ঘুম!

ইজেল

এম এম মোমেন
16 January, 2021, 08:30 am
Last modified: 16 January, 2021, 11:55 am
এখন মধ্যরাতের পর ই-মেইল আসে। ই-মেইলের জবাব না গেলে একটার পর একটা ম্যাসেজ আসে, কি ব্যাপার ঘুমোচ্ছো নাকি? সাথে যোগ হয়েছে ক্যাফেইন, ১৭০০ সালেই লন্ডনের কফিশপের সংখ্যা ৩০০০, ক্যাফেইন ছাড়া বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন যেন অচল। ঘুমের ছন্দে হস্তক্ষেপই সৃষ্টি করেছে ‘রেস্টলেস ওয়ার্ল্ড’-অস্থির পৃথিবী।

ঘুম ঘুম চাঁদ এই মাধবী রাত

এ কালের অজ্ঞাত কোনো মনিষী বলেছেন, যে সভ্যতায় ঘড়ির এলার্ম প্রতিদিন সকালে শুনতে হয় সে সভ্যতার কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

অন্য একজন বলেছেন, কোনো সূর্যোদয় আমার ঘুমের চেয়ে সুন্দর কিছু হতে পারে না যা দেখতে আমাকে জেগে উঠতে হবে। আর এর উল্টোটাও আছে একটু বেশি ঘুমোলেই কুম্ভকর্ণ বলার সুযোগ নিতে কেউ ছাড়ে না। এমনও পরামর্শ দেওয়া হয় মৃত্যুর পর ঘুমোবার অনেক সময় পাবে, কেউ জাগাবে না, এখন কাজ করো।
রিপ ভ্যান উইঙ্কল টানা কুড়ি বছর ঘুমিয়েছেন। কবি মিলটন জিজ্ঞেস করেছেন, রাতের বেলা ঘুমিয়ে কাজটা কি?

ডক্টর সেওসের কথা, যখন তোমার স্বপ্নের চেয়ে বাস্তবতা বেশি আনন্দের তখন তুমি ঘুমোবে না কারণ তুমি প্রেমে পড়েছ।
ঘুম ও নির্ঘুম উভয়ই সাহিত্যে অনেক বড় জায়গা দখল করে আছে, কোনোটিরই উদ্ধৃতির কোনো ঘাটতি নেই।
 

ঘুম, সালভাদর দালি, ১৯৩৭

ঘুমের শত্রু এলার্ম ঘড়ি

ঘুমের আগে সুইচ অফ করতে হয়--যে আমলে সুইচ ছিল না তখন কি মানুষ ঘুমোত না? কিংবা পাথরে পাথরে ঘষে আগুন সৃষ্টি অথবা মানুষের জন্য প্রমিথিউসের আগুন চুরির আগে যখন ঘরে বাতি জ্বলতো না মানুষ কেমন করে ঘুমোত? 

সাদামাটা জবাব আছে--সূর্য তো তখনও ছিল, সূর্য ডোবার পর নিশ্চয়ই ঘুমোতো। খাট-পালঙ্ক জাজিম-তোষক চাদর-বালিশ এসব ছিল না সত্যি, কিন্তু ঘুমের একটা আয়োজন নিশ্চয়ই ছিল। খ্রিষ্টজন্মের হাজার বছর আগেকার মানবনিবাস নিয়ে প্রত্নতাতত্ত্বিক পরীক্ষায় উঠে এসেছে যে তাদের ঘুমোবার একটা আসন ছিল, জটিল কিছু নয়, খানিকটা বৃত্তাকার, মায়ের গর্ভে ভ্রুণের যে ধরনের অবস্থান সে রকম একটা আসন। সম্ভবত সেই আসনই বৃহৎ সংখ্যক প্রাচীন মানুষ তাদের নিত্যরাতের বিছানা হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিল।

ফ্রেডেরিক লেইটনের আঁকা ঘুমন্ত নারী, জুন ১৮৯৫

মানুষের জন্য প্রমিথিউসের আগুন চুরি

আমার অতি প্রিয় শিল্পী সন্ধা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে আমার কৈশোরে যখন প্রথম শুনি ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত--তখন ভেবেছিলাম এটা নিশ্চয়ই ঘুম পাড়ানি গান। কিন্তু বয়স খানিকটা বাড়তেই বুঝতে পারি, এটা ঘুম পাড়ানি নয় ঘুম তাড়ানি গান।
নিজের এবং অন্যদের ঘুম তাড়াতেই সন্ধা মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন :

ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত
আসেনি তো বুঝি আর, জীবনে আমার...
বাতাসেরও সুরে শুনেছি বাঁশি তার
ফুলে ফুলে ঐ ছড়ানো যে হাসি তার
এই চাঁদেরও তিথিরে বরণ করি
ওগো মায়াভরা চাঁদ আর ওগো মায়াবিনী রাত।

মানুষের জন্য প্রমিথিউসের আগুন চুরি

এই গানে যে সব রোমান্টিক বর্ণনা এবং এমনকি বাসর শয্যা রচনারও যে বিবরণ আছে তাতে রাতে ঘুমোবার সুযোগ নেই। চিকিৎসা বিজ্ঞান মানুষের পর্যাপ্ত ঘুমের পক্ষে যত সাফাই সাক্ষ্য দিক না কেন সভ্যতা গড়ে উঠেছে ঘুম বিসর্জনের ভিত্তির উপর। শরীর-ঘড়ির ডাক উপেক্ষা করেই সভ্যতার সূচনা এবং এমনকি একবিংশ শতকে পৌঁছেও ঘুম শাসনের নির্ঘুম প্রচেষ্টা অব্যহত রয়েছে।

তারপরও ঘুম কোত্থেকে এসে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের পূর্ব গোদাবরির বাবু নামের ২২ বছর বয়সী এক যুবকের জীবনটা লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। মাত্র ক'মাস আগে ২০২০-র ১২ সেপ্টেম্বর বাবু চারদিক ভাল করে দেখেশুনে ভোর চারটায় একটি পেট্রোল পাম্পের মালিক শক্তি ভেঙ্কট রেড্ডির বাড়িতে জানালা ভেঙ্গে ঢুকল। অত্যন্ত সপ্তর্পণে ঘরের ভেতরটা একবার জরিপ করে নিল--কে কোথায় ঘুমিয়ে আর তুলে নেবার মতো কোথায় কি আছে নিশ্চিত হয়ে খোলা দরজা পথে পাশের একটি রুমে ঢুকতেই এয়ার কন্ডিশনারের শীতল হাওয়ায় তার শরীর ও মন জুড়িয়ে গেল। আরো নিশ্চিত হলো এই ঘরে কেউ নেই। বাবুর দীর্ঘ হাই উঠল। বিছানা তাকে ডাকতে লাগল, আয় বাবু আয়।

বাবু তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিল, সবই যখন ঠিকঠাক আছে একটু ঘুমিয়ে নিলে ক্ষতি কি? যাবার সময় তার ব্যাগ ভর্তি করে চুরির মাল নিয়ে বেরিয়ে যাবে। সূর্য উঠতে ঢের দেরি।

দি স্লিপিং জিপসি, হেনরি রুসো, ১৮৯৭

বাবু ঘুমিয়ে পড়ল। ভোর সাড়ে সাতটার দিকে নাক ডাকার শব্দ শুনে শক্তি রেড্ডি একটু খানি উকি দিয়ে আবার বেরিয়ে এলেন--পাছে আগন্তুকের ঘুম না ভেঙ্গে যায়। তিনি দরজায় তালা লাগালেন এবং পুলিশকে ফোন দিলেন। পুলিশ তেমন দেরি করেনি। পুলিশ ও চোরের প্রাগৈতিহাসিক সখ্যের কারণে সম্ভবত বাবু পুলিশের ঘ্রাণ পেয়ে যায় এবং পুলিশ তার রুমে ঢোকার আগেই ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। কিন্তু বেশিক্ষণ এ অবস্থায় থাকেনি, এক সময় দরজা খুলে আত্মসমর্পণ করে। ঘুমের কারণেই বাবুর এত বড় একটা সর্বনাশ হলো।

১৭ ডিসেম্বর ২০২০ মধ্য প্রদেশের শাজাপুর লালবাই ফুলবাই মাতা মন্দিরের একাধিক তালা ভেঙ্গে চোর ভেতরে প্রবেশ করল। যা কিছু মূল্যবান সামনে পড়ল সবই তার ব্যাগে ভরে মন্দিরের সেবায়েত কক্ষে চকিতে বিছানাপাতা দেখে মাথার কাছে মালামালের ব্যাগটি রেখে কম্বল টেনে ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে তালাভাঙ্গা দেখে প্রধান সেবায়েত এমনিতেই চিন্তিত, মাতৃমূর্তির কাছে গিয়ে নাক ডাকার শব্দ শুনে রীতিমত হতভম্ব। কাছে গিয়ে এক নজর দেখে পুলিশ ডাকল। পুলিশ তার চোরাই মালামাল সিজ করে তাকে যখন থানায় নেবার জন্য টানা হেচড়া করল, চোর মিনতি করে বলল, হুজুর আর একটু ঘুম বাকি আছে, আমি পালাবো কোথায়? অন্তত ঘুমটা পুরো করি। ভীষণ অবিচার করেছে পুলিশ, অসমাপ্ত ঘুমাক্রান্ত একজন চোরকে মন্দির থেকে তুলে নিয়ে গেছে।

