, কিরকম লাগছে?' একটি ড্রাইভার একখানি খুব ভালো ছবি দেখিয়ে বললে, এই ছবিখানি যেমন হয়েছে আর কোনোটা তেমন হয়নি। সেটি কার ছবি এখন মনে নেই। সেদিন বুঝলাম এরাও তো ছবি বোঝে। তার কারণ সহজ চোখে ছবি দেখতে শিখেছে এরা।

মতিবুড়ো একবার ঐরকম বলেছিলেন আমায়, 'ছোটোবাবু, একটা কথা বলব, রাগ করবেন না?'

বললুম, 'না, রাগ কেন করব, বলুন-না?'

'দেখুন ছোটোবাবু, আপনার ছাত্র নন্দলাল, সুরেন গাঙ্গুলি, ওরা ছবি আঁকে, দেখে মনে হয় বেশ যত্ন করেই ভালো ছবিই এঁকেছে। কিন্তু আপনার ছবি দেখে তা তো মনে হয় না।'

'ছবি বলে মনে হয় তো?'

'তাও নয়।'

'তবে কী মনে হয়?'

'মনে হয়--'

'বলেই ফেলুন-না, ভয় কী?'

'আপনার ছবি দেখলে মনে হয় আঁকা হয়নি মোটে।'

'সে কি কথা! আপনার কাছে বসে আঁকি আমি, আর বলছেন আঁকা বলেই মনে হয় না!'

'না, মনে হয় যেন ঐ কাগজের উপরেই ছিল ছবি।'

বড় শক্ত কথা বলেছিলেন তিনি। শক্ত সমালোচক ছিলেন বুড়ো, বড়ো সার্টিফিকেটই দিয়েছিলেন আমায়। এ কথা ঠিক, এঁকেছি, চেষ্টা করেছি, এ-সমস্ত ঢাকা দেওয়াই হচ্ছে ছবির পাকা কথা। গান সম্বন্ধেও এই কথাই শাস্ত্রে বলেছে। আকাশের পাখি যখন উড়ে যায়, বাতাসে কোনো গতাগতির চিহ্নই রেখে যায় না। সুরের বেলা যেমন এই কথা, ছবির বেলাও সেই একই কথা।' (অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০১৫: ১৫৯-১৬০)

সবিনয়ে যোগ করিতে চাই, 'ভাষার বেলায়ও সেই একই কথা'। ইহাতে আমার সাফাই হইল, সমস্যার কিন্তু উপায় হইল না। কবুল করিতে হইবে, দেখার দিকটি বদলাইলে ছবিও বদলাইয়া যায়। ছবিটি অন্যরকম দেখায়। সেলিম মোরশেদের গল্প আর কাহিনীতে দেখিলাম এই দেখার দৃষ্টিটা আলাহিদা। একথা অস্বীকার করার উপায় নাই।

'কাটা সাপের মুণ্ডু' গল্পের রস বীভৎস। ভারতীয় শাস্ত্রে এই রস মোটেই অপাংক্তেয় নয়। নায়িকার -- যদি নায়িকা শব্দের প্রয়োগে অন্যায় না হয় -- বাহারি নাম হেমাঙ্গিনী বা সোনার শরীরওয়ালি। নামটা ব্যাজস্তুতিপূর্ণ, সন্দেহ কি! তাহার মায়ের নামটা জানা যায় নাই। তবে গল্পকার -- কারণ তিনিই এক্ষণে পরম -- জানিতে পারিয়াছেন, 'অনেকদিন পর হেমাঙ্গিনী --জেনেছিলো তার মা সে-সময় গোপনে শরীর বেচতো'। বাবার নাম গগন পাল। গল্পের ভাষায়,'গগন দয়া করে হেমাঙ্গিনীকে বৈধ সন্তান বানাবে ভেবে জন্ম দিয়েছিলো। এ-ঋণে মা কতোদিন গগনকে শ্রদ্ধা করে গেলো। বাপ গগন তাকে, একদম ছোটবেলায়, গোটা তিনেক কমলালেবু কিনে দিয়েছিলো।' গোটা গল্পে সম্ভবত ইহাই একমাত্র সংবাদ যাহাতে স্নেহজাতীয় পদার্থ স্পর্শ করা যায়।

