কেউ চিঠি লিখে না

ইজেল

19 June, 2021, 02:00 pm
Last modified: 19 June, 2021, 02:10 pm
গোটা পৃথিবী যখন চিঠি লেখালেখি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ডাকঘর বন্ধ করতে শুরু করেছে, কোথাও কোথাও ডাকসেবার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে বেসরকারি খাত বাংলাদেশে সুদৃশ্য ১৪ তলা ডাকভবনের উদ্বোধন হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে অবমুক্ত নতুন ডাকটিকেটও বাজারে এসেছে।

পুরোনো দিনের রানার
কত চিঠি লিখে লোকে!
রাত নির্জন পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে
দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সুর্য উঠে।
কত চিঠি লেখে লোকে 
কত সুখে, প্রেমে, আবেগে স্মৃতিতে কত দুঃখে ও শোকে
এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনো দিনও
এর জীবনের দুঃখ কেবল জানবে পথের তৃণ,
এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে
এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই কালো রাত্রির খামে।

সুকান্ত বেঁচে থাকলে দেখে যেতেন এ আমলে আসলে কেউ চিঠি লিখে না।

তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ডাক হরকারা, সুকান্ত ভট্টাচার্যের রানার একই পেশায় মানুষ, দু'জনেরই ভীষণ তাড়া, মেইল ট্রেন তো ধরতে হবে। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে খাকি পোশাকের ডাক পিয়ন পায়ে হেঁটে বাড়ি বাড়ি ডাক বিলি করলেও ষাটের দশকে তাদের জন্য সাইকেল বরাদ্দ হয়। ঘরের দরজায় ডাক পিয়নের সাইকেলের বেল শোনার প্রতীক্ষায় থেকেছে শহরে মানুষ। কুরিয়ার সার্ভিস এসে তাদের খুব বড় একটা ধাক্কা দেয়। তারপর এসএমএস, ই-মেইল, চ্যাট, ম্যাসেঞ্জার কতো কিছু এলো, ডাকপিয়নের কথা আর মনে রাখার কী দরকার।

আর চিঠি? কেই বা চিঠি লিখে? আপনি কবে শেষ চিঠিটি লিখেছেন? আপনি বলবেন, টেক্সট ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন, ই-মেইল করেছেন, ম্যাসেঞ্জার ব্যবহার করেছেন- কিন্তু এসব আবার চিঠি নাকি?
 
সাইকেল পিয়ন

কে বলে পোস্টম্যান রিংস টোয়াইস? ডাকপিয়ন দুবার বেল টিপে? এ প্রজন্মের কেউ সে শব্দ শোনেনি। ডাকপিয়ন শেষ কবে আপনার বাড়িতে এসেছে সম্ভবত আপনার মনেও নেই। রাত জেগে এখনও কেউ কেউ আপনার কথা হয়ত ভাবে। কিন্তু সে কী ভাবে, তা চিঠিতে লিখে আপনাকে জানায় না। যে বার্তা আপনাকে আপ্লুত করে তাতে বড় জোর লেখা থাকে: বাবু খাইসো? (খাইছো কিংবা খেয়েছো নয়, বানান বদলে গেছে)। 

প্রথম দিকের একজন ডাকহরকরা

কর্নেলকে কেউ চিঠি লিখে না

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের বইয়ের নামই 'কর্নেলকে কেউ চিঠি লিখে না'। এমনকি নাজিম হিকমতেরাও জেলখানা থেকে চিঠি লিখেন না। ছিন্নপত্র লেখার মতো এ কালের কোনো রবীন্দ্রনাথ নেই। বড় শহরগুলোতে অভিজাত বাড়িগুলোর গেটে এবং এমনকি মফস্বল শহরগুলেতে বাড়ির গেটে কিংবা দেয়ালে সাঁটা থাকতো লেটার বক্স। সেই লেটার বক্সগুলো কোথায়? চিঠিপত্রের স্বর্ণযুগ শেষ। রৌপ্যযুগ, তাম্র যুগ, সবই শেষ। চিঠি, ডাকঘর ডাকপিয়ন এখন কেবলই কি স্মৃতি?