এয়ারপোর্টের বাথরুমে কমোডে বসে ঘুমিয়ে পড়ার ঘটনা হামেশাই ঘটছে এবং জাহাজ ছাড়তে দেরি হচ্ছে, একবার ঘুমিয়ে পড়া একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সন্ধানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের প্রায় সব টয়লেট তল্লাসি করে একটি থেকে ঘুম ভাঙ্গিয়ে তাকে তুলে আনতে হয়।
 
১৮৮৬ সালে প্রয়াত একজন বাঙালি মনিষীর স্মরণ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বয়ষ্ক একজন পূর্ণমন্ত্রী অনুষ্ঠানের শুরুতেই তার চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েন। প্রধান অতিথির ভাষণের পালা এলে তাকে জাগাতেই তিনি তাৎক্ষণিকভাবে উঠে মাইকের সামনে চলে যান এবং বলেন ১৯৭১ সালে এই মনিষীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন। অসমাপ্ত ঘুমের এমন প্রতিক্রিয়া হতেই পারে। বেসরকারি অফিসে কেউ ঘুমিয়ে পড়লে তাকে সতর্ক করে দেওয়া হয়--এটা সরকারি অফিস নয় বলে।

দি নাইটমেয়ার, জন ফুসেলি, ১৭৮১

পার্লামেন্ট চলাকালে ঘুম, মন্ত্রিসভা বৈঠকে নাক ডেকে ঘুম বিভিন্ন দেশে এর নজির যথেষ্ট মিলে। হালে ট্রাম্প সমর্থকদের হাতে তছনছ হওয়া ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবন থেকে লোটাকম্বল কাথা-বালিশ অনেক কিছুই বেরিয়ে এসেছে। তারও আগে রিপাবলিকান দলের কংগ্রেসম্যান ড্যান ডোনাভান দিনে ও রাতে এই ভবনে তার অফিস কক্ষে ঘুমোবার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং ডেমোক্র্যাট সদস্য বিল আনার প্রস্তাব করেছেন। ড্যান ডোনাভান সোজাসাপটা বলেছেন কংগ্রেসম্যানের বছরে বেতন ১,১৭,০০০ ডলার। এই টাকায় নিজের নির্বাচনী এলাকা ও ওয়াশিংটনে পৃথক ঘুমোবার জায়গা রাখার কোনো সুযোগ নেই। এদিক দিয়ে ইতালির কিছু বেসরকারি অফিস সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে দুপুরে একটি নাতিদীর্ঘ অফিস ঘুম কর্মচারিদের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে দেয়। সুতরাং তারা সেই সুযোগ দিচ্ছে।

২০১৩ সালের মার্চে কাজাখস্তানের কালাচি নামক স্থানে গণঘুমের একটি রোগ ধরা পড়ে। মানুষ যখন তখন ঘুমিয়ে পড়ছে, কোনোভাবে ডেকে তুললেও একটু পরই আবার ঘুম। খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়ছে, বাথরুম থেকে বোরোবার আগেই ঘুমে ঢলে পড়ছে। সাথে খানিকটা বমি বমি ভাব, দৃষ্টি ও স্মৃতি বিভ্রম। শুরুতে ভয় ছিল মনে করা হলো ছোঁয়াচে রোগ। ডাক্তাররা বললেন ছোঁয়াচে নয়। আবার এটা মাছিবাহিত আফ্রিকান স্লিপিং সিকনেস রোগও নয়। 