হেমাঙ্গিনী এখন ভিখারিণী। খানিক অঙ্গবৈকল্যও ঘটিয়াছে তাঁহার: 'বাম ঠ্যাং ব্যাঁকা। মিহি করে আঙ্গুলগুলো কাটা থাকায় সে ঠ্যাং-এর পাতা খড়মের কাঠ।' আর ডান হাতটা তাহার কি করিয়া নুলা হইল হেমাঙ্গিনী ঠাহরও করিতে পায় নাই। শরীর বেচার আনন্দ হইতে হেমাঙ্গিনীকেও গল্পের বয়াতি বঞ্চিত করেন নাই। তিনি কহিতেছেন,'চার মাস আগে সচল ছিলো; যখন সে পা খুঁড়িয়ে শীর্ণ দেহটা টেনে টেনে ভদ্দরলোকদের সংস্পর্শে যেতো, তার ডান হাত তখন "মেয়েলি"--অথবা কী এক অজ্ঞাত কারণে বুকের সঙ্গে লেপ্টে থেকে মুষ্টি থাকতো আপন গলার দিকে, জানতো, এ-ভাবে হাত বুকে থাকায় সে ভদ্দরলোকদের কাছে দস্তুর মতো বিশ্বস্ত।' ইহা নাটকের প্রথম অঙ্ক। হেমাঙ্গিনী ভিক্ষা করে। ভিক্ষাক্ষেত্রের বিবরণ অধিক হেমন্ত, আরো মনোহর: 'মুসলমানরা হেমাঙ্গিনীকে পয়সা দিয়ে আপিসে গেলো। শিশুদের দু'পায়ে শাদা ধবধবে মোজা। হেমাঙ্গিনী বসলো একটা জনবহুল ক্ষেত্রমুখে, ব্যস্তচলাচল গাড়ি এবং মানুষের উপস্থিতি সেখানে উৎকট। তার চারপাশে অফুরন্ত ধুলো। টুকরো চটের উপর গোটা দু-এক দশ-পয়সা অথবা সিকি--নিরিবিলি।' ভিক্ষাদাতারা মুসলমান -- খানিক চমক লাগে। এই পরিচয় সচরাচর নয়। হেমাঙ্গিনীর চোখ তো আমার চোখ নহে। দ্বিতীয় অঙ্ক গতাগতির চিহ্নে প্রায় ভরপুর।

গল্পের বয়ানে জানা যায়, 'বড়ো রাস্তার ধুলো কেটে কেটে হেমাঙ্গিনীর চলাচল। শহরে ভিখিরিদের সংখ্যা কমে গেছে। গভমেন্ট ভিখিরি পুনর্বাসন নামক এক আস্তানা করেছে, সেখানে ওদের খাওয়া-দাওয়া নি-রা-প-ত্তা-র ব্যবস্থা আছে। ধিঙ্গি বললো,"হেমাঙ্গিনী, ওদিকে আমি যাব নানে, খাওয়া পরার নামে ওরা আমাদের মেরে ফ্যালবেনে, মেরে ফেলে ফকির কুমোবে ওরা।" সে আরও বললো,"দু-তিন শো ফকির নাকি গ্রামের দিকে চলে গেছে।" হেমাঙ্গিনী এসব শুনলো, গেলো না কোথাও, খুপরির ভেতরেই সে নির্বিঘ্নে মরবে।'

তৃতীয় অঙ্কে ভাসিয়া আসে হেমাঙ্গিনীর খুপরির দৃশ্য: 'পাঁচ হাত লম্বা খুপরিটার উচ্চতা প্রায় চার হাত; উপরে ছাদ হিসেবে ভাঙা টিন -- ছেঁড়া ত্রিপল -- ক'একটা কঞ্চি এবং ধূসর গোলপাতা। চারপাশে মাটি ও চাটাই একত্রে গ্রথিত। বস্তি বস্তিই।' এই বস্তির মধ্যেই হেমাঙ্গিনীর খুপরি: 'তার খুপরি এক পুরনো জংশনের পেছনে। এ-জংশন নিশ্চল এবং ভাঙা। এ-পথে রেল চলে না এখন। লাইনের পাটিগুলো এখন ঝড়ে-পড়া গাছের শিকড়ের মতো মাটি থেকে উপড়ে গিয়ে বেঁকে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে। দিনে সেখানে দু-একটা গরু ঘাস খায়। স্বল্প স্পন্দনপুষ্ট এ জায়গায় চার-ঘর বস্তি আছে। কাচ্চা-বাচ্চা, মেয়ে-মরদ নিয়ে দশ জন হবে; তারা অধিকাংশই কৃশ, রোগাক্রান্ত, আপসকামী অনাথ মানুষ।' 

