কয়লা দৈত্যের আখ্যান

ইজেল

02 July, 2021, 11:15 pm
Last modified: 03 July, 2021, 12:37 pm
অনেকেই ছিল কয়লা ব্যবহারের ঘোর বিরোধী। তাদের সামনে কয়লার মহিমাকে দৃশ্যমান করে তুলতেই প্রয়োজন ছিল কয়লা নিয়ে শত উপমা ও কাব্যিকতার বাড়াবাড়ি। চেষ্টা করা হতো কয়লাকে কেবল একটি অতি প্রয়োজনীয় বস্তুতে সীমাবদ্ধ না রেখে, একে মানবজাতির নিয়তির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে অধিষ্ঠিত করার। এই প্রচেষ্টাকে আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায় ১৮৫০ সালে চার্লস ডিকেন্স সম্পাদিত একটি জনপ্রিয় সাপ্তাহিকে প্রকাশিত অজ্ঞাতপরিচয় লেখকের ‘ক্রিসমাস ক্যারল অভ কার্বন’ গল্পের মাধ্যমে। 

১৩০৬ সালের গ্রীষ্ম। ইংল্যান্ডের সকল বিশপ, ব্যারন ও নাইটরা তাদের কান্ট্রি ম্যানর ও গ্রাম ছেড়ে যাত্রা শুরু করলেন লন্ডন অভিমুখে। তাদের উদ্দেশ্য: সংসদ নামক আনকোরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সশরীরে অংশগ্রহণ। 

কিন্তু শহরে পা রাখা মাত্রই এক বিদঘুটে দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা দিল তাদের নাকে। তারা মধ্যযুগীয় মফস্বলের গোবর কিংবা ময়লা-আবর্জনার ঘ্রাণের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন বটে, কিন্তু শহরে এসে তারা একদমই ভিন্নধর্মী এক দুর্গন্ধের সম্মুখীন হলেন—পোড়া কয়লার ঝাঁঝালো গন্ধ।

এর কারণ, মাত্র কিছুদিন আগেই লন্ডনের কামারসহ অন্যান্য কারিগররা কাঠের বদলে এই কৃষ্ণবর্ণ পাথরগুলো পোড়াতে শুরু করেছে জ্বালানি হিসেবে, এবং তারই ফলস্বরূপ শহরের রাস্তাঘাট ছেয়ে গেছে কটুগন্ধী ধোঁয়ায়।

শহরে আগত সম্মানিত অতিথিরা অচিরেই নতুন এই জ্বালানি ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করলেন। রাজা প্রথম এডওয়ার্ডও তাই বাধ্য হলেন কয়লা পোড়ানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে। 

তবে সেই নিষেধাজ্ঞায় বিশেষ কাজ হলো না। অধিকাংশ মানুষই রাজার আদেশ অমান্য করে কয়লা পোড়ানো অব্যাহত রাখল। তাই রাজা এবার নতুন আইন জারি করলেন। প্রথমবার কেউ নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করলে তাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ জরিমানা করা হবে। আর কেউ যদি নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে বসে, তাহলে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হবে তার চুল্লি। 

যদি তখন কয়লা পোড়ানোর উপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া হতো, তাহলে হয়তো মানবসভ্যতার ইতিহাস অনেকটাই ভিন্ন হতো। কিন্তু সেজন্য অপেক্ষা করতে হয় ষোড়শ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে বনভূমির পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকে, এবং তীব্র শক্তি সংকট দেখা দেয়। তাই ইতঃপূর্বে যা সাধারণ মানুষের নিকট অসহনীয় ছিল, সেটিকেই এবার তারা সহ্য করতে শুরু করে, এবং ইংল্যান্ড পরিণত হয় খনি থেকে কয়লা উত্তোলন ও জ্বালানি হিসেবে ব্যাপক হারে ব্যবহারকারী প্রথম দেশে। 

এর ফলাফল ছিল ভয়াবহ। লন্ডন ও ইংল্যান্ডের অন্যান্য শহর যে ধরনের বীভৎস বায়ু দূষণের শিকার হয়, তা এখনো বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। 

এক সময় কয়লা খনিতে ব্যাপকহারে শিশুশ্রম ব্যবহার হতো

ইংরেজরা এখানেই থেমে থাকে না। তারা কয়লা পুড়িয়ে শুরু করে এমন এক শিল্প বিপ্লব, যা বদলে দেয় গোটা পৃথিবীকে। আপনি তাই এ কথা বলতেই পারেন যে আধুনিক বিশ্বের ইতিহাস রচিত হয়েছে কয়লার ধোঁয়ায়। এবং যেহেতু কয়লা পোড়ানোর সেই ভয়াল প্রভাব এখনো থেমে নেই, তাই আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি, ভবিষ্যতে এই পৃথিবীর জন্য কেমন পরিণতি অপেক্ষা করে আছে। 