একটি প্রেমের উপন্যাস আমাকেই লিখতে হয়েছে: এসএমএস যুগের আগে। পোস্ট করা এবং পোস্ট না করা ক'টা আবেগতম এবং ক'টা নিরাবেগ চিঠি নিয়ে এই উপন্যাস, তখনো এসএমএস যুগ শুরু হয়নি।

গারসিয়া মারকেসের কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না

চিঠি কেমন করে লিখবে? পোস্ট অফিস কারো জানা নেই।

নভেরাকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করুন, বলবে নভেরা অ্যাট ইয়াহু ডটকম, নভেরা অ্যাট জিমেইল ডট কম। সাকিব বলবে, ফেসবুকে এসো। টুইটারে, উইচ্যাটে, সামাজিক মাধ্যমের কোনো শেষ নেই- সবই ভার্চুয়াল। চিঠি মা কিংবা বাবার হাতে পড়ার ভয় নেই। অবশ্য এগুলো তো চিঠি নয়, এগুলো মেসেজ। শর্ট মেসেজ। প্রেম কি কখনো সংক্ষিপ্ত হয় নাকি? শর্ট লাভ! 

ডাকের কাজ শুধু কি চিঠি বিলানো?

১৯১৪ সাল, প্রথম মহাযুদ্ধের ডঙ্কা কখনো আটলান্টিকের ওপারে তেমন বাজতে শুরু করেনি। তাছাড়া দারিদ্র্য অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে যুদ্ধ বা শান্তি বলে আলাদা কিছু নেই, জীবনে যুদ্ধ তো তাদের লেগেই আছে। জন পিয়েরস্টর্ফ আর তার স্ত্রী সারার হাতে তেমন পয়সা নেই যে রেলগাড়িতে চড়িয়ে তাদের কন্যাকে আইডাহোর প্রান্তে দাদির কাছে পাঠাবেন। সুতরাং তাদের বিবেচনায় সবচেয়ে সহজ ও সুলভ সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেললেন। পাঁচ বছর ধরে বয়সী মেয়েকে উইন্টার কোট পরিয়ে কোটের উপর ঠিকানা সেঁটে, ৫৩ সেন্ট মূল্যমানের ডাকটিকেট লাগিয়ে নিয়ে এলেন ট্রেনের মেইল (পুরুষের নয়, ডাক কিভাগের, চিঠিপত্র ও পার্সেল টানার) কম্পার্টমেন্টে। (বাংলাদেশের ট্রেন সম্পর্কে যারা ভালো ধারনা রাখেন তারা জানেন যে সব ট্রেন ডাক বিভাগের জন্য নির্ধারিত বগিটি সংযুক্ত থাকত সেগুলোকে বলা হতো মেইল ট্রেন)। ডাক বিভাগ মেয়েটিকে গ্রহণ করল এবং ৫৩ সেন্ট মূল্যের ডাকটিকেটের বিনিময়ে পোস্টাল ক্লার্ক তাকে নির্ধারিত স্টেশনে দাদির কাছে তুলে দিরেন। মেইল বা ডাক হিসেবে সফর করা সেই মেয়েটির নাম শার্লট মে পিয়েরস্টর্ফ।
  
পার্সেল ডাক: শার্লট মে

কেবল শার্লটই নয়, আরও অনেকে আমেরিকান ডাক বিভাগের এই সুলভ সেবা গ্রহণ করেছেন। সে সময় মানুষ পরিবহনের জন্য ব্যক্তিখাতে কিছু ব্যবস্থা থাকলেও সাধারণ মানুষের আস্থা ছিল ডাক বিভাগের উপর। প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে অভিযোগ ছিল তারা রাফ ইন হ্যান্ডলিং। ডাকবিভাগের হাত কোমল এবং বিশ্বস্ত।

পারসেল মেইলের শার্লট মে

শার্লট মে পিয়েরস্টর্ক ১৯৯০-এর শেষে মাইকেল ও'টানেলের বেস্টসেলার শিশুতোষ বই 'মেইলিং মে'এর কারণে আরো বেশি পরিচিত হয়েছেন। শার্লট মের জন্ম ১ মে ১৯০৮ আর তাকে পার্সেল পোষ্ট করা হয়েছিল ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯১৪। শার্লট তার দাদির বাড়িতে যাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু রেলের ভাড়া ১ ডলার ৫৫ সেন্ট যোগাড় করা তার মা বাবার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল। সুতরাং পার্সেল ডাক হিসেবেই তাকে দাদির কাছে পৌঁছাতে তার বাবা মায়ের সাশ্রয় হয় ১ ডলার ২ সেন্ট।  দেখা যাচ্ছে ৪৮ পাউন্ড ওজনের পার্সেলের জন্য ৫৩ সেন্টের টিকেট লাগে আর মালামালের হিসেব বিবরণীতে তাকে বলা হয় বেবি চিক। 

