কী লেখা আছে মহাবিশ্বের নিয়তিতে?
অবাক হলেও সত্যি যে প্রায়ই দেখা যায় বিভিন্ন বস্তু যে কারণে জন্ম নেয়, শেষ পর্যন্ত তাদের মৃত্যুও ঠিক সেই কারণেই হয়। বিশেষ করে আমরা যখন মহাজাগতিক বস্তুর অন্তিম পরিণতি নিয়ে চিন্তা করি, তখন ব্যাপারটা একেবারে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। পৃথিবীর ইতি থেকে শুরু করে মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি- সবই আছে এর মাঝে।
উদাহরণস্বরূপ, অধিকাংশ গ্রহবিজ্ঞানীরা এই ব্যাপারে ক্রমে একমত হচ্ছেন যে ধূমকেতু (ধুলো আর তুষারের সমন্বয়ে সৃষ্ট বরফের গোলা) আর বরফে ভরতি উল্কাপিণ্ড প্রাচীন পৃথিবীতে আছড়ে পড়েই সৃষ্টি হয়েছে এ গ্রহের সিংহভাগ পানি- প্রাণধারণের জন্য যা অত্যাবশ্যক। সে সঙ্গে জৈব পদার্থের উৎপত্তির কারণও প্রাচীন পৃথিবীতে উল্কাপিণ্ডের আছড়ে পড়া। দ্য হেইল-বপ-এর মতো ধূমকেতুতে পাওয়া গেছে জৈব অণু। এ ছাড়াও সাম্প্রতিক এক গবেষণায় গবেষকেরা একটা গ্যাস গান ব্যবহার করে ওই মহাজাগতিক বস্তুগুলোর পতনের স্থান ফের সৃষ্টি করেছেন। ঘণ্টায় ১৬ হাজার মাইল বেগে ধাতব প্রজেক্টাইল ছোড়েন তারা বরফের চাঁইয়ে। ওই চাঁইগুলোর ভেতরে ছিল সেই একই রসায়নিক দ্রব্যাদি, যা একত্র হয়ে ধূমকেতু গঠন করে। শক ওয়েভ আর তার প্রভাবে সৃষ্ট উত্তাপের ফলে অ্যামিনো অ্যাসিড গঠিত হয়, যা প্রোটিন তথা আমিষের ভৌত মৌলিক উপাদান।
অথচ যে জিনিসগুলো এই গ্রহটাকে প্রাণ উপহার দিয়েছে, সেগুলোই আবার এর ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে! জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, বড় কোনো ধূমকেতু কিংবা উল্কাপিণ্ড সম্ভবত প্রতি দশ কোটি বছরে একবার পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে বৈশ্বিক ধ্বংসযজ্ঞের কারণ হবে। সৌভাগ্যক্রমে বিজ্ঞানীরা এমন একটা পর্যবেক্ষণব্যবস্থা আবিষ্কার করছেন, যার ফলে সময়ের আগেই এমন কোনো ধূমকেতু কিংবা উল্কাপিণ্ড হাজির হলে তা জানা যাবে। সেই সঙ্গে পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসা বস্তুকেও শনাক্ত করা যাবে সহজেই। আশা করা যায়, সেই অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ এড়াবার মতো যথেষ্ট সময় মানবজাতির হাতে থাকবে।
কিন্তু এমন অনেক মহাজাগতিক সংঘর্ষ আছে যা এড়ানো যাবে না, তা আমাদের কাছে যত দ্রুতই খবর পৌঁছাক না কেন! মহাকর্ষের যে অপ্রতিরোধ্য টানের কারণে মিল্কিওয়ে, ওরফে আকাশগঙ্গা ছায়াপথটা গঠিত হয়েছে, সেটার কারণেই আমরা আমাদের পার্শ্ববর্তী ছায়াপথ অ্যান্ড্রোমিডার সঙ্গে ধাক্কা খেতে চলেছি। সাম্প্রতিক তথ্যাবলি থেকে নিশ্চিতভাবে জানা গেছে, অ্যান্ড্রোমিডা সরাসরি আমাদের দিকে ছুটে আসছে, সেকেন্ডে প্রায় ৬০ মাইল গতিতে। প্রায় চার শ কোটি বছরের মাঝে ২.৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ পথ অতিক্রম করে এই দুই ছায়াপথের মধ্যবর্তী দূরত্ব অতিক্রম করবে অ্যান্ড্রোমিডা।
দুই ছায়াপথের মাঝে সংঘর্ষের কথা ভাবলেই মানসপটে হয়তো প্রকা- এক ধ্বংসযজ্ঞের কথা ভেসে ওঠে। তবে আমাদের উত্তরসূরিরা এই ঘটনা বলতে গেলে টেরই পাবে না, যদি তখনো মানবজাতি টিকে থাকে আরকি। তবে মানুষকে তত দিনে নতুন বাসস্থান খুঁজে নিতে হবে; কারণ, ওই সময়ের আগেই আমাদের সূর্যের ঔজ্জ্বল্য এত বেড়ে যাবে যে পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। ছায়াপথগুলো আসলে ফাঁকা স্থান, তাই বলতে গেলে অন্য কোনো তারা কিংবা গ্রহ সত্যিকার অর্থে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয় না।
সে যা-ই হোক, আমরা যে মিল্কিওয়েকে চিনি, তার অন্ত ঘটবে। প্রথমে ছায়াপথ দুটো একে অন্যের পাশ দিয়ে ছুটে যাবে। অনেক দূর এগিয়ে যাবার পর মহাকর্ষ দেখাবে তার খেল- ছায়াপথ দুটে ফের ছুটে আসবে একে অন্যের দিকে। অ্যান্ড্রোমিডা আর মিল্কিওয়ে এক হয়ে যাবে। উভয়েই হারাবে তাদের চাকতির মতো গঠন। দুইয়ে মিলে একটামাত্র ডিম্বাকৃতির ছায়াপথ তৈরি হবে, যার নাম অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী দিয়েছেন 'মিল্কোমিডা'!