কয়লা হলো এমন এক পদার্থ, যার কোনো গ্ল্যামার নেই। এটি নোংরা, সেকেলে ও সস্তা। বিশেষ করে কয়লার মহিমা অনেক বেশি তলানিতে গিয়ে ঠেকে, যখন এর তুলনা করা হয় আরেক জীবাশ্ম জ্বালানি তেলের সঙ্গে। 

তেলের নাম শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে নানাবিধ আড়ম্বরতার চিত্র। বিশাল অঙ্কের ঝুঁকি, মিলিয়ন-বিলিয়ন অর্থের ঝনঝনানি কিংবা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, সবকিছুই তেলকে ঘিরে। তেলের কল্যাণেই আমরা পেয়েছি রকফেলার থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের অগণিত শেখের মতো ধনকুবের তারকাদের, যাদেরকে কেউ ভালোবাসে আবার কেউবা করে ঘৃণা। 

এমনকি ইংরেজিতে 'স্ট্রাইকিং অয়েল' বলেও একটি উপমার প্রচলন ঘটেছে, যা দ্বারা বোঝানো হয় আকস্মিকভাবে কিংবা ভাগ্যের জোরে প্রভূত সম্পদের মালিক হয়ে ওঠাকে। 

অথচ কয়লার কথা উঠলে কিন্তু আমরা ধনীদের কথা ভাবি না, ভাবি দরিদ্রদের কথা। কয়লার প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে ঝুল-কালি মাখা হতদরিদ্র খনি শ্রমিকদের কথা, যারা দিন-রাত অমানুষিক পরিশ্রম করে যায় তাদের পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর আশায়। আজকাল আর জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনে কয়লার ব্যবহার চোখে পড়ে না। তারপরও কয়লাকে নিতান্তই ঘরোয়া বস্তু বলে বোধ হয়। 

কয়লার সঙ্গে পূর্ববর্তী প্রজন্মসমূহের যে তিক্ত সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল, তা এখনো রয়েছে অনেকাংশে বিরাজমান। ইংল্যান্ডে এমনকি আজকের দিনেও অনেক বাবা-মাই তাদের বাচ্চাকে এই বলে হুমকি-ধামকি দেয় যে তারা যদি নম্র-ভদ্র হয়ে না থাকে তাহলে বড়দিনে তাদের কপালে জুটবে কেবলই একতাল কয়লা। 

এবং ওই বাচ্চারাও হয়তো কোনোদিন স্বচক্ষে কয়লা দেখেইনি, তবু তারা জানে একতাল কয়লা কখনো তাদের কাম্য নয়। 

ফলে তেল যেখানে সৌভাগ্যের প্রতীক, সেখানে কয়লা হতাশা ও বঞ্চনার সমার্থক বৈ আর কিছুই নয়।

তারপরও আমরা এমন এক সংস্কৃতির কথা কল্পনা করতেই পারি, যেখানে অতীতের প্রতি রয়েছে গভীর আবেগ ও সম্মান, বিশেষত অতি প্রাচীন ও সুদূরবর্তী অতীতের প্রতি, যেখানে কয়লার মহিমা ছিল একেবারেই ভিন্ন। সেখানে একতাল কয়লা দেখে কেউ নাক সিঁটকাত না, বরং ভক্তিভরে পূজা করত জীবাশ্ম হিসেবে। 

যখনো স্তন্যপায়ীদের আবির্ভাব ঘটেনি, উদ্ভব ঘটেনি ডাইনোসরদেরও, মহাদেশগুলোও তাদের বর্তমান আকৃতি ধারণ করেনি, তখন এই কয়লাগুলো ছিল জীবন্ত। তারা ছিল এমনই বিশাল জলাবনের অংশ, যেখানে ছিল অদ্ভুত সব গাছ ও দৈত্যাকার ফার্নের সম্মিলন—উনবিংশ শতকের এক লেখক যাকে অভিহিত করেছেন 'মনস্টারস অভ দ্য ভেজিটেবল ওয়ার্ল্ড' হিসেবে। এখন অবশ্য এমন বনভূমির অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হয়ে গেছে, কেবল পৃথিবীর অল্প কিছু অংশে তারা রয়েছে অতি সঙ্কুচিত রূপে। 

ভূগর্ভস্থ অধিকাংশ কয়লার স্তরই ছিল সেই প্রথম প্রবাহের বৃক্ষরাজির অংশ, যারা সমুদ্র ছেড়ে স্থলে উপনিবেশ গড়েছিল, এবং অন্যান্য প্রাণিকেও একই কাজ করার পথ দেখানোর মাধ্যমে বিবর্তনের ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিল। 

সহজ কথায় বলতে গেলে, কয়লা হলো সেইসব নিশ্চিহ্ন ও বিলুপ্ত প্রাণের ঘনীভূত রূপ, যারা এককালে পৃথিবীর বুকে জীবনের ফুল ফুটিয়েছে। 

সুতরাং, পৃথিবীকে বর্তমান অবস্থানে এসে পৌঁছাতে সেই প্রথম দিককার বৃক্ষজীবন যে অসামান্য অবদান রেখেছে, কয়লা আজো তারই সাক্ষ্য বহন করে। 