চতুর্থ অঙ্কে পাই হেমাঙ্গিনীর খুপরির অভ্যন্তর। আগে তো সারাদিনের হিশাব -- তারপরে না হয় অন্য কথা: 'সারাদিন আয় তার ত্রিশ পয়সা। সকালে পয়সাগুলো দিয়ে একটা রুটির অর্ধেক খেয়েছে ইটের হোটেল থেকে। আর একজনকে সঙ্গে নিয়ে ষাট পয়সা দিয়ে আটার একটা রুটি কিনে হেমাঙ্গিনী আর সে লোক খেয়েছে। পলকে অর্ধেক রুটি পেটের ভেতর মিশে যাওয়ায় হেমাঙ্গিনী রেগে আছে তখন থেকে।' এই রাগ যবন বীর-পুরুষের উব্রিসের মত।

হেমাঙ্গিনী এখন -- মানে রাতের বেলায় – বাড়ি -- মানে খুপরিতে --ফিরিবে: 'এখানে আলো নেই, অন্ধকার প্রকট, বিড়ির আগুনে রাতের অন্ধকার গোমেদ-কালচে হিম। একমাত্র মসি এখানে সুস্থ ও সুঠাম পুরুষ, সে কালো হলেও দয়ালু, তার বয়স ত্রিশ। মসির অর্ধেক বয়সটা হেমাঙ্গিনী নিয়েছে; রাতের বেলায় খুপরিতে ফেরার সময় মসিকে দেখলো হেমাঙ্গিনী, ভাত খাচ্ছে। হেমাঙ্গিনীকে দেখেই বললো,"তোর চুলোয় আগুন দিয়ে আইছি ---চাল চড়াবি নাকি?" এ-কথায় হেমাঙ্গিনী হালকা প্রসন্ন হলেও উত্তর দিলো না।' 'কালো হলেও দয়ালু' কথাটা 'মুসলমান ভিক্ষাদাতা' আর শিশুদের 'দু'পায়ে শাদা ধবধবে' মোজার মতো দাগা দিয়া যায়। উত্তর দেয় না। কালোর সহিত দয়ার কি সম্পর্ক! অন্ধকার অন্ধকারেই থাকিয়া যায়।

হেমাঙ্গিনী কেন উত্তর দিল না তাহা একটু -- বা আধাআধিটুকু-পরেই পরিষ্কার: 'খুপরির ভেতর মাটির লেপা চুলোয় আগুনের নীলচে আঁচ রবীন্দ্রনাথকে পুড়িয়ে দিয়ে মরা হাড়ের অস্তিত্ব সারা খুপরিতে ছড়িয়ে দিয়েছে।' এখানে অকস্মাৎ রবীন্দ্রনাথকে কেন পোড়াইতে হইল তাহা প্রথম আলো হইল না। বুঝিতে হইল, তাঁহার কবিতা না গেলেও বিচিত্র পথে, হইয়াছে সর্বত্রগামী। বোঝা গেল রবীন্দ্রনাথও মেঘের মতন -- 'আস্তা বহুগামী'। দেখা গেল: 'চুলোর পাশে কলস, তোবড়ানো মগ, হেমাঙ্গিনীর ফুটো থালা, থালার কোণে কিছু লবণ, জং-ধরা বটি, আর হেমাঙ্গিনীর সংসার।' আজি রজনী যায়। হেমাঙ্গিনী চুলায় চাল চড়ায় নাই। সে বরং এক মগ পানি খাইয়া প্রায় শেষ হইয়া যাওয়া কেরোসিন ল্যাম্পে আগুন জ্বালাইয়া চাটাইয়ের দরজা টানাইয়া শুইয়া পড়িল। বয়াতির আলো-অন্ধকার ভাষায়: 'সে মাটিতে শুয়ে পড়লে শরীর অবশ হয়ে ওঠে, ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি থেকে বুকের পোকে-কাটা আলুথালু দুধদুটোয় ক্ষুধা ও ক্লান্তির রোদ-গলা তামা।'

