জীবনানন্দ থেকে জীবনবেদনার দিকে
কারও কাছে তিনি 'চিত্ররূপময়', কারও কাছে 'নির্জনতম', কারও কাছে 'শুদ্ধতম' আবার কারও কাছে কেবলই 'নক্ষত্রপ্রতিম'। আমার জীবনানন্দ সকল সংজ্ঞাতিক্রমী। চিত্র নির্মাণ করে পরক্ষণেই চিত্রের ঘেরাটোপ ভেঙে এক সারিতে দাঁড় করায় যে রূপসনাতন আর অরূপরতনকে, তাকে কি কেবল 'চিত্ররূপময়' অভিধাভুক্ত করে রাখা যায়? আমি তো তাঁর কবিতায় শুনি ইতিহাস - ভূগোলের আবহমান কাকলি। তবে তাকে 'নির্জনতম' বলি কেমনে? আমি তো তাঁর কবিতায় শুদ্ধ কল্পনা আর চূড়ান্ত বাস্তবের ভেদ লুপ্ত হতে দেখি। তাই তাঁকে 'শুদ্ধতম' সম্বোধনে খণ্ডিত মনে হয়। আমি তো তাঁর কবিতায় জ্যোতির পাশাপাশি দেখি তমসের দীপ্তি৷ তাই তাঁকে নক্ষত্রের সীমানায় বাঁধতে পারি না।
এমনই আমার জীবনানন্দ। কলকাতায় বা বরিশালে বসে চৈতন্যে ধারণক্ষম ব্যবিলন, লিবিয়া কিংবা সিংহল৷ মাটিতে বসে অনুভব করে যে নক্ষত্রের আয়ুক্ষয়। যাঁর কবিতায় তারার পাশে চুপচাপ শুয়ে থাকে তিমির। বেলার পিছে দাঁড়িয়ে থাকে কালবেলা।
জ্যোৎস্নার ভেতর সবাই ভূত দেখে না। যে দেখে সে-ই জীবনানন্দ। পৃথিবীতে যাঁর কোনো বিশুদ্ধ চাকুরি নেই সে-ই জীবনানন্দ। যখন সবাই স্বর্গের স্বপ্নে বিভোর তখন নরকের নবজাত মেঘের দিকে প্রব্রজ্যা যাঁর, সে-ই জীবনানন্দ। জীবনের রাত্রিভোর কারুবাসনা যাঁর সমস্ত সামাজিক সফলতা নষ্ট করে দেয় সে-ই জীবনানন্দ। ট্রামনিয়তি গ্রহণ করে যে শম্ভুনাথ হাসপাতালে ধুঁকে ধুঁকে মরে যায় সে-ই জীবনানন্দ৷ পৃথিবীতে ঢের শালিখের ভিড়ে যে জনমভর অজ্ঞাত তিনটি শালিখ খুঁজে ফেরে সে-ই জীবনানন্দ।
চারদিকে কত মাছের কাঁটার সফলতা, কত সোনাদানা! এর কোথাও আমার জীবনানন্দকে খুঁজে পাওয়া যায় না৷ কারণ নিদ্রার ভেতর সংঘারাম জেগে থাকলে যে যুগপৎ বর্তমান ও আট বছর আগের কোনো একদিনে বিচরণ করে একমাত্র সে-ই জীবনানন্দ। অর্থ কীর্তি স্বচ্ছলতা নয়; বিপন্ন বিস্ময়ের সূত্র জানা যাঁর সে-ই জীবনানন্দ।
আমার জীবনানন্দ জগতের যাবতীয় সুতীর্থে খাপ না খাওয়া এক করুণ মাল্যবান মাত্র।
২.
২০০৮-এর শীতবেলা। জীবনানন্দ-পরবর্তী কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পিতৃভিটে মাদারীপুরের মাইজপাড়ায় গিয়েছিলাম বন্ধু সাব্বির আহমেদ সুবীর এবং আমি। ফেরার পথে বরিশাল হয়ে ঢাকা আসা সাব্যস্ত হলো।
বরিশাল যাবো আর আমার জীবনানন্দের জন্মসদনে যাব না তা কি হয়?