শার্লট ছাড়াও আরও কেউ কেউ পার্সেল পোষ্টে পরিবাহিত হলে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। জানতে চাওয়া হয় একটি ছেলে বা মেয়েকে কোন ধরনের পার্সেল ব্যাগে ঢুকানো হয়? এটি অমানবিক বিবেচনা করে কিছুকাল পরে ডাকযোগে মানুষ পাঠানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ১৫ এপ্রিল ১৯৮৭ তারিখে যখন শার্লট মৃত্যুবরণ করেন তখনও তার উপর গণমাধ্যমের নজর পড়েনি। মৃত্যুর দশ বছর পর থেকে যিনি নিয়মিত আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেন। শার্লটের ১৪ বছর আগে ইংরেজ উইলিয়াম রেজিনার্ড ব্রে ব্রিটিশ পোষ্টাল সার্ভিস রয়াল মেইলের পার্সেল হিসেবে নিজেকে প্রেরণ করেন। দু'বছর পর ১৯০৩ সালে রেজিস্টার্ড পার্সেল হিসেবে আরো একবার তিনি নিজেকে পাঠান।

যুক্তরাষ্ট্রের পোস্টাল সার্ভিস ১৯১৮ সালে এয়ারমেইল সার্ভিস চালু করার পর একজন নারী কার্গো পার্সেল হিসেবে ক্যালিফার্নিয়ার সান ডিয়োগো গমন করেন।

শুঁড়িখানায় ডাকঘর

যুক্তরাষ্ট্রে ডাকবিভাগের কাজের সূচনা একটি শুঁড়িখানায়। ঔপনিবেশিক আমেরিকায় ১৬৩১ সালে বোস্টনের একটি শুঁড়িখানায় যেখানে রিচার্ড ফেয়ারব্যাঙ্ক নামক এক ব্যক্তির তৈরি করা কড়া পানি বিক্রয় হতো, সেখানেই প্রথম ডাকঘরের কাজ শুরু হয়। তবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা আরও ১৩৬ বছর পর ২৬ জুলাই ১৭৭৫ থেকে। এ কালেই আর কেউ স্মরণ করে না যে আমেরিকায় সংবাদপত্র জগতটি মূলত ডাক বিভাগের সহায়তার কারণেই টিকে থাকতে পেরেছে। সংবাদপত্র বিতরণের নেটওয়ার্ক তখন তৈরি হয়নি, তা ছাড়া এটা ছিল খুব ব্যায়বহুল। উনবিংশ শতকে ডাক বিভাগের বিস্তৃতির কারণও সংবাদপত্র। ডাকের অধিকাংশই ছিল খবরের কাগজ। ডাক বিভাগ এবং সংবাদপত্র এই দুয়ে মিলে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের উপর যে সামাজিক চাপ সৃষ্টি করে তাতে তাদের খুব দ্রুত সংবাদপত্র পাঠ শিখতে হয়। ১৮৪০ সালে ৯১ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক ভালোভাবে পড়তে পারতেন।

ইউএস  মেইল ও  রয়াল মেইল

১. ২০০৮ সালে যুক্তরাজ্যের ডরসেটে ওয়াইমাউথের একটি গেস্ট হাউসের মালিক জেনেট ব্যারেট একটি চিঠি পেলেন। চিঠিটি এই ঠিকানারই একজন পার্সিকে লিখা। লিখেছেন বাফি। বক্সিং ডের পার্টিতে যোগ দেবার আমন্ত্রণের জবাব।

প্রিয় পার্সি
নিমন্ত্রণের জন্য অনেক ধন্যবাদ, খুশি হয়েছি। ২৬ ডিসেম্বর তোমার সাথে দেখা হচ্ছে।

