কাগজের বই কি হারিয়ে যাবে?

১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় পিটার জেমস-এর উপন্যাস 'হোস্ট'। উপন্যাসটি প্রকাশ পেয়েছিল দুটো ফ্লপি ডিস্কে। বইটি প্রকাশের পর সাংবাদিক ও অন্যান্য লেখকরা যে তাঁকে তীব্র সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করবে, তা তিনি আগেভাগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। সেজন্য প্রস্তুতও রেখেছিলেন নিজেকে। এক সাংবাদিক তো বই পড়ার এই নতুন পদ্ধতিটি যে কতটা হাস্যকর, তা দেখাবার জন্য সমুদ্র সৈকতে কম্পিউটার আর জেনারেটর নিয়েই বসে পড়েছিলেন। দুনিয়া জুড়ে নানা পত্র-পত্রিকায় প্রথম পাতার খবরে পরিণত হন জেমস। অভিযোগ করা হয়, উপন্যাসকে খুন করেছেন তিনি। জেমস অবশ্য আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছিলেন, 'কিন্তু আমি টের পেয়েছিলাম, আমার সাহায্যের দরকার পড়েনি, তার আগেই উপন্যাসের মুমূর্ষু দশা হাজির হয়ে গেছে।'
'হোস্ট' বের হওয়ার কিছুদিন পরই জেমস আরেকটা ভবিষ্যদ্বাণী করেন—ছাপা বইয়ের মতো সহজলভ্য ও উপভোগ্য হলেই ইবইয়ের জনপ্রিয়তাও হুহু করে বাড়তে থাকবে। ৯০-এর দশকে যা ছিল একেবারেই আনকোরা একটা জিনিস, তা আজ প্রথাগত বইয়ের অস্তিত্বের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই দশক পর অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে পিটার জেমসের ভবিষ্যদ্বাণী।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইবইয়ের জনপ্রিয়তার পারদ আকাশচুম্বী হয়েছে। তবে এর চেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে, এ বইয়ের গন্তব্য কোথায়—এবং ছাপা শব্দের ওপর এর প্রভাবটা কেমন হবে, তা এখনও অজানা। ছাপা বই কি শেষ পর্যন্ত মাটির ট্যাবলেট, স্ক্রল এবং টাইপ করা কাগজের মতো বাতিলের খাতায় চলে যাবে? পরিণত হবে জাদুঘরে প্রদর্শনের জিনিসে? এসবই যদি সত্যি হয়, আমাদের কি উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত?

এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়। গত বছর পিউ রিসার্চ (PEW RESEARCH)-এর এক জরিপে দেখা গেছে প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকানদের প্রায় অর্ধেকেরই এখন ট্যাবলেট বা ই-রিডার আছে। আর ২০১৩ সালে প্রতি ১০ জনে ৩ জন কমপক্ষে একটি ইবই পড়েছেন। যদিও পড়ার মাধ্যম হিসেবে ছাপা বই-ই এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয়, তবে গত দশকে ইবইও পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতা করেছে।
ডিজিটাল বইয়ের উত্থানের পথটা বেশ বন্ধুর, কারণ ইবইয়ের সংজ্ঞা সম্পর্কে নানা মানুষ নানা রকম ধারণা পোষণ করেন। প্রজেক্ট গুটেনবার্গ গত শতকের ৭০-এর দশক থেকে ইলেকট্রনিক টেক্সট ফাইল প্রকাশ করতে শুরু করে। এ কাজে তাদেরকে সাহায্য করে ভয়েজার ও ইস্টগেট সিস্টেমস-এর মতো কোম্পানিগুলো। গোড়ার দিকে ইবই পড়ার জন্য পাম পাইলট, মাইক্রোসফট রিডার, সনি রিডার প্রভৃতি ডিভাইস ব্যবহার করা হতো।
প্রকৃতপক্ষে ১৯৯৩ সালে প্রথম ডিজিটাল উপন্যাসটি প্রকাশ হওয়ার পর প্রকাশকদের নজর তেমন টানতে পারেনি। ইনস্টিটিউট ফর দ্য ফিউচার অফ দ্য বুক-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ভয়েজার অ্যান্ড দ্য ক্রাইটেরিয়ন কালেকশন-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা রবার্ট স্টাইন বড় পাঁচটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা সবাই একবাক্যে জানিয়ে দেন, লোকে কখনো পর্দায় বই পড়বে না।
কিন্তু ২০০৭ সালে আমাজন কিন্ডল বাজারে ছাড়ার পর রাতারাতি বদলে যায় তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশনা অঙ্গনে আলোড়ন ফেলতে শুরু করে যন্ত্রটি। আমাজন বড় প্রতিষ্ঠান বলেই তাদের পক্ষে প্রকাশকদের কাছে গিয়ে বই চাওয়া সম্ভব হয়েছে। সে কারণেই লাভের পরোয়া না করে নামমাত্র মূল্যে পাঠকদেরকে ইবই সরবরাহ করতে পেরেছে তারা।
২০০৮ থেকে ২০১০-এর মধ্যে ইবইয়ের বিক্রি তুঙ্গে উঠে যায়। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদন অনুসারে, ডিজিটাল বইয়ের বিক্রি এক লাফে ১২৬০ শতাংশ বেড়ে যায় এ সময়। অবস্থা আরও রমরমা হয়ে ওঠে নুক ও আইপ্যাড বাজারে আসার পর। ২০১১ সালে পশ্চিমে প্রকাশনা শিল্পের অবস্থা সঙিন হয়ে ওঠে। বর্ডারস বুকস নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। অন্যদিকে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ইবইয়ের জনপ্রিয়তা।