বগুড়া রোড। আমি আর সুবীর। দুপুর হয় হয়। এক্কেবারে জীবনানন্দীয় প্রহর।
বাড়িতে ঢুকতেই জীবনানন্দ গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দের ফোন,যিনি তখন পর্যন্ত বরিশাল আসেননি। আমি জীবনানন্দের ভিটেয় শুনে বললেন ওখানে এখনও কবির সময়কার একটি খুঁটি বহাল আছে, দেখে নিন।
দেখলাম, স্পর্শ করলাম। স্পর্শের বাইরে ঐন্দ্রজালিক অনুভবের জলে স্নান সারলাম। মায়াভরা জঙ্গুলে আবহাওয়া, বাড়ির সামনে এক চিলতে উঠোন, পেছনে মালঞ্চমধুর। এখন অন্যসব পরিবারের বসত, পাশেই জীবনানন্দ দাশ জাদুঘর মতো কিছু একটা ব্যাপার। কোনো আগ্রহ জন্মালো না, আমার বরং ভালো লাগছিল সাদামাটা 'সর্বানন্দ ভবন'।
না নেই সেখানে কোনো স্মারক বা স্মৃতিচিহ্ন তবু ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে যে তাঁরই পদচ্ছাপ, যেমনটা ঠিক বাংলা কবিতার বুকে তাঁর অমোচ্য পদচ্ছাপ।
৩.
২০১৫'র এপ্রিল।
কলকাতা এসেছি প্রথম কিন্তু শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল যাবনা তাই কি হয়!
বহু আগে কবি মজনু শাহের কবিতায় পড়েছিলাম 'ডেকেছিল তাকে লাক্ষারঙ যবনিকা।'
যেন নিরুজ্জ্বল জীবন শেষে বর্ণিল যবনিকার ডাকে জীবনানন্দ তাঁর শেষ শ্বাস ফেলেছেন শম্ভুনাতে। লড়াই করেছেন মৃত্যুর সঙ্গে অথবা আলিঙ্গন।
কবিবন্ধু জুবিন ঘোষ সঙ্গে ছিল, বলল তুমি জানো কী করে শম্ভুনাথের কথা?
বলি,জানতেই হবে।
জীবনানন্দ আমার অসুখ ও আরোগ্য। ঠিক যেমন এ হাসপাতাল ;তাই তাঁর কাছে তো আসতেই হবে। এলাম, দেখলাম, কত রোগ আর রোগহর ওষুধের ছবি আর বিবরণে ভরা হাসপাতাল; নার্স, ডাক্তার, রোগী।
আরে ওই তো জীবনানন্দ দাশ,
ল্যান্সডাউন রোড থেকে রক্তমাখা গা নিয়ে এইমাত্র এলেন।
ওই তো ভূমেন্দ্র গুহ,
ওই তো ময়ূখগোষ্ঠী,
বাংলা কবিতার মায়াময় ধারা।
না, সঙ্গে ফোন ছিল না, জুবিনের ফোনেও ছিল না ভালো ক্যামেরা। কোনোমতে একটা ছবি তোলা গেল।
অতঃপর মনের অ্যালবামে ধারণ করে এলাম জীবনানন্দ-প্রয়াণের পুণ্য, করুণভূমি।
দূরে একটা ভবন, দাশ নয় 'জীবনানন্দ দাস ভবন', হায় ভুল নাম ও ভুল সময়ের মাঝে এক গোলকধাঁধায় খাবি খেতে খেতে দুপুরের চিলচিৎকারে হঠাৎ শুনি এক মিহি কণ্ঠের ডাক,
বন্দরের কাল হলো শেষ।
অমর্ত্য জাহাজ ছাড়লো বলে।
শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল ছেড়ে জীবনানন্দ কেওড়াতলার ছাইভষ্মের বাড়িতে চলেন,
সঙ্গে সঙ্গে অনেকে।
জীবনানন্দ চলে যান,
চলে গিয়ে আবার অক্ষরের ডানায় ভরে উড়ে আসেন।
পড়ি, পড়তেই থাকি;
জীবনানন্দ দাশ।