শুভেচ্ছা, বাফি।

রয়াল মেইলের একটি প্লাষ্টিক ব্যাগে ভরে চিঠিটি পাঠানো হয়েছে সাথে দিয়েছে একটি দুঃখ প্রকাশ পত্র। যদি চিঠির কিছু নষ্ট হয়ে থাকে সে জন্য রয়াল মেইল আন্তরিকভাবে দুঃখিত। 
কিন্তু যে জন্য দুঃখ প্রকাশ করার কথা সে বিষয়ে নিশ্চুপ।

চিঠি পোস্ট করার তারিখ ২৯ নভেম্বর ১৯১৯। ৮৯ বছর পর এই চিঠিটি ঠিকানায় পৌঁছল।

রয়াল মেইল ক্ষমা না চাইলেও একটি রেকর্ডের অধিকারী হয়। ঠিকানায় চিঠি পৌঁছাতে দীর্ঘ সময়ের রেকর্ড: ৮৯ বছর। অবশ্য রয়াল পোস্ট বলছে তাদের কোনো লালবাক্সে একটি চিঠি এলে দীর্ঘকাল পড়ে থাকার সুযোগ নেই, যদিও লাল ফিতের দৌরাত্ম্যের কথা কেউই অস্বীকার করেন না।

২. উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে পত্র প্রেরককে নয়, পত্র গ্রাহককে ডাক টিকেটের দাম দিতে হতো। কিন্তু এক সময় দেখা গেলো বহু সংখ্যক পত্র প্রাপক গাটের পয়সা খরচ করে চিঠি রাখতে আগ্রহী নন। ফলে এই 'আনডেলিভার্ড' চিঠি প্রেরকের কাছে আবার পাঠাতে হয়। এতে রাষ্ট্রের খরচ অনেক বেড়ে যায়। মূলত এই সঙ্কট থেকে রেহাই পেতে ১৮৪৭ সালে প্রিপেইড পোস্টেজ স্ট্যাম্প চালু করা হলো। 

৩. চিঠি আনতে হলে পোস্ট অফিসেই যেতে হবে এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমেরিকার সিভিল ওয়ার আমেরিকানদের মনোজগতের পরিবর্তন আনল। ওহাইও শহরের ডাক বিভাগের কেরানি জোসেফ ব্রিগস দেখলেন বৃদ্ধ মহিলারা প্রচন্ড শীতে তুষারঝরা দিনে ডাকঘরের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন -তারা রণাঙ্গনে থাকা তাদের ছেলেটা বেঁচে আছে কিনা এই সংবাদটা চান। সৈনিকরা তাদের চিন্তিত মায়েদের চিঠি লিখে আশ্বস্ত করেন। জোসেফ ব্রিগস পরীক্ষামূলকভাবে নিজেই ফ্রি সিটি ডেলিভারি চালু করলেন। জবুথবু বৃদ্ধ নারী ও পুরুষকে আশ্বস্ত করলেন, চিঠি এনে তিনিই পৌঁছে দেবেন। খুব দ্রুত এই উদ্যোগটি জনপ্রিয়তা পেল। রণাঙ্গণ ফেরত ওয়ার ভোটাররা নিজেরা এগিয়ে এলেন- তারা চিঠি বিতরণের কাজ করবেন। তাদের জন্য ডাকপিয়নের চাকরি সৃষ্টি করা হলো। ১৮৬৩ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন ক্লিভল্যান্ড উদ্বোধন করলেন ডাক বিভাগের ফ্রি সিটি ডেলিভারি।

৪. ডাকযোগে হীরে পাঠানোর ঘটনা তখনই ঘটতে যখন ডাক বিভাগের উপর মানুষের অখণ্ড আস্থা। ১৯৫৮ সালে নিউ ইয়র্কের অলঙ্কার ব্যবসায়ী হ্যারি উইনস্টন এখনকার অন্তত সাড়ে তিন শত মিলিয়ন ডলার মূল্যের 'হোপ ডায়মন্ড' স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটকে দান করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ডাক ব্যবস্থার উপর আস্থাবান এবং তার ব্যবসার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ (স্বর্ণ, অলঙ্কার, দামি পাথর) ডাক বিভাগের মাধ্যমেই পরিবহন করে থাকেন। এটি পাঠাতে তার প্রথম শ্রেণীর ডাক খরচ লেগেছে ২ ডলার ৪৪ সেন্ট আর ১৯৫৮ সালে হীরকখন্ডটির দাম আনুমানিক ১ মিলিয়ন ডলার সাব্যস্ত করে এর জন্য ইনস্যুরেন্স ফি দিয়েছেন ১৪২ ডলার ৫ সেন্ট। অত্যান্ত নিরাপদে তা স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটে পৌঁছে। তারা পার্সেলের প্যাকেটসহ হীরকটি সংরক্ষণ করছেন। অবশ্য প্যাকেটটি তারা প্রদর্শনীতে রাখেননি।

