চিঠির তালা! 

ইজেল

19 June, 2021, 03:00 pm
Last modified: 19 June, 2021, 04:36 pm
খামের প্রচলন শুরু হওয়ার আগে, সাবধানী মানুষ ভাঁজের নানা কারিকুরি করে চিঠিতে তালা দিত। সুতরাং, এটি বাণিজ্যপত্রই হোক কিংবা প্রেমপত্র, গুপ্তচরের চিঠিই হোক কিংবা কূটনীতিকের চিঠি, সেটিতে তালা দেয়া ছিল একটি আবশ্যিক কাজ। চিঠি লিখতে ও পাঠাতে পারত যারা, তাদের মধ্যে কমবেশি সকলেই ছিল চিঠিতে তালা দিতে দক্ষ। এই দক্ষতা শুধু  কোনো বিশেষজ্ঞের কুক্ষিগত ছিল না। 

১৫৮৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি; শেষ রাত। কারাবন্দি স্কটের রানি মেরি তার জীবনের সর্বশেষ চিঠিটি রচনা করলেন। প্রাপক: তার দেবর, ফ্রান্সের রাজা তৃতীয় হেনরি।

"আজ রাতে, ডিনারের পর, আমাকে আমার মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে জানানো হয়েছে। সকাল আটটায় একজন অপরাধীর মতো করেই আমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে," তিনি লেখেন। "আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ মূলত দুটি : আমার ক্যাথলিক বিশ্বাস, এবং ইংরেজ রাজমুকুটে আমার ঈশ্বরপ্রদত্ত অধিকার দাবি।"

দুঃখভরা মন নিয়ে মেরি তার নিয়তিকে মেনে নেন। রাজা হেনরিকে অনুরোধ করেন তার বিষয়-আশয়ের দেখভাল করতে, এবং তার ভৃত্যদের পাওনা বুঝিয়ে দিতে। সবশেষে তিনি রাজা হেনরিকে শুভেচ্ছা জানান সুস্বাস্থ্য এবং একটি দীর্ঘ ও সুখী জীবনের। 

চিঠি লেখা শেষে মেরি এক বিচিত্র কাজ করতে শুরু করেন। তিনি চিঠিটিকে এমনভাবে ভাঁজ করতে থাকেন, যেন সেটির বিষয়বস্তু গোপন থাকে। তিনি চাননি এই চিঠির ব্যাপারে যেন তাকে বন্দিকারীরা, বিশেষত রানি প্রথম এলিজাবেথ, নাক গলাতে পারেন। 

তবে সমস্যাটা হলো, সেই ষোড়শ শতকে খামের প্রচলন ছিল না। কেননা, কাগজের মূল্য তখন ছিল আকাশচুম্বী। এদিকে তখনকার দিনে কোনো বিশ্বস্ত ডাকব্যবস্থাও ছিল না। 

দুষ্প্রাপ্য খোলা হয়নি এমন চিঠি। লাল কালিতে ডাকখরচ নির্দেশ করা হয়েছে

তাই নিজের চিঠির নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব মেরি নিজের হাতে তুলে নেন। তিনি প্রথমে কাগজের প্রান্ত থেকে সরু একটা অংশ কেটে নেন। তারপর ভাঁজ করে চিঠিটিকে একটি ছোট আয়তক্ষেত্রে পরিণত করেন। ছুরি দিয়ে সেই আয়তক্ষেত্রের ভেতর তিনি একটি গহ্বর সৃষ্টি করেন, এবং সেই গহ্বরের মধ্যে প্রবেশ করান কাগজের সরু করে কাটা অংশটিকে। কয়েকবার সেটিকে তিনি ফাঁস দিয়ে আঁটসাঁট করে তোলেন। এভাবেই তিনি তৈরি করেন একটি 'স্পাইরাল লক'।

কোনো মোম বা আঠালো পদার্থেরই প্রয়োজন পড়েনি এ কাজ করতে। কিন্তু তারপরও, চমৎকারভাবে নিশ্চিত করা গেছে যেন কেউ চিঠির ভেতর নজর দিতে না পারে। কেউ যদি চিঠিটি পড়তেই চায়, তাহলে তাকে কাগজের ফাঁসটিকে ছিঁড়ে ফেলতে হবে। এতে করে রাজা হেনরিও বুঝে যাবেন, নির্ঘাত কেউ চিঠিটি পড়ার চেষ্টা করেছে।