কাজাকিস্তানের কালাচি, যেখানে রহস্যময়ভাবে ঘুমিয়ে পড়ত গ্রামবাসী

গবেষকরা বের করলেন আরও আগে, ২০১০ সালে প্রতিবেশি একটি গ্রামে এই রোগটা দেখা দিয়েছিল, কিন্তু অল্প দিনেই প্রকোপ কমে যাওয়ায় তেমন প্রচারনা পায়নি। ২০১৫ সালে পুনরায় কালাচিতে দীর্ঘমেয়াদের গণঘুমের প্রকোপ শুরু হয়। ২০১৩ থেকেই গবেষক ও চিকিৎসকরা এ নিয়ে কাজ করছিলেন। কালাচিতে অসুখ চলাকালীন বাতাসে অক্সিজেনের ঘনত্ব কম প্রতীয়মান হলো। গবেষণায় বেরিয়ে এলো রোগটা আসছে নিকটবর্তী একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া ইউরেনিয়াম খনি থেকে। ২০১৫ সালে ডিসেম্বরে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করলেন এই ইউরেনিয়াম খনি থেকে কখনো কখনো ঘণিভূত কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস বেরিয়ে আসে, কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাতাসে যতক্ষণ অতিরিক্ত পরিমাণ কার্বন মনোক্সাইড থাকছে ততক্ষণ সেখানকার প্রায় সকলেরই ঘুমরোগগ্রস্থ হবার সম্ভাবনা থাকছে। 

এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে দ্রুত সে সব এলাকার জনগণকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে সাময়িক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কাজাখ সরকার এই গবেষণাও সুপারিশ মেনে নিয়েছে এবং ভবিষ্যতের ঘুমাক্রান্ত মানুষ রক্ষায় সাময়িক পুনর্বাসনের বন্দোবস্তও করেছে। 

কিন্তু নিদ্রা না আসলে কি সুপারিশ করা হবে? সঙ্কট কতো তীব্র নির্মলেন্দু ঘুণের কবিতাই তা বলে দেয় :

হয় নিদ্রা আসুক, না হয় এক্ষুনি অবসান হোক
এই অসহ রাত্রির। আমি আর সইতে পারছি না।
আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেছে নির্ঘুমতা।
এই রাত্রি এখন আমার সহ্যসীমার বাইরে।
দুঃখে-ক্ষোভে, অভিমানে আমার বুকের ভিতর থেকে
বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস, যেন সমুদ্রের তলদেশ থেকে
শূন্য হাতে উঠে আসা কোনো ব্যর্থ ডুবুরী।
চোখের ভিতরে হুল ফুটিয়ে বলি, একটু ঘুমাও,
আর কতক্ষণ, আর কতদিন এভাবে চলবে?...
ভালোবাসার সাঁকো বেয়ে তুমি পৌঁছে গেছো এক
চির-নির্ঘুম দেশে, যেখানে দাউদাউ অগ্নিকুন্ডে
জ্বলন্ত পৃথিবী; যেখানে নিদ্রা এক অচেনা প্রসঙ্গ।
একশ' থেকে উল্টোদিকে শূণ্য পর্যন্ত গুনে
সেই কখন শেষ করেছি, তবু ঘুম আসে না।
চিৎকার করে বলি, একশ এতো কম কেন?
দুঃখ আমাকে জাগিয়ে রাখে।
আনন্দের সাধ্য কী সে পাল্লা দেবে
দুঃখের সঙ্গে, দুঃখ খুব জাগরণ ভালোবাসে।

শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ঘুমের প্যাটার্নটি বিশেষ বিখ্যাত। তিনি প্রতি চার ঘন্টায় ২০ মিনিট করে ঘুমোতেন। তার দেহঘড়ি তার স্বআরোপিত পদ্ধতির সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। কুড়ি মিনিট ঘুমোনোর পর তিনি পরবর্তী চার ঘন্টা কাজ করার পুর্ণ শক্তি ও উদ্যোম ফিরে পেতেন। এতে দিনরাতের ২৪ ঘন্টায় তাকে ২০ গুণ ৬, ১২০ মিনিট অর্থাৎ মোট দুই ঘন্টা ঘুমোলেই চলত। এটাই ওবারম্যান স্লিপ সাইকেল। সুপারম্যানই ফ্রেডেরিখ নিৎসের ওবারম্যান। ভিন্ন প্যাটার্নের হলেও আইজাক নিউটন ঘুমোতেন টানা দু'ঘন্টা এবং তা রাতের বেলায়। উদ্দেশ্য দু'জনের একই কাজ করার জন্য বেশি সময় বের করা।