গত দু-বছরে অবশ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে গেছে। অ্যাসোসিয়েশন অফ আমেরিকান পাবলিশার্স-এর তথ্য অনুসারে, ইবইয়ের (বই বাজারের ২০ শতাংশ এ সংস্করণের দখলে) বিক্রি একটি স্থিতাবস্থায় পৌঁছেছে। পিউ-এর সাম্প্রতিকতম জরিপেও এটি দেখা গেছে।
এছাড়াও টাইমস জানিয়েছে, ২০১৫ সালের প্রথম দুই মাসে কিছুটা কমে গেছে ইবইয়ের বিক্রি। (পিউয়ের জরিপে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে কাগজের বইয়ের বিক্রিও ৬৯% থেকে ৬৩%-এ নেমে গেছে)। ডিজিটাল সংস্করণের পাঠকসংখ্যা কমায় কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন প্রকাশকরা।
কাগজের বইয়ের ভবিষ্যৎ কী হবে, কেউই অনুমান করতে পারছেন না। তবে রবার্ট স্টাইনের বিশ্বাস, ইবইয়ের বিক্রি এখন স্থিতিশীল থাকলেও ধীরে ধীরে এই গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হবে। তিনি বলেন, 'আমরা একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। পর্দায় পড়া পাঠকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকবে।'

স্টাইন স্বপ্ন দেখেন, ভবিষ্যতে প্রথাগত প্রকাশকরা বই প্রকাশ করবেন না, করবে গেমিং ইন্ডাস্ট্রি। তিনি এ-ও ধারণা করেন, লেখক-পাঠকের মধ্যকার পার্থক্য একদিন মুছে যাবে। এমন সময় আসবে, যখন লেখক ও পাঠকরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে যোগাযোগ করে একটি বইয়ের যেকোনো অনুচ্ছেদ, বাক্য কিংবা লাইন নিয়ে আলোচনা করতে পারবে। সত্যি বলতে কী, স্টাইনের সর্বশেষ প্রকল্প সোশাল বুক-এ ডিজিটাল বইয়ের লেখায় সরাসরি মন্তব্য করার সুযোগ পায় পাঠকরা। প্রকল্পটি ইতিমধ্যে বেশ কিছু হাই স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা ব্যবহার করছেন। স্টাইনের মতে, বই পড়ার কাজটা যে একা একা করা যায়—এই ধারণাটাই ভবিষৎ প্রজন্মের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকবে। তিনি বলেন, 'দুনিয়াজোড়া মানুষের চিন্তাভাবনা, বিশ্লেষণ—বিশেষ করে তারা যখন আপনার বিশ্বস্ত—যখন আপনি জানতে পারছেন, তখন কেন কষ্ট করে নিজে নিজে পড়তে যাবেন?'
অবশ্য আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, কাগজের বই সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কাঠের ব্লক প্রিন্টিং, হ্যান্ড-প্রসেসড ফিল্মের মতো ছাপা বইও শিল্পের মর্যাদা পেতে পারে। ভবিষ্যতে হয়তো কাগজের বই পড়ার কাজে লাগবে না, সৌন্দর্যবর্ধক হিসেবে নানা জায়গার শোভা বাড়াবে। স্টাইনের মতে, কবিতার এখন যে অবস্থা চলছে, ভবিষ্যতে ছাপা বইয়ের অবস্থাও হবে ঠিক তেমন।