তবে কেউ যেন মনে করবেন না, রানি মেরিই 'লেটারলকিং' তথা চিঠিতে তালা দেয়ার শিল্পে পারদর্শী প্রথম ব্যক্তি। ইউরোপজুড়ে এই কৌশলের সূচনা ঘটে সেই মধ্যযুগের শেষভাগ (১২৫০-১৫০০) থেকেই। এবং তা চলতে আধুনিক যুগের শুরু (১৫০০-১৮১৫) পর্যন্ত। 

চিঠিকে ভাঁজ করে বা কেটে মানুষ নানা ধরনের বিচক্ষণ প্যাটার্ন তৈরি করত, যেন তাদের চিঠি অনাহূত পাঠকের দৃষ্টি থেকে সুরক্ষিত থাকে। এক্ষেত্রে চিঠিকে তালা দেয়ারও ছিল অগণিত পদ্ধতি। 

শুধু বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ্যেই যে মানুষ এমনটি করত, তা-ও আসলে না। যতদিন পর্যন্ত খামের প্রচলন শুরু হয়নি, সাবধানী মানুষ এভাবেই তাদের চিঠিতে তালা দিত। সুতরাং, এটি বাণিজ্যপত্রই হোক কিংবা প্রেমপত্র, গুপ্তচরের চিঠিই হোক কিংবা কূটনীতিকের চিঠি, সেটিতে তালা দেয়া ছিল একটি আবশ্যিক কাজ। চিঠি লিখতে ও পাঠাতে পারত যারা, তাদের মধ্যে কমবেশি সকলেই ছিল চিঠিতে তালা দিতে দক্ষ। এই দক্ষতা কোনো বিশেষজ্ঞের কুক্ষিগত ছিল না। 

তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, চিঠিতে তালা দেয়ার এ ধরনের কৌশল ইতিহাস পাঠে এতদিন অনেকটা যেন নিগৃহীতই ছিল। মাত্র অল্প কিছুদিন হলো, ইতিহাসবিদরা এটিকে গুরুত্ব দিতে আরম্ভ করেছেন। আর তাতেই, চিঠিতে তালা দেয়ার একটি গোটা শ্রেণিবিন্যাসের উন্মোচন ঘটেছে। 

চিঠিতে তালা দেয়া বিষয়ক গবেষণার শুরুটা হয়েছে কনজার্ভেটর (রক্ষণের দায়িত্বে থাকেন যিনি) জানা ড্যামব্রোজিওর হাত ধরে, যখন তিনি কাজ করছিলেন ইতালিতে অবস্থিত ভ্যাটিকান সিক্রেট আর্কাইভসে। 

এ শতাব্দীর শুরুর দিকে তিনি বাইরে থেকে আসা প্রথম নারী হিসেবে ওই আর্কাইভসের কনজার্ভেশন ল্যাবরেটরিতে কাজের সুযোগ পান। প্রথম দিনেই তাকে প্রস্তাব দেয়া হয় দ্বিতীয় ফন্দো ভেনেতো সেজিওনের উপর কাজ করার। ষোড়শ শতকের শেষভাগের বিভিন্ন মানচিত্র, চিঠি, হিসাবপত্র ও দলিল-দস্তাবেজ দেয়া হয় তাকে, যার মধ্যে অনেকগুলোই ছিল বাতিলপ্রায়।

সংরক্ষণের কাজ করতে গিয়ে তিনি বেশিরভাগ সময়ই লেখার দিকে খেয়াল করতেন না, যেহেতু সেগুলো ছিল প্রাচীন ইতালীয় উপভাষায় রচিত। তবে তিনি কাগজের কাটা বা ভাঁজের দাগ লক্ষ করতেন। অপ্রশিক্ষিত চোখে অনেকের কাছেই এগুলোকে দেখে নিছকই ক্ষতিগ্রস্ত বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন যে এগুলো হলো চিঠিতে তালা দেয়ার প্রমাণ। তাই তিনি ধারাক্রমে কী কী পর্যবেক্ষণ করেছেন তার নোট নিতে থাকেন। 

পরে অবশ্য ড্যামব্রোজিও যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন। বর্তমানে তিনি ম্যাসাচুসেটসের এমআইটিতে কাজ করছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার পরই তিনি বুঝতে পারেন যে মূল নথিগুলোর যেসব নোট ও মডেল তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন, সেগুলো এবার কাজে লাগতে পারে। 