দুপরের কাজের ফাঁকে ঘুম, ভিনসেন্ট ভ্যান গখ, ১৮৯০

একালের শীর্ষ ধনী এলন মাস্ক ঘুম নিয়ে সমঝোতা করতে নারাজ। রাত একটা থেকে ভোর সাতটা ঘুমোবেনই, এ ছাড়াও স্লিপিং ব্যাগ সাথে রাখেন, ঘুম পেলে আগে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে আবার কাজে বসেন।
এমিলি ব্রন্টি ও শার্লট ব্রন্টি দুই বিখ্যাত বোনেরই ঘুম না আসার সমস্যা ছিল, দুজনই রাতের বেলা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমোতেন। ঠিক উল্টো আমেরিকান সঙ্গীত শিল্পী মারিয়া ক্যারি-তাকে ১৫ ঘন্টা ঘুমোতে হয়; টম ক্রুজ ঘুমান শব্দ নিরোধক একটি কক্ষে। এ ধরনের কক্ষের নাম স্নোরাটোরিয়াম। উইলস্টন চার্চিল দিনে দু'ঘন্টা ঘুমোতেন এবং তা সন্ধ্যেবেলায়। চার্লস ডিকেন্স বিছানায় কম্পাস রাখতেন এবং নিশ্চিত হতে চাইতেন যে উত্তর দিকে মুখ দিয়ে ঘুমোচ্ছেন। উত্তরমুখী ঘুম তার সৃজনশীলতা নিশ্চিত করত বলে তিনি মনে করতেন। ইয়াহুর প্রধান নির্বাহী মারিসা মেয়ার কোনো কোনো সপ্তাহে ১৩০ ঘন্টা অফিসে কাজ করেন। কম ঘুমোনো পুষিয়ে নিতে চার মাস পরপর এক সপ্তাহের ছুটি নেন এবং টানা ঘুম দেন। জলদানব মাইকেল ফেলপস সর্বাধিক অলিম্পিক স্বর্ণপদক বিজয়ী, তিনি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উপরে অক্সিজেন ঘাটতি অঞ্চলে ঘুমোন যাতে শরীরের কষ্ট হয়, লোহিত কনিকা তৈরি করতে শরীরকে অধিক পরিশ্রম করতে হয়, এতে তার 'পারফার্মন্স এবিলিটি' বাড়ে। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এবং প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন পুরো দিনটাকে দুই শিফটে ভাগ করে কাজ করতেন, দুবার ঘুমোতেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘুমান সর্বোচ্চ ৪ ঘন্টা।

তিনটি ঘুম গ্রন্থ

হোয়াই উই স্লিপ: আনলকিং দ্য পাওয়ার অব স্লিপ অ্যান্ড ড্রিমস, লেখক ম্যাথিউ পি ওয়াকার স্নায়ুবিজ্ঞানী এবং ঘুম বিশেষজ্ঞ। ম্যাথিউ ওয়াকার ঘুমের সাথে জীবন সুস্থ্যতা ও আয়ুর সম্পর্ক দেখিয়েছেন। ঘুমের র‌্যাপিড আই মুভমেন্ট পর্বটিতে আসলে কি ঘটে, ঘুমের ধরন কেমন করে বদলায়, ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল ঘুমের উপর কেমন প্রভাব বিস্তার করে তা বিশ্লেষণ করেছেন।