এক্ষণে মহাকাব্যের শেষ অঙ্কে পৌঁছিতেছি আমরা: 'হেমাঙ্গিনী চোখ উপরদিকে তুললে সেখানে গোলপাতা গলিয়ে আকাশ দেখা যায়, নক্ষত্রবিন্দু সূর্য হয়ে হেমাঙ্গিনীর চোখের ভেতর জ্বলে;--হেমাঙ্গিনী তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ।' 

হেমাঙ্গিনী একদিন নিজের চারি হাত উঁচু খুপরিতে 'হালকা হলদেসহ জলপাইরঙ্গা এবং লেজ ক্রমশ সরু ও কুচকুচে কালো মোটা লাঠির মতো দু'হাত লম্বা বিষাক্ত সাপ' দেখিয়াছিল। এক্ষণে নির্বিকার আকাশ দেখিতেছিল সে: 'হঠাৎ গোলপাতার ভেতর নড়াচড়ার শব্দে দেখলো চর্বিযুক্ত পেটিটা স্পষ্ট হচ্ছে আরও। তার সারা শরীর শিরশির করে উঠে মাটির উপর দুলে উঠলো।' হেমাঙ্গিনীতে সাহস সঞ্চার করিলেন আমাদের বয়াতি-গল্পকার: অনেকটা ঠাণ্ডাযুদ্ধের যুগে কতিপয় জোটনিরপেক্ষ দেশের মতন এই সাহস সম্বল করিয়া 'হেমাঙ্গিনী ক্ষিপ্রকারী মুহূর্তে মরিয়া হয়ে বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল ও তর্জনীর মূল সহায়তায় ছোবলে, এক ঝটকায় গোলপাতা থেকে সাপটাকে টেনে আনলো। তার হাতের ভেতর জমাট বরফের ঝটপটানি চরম ক্রুদ্ধতায়।' এখানেই শেষ নহে ঘটনার। 

পথের শেষ কোথায় জানি না কিন্তু জানি পথশেষের পরেও পথ আছে: 'ইতোমধ্যে ওটা সারা শরীর দিয়ে বারকয়েক হেমাঙ্গিনীর সমগ্র বাম হাত পেঁছিয়ে ধরতে চাইলো।' হেমাঙ্গিনীর ভাগ্য ভালো। ইশ! মসি -- যাহার বিশেষণ 'কালো ও সুঠাম পুরুষ'--তাহার চুলায় আগুন দিয়া আসিয়াছিল সন্ধ্যায়। অস্বীকার করিবার উপায় নাই, 'মসির অর্ধেক বয়সটা হেমাঙ্গিনী নিয়েছে।' সে জিজ্ঞাসিয়াছিল, 'চাল চড়াবি নাকি?' হেমাঙ্গিনী এক্ষণে চাল নহে চড়াইতেছে সাপ: 'হেমাঙ্গিনীর খুপরিতে মাটির চুলোর গভীরে আগুন জ্বলে, মুষ্টিবদ্ধ টাটকা সাপ তাই আগুনের বেশ ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে সে অপেক্ষা করলো।'

অপেক্ষায় আনন্দ আছে, সন্দেহ নাই: 'প্রায় আধ ঘণ্টা পর পোড়া কাঁচকলার মতো সিদ্ধ সাপ হেমাঙ্গিনী পেট পুরে খেতে খেতে ভাবলো -- ভয়ঙ্কর সাহসী হলেই খেতে পাওয়া যায়।' এই সাপ -- কাহিনীকার জানাইতেছেন -- যে সে সাপ নহে, এ সাপ অভিজাত! "এ শঙ্খচূড়।" অধিক কি! 'পুরো সাপটাই সে একবার খেয়েছে: তার হাতের আঙ্গুল ও চেটোর ভেতর এখন রয়েছে কেবল দাঁতে-কাটা নিখুঁত মুণ্ডু। হেমাঙ্গিনী কাটা মুণ্ডুটা মাটিতে ফেলে দিয়ে, দগ্ধ হাত নিয়ে, ঠাণ্ডা মাটিতে বহুদিন পর ঘুমুতে চাইলো পরম নিশ্চিন্তে।'