কয়লাই বেঁচে থাকার অবলম্বন ছিল অনেক অঞ্চলের মানুষের

দুর্ভাগ্য একটাই যে পৃথিবীতে কয়লার পরিমাণ প্রায় অফুরান। যদি কয়লা এত সহজেই লভ্য না হতো, তাহলে জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো তো দূরে থাক, নির্ঘাত জাদুঘরে ডাইনোসরের হাড়ের পাশে সযতনে সাজিয়ে রাখা হতো তাদের। 

কয়লা কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে, তারচেয়েও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো কয়লা আমাদের কী দিচ্ছে। কয়লার মাধ্যমে আমরা পাচ্ছি এত বিপুল পরিমাণ শক্তি, যা পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। 

কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীর বুকে প্রায় সকল প্রাণের রূপই তাদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য নির্ভর করে এসেছে সূর্য থেকে প্রাপ্ত সতেজ শক্তির উপর। সেই সৌরশক্তি অস্থায়ীভাবে মজুদ হয় সকল প্রাণশীল পদার্থের ভেতর। বৃক্ষরাজি সূর্যরশ্মিকে গ্রহণ করে তাকে রূপান্তর করে রাসায়নিক শক্তিতে, এবং প্রাণিরা সেই শক্তি লাভ করে গাছপালাকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণের মাধ্যমে।  

তবে বৃক্ষরাজি কেবল শক্তির রূপান্তরই ঘটায় না, তারা সেই শক্তির কিছু অংশকে নিজেদের অভ্যন্তরে জমিয়েও রাখে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ওইসব বৃক্ষের আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে আসে, তারা পুড়ে ছাই হয়, কিংবা কোনো প্রাণির পেটে চলে যায় খাদ্য হিসেবে (তাছাড়া কিছু বিরল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আবার শক্তি বৃক্ষের গভীরে জীবাশ্ম জ্বালানি হিসেবেও সঞ্চিত থাকে)।

তৃণভোজী প্রাণিরা খাদ্যের মাধ্যমে ওই সঞ্চিত শক্তিকে তাদের শরীরে গ্রহণ করে, এবং সেটিকে কেবল নিবিষ্ট রূপেই রেখে না দিয়ে, শরীরের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়। তাই আমরা যেসব প্রাণিদের দেখতে পাই, তারা নিছকই প্রাণি নয়, তারা যেন একেকটি মোবাইল ব্যাটারি। 

প্রত্যেক প্রাণির শরীরই একেকটি শক্তির আধার। তারা সৌরশক্তিকে নিজেদের শরীরে বহন করে, এবং পরবর্তীতে যখন তারা অন্য কারো খাদ্যে পরিণত হয়, তখন তাদের খাদকের মাঝেও প্রবাহিত হয় সেই শক্তি। এভাবে সূর্য থেকে আগত শক্তি কোনো একটি জায়গায় থেমে থাকার বদলে, ক্রমাগত এক আধার হতে আরেক আধারে স্থানান্তরিত হয়। 

প্রাণিজগতে যে সকল প্রজাতি তাদের খাদ্য থেকে প্রাপ্ত ক্যালরিকে সর্বাধিক দক্ষতার সঙ্গে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারে, তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলাম আমরা মানবজাতি। 

একটি ঘোড়ার কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ শারীরিক শক্তি অর্জনে যে পরিমাণ ক্যালরির প্রয়োজন হয়, মানুষের প্রয়োজন হয় মাত্র তার অর্ধেক। 

আমাদের মেটাবলিজম আশ্চর্য রকমের শক্তি সাশ্রয়ী, এবং এই বিষয়টিই বিবর্তনের পথে অন্য অধিকাংশ প্রজাতির তুলনায় আমাদেরকে এগিয়ে রেখেছে। সম্ভবত এই সুবিধাটাই আমাদের মস্তিষ্কের উন্নতিসাধনেও সাহায্য করেছে, যার ফলে সেই মস্তিষ্ককে কাজে লাগিয়ে আমরা নিজেদেরকে ক্রমশ অন্যান্য প্রজাতির ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যেতে পেরেছি। 

যেমন আমরাই হলাম সেই বিশেষ প্রজাতি, যারা তৃণদেহে মজুদকৃত সৌরশক্তিকে আরেকভাবে বের করে আনার পথ খুঁজে পেয়েছি: আগুন জ্বালিয়ে। 

গাছপালা পোড়ানোর মাধ্যমে—বিশেষত যেগুলোকে আমরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি না—মানবজাতি নিজেদের গ্যাস্ট্রিক ও মেটাবলিক সিস্টেমের ফলে সৃষ্ট শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে জয় করতে পেরেছে, এবং পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক সৌরশক্তির অবমুক্তি ঘটাতে পেরেছে। তাই আগুন জ্বালাতে শেখা নিঃসন্দেহে একটি কালান্তকারী ঘটনা। 