. হোয়াই উই ড্রিম: দ্য ট্রান্সফর্মেটিভ পাওয়ার অব আওয়ার নাইটলি রিসেট: একটি গবেষনা সফরে পেরু যাবার সময় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক এলিম রব নিজেই একটি স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে পড়লেন এবং দীর্ঘ গবেষনায় নিজেকে নিয়োজিত করে এই গ্রন্থটি লিখেন।
. ওয়াইল্ড নাইটস: হাউ টেমিং স্লিপ ক্রিয়েটেড আওয়ার রেস্টলেস ওয়ার্ল্ড, বেঞ্জামিন রিস এর লেখা ২০১৭ সালে প্রকাশিত। নামই বলে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অধ্যাপক ঘুমের দুঃসময় ও দুর্যোগকে সাহিত্যিকের চোখে, দার্শনিকের চোখে দেখতে চেয়েছেন। শিল্প বিপ্লবের আগে তো ঘুম ভাবনা কিংবা দুর্ভাবনার বিষয় ছিল না। ঘুম নিজস্ব বৃত্তে নিজস্ব শৈলীতে আবর্তিত হতো। মানুষ তাকে অনুসরণ করত। কিন্তু শিল্প-বিপ্লবোত্তর পৃথিবী ঘুমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করল এবং নিয়ন্ত্রিত হতে বাধ্যও করল। বইয়ের নাম ওয়াইল্ড নাইটস এমিলি ডিকিনসনসনের একটি কবিতার শিরোনামের অর্ধেক। মূল নামটি 'ওয়াইল্ড নাইটস, ওয়াইল্ড নাইটস।' শেকসপিয়রের টেমিং অব দ্য শ্রু বাংলায় অনূদিত হয়েছে 'মুখরা রমনী বশীকরণ' নামে। এখানেও ঘুমকে বশীকরণ। আর সে জন্যই সৃষ্টি হয়েছে আমাদের অস্থির পৃথিবী। চার পর্বে বিভক্ত বইটির ছয়টি অধ্যায়--ঘুম নিয়ে একালের 'আই ওপেনার' এই বই। শিল্প বিপ্লব বিদ্যুতের যোগান দিয়েছে, কৃত্রিম আলো দিয়েছে, ফ্যাক্টরিতে কাজের সময় বাড়িয়েছে, প্রযুক্তি দিয়ে ঘুমকে বশীভূত করার চেষ্টা করেছে মানুষের দেহের প্রাকৃতিক ছন্দ আর শিল্প ও উন্নয়নের সৃষ্টি করা ছন্দ মোটেও এক নয়। আড়াইশ তিনশ' বছর আগে শরীরের নিজস্ব ছন্দের উপর কোনো আঘাত আসেনি। এখন মধ্যরাতের পর ইমেইল আসে। ই-মেইলের জবাব না গেলে একটার পর একটা ম্যাসেজ আসে, কি ব্যাপার ঘুমোচ্ছো নাকি? সাথে যোগ হয়েছে ক্যাফেইন, ১৭০০ সালেই লন্ডনের কফিশপের সংখ্যা ৩০০০, ক্যাফেইন ছাড়া বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন যেন অচল।

দি স্লিপ অফ রিজন, ফ্রান্সিসকো গইয়া, ১৭৯৯

ঘুমের ছন্দে হস্তক্ষেপই সৃষ্টি করেছে 'রেস্টলেস ওয়ার্ল্ড'-অস্থির পৃথিবী।এখন একদিকে যেমন চলছে না ঘুমোনোর লড়াই অন্যদিকে বেড়েছে ঘুমহারা মানুষের ঘুমোবার আকুতি। পরস্পর বিরোধী এ দুটো পৃথিবীর দ্বন্দ্ব স্পষ্ট এই 'ওয়াইল্ড নাইটস' গ্রন্থে।

তালাত মাহমুদের গাওয়া প্রণব রায়ের লেখা ঘুমের একটি স্মরনীয় গান উদ্ধৃত করতেই হয়:

ঘুমের ছায়া চাঁদের  চোখে এ মধুরাত নাহি বাকি
এ মধুরাত নাহি বাকি মুখপানে মোর রয়েছে জাগি
যে আঁখিতে লাজ ছিল গো সেথা প্রেমের ভাষা
হিয়া যে চাহে এ মধুরাতে পরাতে তোমায় মিলন রাখি
আধো জোছনায় আবেশ লাগে অধর নিরব শুধু নয়ন জাগে
হৃদয় কহে আমি তোমারি নিরব ভাষায় সাথিরে ডাকি
হয়তো এ নিশী সারা জীবনে আসিবে না ফিরে কোনো ক্ষণে
ক্ষণিক মিলনে মিলেছি দু'জনে রাত জাগা দু'টি পাখি
হিয়া যে চাহে এ মধুরাতে পরাতে তোমায় মিলন রাখি।

এতো ঘুমোবার নয়, রাতজাগার গান। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল তল্লাসি করে দেখেছি, ঘুমের নয় জাগরণের গানই বেশি। এই 'ঘুম ঘুম চাঁদ এই মাধবী রাত লেখাটির উপসংহার টানতে চাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ঘুম ভাঙ্গার পর কবিতাটি দিয়ে :

ঘুম ভাঙার পর যেন আমার মন ভালো হয়ে যায়।
হলুদ-তেল মাখা একটি সকাল,
ঝর্নার জলে বৃষ্টিপাতের মতন শব্দ
ঝুল বারান্দার সামনের বাগানে কেউ হাসছে
শীতের রোদ্দুরের মতন।
কিছু ভাঙছে, কিছু খসে যাচ্ছে
বইয়ের পাতায় কার আঙুল, এখুনি যাবে অন্য পাতায়।
দিগন্ত থেকে ভেসে আসছে বিসর্জনের সুর
ঘুম ভাঙার পর যেন আমার মন ভালো হয়ে যায়।

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.