হেমাঙ্গিনীর খুব খিদা (গল্পলেখকের ভাষায় 'ক্ষুধা') পাইয়াছিল। তাঁহার খাওয়া--মনে হইতে পারে-- ইতিহাসের অন্তর্গত নয়: শঙ্খচূড়ের 'গলা পর্যন্ত খাওয়ায় তার দাঁতে ও মুখে বোঁটকা গন্ধ এবং মাংসের আঁশ। মুষ্টির বাইরে বেরিয়ে রয়েছে মাংসল অল্পাংশ। সে ওই শেষ অংশটুকু দাঁতে কেটে গালে লবণ ছিটিয়ে, অতি ধীরে চিবিয়ে চিবিয়ে খেলো।' কিন্তু ইহারও ইতিহাস আছে: 'হেমাঙ্গিনী পেটে থাকতে তার মা বটি দিয়ে ঢ্যাঁড়স টুকরো করে আগুনে সেদ্ধ করে খেয়েছিলো, তাই পাঁচটা আঙ্গুল সে সময় পেটের ভেতর গলে গেলো। হেমাঙ্গিনীর মা দুঃখে কথাটা বলেছিলো মরার আগে।' না, ইহা ইতিহাস নহে -- হয়তো প্রাগিতিহাস। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যে প্রাগিতিহাস রচনা করিয়াছিলেন ইহার বয়স তাহার কম কি! এক্ষণে হেমাঙ্গিনী একাই একশ, অন্তত একের ভেতর দুই -- সে একাধারে পাঁচী ও ভিখু।

ইতিহাস অন্য জিনিশ: 'হেমাঙ্গিনীর মা দু'গ্রাম পেরিয়ে এক জলার ধারে যেতো; --সেখানে গেলে জলার পানি কমে যেতো, আর তেলো টাকি চ্যাং জ্যান্ত দু'একটা ধরে আঁচলে কলমি শাক নিয়ে সন্ধ্যায় মা যখন ফিরতো, পুরনো কালের নাঙ ওসমান দু'কৌটো চাল দিতো। খুশিতে হেমাঙ্গিনীর মা কুঁচকির ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ভাত চড়িয়ে মাছ কুটতো, আর সে ভাতের গন্ধে বস্তির অন্যান্য ছেলেরা, যাদের বয়েস সাত/আট, তারা না বুঝে কালো পাছা বের করে, একে অপরের পিঠের ওপর লাফ দিয়ে খেলা করতো। গরম ভাতের উপর জ্যান্ত চ্যাং-এর পেটি। উল্লাস। সে কী উল্লাস। সে কেবল হেমাঙ্গিনীই জানে। জানে, গরম উনুনে ন্যাতানো কলমি শাক কীভাবে গলা গলিয়ে পেটের নাড়িতে পেঁচিয়ে যায়।'

মানুষের ক্ষুধা কি বীভৎস হইতে পারে! হইতে পারে শুদ্ধ তখনই যখন বাঁচিয়া থাকা মৃত্যু হইতেও ভয়ংকর। তবু মানুষ বাঁচিয়া থাকা বাছিয়া লয়। এই ভয়ংকরের আবির্ভাবকেই জনৈক ফরাশি ধুরন্ধর -- ভদ্রলোকের নাম জাক লাকাঁ -- চিহ্নিত করিয়াছেন 'নিরাকার' নামে। যখন আকার (বা ভাষা) ও সাকার (বা ছবি) একাকার হইয়া যায় তখনই নিরাকারের আবির্ভাব। কেহ কেহ বলেন 'একাকার'। খিদার আকার নাই।

এক্ষণে ঠাহর পাইতেছি,'খুপরির ভিতর মাটির লেপা চুলোয় আগুনের নীলচে আঁচ' কেন 'রবীন্দ্রনাথকে পুড়িয়ে দিয়ে মরা হাড়ের অস্তিত্ব সারা খুপরিতে' ছড়াইয়া দিয়াছিল। নিরাকারের গল্প আমাদের ঠাকুরও কম লেখেন নাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরচিত 'শাস্তি' গল্পের শেষ দৃশ্যে এই নীলচে দহনের ছায়াসম্পাত ঘটিয়াছে খানিক ধূসর। লাকাঁ মহাশয় আরো কহিয়াছেন, নিরাকারের অপর নাম 'মরণ'। স্বামী জিনিশটা আকার মাত্র। সামান্য উদ্ধার করি:

জেলখানায় ফাঁসির পূর্বে দয়ালু সিভিল সার্জন চন্দরাকে জিজ্ঞাসা করিল, "কাহাকেও দেখিতে ইচ্ছা কর?" 