আগুন জ্বালাতে পারা আমাদের প্রজাতির একটি অন্যতম বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। আগুনকে ব্যবহার করতে পারে একমাত্র মানুষই। অবশ্য এক্ষেত্রে 'মানুষ' হিসেবে যদি আমরা বিবেচনা করি সেইসব প্রাইমেটদেরও, যারা এক পর্যায়ে মানুষে পরিণত হয়েছে। কেননা আগুন নিয়ন্ত্রণের বিদ্যা অর্জিত হয়েছে প্রায় অর্ধ-মিলিয়ন বছর আগে, যখনো হোমো সেপিয়েন্সের আবির্ভাব ঘটেনি।  

তবে সে যা-ই হোক, আগুনকে নিজেদের প্রয়োজনমাফিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাই প্রকৃতির নিকট অতীতে আমাদের যেসব দুর্বলতা ছিল সেগুলোকে অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছে। বিশেষত সেইসব সুদীর্ঘ বরফ যুগেও আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে, যার ফলে আমরা হয়ে উঠেছি 'সত্যিকারের মানুষ'।

একটা সময় পর্যন্ত মানুষের ছিল ভবঘুরে জীবন। তারা স্থলভূমির এক স্থান থেকে আরেক স্থান ঘুরে বেড়াত শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের লক্ষ্যে। কিন্তু তারপর এক পর্যায়ে তারা নিজেরাই খাদ্য উৎপাদন করতে শেখে, যেটি প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে সভ্যতার সূচনালগ্ন। এবং কৃষিভিত্তিক সভ্যতার এই সূচনা সম্ভব হয়েছে আগুন, এবং প্রায় দশ হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে অপরিবর্তিত জলবায়ুর কল্যাণে।  

আগুন কীভাবে কৃষিকাজে সাহায্য করল? প্রথমত, বনভূমি পুড়িয়ে জমি পরিষ্কার করে ফসল উৎপাদনের উপযোগী করে তোলার মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, মানুষের উৎপাদিত ফসলগুলোকে রান্নার মাধ্যমে হজমযোগ্য খাদ্যে পরিণত করার মাধ্যমে। 

শিল্পীর তুলিতে লন্ডনের শিশুশ্রমিক

তাছাড়া এই স্থায়ী বসতিতে মানুষ ক্রমশ অন্যান্য উৎপাদন দক্ষতাও অর্জন করতে শুরু করে, যেগুলোর সঙ্গে আগুন ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেমন: মৃৎশিল্প, ইট তৈরি, ধাতু বিগলন ইত্যাদি। 

সভ্যতার গোড়ার দিককার কারিগররা এমন এক জ্বালানিকে কাজে লাগাতে শুরু করে, যা কাঠ ও কয়লার মধ্যে সেতুবন্ধন ঘটায়, এবং যার সঙ্গে কাঠ ও কয়লা উভয়েরই সাদৃশ্য বিদ্যমান। সেটি হলো কাঠকয়লা। এটি এমন এক ধরনের কাঠ, যা ইতোমধ্যেই আংশিকভাবে পুড়ে গেছে। 

হাজার হাজার বছর ধরে কাঠকয়লা তৈরি হয়েছে কাঠকে বিশাল গাদায় স্তূপীকৃত করে, কিংবা কিছু অংশ মাটিতে পুঁতে রেখে, তারপর তাদেরকে ধীরে ধীরে, সামান্য অক্সিজেনের উপস্থিতিতে পুড়িয়ে, যেন শেষ অবধি কেবল খাঁটি কার্বন অবশিষ্ট থাকে। 

এতে করে যে কাঠকয়লা তৈরি হতো, তা কাঠের চেয়ে অনেক বেশি গরম হতো এবং অনায়াসে জ্বলত। তবে এর একটি নেতিবাচক দিকও ছিল। কাঠকয়লা তৈরির প্রক্রিয়া কাঠের প্রকৃত জ্বালানি গুণকে অনেকটাই নষ্ট করে দিত, এবং বনভূমিতেও দ্রুতই গাছের শূন্যতা সৃষ্টি হতো। 

ফলে দেখা গেল, সভ্যতার বিকাশ ও নিত্যনতুন জাতির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে, বনভূমির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেল। কেননা মানুষের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তো চাহিদা বৃদ্ধি পায় জ্বালানি, আসবাবপত্র এবং চাষযোগ্য জমির। এই সকল চাহিদা মেটাতেই প্রয়োজন হয় গাছের, যার ফলে হ্রাস পায় সৌরশক্তি সঞ্চয়ের নিশ্চিত আধার। 

তবে এমন একটা সময়েই কয়লা আবির্ভূত হয় ত্রাণকর্তা হিসেবে। কেননা কয়লাতে সঞ্চিত রয়েছে লক্ষ-কোটি বছরের পুরনো সৌরশক্তি, যা জ্বালানি হিসেবে শত-সহস্র জীবন্ত বৃক্ষরাজির চেয়েও অধিক ক্ষমতাশালী। ফলে কয়লা এসে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির মৌলিক সম্পর্কে ব্যাপক পরিবর্তন এনে দেয়। 