মহাবিশ্বের আকৃতি যদি অপরিবর্তিত থাকত, তবে ছায়াপথগুলোর মধ্যবর্তী মহাকর্ষীয় শক্তির টানে সবগুলো ছায়াপথ একসঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। তবে ১৯২৯ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানি এডউইন হাবলের আবিষ্কারের পর থেকে আমরা জানি- মহাবিশ্ব ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে, তাই সাধারণ ছায়াপথগুলো একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
বিংশ শতাব্দীর প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানিদের মাঝে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল: মহাবিশ্বে কি যথেষ্ট পরিমাণ ভরসম্পন্ন বস্তু আছে, যাদের পারস্পরিক মহাকর্ষ বন্ধনের কারণে মহাবিশ্বের এই সম্প্রসারণ থমকে যেতে পারে? নাকি ছায়াপথগুলো ক্রমেই একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে? সম্প্রসারণের মাত্রা কমে গেলেও কখনো কি পুরোপুরি বন্ধ হবে না?
এরপর ১৯৯৮ সালে তৃতীয়, অপ্রত্যাশিত একটা সম্ভাবনা চলে এল সামনে: মহাবিশ্বের সম্প্রাসারণের মাত্রা কমছে না- যেটা প্রত্যেক 'বুদ্ধিমান' মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে হওয়া উচিত- বরঞ্চ বাড়ছে।
আমরা এখন জানি, মহাবিশ্বের মোট শক্তির ৭০ শতাংশ থাকে শূন্য স্থানে। অবশ্য শূন্য স্থানে কেন থাকে, সে প্রশ্নের জবাব আমাদের একদমই জানা নেই। এই 'অন্ধকার শক্তি' তথা 'ডার্ক এনার্জি' একধরনের মহাজাগতিক অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি হিসেবে কাজ করে- কেননা শূন্য স্থান খুব সম্ভব 'বিকর্ষণকারী শক্তি' উৎপন্ন করে, যা প্রতিটি পদার্থের প্রদর্শিত আকর্ষণ শক্তির বিপরীত। বিগ ব্যাঙের ফলাফল হিসেবে সৃষ্ট মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের ওপর প্রভাব ফেলেছে এই দুই শক্তি। কিন্তু মহাবিশ্ব যত প্রসারিত হয়েছে, ততই কমেছে পদার্থের ঘনত্ব। অথচ অন্ধকার শক্তির পরিমাণ একই আছে।
মহাকর্ষকে থামাবার শক্তির প্রভাব কমে যাওয়ায় মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের গতি গেছে বেড়ে। এই অন্ধকার শক্তির আধিপত্য যদি বজায় থাকে, তাহলে পরিস্থিতি যে রূপ ধারণ করবে, তা আগেকার ধারণার চেয়ে অনেক ভয়ানক। বর্তমান সম্প্রসারণ চলতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। বাড়তে থাকবে সম্প্রসারণের গতিও। তাই বর্তমানে আমরা যেসব ছায়াপথ দেখতে পাচ্ছি- মোট দশ হাজার কোটি কিংবা তার চাইতেও বেশি- ওগুলো একদিন এত দূরে সরে যাবে যে আমরা ওদের আর দেখতেও পারব না! একমাত্র আমাদের ছায়াপথই থাকবে দৃষ্টিসীমার মধ্যে। তারপর, নক্ষত্রগুলো যখন শক্তি হারিয়ে ফেলবে, তখন মহাবিশ্ব আক্ষরিক অর্থেই পরিণত হবে অন্ধকার, শীতল আর শূন্য স্থানে।
এসব জানার পর যদি আপনার মাঝে হতাশা জন্ম নেয়, তাহলে অন্তত এতটুকু জেনে নিজেকে সান্ত¡না দিন যে এই ভবিষ্যৎ এমন যা হলেও হতে পারে। যত দিন আমরা অন্ধকার শক্তি তথা ডার্ক এনার্জির স্বরূপ বুঝতে না পারব, তত দিন মহাবিশ্বের ভাগ্য রহস্যঘেরাই রয়ে যাবে। কে বলতে পারে, হয়তো বিস্ময়কর একটা সমাপ্তি অপেক্ষা করছে আমাদের এই মহাবিশ্বের জন্য!