চন্দরা কহিল,"একবার আমার মাকে দেখিতে চাই।"

ডাক্তার কহিল "তোমার স্বামী তোমাকে দেখিতে চায়, তাহাকে কি ডাকিয়া আনিব।"

চন্দরা কহিল, "মরণ।--" (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৪২২: ৩৮৩)

পুনরাবৃত্তি করিতেছি। লাকাঁ মহাশয় এই মরণেরই অপর নাম রাখিয়াছিলেন 'নিরাকার'। মনে রাখিবেন, মরণের অপর নাম যদিও ঘুম, তাই বলিয়া ঘুমের অপর নাম কিন্তু মরণ নহে--ঘুম জীবনেরই অপর ক্রোড়। হেমাঙ্গিনী ঘুমায় কারণ তাহার জীবন আছে: '... সেই ঘুমের ভেতর হেমাঙ্গিনী জেনে গেলো, কাটা উরঙ্গের মুণ্ডুটা, হেমাঙ্গিনীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত এক পাক ঘুরে, জাজ্বল্যমান খুপরি ছেড়ে পেরিয়ে গেলো নিঃশব্দে।' ঘুমের মধ্যে আকার আসিয়া হাজির হইয়া থাকে। ঘুমই প্রমাণ করিতেছে হেমাঙ্গিনীর অঙ্গে হেম আছে। মাংসল অল্পাংশই সবটুকু নহে।

একটা দুঃখ কিন্তু রহিয়াই গেল আমার। এহেন গল্প যিনি কল্পনা করিতে পারেন, এমন যাঁহার আলাহিদা দৃষ্টি, তাঁহার ভাষা কেন এমন অপরাধীন হইবে! যাঁহার জগদ্দৃষ্টি এহেন সর্বত্রগামী তিনি কি করিয়া ভাষার কাহিনী দেখিবার সময় এমন উরগ হইয়া চলেন! এই সরীসৃপ ভাষা আর সেই জাজ্বল্যমান খুপরি একসঙ্গে বাস করিতে পারে না। নির্ঘাত বাহির হইয়া যায় নিঃশব্দে। নচেৎ কি করিয়া তিনি লিখিতে পারেন--'সে কী উল্লাস!' অথবা 'জানে, গরম উনুনে ন্যাতানো কলমি শাক কীভাবে গলা গলিয়ে পেটের নাড়িতে পেঁচিয়া যায়।' 'অথবা কী এক অজ্ঞাত কারণে বুকের সঙ্গে লেপটে থেকে মুষ্টি থাকতো আপন গলার দিকে, জানিতো, এ-ভাবে হাত বুকে থাকায় সে ভদ্দরলোকদের কাছে দস্তুরমতো বিশ্বস্ত। কয়েকটা কাজ ছাড়া হেমাঙ্গিনী এ-হাতটা ব্যবহারে তেমন উৎসাহী ছিলো না; তবে হাত তার নিয়ন্ত্রণে ছিলো।' আহা, কি করিয়া পারেন! অন্ধকারের উঁকি কি প্রবল শক্তিধর! 'ক'একটা', 'দু-একটা' 'আরশ-এর' প্রভৃতি বানানের সমস্যা অপরাধীনতার স্মৃতিকথা মাত্র নহে। হায়রে বাংলা ভাষায় 'আরশ' শব্দটা এখনও মিশিল না -- এমন কি নজরুল ইসলাম 'খোদার আসন আরশ ছেদিয়া' লিখিবার পরও। নহিলে --'আরশ-এর' লেখার দায় চাপিত না। 'আরশের' লিখিলে লোকে পাছে কি না কি বোঝে!