অবশ্য, কিছু পেতে গেলে কিছু তো হারাতেও হয়। কয়লার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। কয়লা থেকে প্রাপ্ত চটজলদি সুবিধা ভোগ করতে গিয়েও মানবজাতিকে চোকাতে হচ্ছে বড় ধরনের মূল্য। 
সেই মূল্যের রয়েছে একটি গালভরা নাম, যার সঙ্গে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি। 

এক্ষেত্রে কেস স্টাডি হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে মিনেসোটার কথা। এটি একটি শীতল রাজ্য। যুক্তরাষ্ট্রে আলাস্কার বাইরে এই রাজ্যেই সাধারণত শীতকালে তাপমাত্রা সবচেয়ে কম থাকে। 

উত্তরের কিছু অঞ্চলে মাইনাস ৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তো নতুন কিছু না। এই তাপমাত্রায় এক বালতি পানি ছুড়ে দিলে মাটিতে পড়ার আগেই বরফ হয়ে যায়, এবং শরীরের কোনো অংশ অনাবৃত থাকলে মুহূর্তের মধ্যেই সেখানকার ত্বক জমে যায়। 

ফলে এরকম কোনো জায়গায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সামান্য কয়েক ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তাতে কারোই কোনো হেলদোল হয় না। তাছাড়া উত্তর আমেরিকার অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে মিনেসোটাই সমুদ্র থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থিত হওয়ায়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়েও সেখানে কেউ ভাবিত নয়। 

মোদ্দা কথা, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন বা সংকট মিনেসোটায় আহামরি কোনো ব্যাপার হওয়ার কথা নয়। তারপরও তারা চেয়েছিল স্রেফ ধারণা নিয়ে রাখতে যে তারা যেভাবে শক্তি ব্যবহার করছে তাতে দূরবর্তী ভবিষ্যতেও তাদের জলবায়ুর কোনো ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে কি না। 

আর সে কারণেই, কয়েক বছর আগে এই রাজ্য আইনি প্রক্রিয়া শুরু করে তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ধরন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে কতটুকু প্রভাব ফেলে তা পরিমাপ করে দেখতে। বলাই বাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য অংশের মতো, মিনেসোটায়ও বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় কয়লা থেকে। তাই তাদের জানার আগ্রহ ছিল মূলত এটি যে তাদের কয়লা চালিত তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনে কেমন ভূমিকা রাখে।

স্কটল্যান্ডের খনিতে নারী শ্রমিক
 

যখন এই প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন খুব কম মানুষই অনুমান করতে পেরেছিল এর ফলাফল কতটা স্পর্শকাতর হতে চলেছে। দেশটির কয়লা শিল্পের প্রতিনিধিত্বকারী উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ এবং উগ্রবাদী রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেয় মিনেসোটার শুনানিতে। তারা মিনেসোটার এই প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকে পরিণত করে রাজ্যের ইতিহাসের দীর্ঘতম শুনানিগুলোর একটিতে। 

একঝাঁক বিজ্ঞানীকে নিয়ে আসা হয়, যারা সকলেই সাক্ষ্য দেয় যে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের বিজ্ঞানীরা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যেসব দাবি করছে, মিনেসোটার কোনো প্রয়োজন নেই সেসবে কর্ণপাত করার। কেননা জলবায়ুর আসলে বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটছে না। যেটুকু পরিবর্তন ঘটছে, তা বরং মিনেসোটাবাসীর জন্য উপভোগ্যই হবে।  

কিন্তু ক্রমশ বিষয়টি পরিণত হয় একটি জাতীয় বিতর্কে, এবং মিনেসোটা সেখানে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। কয়লা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যেমন আগ্রাসী রূপ ধারণ করে, তাতে বোঝা যেতে থাকে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে আসলেই তাদের সম্পর্ক রয়েছে। 

জলবায়ু পরিবর্তন মূলত ঘটে থাকে জীবাশ্ম জ্বালানি তথা কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানোর ফলে। এবং এসব জ্বালানির মধ্যে, কয়লাই মোট গৃহীত শক্তির বিপরীতে সর্বোচ্চ গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি করে। এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি কয়লা পোড়ানো হয়, যার সিংহভাগই কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে। 

যদিও মিনেসোটার সিদ্ধান্তপ্রণেতারা কয়লা শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের মাধ্যমে আসলে জলবায়ুর উন্নতিই ঘটবে, এ ব্যাপারটি এখনো নিশ্চিত নয় যে আসলেই এতে করে রাজ্যটির শক্তি নীতিতে আদৌ কোনো রদবদল ঘটবে কি না। 