ভারতের ভাসমান ডাকঘর

৫. ব্রিটিশ রয়াল মেইল রাজা অষ্টম হেনরির রাজত্বকালে ১৫১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতে উদ্দেশ্য ছিল স্কটল্যান্ড শাসনের সুবিধার্থে লন্ডন ও এডিনবরার মধ্যে সুষ্ঠু পত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা। তবে রাজা জেমসের পুত্র প্রথম চার্লস ১৬৩৫ সালে তা ব্রিটেনের জনগণের আন্তঃযোগাযোগের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। রয়াল মেইল সপ্তাহে একদিন রোববার বাদে ৬ কার্যদিবসে ২ কোটি ৯০ লক্ষ চিঠি বিতরণ করে থাকে, ১৯২৭ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডে রয়াল মেইল রেল চালু ছিল, প্যাডিংটন থেকে হোয়াইট চ্যাপেল পর্যন্ত বছরে ২৮৬ দিন চলাচল করত, প্রতিদিন গড়ে ৪০ লক্ষ চিঠি বহন করত। ২০১৩ থেকে রয়াল মেইলের ৯০ ভাগ মালিকানা ব্যক্তিখাতে এবং ১০ ভাগ কর্মচারিদের। ব্যক্তিখাতে ছাড়ার পর লাভ ৩১ মিলিয়ন পাউন্ড থেকে ২১১ মিলিয়ন পাউন্ডে উঠেছে। টিকে থাকার জন্য কেবল চিঠি আর পার্সেল ভিত্তিক (এককালে মানি অর্ডার যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল) সেটাই যথেষ্ট নয় পৃথিবী জুড়েই ডাক সেবাতে বহুমুখীকরণ চলছে।

২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডাকঘরগুলোতে সপ্তাহে ২ কোটি ৮০ লক্ষ নাগরিক সেবা গ্রহণ করতেন। ২০১৬ তে সে সংখ্যা ১ কোটি ৭০ লক্ষে নেমে আসে। রয়াল মেইল কেবল ডাক ভিত্তিক আয় ২০০৫ সাল ছিল ৫৭৬ মিলিয়ন পাউন্ড ২০১৮-তে তা ৯৯ মিলিয়ন পাউন্ডে নেমে এসেছে। বেসরকারিকরণের পর রয়াল মেইলের লাভ বাড়লেও একচেটিয়াত্ব লোপ পেয়েছে। বহু ধরনের প্রতিযোগীর মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

ব্রিটেনে আয় সহায়তা ভাতা বয়স্ক ভাতা, বেকার ভাতা, শিশু ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় ভাতা গ্রহণ করতে ১৯৯০ এর দশকে কমপক্ষে ১ কোটি ৩০ লক্ষ পরিবারের সদস্য ডাকঘরে আসতেন। তখনই এই ভাতার অর্থ অনলাইন ব্যাংকি-এর মাধ্যমে প্রাপকের একাউন্টে প্রবেশ করতে শুরু করলে এক ধাক্কায় ডাক বিভাগের এ ধরনের খদ্দের ১ কোটি ৩০ লক্ষ থেকে মাত্র দশ লক্ষ্যে নেমে আসে। এতোদিনে সম্ভবত তা হাজারে নেমে এসেছে।

নব্বই এর দশকে আমি লন্ডনের পূর্ব প্রান্তে সেইন্ট স্টিফেনস রোডের পোস্ট অফিস থেকে ৯০ সেকেন্ড দূরত্বের একটি বাসায় থাকতাম। সোমবার লম্বা কিউ পড়ত, যারা টাকা উত্তোলন করতেন তাদের মধ্যে একটি প্রাপ্তিযোগের আনন্দ কাজ করত, এমন একজন আধো পরিচিত আইরিশ টাকা পাওয়ার আনন্দে ২৫ পেন্স ভেন্ডিং মেশিনে ঢুকিয়ে আমাকে এক কাপ কফিও খাইয়েছেন। এখন সঙ্গোপনে নিঃশব্দে টাকা একাউন্টে প্রবেশ করে। ডাকঘরে যাবার আনন্দ ও উত্তেজনা ফুরিয়ে গেছে। মস্তিষ্কের এবং অন্তরের আবেগ সব হাতে নেমে এসেছে- স্মার্টফোনে। টাকা পাবার বার্তা আসে। ডাকবিভাগের মতো সম্মানজনক রাজকীয় প্রতিষ্ঠান স্মার্টফোনের সামনে হুমকি খেয়ে পড়েছে।