'ক' অক্ষরে অকারণ দীর্ঘ ঈকারের এহেন জবরদস্তি বা জোরাজুরি আর দুই লব্জের মধ্যখানে অবারিত হাইফেনের ছড়াছড়ি দেখিলেই বুঝিতে পারি রবীন্দ্রনাথকে পুড়িয়ে দেওয়া একটা কথার কথা মাত্র। 'ক'একটা কঞ্চি' আর 'জ্যান্ত চ্যাং-এর পেটি' দেখিলেই বুঝিয়া লই কেন এই লেখক লেখেন, 'তখন ক্ষুধা, কী ক্ষুধা!' হায়, আমার বাংলা ভাষা! তোমার এই দশা হইল কোন পাপে, বাপ!

সেলিম মোরশেদের গল্পটাকে আপনি ইচ্ছা হয় প্রবন্ধও বলিতে পারিবেন। আমি ইহাকে কবিতাজ্ঞানেই প্রণাম করিলাম। একজন বিদেশি কবি--ঘটনাচক্রে ইনি ইতালিয়া-লিখিয়াছেন: পশু না হইলে আমরা ঘুমাইবই বা কেমন করিয়া? 

 

Essere animale per la grazia

di essere animale nel tuo cuore.

Mi scorge amore, mi scorge quando dormo.

Per questo io dormo. Di solito io dormo.

 

To be animal for the grace 

of being animal in your heart.

Love sees me, sees me while I sleep.

It's why I sleep. Usually I sleep. 

আমার ভাঙ্গা বাংলায় ইহার রূপান্তর দেখিবেন এই রকম দাঁড়াইয়াছে--

তোমার অন্তরের পশু হইব বলিয়া 

আমার এই পশোয়াস্তি।

পীরিতি আমাকে দর্শে, ঘুমের ভেতর দর্শে

তাই ঘুমাই আমি। আমি ঘুমাই অভ্যাসের বশে।

(পাত্রিৎসিয়া কাবাল্লি ২০১৩: ২৩২-২৩৩)

কথা আর বাড়াইব না আজ। যাঁহারা সমাজ পরিবর্তনের জন্য গল্পকাহিনী লেখেন, তাঁহারা বড়লোক, তাঁহাদের সমীপে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করে: 'গল্পকাহিনী -- এসব গল্পগাছা--বদলাইবে কে?' সেলিম মোরশেদ যাহা দেখিয়াছেন বলিয়া মনে করিয়াছেন তাহাই লিখিয়াছেন। সমাজকে না বদলাইলেও তিনি গল্পকে বদলাইতে শুরু করিয়াছেন। তিনি আলাহিদা হইয়াছেন। আমি হয়তো দেখিলাম অল্প হইয়াছে -- আবার অতি অল্প হইয়াছে দেখিলাম।

দেখিলাম কি? হেমাঙ্গিনীর স্বপ্নই ভাষা পাইয়াছে পাত্রিৎসিয়া কাবাল্লির কবিতায়। কথাটা আগেও একবার উদ্ধার করিয়াছি -- পুনরাবৃত্তিতে দোষ নিবেন না: 'সেই ঘুমের ভেতর হেমাঙ্গিনী জেনে গেলো, কাটা উরঙ্গের মুণ্ডুটা, হেমাঙ্গিনীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত এক পাক ঘুরে, জাজ্বল্যমান খুপরি ছেড়ে বেরিয়ে গেলো নিঃশব্দে।' ছাড়িয়া গিয়া উরগ ভালই করিয়াছিল। নহিলে হেমাঙ্গিনী নামের কোন হিল্লে -- মানে সার্থকতা লাভ -- হইত না। একমাত্র ঘুমের ভেতরই পীরিতি আমাকে থামাইবে। দর্শিবে -- দেখিতে পাইবে। আমার খুপরি জ্বলিতে থাকিবে। এই ভাষাকে -- মানে গগনকে --যদি না শ্রদ্ধা করিয়া গেলেন তো কাকশিয়াল নদীতেও স্রোত থাকিবে না।