তবে প্রশাসনের ভূমিকা যা-ই হোক না কেন, মিনেসোটার এই ঘটনায় কয়লার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে একটি কথোপকথন অন্তত শুরু হয়েছে, এবং অনেকেই এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠছে। জলবায়ুর উপর কয়লার ভূমিকা নিয়ে প্রচুর লেখালেখিও হচ্ছে। 

অবশ্য লেখালেখি নেহাত নতুন কিছুও নয়। পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, উনবিংশ শতকের শেষভাগ কিংবা বিংশ শতকের শুরুর দিকে প্রকৌশলী, বৃক্ষবিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী কিংবা ধর্মতত্ত্ববিদরা কয়লা নিয়ে যেসব বই কিংবা আর্টিকেল লিখতেন, সেগুলোতে থাকত কেবল কয়লা নিয়ে আবেগে গদগদ প্রশস্তি। কাব্যিক উপমার ডালা সাজিয়ে বসতেন তারা কয়লার জয়গান গাইতে। 

যেমন উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে র‍্যালফ ওয়াল্ডো এমারসন কয়লা নিয়ে লিখেছিলেন :

প্রতিটি ঝুড়িই যেন ক্ষমতা ও সভ্যতা,
কেননা কয়লা জলবায়ুর বাহক। 
শীতল অঞ্চলে সে নিয়ে আসে গ্রীষ্মমণ্ডলের উত্তাপ,
এবং নিজেকে নিয়ে যায় যেখানে খুশি।
ওয়াট ও স্টিফেনসন মানবজাতির কানে আউড়ে গেছে
তাদের গূঢ় রহস্য—
আধ-আউন্স কয়লা টানবে প্রতি মাইলে দুই টন,
কয়লাই বইবে কয়লাকে,
কানাডা হয়ে উঠবে কলকাতার মতো উষ্ণ;
আর এভাবেই প্রশান্তি এনে দেবে 
শিল্পের শক্তি। 

এই পঙক্তিগুলো শুধু এ কারণেই অনন্য নয় যে এখানে এমারসনের উপমাগুলো ছিল অদ্ভুত রকমের যথার্থ, বরং এজন্যও যে এগুলোর মাধ্যমে কয়লার বিশ্ব-পরিবর্তনকারী নির্যাসকেও চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। 

ট্রি ফার্ন আর লাইকোপড ট্রি, ১৯০৬ সালে কয়লায় রূপান্তরিত হওয়া এই বনের কল্পনা করেছেন শিল্পী

পাশাপাশি এই পঙক্তিগুলোর মাধ্যমে আরো বোঝা যায় যে উনবিংশ শতকে কয়লাকে কতটা উঁচুদরে মূল্যায়ন করা হতো, এবং ভাবা হতো এর মাধ্যমে মানবজাতি শীতলতার পরিবর্তে উষ্ণতর, সভ্যতর ও প্রশান্তিকর এক পৃথিবীর দেখা পাবে। 

এটা এমন এক সময়ের কথা, যখন কয়লা আর নিছকই কোনো জ্বালানি ছিল না, স্রেফ কোনো ব্যবসায়ের চাবিকাঠিও ছিল না, বরং এটি হয়ে উঠেছিল প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানবতার জয়ের স্মারক। 
আরেকজন লেখক যেমন লিখেছিলেন, "কয়লার কল্যাণে আজ আমাদের আলো আছে, শক্তি আছে, ক্ষমতা আছে, সম্পদ আছে, সভ্যতা আছে। অথচ কয়লা ছাড়া, আমাদের ছিল কেবলই অন্ধকার, দুর্বলতা, দরিদ্রতা ও বর্বরতা।" 

কয়লা নিয়ে এত এত প্রশস্তির একটি কারণ আন্দাজ করা যায়। সেটি হলো : তখনো সকলে কয়লার গুরুত্বকে স্বীকার করেনি। অনেকেই ছিল কয়লা ব্যবহারের ঘোর বিরোধী। তাদের সামনে কয়লার মহিমাকে দৃশ্যমান করে তুলতেই প্রয়োজন ছিল কয়লা নিয়ে এত উপমা ও কাব্যিকতার বাড়াবাড়ি। এভাবেই চেষ্টা করা হতো কয়লাকে কেবল একটি অতি প্রয়োজনীয় বস্তুতে সীমাবদ্ধ না রেখে, একে মানবজাতির নিয়তির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে অধিষ্ঠিত করার। 

এই প্রচেষ্টাকে আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায় ১৮৫০ সালে চার্লস ডিকেন্স সম্পাদিত একটি জনপ্রিয় সাপ্তাহিকে প্রকাশিত অজ্ঞাতপরিচয় লেখকের 'ক্রিসমাস ক্যারল অভ কার্বন' গল্পের মাধ্যমে। 