তার ভাষায়, "ভ্যাটিকানে সম্ভবত হাজার হাজার চিঠি রয়েছে, কিন্তু আমি হাতেগোনা যে অল্প কয়েকটির মডেল তৈরি করেছি, সেগুলোই আমাদেরকে চিঠিতে তালা দেওয়ার ভাষা নির্মাণে সাহায্য করেছে।"

ড্যামব্রোজিও যোগাযোগ করেন ড্যানিয়েল স্টার্জা স্মিথের সঙ্গে, যিনি কিংস কলেজ লন্ডনে আর্লি মডার্ন ইংলিশ লিটারেচারের একজন লেকচারার। 

স্টার্জা স্মিথের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের পর ড্যামব্রোজিও ও তার সহকর্মীরা চিঠিতে তালা দেয়ার আরও উদাহরণ খুঁজতে শুরু করেন পুরনো আর্কাইভ কিংবা জাদুঘরের সংগ্রহশালায়।

এ কাজ করতে গিয়েই বছর কয়েক আগে তারা এমন কিছুর সন্ধান পান, যা তাদের কাছে অমূল্য গুপ্তধনের সমান। তারা সপ্তদশ শতকের ইউরোপের পুরো এক ট্রাঙ্ক অবিলিকৃত চিঠি খুঁজে পান। সেখানকার ২,৬০০ চিঠির মধ্যে ৫৭৭টিই কখনো খোলাই হয়নি।  

সতের শতকের খোলা হয়নি এমন চিঠির ট্রাঙ্কভর্তি সংগ্রহ

এই অসাধারণ সংগ্রহটির মালিক ছিলেন সিমন ব্রিয়েন ও মেরি জার্মেইন নামের এক পোস্টমাস্টার ও পোস্টমিস্ট্রেস দম্পতি। তারা বাস করতেন নেদারল্যান্ডসে। সপ্তদশ শতকে চিঠির প্রাপকদেরকে চিঠি গ্রহণের জন্য টাকা দিতে হতো। কিন্তু নানা কারণেই অনেক চিঠি সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানোর পরও বিলি হতো না। এর মধ্যে কিছু কারণ হলো : প্রাপকের আর্থিক দুরবস্থা, বসবাসের স্থান পরিবর্তন কিংবা মৃত্যু। তো, এ ধরনেরই অনেক চিঠির উপরে ডাচ ভাষায় লেখা রয়েছে 'niet hebben', যার বাংলা করলে দাঁড়ায় 'প্রত্যাখ্যাত'।

তবে ওই দম্পতি আশাবাদী ছিলেন, কখনো কখনো হয়তো ওইসব চিঠির প্রাপকরা তাদের কাছে এসে দুই-একটি চিঠির মালিকানা দাবি করবে। তাই তারা ও তাদের কর্মচারীরা সব অবিলিকৃত চিঠি মজুদ করে রাখতেন ট্রাঙ্কের ভেতর, যেটির তারা নাম দিয়েছিলেন 'spaarpotje' বা 'পিগি ব্যাংক'। 

এসব চিঠির অধিকাংশই মামুলি, আটপৌরে। কিন্তু সামষ্টিকভাবে তারা এলেবেলে নয়। কেননা তাদের মাধ্যমে সপ্তদশ শতকের ইউরোপের জীবনধারার একটি পরিষ্কার চিত্র ফুটে ওঠে। ওইসব চিঠিতে প্রতিফলিত হয় তখনকার দিনের মানুষের চিন্তাধারা, তাদের আবেগ-অনুরাগ, একটি সীমানাহীন সমাজের স্বপ্ন। 

ট্রাঙ্কের সংগ্রহ কম্পিউটারে ভাঁজ খোলা হয়েছে

কত বিচিত্র শ্রেণি-পেশার মানুষের চিঠিই না এভাবে সংরক্ষিত হয়েছে। তাদের মধ্যে কূটনীতিক, ডিউক, ডাচেস, বণিক, প্রকাশক, গুপ্তধর তো রয়েছেই, আরো রয়েছে সংগীতশিল্পী, প্রেমিক, সংগ্রামী শরণার্থী কিংবা অতি সাধারণ নারী ও পুরুষ। 