সেলিম মোরশেদের জগত বিষণ্ন, বিমর্ষ এবং বীভৎস। তাঁহার সাহস মৃত্যুভয়হীন। তিনি অনায়াসে জীবনত্যাগ—দেহত্যাগ--করিতে পারেন। এই ত্যাগ তুচ্ছ নহে। কিন্তু সমস্যাও সেখানে নহে। মৃত্যু অনিবার্য। তাহা যে কেহ বাছিয়া লইতে পারে। সমস্যা তখনই যখন আপনি মৃত্যুকে ত্যাগ করিতে পারেন না। মৃত্যুকে ত্যাগ করিয়া জীবনকে বাছিয়া লওয়া আরও শক্ত, আরো শোকাবহ। জীবন তো পরম প্রভুর দত্তক। তিনি যখন ইচ্ছা তাহার ধন অধিগ্রহণ করিতে পারেন। কিন্তু আপনার খোলসটি তো -- আপনার নামটি -- আপনারই। আপনি তাহা ত্যাগ করিতে পারেন না। গল্পে আছে --পরম প্রভু তাঁহার একদা প্রিয় কোন এক ফেরেশতাকে জার্মান বন্দীশিবিরের মহাপরিচালক নিযুক্ত করিয়াছিলেন।

কোন বড় লেখক যখন বড় বড় ব্যবসায় বা বাণিজ্যে নিয়োজিত পত্রপত্রিকায় না লিখিয়া থাকিবার লোভ অনায়াসে ত্যাগ করিতে পারেন তিনি তুচ্ছ নহেন। কিন্তু সেই লেখকই যখন পশ্চাত পশ্চাত 'কি' বানান 'কী' লেখেন, দুই হাতে হাইফেন ছিটাইতে থাকেন তখন ধরা পড়ে তিনি মৃত্যুকে ভয় না পাইলেও জীবনকে -- সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াইবার সাহসকে--ভয় পান। এই বিয়োগান্ত নাটকের সাক্ষী হওয়া ছাড়া আমার আর কি করার থাকিতে পারে! আহা হীনমন্যতায় কি আনন্দ! তাহা আপনি ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যয়ন করিলে কি সিডনি নগর অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে গমন করিলেও ছাড়িতে পারিবেন না। নিয়তি অমোঘ। নিয়তি মানে যাহার 'যতি' অর্থাৎ স্থিরতা নাই।

সেলিম মোরশেদের মতন বড় গল্পকাহিনীকারের যখন এই পরম নিয়তি, তখন আমাদের মতন বিদ্যা উপজীবী ক্ষুদ্রকায় আপসকামী অনাথগণের কি অস্থিরতা বুঝিতেই পারেন। বুক চিরিয়া হাহাকার ধ্বনিত হয়। বিদেশি কবির আর্তনাদ ভাসিয়া আসে কানে:

 

বিলাস-ব্যসনে মত্ত হে শহর তুমি নিষ্ঠুর বাড়িয়াছ বড় ধনে

দেখ চলিয়াছি উহাদের পিছু পিছু আমিও -- ঢের হতভম্ব --

আর বলি -- কি খুঁজিছে আকাশপানে এই দুনিয়ার যত অন্ধ।

(সলিমুল্লাহ খান ২০২০: ৩০)

 

দোহাই

১. অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, 'জোড়াসাঁকোর ধারে,' রচনাসমগ্র, প্রথম খণ্ড (স্মৃতিকথা), সুধাংশুশেখর মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত (কলিকাতা: দে'জ পাবলিশিং, ২০১৪)।

২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, 'শাস্তি,' রবীন্দ্র রচনাবলী, নবম খণ্ড (সুলভ সংস্করণ), (কলিকাতা: বিশ্বভারতী,১৪২২)।

৩. সলিমুল্লাহ খান, 'দৃষ্টি ও অদৃষ্ট: জাক লাঁকার ভূমিকা,' সিনেমা দর্শন, অক্টোবর ২০২০, পৃ. ২৩-৩৭।

৪. সেলিম মোরশেদ, 'কাটা সাপের মুণ্ডু,' শ্রেষ্ঠগল্প (ঢাকা: উলুখড়, ২০১৬)।

৫. Patricia Cavalli, my poems won't change the world: selected poems, ed. gini alhadeff (New York: Farrar Straus Giroux, 2013).

৬. P. Saarikoski, Trilogy, trans. A. Hollo (Albuquerque: La Alameda Press, 2003).

 

২৫ অক্টোবর ২০২০

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.