সেখানে দেখা যায়, ফ্ল্যাশলি নামের এক তরুণ নোংরা কয়লা এবং কয়লাখনিতে কর্মরত শ্রমিকদেরকে অবজ্ঞা করে। তারপর এক রাতে তার ঘরের কয়লার আগুন থেকে উঠে আসে এক ভীতিকর মানুষ—তার শরীর কালো ও ভারি, তার শরীরের ত্বক খুবই রুক্ষ, এবং কণ্ঠস্বর এমনভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, যেমনটি হয়ে থাকে কয়লা খনির গহীনে। সেই মানুষটি ফ্ল্যাশলিকে নিয়ে যায় এক আবেগময় যাত্রায়। বলে সেইসব আদিম জঙ্গলের কথা, যেখানে নিহিত রয়েছে কয়লার অতীত। বলে কয়লা খনির ভীতিপ্রদ অতীত ও বর্তমানের কথা। বলে কয়লা খনির শ্রমিকদের অসামান্য আত্মত্যাগের কথা, যার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে আজকের আধুনিক সভ্যতা। অবশেষে ফ্ল্যাশলির সামনে উন্মোচিত হয় কয়লার প্রকৃত তাৎপর্য। সে বুঝতে পারে, কয়লা হলো পৃথিবীর বুকে এক স্বর্গীয় নিয়ামক, যার মাঝে অনুভব করা যায় সৃষ্টিকর্তার আত্মাকে, এবং যার কল্যাণে মানুষ আজ বন্য, অসভ্য, বর্বর জীবনের পরিবর্তে লাভ করছে এক সভ্য, পরিশোধিত জীবন।  

অর্থাৎ, গল্পের সারকথা হলো: কয়লা শুধু মানবসভ্যতাকেই জাগিয়ে তোলেনি, বিকশিত করেছে মানব আত্মাকেও। সে আমাদেরকে দিয়েছে প্রকৃতির নানা বাহ্যিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই, এবং আমাদের নিজেদের বর্বর প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। তাই কয়লা হলো আমাদের প্রজাতির ত্রাণকর্তা।

কয়লার ব্যাপারে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি আজকের দিনেও কিছুটা অবশিষ্ট রয়েছে। তবে তা আর কবি-সাহিত্যিকদের কলমে প্রকাশিত হয় না, জোর গলায় উচ্চারিত হয় কয়লা শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের মুখ থেকে। 

কেউ কেউ তো কয়লার প্রতি দরদকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। তারা কয়লার মাঝে কেবল ঈশ্বরের মানবজাতিকে নতুন উচ্চতা প্রদানের আকাঙ্ক্ষাই দেখতে পায় না, পাশাপাশি তা যে অ্যাংলো-স্যাক্সন প্রোটেস্ট্যান্টদের হাত ধরেই সংঘটিত হবে সেই ব্যবস্থার চিহ্নও খুঁজে পায়। 

তাই সেই উনবিংশ শতকেই ব্রিটিশ ও আমেরিকান ধর্মভীরুরা খেয়াল করে ফেলে যে ঈশ্বর তাদেরকে বিশ্বের সর্বাধিক কয়লা দান করেছেন। মানে, তাদের কাছে ওই সময় অন্তত তেমনটিই মনে হয়। এবং অচিরের তারা দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলে যে ঈশ্বরের এই অসীম কৃপা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়।

১৮৫৬ সালের 'ক্রিশ্চান রিভিউ'-র এক সংখ্যায় যেমন এক আমেরিকান লেখেন, কয়লার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী স্বয়ং ঈশ্বরই অনেককাল আগে প্রস্তরখণ্ডের উপর লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

"কর্মচঞ্চল ও উদ্যোগী এক জাতি দেখা যাবে, তাদের থাকবে উপযুক্ত প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, অসামান্য মানসিক ও নৈতিক সংস্কৃতি; তাদের অধীনেই থাকবে যীশু খ্রিস্টের বিশুদ্ধ গসপেল। তারা মানবজাতিকে এগিয়ে নেয়ার পথে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবে। তাদের হাত দিয়ে বেরোবে তলোয়ারের খোঁচা, এবং তারা পেয়ে যাবে এক অপ্রত্যাশিত ধন, যা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে, তারা লাভ করবে বৈশ্বিক সকল ঘটনায় নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালনের ক্ষমতা।"

নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কয়লাকেই মনে করা হয়েছিল সেই অপ্রত্যাশিত, অমূল্য ধন।

হয়তো এ থেকে আরো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় যে কেন চীনে গিয়ে কিছু মিশনারি সেখানকার কয়লা খনির উপরে গভীর নজরদারি শুরু করেন। যেমন উনবিংশ শতকের শেষ দিকে চীনের উত্তরাঞ্চল ভ্রমণকালে এক মিশনারি সেখানকার প্রতিটি এলাকার কয়লা সম্পর্কে বিস্তারিত লেখেন, এমনকী সেইসব কয়লার রাসায়নিক গঠনও বাদ যায় না তার লেখায়। 