ডাক পিয়নের যে দুঃখের কথা জানবে না কেউ কোনদিনও

২০২০ সালে কোভিড মৃত্যু যখন বেড়েই চলেছে সে সময়ের একটি অমানবিক সতর্ক বার্তা: আপনার এলাকার ডাকপিয়ন করোনাভাইরাস বহন করে আনছে না তো? সতর্ক থাকুন।

এ বাড়ি ও বাড়ি যখন চিঠি বিলি করতে হচ্ছে (পশ্চিমে ব্যক্তিগত চিঠির মহাকাব্যিক পতন ঘটলেও দাপ্তরিক চিঠির কমতি নেই। কাউন্সিলের চিঠি, সমাজকল্যাণ বিভাগের চিঠি, নির্বাচনের লিফলেট প্রতিদিনই আসছে। তার সবই করছে ডাক বিভাগ।

বিভিন্ন ধরনের কৌতুকেও ডাকপিয়নই ভিকটিম হয়ে উঠছেন।

১. বরিসের স্ত্রী ক্লারা মা হতে যাচ্ছে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ডাক্তার তিন বোতামের একাটি যন্ত্র সামনে রেখে বরিসকে বললেন, তুমি ইচ্ছে করলে ক্লারার যন্ত্রণার সিকিভাগ নিয়ে নিতে পারো। একটি বোতাম টিপলে অনাগত সন্তানের বাবা হিসেবে সিকিভাগ যন্ত্রণা তোমার শরীরে চলে যাবে, দুটো বোতাম টিপলে অর্ধেক। আর তিনটি টিপলে পুরোটাই, কিন্তু তা ঝুঁকিবহুল। বরিস বলল, ঠিক আছে তা হলে অর্ধেক।
ডাক্তার প্রথম বোতাম টিপলেন। বরিসের কিছুই হলো না। দ্বিতীয় বোতাম টিপলেন এবারও কোনো ভাবান্তর নেই, তবে ক্লারার অভিব্যক্তি থেকে স্পষ্ট তার যন্ত্রণা অনেক কমে গেছে। ঈশ্বর বরিসকে রক্ষা করুন বলে ডাক্তার তৃতীয় বোতাম টিপলেন, ক্লারার এতোটুকু যন্ত্রণাও নেই, বরিসও নির্বিকার। কিন্তু তাদের ঘরের দরজার বাইরে একটা কিছু পতনের শব্দ হলো। দরজা খুলতেই দেখা গেল পোস্টম্যান প্যাট মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।
২. ওলগা নামের দরিদ্র এক রুশ বুড়ি একশ রুবল চেয়ে ঈশ্বরের কাছে একটি চিঠি লিখলেন, খামের উপর লেখা শুধু 'গড'। ডাকপিয়ন কৌতুহলী হয়ে চিঠিটা পড়লে তার মনে হলো, টাকাটা না পেলে ঈশ্বরের উপর বুড়ির বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং নিজের কাছে যা আছে তা গুণে দেখল ৯০রুপিম তা একটা খামে ভরে বুড়ির ঠিকানা লিখে বরফ ঢাকা রাস্তা পেরিয়ে তাকে দিয়ে এলো।
কদিন পর 'গড'কে লেখা আর একটি চিঠি ডাকপিয়নের হাতে পড়ল তাতে লিখা: তোমার উপর বিশ্বাস আমার বরাবরই ছিল। আমি জানি তুমি একশত রুবলই পাঠিয়েছিলে কিন্তু আমাদের ঐ বদমাশ ডাকপিয়নটা এখান থেকে দশটা রুবল মেরে দিয়েছে। -ওলগা। 
এ ধরনের অনেক কৌতুকর অপবাদ ডাকপিয়নকে বহুদিন ধরে সইতে হয়েছে।