ব্রিয়েন কালেকশনসহ আরো নানাবিধ উৎস থেকে প্রাপ্ত চিঠির দৃষ্টান্ত ড্যামব্রোজিও ও স্টার্জা স্মিথকে সাহায্য করেছে আধুনিক যুগের গোড়ার দিকের হরেক রকম চিঠিতে তালা দেয়ার কৌশল শনাক্ত করতে। 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই জুটি নির্মাণ করতে পেরেছেন চিঠিতে তালা দেয়ার পদ্ধতির একটি 'পর্যায় সারণি', যেখানে রয়েছে অন্তত ১৮টি পৃথক ফরম্যাট। কোনোটি খুবই সহজ : ভাঁজ করা কাগজের মুখে মোম লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। আবার কোনোটি প্রচণ্ড জটিল : একটি প্যাকেটের মোট ১২টি প্রান্ত রয়েছে, যার প্রতিটিকে আটকে দেয়া হয়েছে। 

তারা চিঠিগুলোর আরো কিছু বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করেন, যেমন: সেগুলোর কোথাও চেরা বা সেলাই করা ভাঁজ রয়েছে কি না, কিংবা নিরাপত্তার ভিত্তিতে তালাগুলোর রেটিং কত হতে পারে। 

ভিন্ন ধরনের চিঠি নিরাপদ ভাঁজ করার কৌশল

অবশ্যই এ সম্ভাবনা একদম উড়িয়ে দেয়া যায় না যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো তালা না খুলেই অন্য কোনোভাবে চিঠিগুলো পড়ে ফেলেছে কেউ, কিংবা তালা খুলে পড়ার পর আবার এমনভাবে তালা লাগিয়ে দিয়েছে যেন কারো মনে কোনো সন্দেহই না জাগে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, কেননা একবার চিঠির তালা খুলতে গেলে ভেতরের চিঠিতেও সেটির ছাপ পড়তে পারে, কিংবা তালা এমনভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে যে তা দিয়ে পুনরায় চিঠিকে আটকানো অসম্ভব। 

এই ফিচারের মূল লেখক, বিবিসি ফিউচারের সিনিয়র সাংবাদিক রিচার্ড ফিশার নিজেও সম্প্রতি এমআইটি আয়োজিত একটি ওয়ার্কশপে গিয়ে চিঠিতে তালা দেয়ার চেষ্টা করেন। সেখানে তিনি একটি 'ত্রিকোণ তালা' দিতে সক্ষম হন। এই বিশেষ কৌশলটি ব্রিয়েন কালেকশনে পাওয়া না গেলেও, পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতকে ইউরোপ ও ইংল্যান্ডে নিয়মিতই ব্যবহৃত হতো। 

এই কৌশলটি ছিল খুবই জটিল, ফলে সেটির উদ্ভাবনী ক্ষমতায় মুগ্ধ হন ফিশার। তারা কাজ শুরু করেন কাগজের একটি এ-ফোর শিট ও কিছু টেপ নিয়ে। তারপরের ধাপগুলোর নির্দেশনা দিতে থাকেন স্বয়ং ড্যামব্রোজিও : "নিচ থেকে একটি ত্রিকোণ কেটে ফেলুন... ছোট ছোট করে ভাঁজ করতে থাকুন এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে... দেখুন আবার যেন খুব চোখা ভাঁজ করবেন না যেন... স্রেফ কাগজটিকে বাঁকিয়ে ফেলুন... এবার একটি ছোট ছিদ্র করে, ত্রিকোণটিকে তার ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে দিন।"

শেষমেশ ত্রিকোণ আকৃতির তালাটিকে চিঠির মধ্যে দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়, তারপর প্রতি প্রান্ত থেকে ভাঁজ করা শেষে, আঠা বা মোম দিয়ে লাগিয়ে দেয়া হয়। 

মোম দিয়ে আটকানো ভাঁজ, কেউ খুললে মোমের সিল নষ্ট হয়ে যাবে

আপনারাও এই ত্রিকোণ তালাটি নিজেরাই তৈরির চেষ্টা করতে পারেন এখানে দেওয়া ডায়াগ্রাম দেখে। 

দ্বিতীয় ডায়াগ্রামটির (মাঝখানের) মডেল তৈরি করা হয়েছে ব্রিয়েন কালেকশনে প্রাপ্ত দুই কাজিনের মধ্যকার চিঠির আদলে। এমআইটির দলটি এক্স-রে মাইক্রোটমোগ্রাফি ব্যবহার করে 'ভার্চুয়ালি' চিঠিটিকে খুলেছে। অর্থাৎ, তালা না ভেঙেই তারা চিঠির ভাঁজ খুলতে পেরেছে। 