এর কয়েক দশক পরে, এক ব্রিটিশ পর্যটক বলেন যে চীনের বুকে লুকিয়ে থাকা প্রতিটি আধুনিক কয়লা খনির সুড়ঙ্গ চীনের উদীয়মান সূর্যকে বেরিয়ে আসতে এবং যাবতীয় কুসংস্কারের কুজ্ঝটিকাকে মুছে দিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। তিনি আরো বলেন, তখন পর্যন্ত চীনের মানুষের পশ্চাৎপদতার কারণ বেশ অনুমেয়: তারা তাদের পদতলে ঘুমিয়ে থাকা কালো দৈত্যকে জাগিয়ে তুলতে পারেনি। 

কয়লাকে বিশেষায়িত করতে যত ধরনের উপমা এখন অবধি ব্যবহৃত হয়েছে, তার মধ্যে দৈত্যই বোধহয় সবচেয়ে উপযুক্ত। কেননা কয়লাকে কেবলই ঈশ্বরপ্রদত্ত উপহার হিসেবে দেখতে গেলে এই উপহারের সঙ্গে সংযুক্ত অনেক বিপদকেই অগ্রাহ্য করে যাওয়া হয়। আবার এটিকে কেবল পরিবেশের শত্রু হিসেবে দেখাও এক ধরনের অবিচার, কেননা তাতে এর সন্দেহাতীত ভালো দিকগুলো ঢাকা পড়ে যায়। 

কয়লা হলো সেই কয়েনের মতো, যার দুই দিকই দেখা জরুরি। কেবল একদিক দেখেই কোনো সিদ্ধান্তে চলে আসা হবে অবিবেচনাপ্রসূত কাজ। একটি ভালো দৈত্যের মতো, কয়লা আমাদের অসংখ্য ইচ্ছা পূরণ করেছে, অধিকাংশ উন্নত রাষ্ট্রকে আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে; আবার একটি খারাপ দৈত্যের মতো এটি আমাদের পরিবেশ ও জলবায়ুর অবর্ণনীয় ক্ষতিরও কারণ হয়েছে। বিস্ময়কর ব্যাপার শুধু এটিই যে, কেবল সাম্প্রতিক সময়েই আমরা কয়লার এই কালো দিকটি সম্পর্কে জানতে শুরু করেছি।

কয়লা নিয়ে তাই আরো অনেক অনেক আলোচনা জরুরি। ব্রিটেন, যারা প্রথম কয়লা নামক দৈত্যকে বাঁধনমুক্ত করেছে এবং বহু বছর ধরে কয়লা উৎপাদনে বাকি বিশ্বকে পথ দেখিয়ে চলেছে, শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে একসময় বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। 

এরপর আমাদের নজর ফেরানো দরকার যুক্তরাষ্ট্রের দিকে, যারা এই কয়লাকে কাজে লাগিয়েই এক সময়কার বন্যতাকে পিছনে ফেলে আজ বিশ্বের শিল্প পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে এবং তুমুল বেগে সামনের দিকে ধেয়ে চলেছে। যদিও কয়লার প্রকোপে আজ যুক্তরাষ্ট্র নিজেও জলবায়ু পরিবর্তনের আশঙ্কার সম্মুখীন, তবু এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে কয়লাই তাদেরকে এক নবতর রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনে সাহায্য করে যাচ্ছে। 

এবং সবশেষে আমাদের আলোচ্য বিষয় হতে পারে চীনও, যেখানে রয়েছে কয়লার বহু বছরের নাটকীয় ইতিহাস, তবে মাত্র অল্প কিছুদিন হলো তারা কয়লাকে জ্বালানি হিসেবে সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত দেশের কাতারে উঠে এসেছে। 

আমরা জানি না, এবং কখনো হয়তো জানা সম্ভবও নয় যে, কয়লা ব্যতীত আজকের এই পৃথিবীটা কেমন হতো। 

আমরা হয়তো কয়লা ছাড়াও নগরায়ণ, কেন্দ্রীকরণ, শিল্পায়ন ও যান্ত্রিকীকরণের স্বাদ পেতাম, তবে তা আরো কয়েক দশক কিংবা শতক পরে, এবং খুবই স্বল্প পরিসরে, পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলে, অন্য কোনোভাবে। 

কয়লা না থাকলে হয়তো আমাদেরকে আরো অনেকদিন ধরেই দরিদ্রতাকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকতে হতো, শিকার হতে হতো শিল্পায়নপূর্ব পৃথিবীর শোষণের। তবে তারপরও, আমরা হয়তো আরো ধীর-স্থির অথচ মানবিক কোনো উপায় খুঁজে বের করতে পারতাম উন্নয়নের। এবং সেই উন্নয়ন হয়তো হতে পারত আরো অনেক বেশি টেকসই, জনকল্যাণকর ও পরিবেশবান্ধব। 

তখন হয়তো পৃথিবীটা আজকের মতো এতটা ধনাঢ্য ও সম্পদশালী হতো না, কিন্তু কয়লার কারণে জলবায়ুকে যে অনিবার্য ছোবলের মুখে পড়তে হচ্ছে, সেটি হয়তো এড়ানো যেত। 
 

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.