অনেকেরই বিশ্বাস, দূর-ভবিষ্যতে কাগজের বইয়ের বিলুপ্তি অনিবার্য। ছাপা বই একে তো ভারী, তার ওপর বহন করাও কঠিন। ভবিষ্যতে কেউ বই নিয়ে ঘুরে বেড়াবার ঝামেলা পোহাতে চাইবে না।
অনেক গবেষকই অবশ্য ছাপা বইয়ের বিলুপ্তির সম্ভাবনা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। তাদের মতে, এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
ম্যাসাচুসেটস-এর টাফ্টস ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর রিডিং অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ রিসার্চ-এর পরিচালক এবং 'প্রাউস্ট অ্যান্ড দ্য স্কুইড: দ্য স্টোরি অ্যান্ড সায়েন্স অফ দ্য রিডিং ব্রেইন'-এর লেখক মারিয়েন উল্ফ বলেছেন, 'বাস্তবতা হলো, ছাপা বই বিলুপ্ত হলে এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার বড় কারণ আছে। তবে আমার মতো মানুষরা উপযুক্ত কারণেই আশা করতে পারেন যে, আশঙ্কাটি সত্যি হবে না।'
উল্ফ ও অন্যদের গবেষণায় দেখা গেছে, একটি লেখার প্রতি মস্তিষ্ক যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানায় বৈদ্যুতিক পাঠ সে প্রতিক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একটি লেখা আত্মস্থ করা, ওটার ওপর মনোযোগ দেয়া, কাহিনির ক্রম ও প্লটের খুঁটিনাটি মনে রাখা—এসবের ওপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে ইবই পাঠ। গবেষণায় প্রাথমিকভাবে আরও দেখা গেছে যে, কাগজের বই পড়লে গভীর মনোযোগ দেয়া যায়, অন্যদিকে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে পড়লে একটু পরপরই মনোযোগ ছুটে যায়। উল্ফ বলেন, 'অনেক পাঠকেরই ধারণা, তাদের গল্পে প্রবেশের দক্ষতা বদলে যাচ্ছে।' তার মতে, আসল চিন্তার বিষয় হচ্ছে, ইবই পড়া পাঠকদের ধৈর্য হবে অনেক কম। এ ধরনের পাঠকদের মস্তিষ্ক তথ্য সংগ্রহের জন্য খুব ভালো হবে, কিন্তু জটিল ও বিশ্লেষণী পাঠদক্ষতা অর্জন করতে পারবে না।
ইবইয়ের বাজার এখনও প্রারম্ভিক অবস্থায় আছে। এ সংস্করণে বই পড়ার ক্ষতিকর প্রভাবগুলো এখনও ঠিকমতো চিহ্নিত করা যায়নি। কিছু গবেষণায় অবশ্য উল্টো ফলও পাওয়া গেছে। এসব গবেষণা অনুসারে, ইবই পড়লে পাঠকের গভীরভাবে চিন্তা করার ক্ষমতায় কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না। অনেক পাঠকের ক্ষেত্রে বরং এ ক্ষমতা বেড়ে যায়। বিশেষ করে যাদের ডিসলেক্সিয়া আছে, তারা বেশি উপকৃত হয়।

ডিজিটাল পাঠ শিশুদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলে এ নিয়েও দ্বিমুখী ফল পাওয়া গেছে। বাচ্চাদের সচিত্র ইবইগুলোতে প্রায়শই চলমান ছবির পাশাপাশি সংগীত এবং শব্দও থাকে। এই বাড়তি সুবিধাগুলো পড়ার ওপর কেমন প্রভাব ফেলছে, তা নির্ভর করে সুবিধাগুলোকে কীভাবে কাজে লাগানো হয়, তার ওপর। ঠিকমতো কাজে লাগালে এগুলো শিশুদের জন্য খুব উপকারী হতে পারে।
নেদারল্যান্ডসে চারশোরও বেশি কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীদের নিয়ে চালানো কয়েকটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, ছাপা বইয়ে যারা গল্প পড়ে তাদের চাইতে অ্যানিমেটেড ইবই পড়া বাচ্চারা গল্পটি বেশি ভালো বোঝে, নতুন শব্দও শেখে বেশি।
ইবই নিয়ে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা থাকলেও এটা সত্য যে, বইয়ের এ সংস্করণ আসার পর সাধারণ মানুষের কাছে জ্ঞান অনেক বেশি উন্মুক্ত হয়ে গেছে। এর আগে কখনও জ্ঞান ও তথ্য সাধারণ মানুষের জন্য এত সহজলভ্য ছিল না। ইবই পড়ার ডিভাইসে বেশি সময় খরচ করলে স্বাস্থ্যগত কিছু সমস্যা হয়। তা সত্ত্বেও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঈশ্বরপ্রদত্ত আশীর্বাদ হয়ে এসেছে ইবই। এসব দেশে মানুষকে শিক্ষিত করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহায় হতে পারে ডিজিটাল সংস্করণে পড়াশোনা করানো।
গবেষকরা আশা করছেন, ছাপা ও ডিজিটাল শব্দ, দু-ধরনের মাধ্যমকেই গুরুত্ব দেয় এমন সমাজব্যবস্থাই গড়ে তোলা কঠিন হবে না। সম্প্রতি পশ্চিমে, বিশেষ করে আমেরিকায়, কাগজের বইয়ের দোকান বাড়তে থাকায় সে আশার পালেও হাওয়া লেগেছে। এর অর্থ, ছাপা বইয়ের গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছে সাধারণ পাঠক।