ডাকের বাংলাদেশ

গোটা পৃথিবী যখন চিঠি লেখালেখি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ডাকঘর বন্ধ করতে শুরু করেছে, কোথাও কোথাও ডাকসেবার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে বেসরকারি খাত বাংলাদেশে সুদৃশ্য ১৪ তলা ডাকভবনের উদ্বোধন হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে অবমুক্ত নতুন ডাকটিকেটও বাজারে এসেছে। জনগণকে চিঠি লেখায় উৎসাহিত করে আর ডাক দিবসে স্কুল কলেজে রচনা প্রতিযোগিতা করে বিশ্ব ডাক ব্যবস্থার নতুন  প্রতিযোগিতায় আর টিকে থাকা যাবে না। সময়ের ডাক শুনতে হবে।

ঢাকার রাস্তায় একসময় এরকম ডাকবাক্স দেখা যেত

বাংলাদেশের ডাক ব্যবস্থায় যে সব সেবা পাওয়া যায় সেগুলো হচ্ছে: লেটার পোস্ট, পার্সেল পোস্ট, রেজিস্ট্রেশন, জিইপি সার্ভিস, ইনশিউরড পোস্ট, মানি অর্ডার ও ইএমটিএস, পোস্টাল অর্ডার সার্ভিস, এক্সপ্রেস মেইল সার্ভিস (আন্তর্জাতিক), রেজিস্ট্রার্ড নিউজ পেপার, স্পিড পোস্ট, পোস্ট বক্স। কিছু এজেন্সি সার্ভিসও দিয়ে থাকে। পোস্ট অপিস সের্ভিং ব্যাংক, পোস্টাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স সেভিং সার্টিফিকেটস প্রাইজ বন্ড, রেভেনিউ স্ট্যাম্প, এক্সাইস স্ট্যাম্প, নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, বিডির ব্যান্ডরোল বিক্রি, পোস্টাল ক্যাশ কার্ড, নগদ ক্যাশ সার্ভিস।

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সাময়িক আয়োজন মূলধারার সাথে একীভূত করে স্বাধীন দেশে ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ ডাক বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। মহাপরিচালকের কার্যালয়ের অধীনে ৪টি জেনারেল পোস্ট অফিস, ২৪টি এ গ্রেড হেড পোস্ট অফিস ৪৭টি বি গ্রেড হেড পোস্ট অফিস, ৪০১টি থানা/ উপজেলা পোস্ট অফিস, ১২১২টি সাব পোস্ট অফিস ৭১২১টি শাখা পোস্ট অফিসে স্থায়ী অস্থায়ী মিলিয়ে কর্মীর সংখ্যা ৪৯ হাজার। পৃথিবী জুড়ে যেখানে সনাতন ডাক বিভাগ উঠে যাচ্ছে, সংকুচিত হচ্ছে, এ ধরনের সেবা প্রদানকারী হিসেবে বেসরকারি খাত মুখ্য হয়ে উঠেছে, সেখানে অর্থবহ প্রতিষ্ঠান হয়ে টিকে থাকা ডাক বিভাগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ডাকের চরিত্র বদলে গেছে পরিবহন ও সঞ্চালনের মাধ্যমও বদলেছে- এ অবস্থায় লাভজনক ও টেকসই না হলে বোঝাটা জাতিকেই টানতে হবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পের উলাপুর গ্রামের পোস্টমাষ্টার তার চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে যখন নৌকায় উঠলেন এবং নৌকা ছেড়ে দিল আর 'বর্ষাবিষ্ফোরিত নদী ধরনীর অশ্রু রাশির মতো চারিদিকে ছলছল করিতে লাগিল' তার ইচ্ছে হল ফিরে গিয়ে বালিকা রতনকে নিয়ে আসবেন, কিন্তু 'ততক্ষণে পালে বাতাস পাইয়াছে। বর্ষার স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে।'

এ কালের পোস্টমাস্টারের জন্য কোনো রতন নেই আছে প্রযুক্তি, তিনি যদি সেই প্রযুক্তিতে সমর্পিত না হতে পারেন ডাকঘর প্রাচীন ধ্বংসস্তুপের মতো হুমকি খেয়ে পড়ে থাকবে। প্রযুক্তির পৃথিবী ডাকঘরের দিকে ফিরেও তাকাবে না।    
                        
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.