তবে আপনি যদি চান একটি সত্যিকারের ফোল্ডিং চ্যালেঞ্জ নিতে, তাহলে ডায়াগ্রামের একদম নিচেরটি হতে পারে আপনার জন্য শ্রেষ্ঠ। এটির নাম 'ড্যাগার ট্র্যাপ'। ড্যামব্রোজিও ও স্টার্জা স্মিথ ১৬০১ সালে ইতালি থেকে প্রেরিত মূল চিঠিটি খুঁজে পেয়েছেন ইউকে ন্যাশনাল আর্কাইভসে। সেটি ছিল ব্রিটিশ গোয়েন্দাবাহিনীর চিঠি। 

ড্যামব্রোজিওর মতে, এটি তাদের খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে নিরাপদ, জটিল ও সময়সাপেক্ষ চিঠি। বাইরে থেকে এটিকে দেখতে একটি সাধারণ ভাঁজ করা চিঠি মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে এর ভেতরে রয়েছে বুবি ট্র্যাপ। একটি সরু চেরা কাগজ রয়েছে ভেতরে, চিঠিটি খোলা হলেই যেটি সরে যায়, ফলে বোঝা যায় যে আগেও চিঠিটিকে কেউ খুলেছে। 

আজকের দিনে যখন মানুষ শিকারী চোখের কবল থেকে নিজেদের মেসেজকে নিরাপদ রাখার কথা চিন্তা করে, তখন তাদের মূল ফোকাস থাকে ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যবস্থায়, যেমন হোয়াটসঅ্যাপ বা সিগনালের 'এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন' পরিষেবায়। কিন্তু চিঠিতে তালা দেয়ার পদ্ধতি আমাদেরকে আরও একবার মনে করিয়ে দেয় যে মানুষের গোপনে ও নিরাপদে যোগাযোগের প্রবণতা আরো অনেক বেশি প্রাচীন। 

ড্যামব্রোজিও বলেন, "যখন থেকে মানবজাতি পৃথিবীর বুকে হাঁটতে শুরু করেছে এবং কোনো কিছুকে নথিভুক্ত করতে চেয়েছে, তখন থেকেই সতর্কতার প্রয়োজন পড়েছে।" 

প্রাচীন গ্রীক ও মিশরীয়রা যেমন তাদের গোপন চিঠিপত্র ও দলিল-দস্তাবেজকে অক্ষত রাখতে সীলমোহর ব্যবহার করত। এবং হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়ায় গোপন নথিকে নিরাপদ রাখতে 'bullae' নামক এক ধরনের কাদামাটির খাম ব্যবহার করা হতো। 

চিঠি লক করা আরও কয়েকটি প্রাচীন কৌশল

এভাবে গোপন যোগাযোগের নানা ফন্দিফিকির বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার পেছনেও বিশাল ভূমিকা পালন করেছে। 

রানি মেরির কথাই চিন্তা করুন। তিনি কেন তার চিঠিতে তালা দিতে গেলেন? কারণ তিনি জানতেন, শাসকগোষ্ঠী তার চিঠি পড়ে দেখতে চাইবে। তাই তিনি চেয়েছিলেন এমন কোনো ব্যবস্থা করতে যেন তার চিঠি পড়া হলে সেটি তার দেবর বুঝে ফেলেন। 

আর শাসকগোষ্ঠী তার চিঠি পড়ে দেখতে চাইবে এমন আশঙ্কারও তো সঙ্গত কারণ রয়েছে। হাজার হোক, এমন একটি পড়ে ফেলা চিঠির ফলেই তো তার এই দুর্দশার শুরু হয়। সেই চিঠি থেকে জানা গিয়েছিল, তিনি প্রথম এলিজাবেথকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছেন। 

এই আলোকে চিঠিতে তালা দেয়ার পদ্ধতি হয়ে উঠছে এক নতুন লেন্স, যার মাধ্যমে আমরা ইতিহাসকে দেখতে পারি, শত বছর ধরে পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের যে চেষ্টা করছি তাতে নতুন পথের দিশা পেতে পারি। 

স্টার্জা স্মিথ যেমন মেরির শেষ কর্মকাণ্ডের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, "মানুষ প্রায়ই বলে, মৃত্যুর আগে তার করা শেষ কাজ নাকি একটি চিঠি লেখা। একদমই না! তার শেষ কাজ হলো চিঠিতে তালা দেয়া।"

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.