করোনার থাবায় বদলে গেল ইংরেজি ভাষা
গত এপ্রিলে অদ্ভুত এক কাজ করে বসেন অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির সম্পাদকরা। গত ২০ বছর ধরে তারা তিন মাস পরপর নতুন শব্দ ও অর্থ অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দিয়ে আসছিলেন। এই আপডেটগুলো সাধারণত মার্চ, জুন, সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বরে জারি করা হয়।
তবে বসন্তের শেষ দিকে, এবং ফের জুলাইয়ে, ইংরেজি ভাষার ওপর কোভিড-১৯-এর প্রভাবকে নথিভুক্ত করার তাগিদে তারা বিশেষ আপডেট প্রকাশ করেন।
সম্পাদকরা অনেকগুলো করোনভাইরাস-সংক্রান্ত ভাষাগত পরিবর্তন নথিভুক্ত করলেও, তাদের কিছু পর্যবেক্ষণ অবাক করার মতো। যেমন: তাদের দাবি, মহামারিটি সত্যিকার অর্থে কেবল একটি নতুন শব্দ তৈরি করেছে—COVID-19.
তারা লক্ষ করেছেন, করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বেশিরভাগ পরিবর্তনই পুরনো ও অপ্রচলিত শব্দ এবং বাক্যাংশের সাথে সম্পর্কিত। তাদের মতে, এসব অপ্রচলিত পুরনো শব্দগুলোই এই মহামারির সুবাদে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে। যেমন, প্রজনন সংখ্যা (reproduction number) এবং সামাজিক দূরত্ব (social distancing)। পুরনো কিছু শব্দের ওপর ভিত্তি করে নতুন নতুন মিশ্র-শব্দ তৈরি হয়েছে। সেসবের দলিলও রেখেছেন তারা।
রেকর্ডের অভিধান
ইংরেজি ভাষা ও ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এবং পরিপূর্ণ রেকর্ড হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি।
১৮৮৪ সালে অভিধানটির প্রথম সংস্করণের কিছু অংশ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯২৮ সালে এর কাজ সম্পূর্ণ হয়। পরবর্তী বছরগুলোতে আরও নতুন নতুন সব শব্দ যোগ করা হয় পরিশিষ্ট হিসেবে। এসব শব্দ এক করে ১৯৮৯ সালে অভিধানটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করা হয়। বেশিরভাগ লাইব্রেরিতে এই সংস্করণটিই থাকে। ১৯৯২ সালে সিডি-রমে অভিধানটির ডিজিটাল সংস্করণ প্রকাশ পায়।
২০০০ সালের মার্চে চালু হয় অভিধানটির অনলাইন সংস্করণ। এই নতুন সংস্করণের জন্য সম্পাদকরা প্রথম সংস্করণে দেওয়া সংজ্ঞাগুলো সংশোধন করছেন। এসব সংজ্ঞার অনেকগুলোই এক শতাব্দীরও বেশি পুরনো। আকারের কারণে এই তৃতীয় সংস্করণটি মুদ্রিত আকারে প্রকাশ পাবে না। এছাড়াও এই সংশোধনগুলো ২০৩৪ সালের আগে সম্পূর্ণ হবে না।
ভাষাটির আকার বৃদ্ধি, পরিবর্তন ও বিকাশ হওয়ার সাথে সাথে সম্পাদকরা সেসব নতুন নতুন শব্দভাণ্ডারও নথিভুক্ত করছেন। ত্রৈমাসিক আপডেটগুলোতে নতুন শব্দ এবং সংশোধনীর তালিকা প্রকাশ করা হয়। যেমন, সেপ্টেম্বরের আপডেটে 'craftivist' ও 'Cookie Monster' অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
নতুন-পুরনোর সমাহার
অভূতপূর্ব সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে ভাষা কীভাবে চটজলদি বদলে যেতে পারে, তার নমুনাই দেখিয়েছে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বিশেষ আপডেটগুলো। যেমন, চিকিৎসা সংক্রান্ত বেশ কিছু অপ্রচলিত ও পুরনো পরিভাষা ফের ব্যাপকভাবে ব্যবহার হতে শুরু করেছে এই মহামারির প্রভাবে।
ঐতিহ্যগতভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিক্ষেত্রের পরিভাষাগুলো যদি তাদের নিজস্ব বলয়ের বাইরে, সাধারণ্যে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রচলন লাভ করে, তাহলেই কেবল সেসব পরিভাষাকে অভিধানভুক্ত করেন সম্পাদকরা। নানা ধরনের ওষুধের নামও এই নিয়ম মেনে অভিধানভুক্ত করা হয়। যেমন, অভিধানে রিটালিন (Ritalin) ও অক্সিকন্টিন-এর (Oxycontin) নাম আছে, কিন্তু অ্যারিপিপ্রাজল-এর (Aripiprazole) নাম নেই।
তবে মহামারিটির সুবাদে অন্তত দুটো ওষুধের নাম জনসাধারণের মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে গেছেন।
প্রথম নাম হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন (Hydroxychloroquine)। ওষুধটি ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। একে ভাইরাসের বিরুদ্ধে ম্যাজিক বুলেট হিসেবে বিক্রি করেছে অনেকে। গত জুলাইয়ে এটি অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারিতে স্থান পায়, যদিও ওষুধটার নাম ছাপার অক্ষরে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫১ সালে।
আরেকটি নব-বিখ্যাত ওষুধ হলো ডেক্সামিথাজোন (dexamethasone)। এই কর্টিকোস্টেরয়েডটি কোভিড-১৯-এ মৃত্যুর হার কমিয়েছে। নামটি ১৯৫৮ সালের গোড়ার দিকে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। অভিধানের দ্বিতীয় সংস্করণে ওষুধটির নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জুলাই আপডেটে সম্পাদকরা করোনাভাইরাসকে মোকাবেলায় ড্রাগের বর্তমান ব্যবহারের একটা চিত্র তুলে ধরেছেন।
আপডেটগুলোতে 'কমিউনিটি ট্রান্সমিশন'-এর মতো পরিভাষার জন্যও নতুন সংজ্ঞা যোগ করা হয়েছে। এ পরিভাষাটি প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। এছারাও 'কমিউনিটি স্প্রেড' নামের পরিভাষাটিরও নতুন সংজ্ঞা দেয়া হয়। এ পরিভাষাটি ছাপার অক্ষরে প্রথম ঠাঁই পেয়েছিল ১৯০৩ সালে।
কোয়ারেন্টিনের ভাষা
সামাজিক বিচ্ছিন্নতার (social isolation) সাথে সম্পর্কিত পরিভাষাগুলো কোভিড-১৯ মহামারির বহু আগে থেকেই ছিল। তবে ২০২০-এ এগুলো অনেক বেশি প্রচলিত হয়ে উঠেছে।
সেলফ-আইসোলেট (self-isolate), সেলফ-আইসোলেটেড (self-isolated), শেল্টার ইন প্লেস (shelter in place)—এই পরিভাষাগুলো তাদের বর্তমান ব্যবহার বোঝানোর জন্য নতুন করে সংজ্ঞায়িত হয়েছে।
কিছু পরিভাষার অর্থ বদলে গেছে। আগে শেল্টার ইন প্লেস বলতে মূলত ঘূর্ণিঝড় বা গোলাগুলির সময় নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় সন্ধান করা বোঝানো হতো। কিন্তু পদটি বর্তমানে দীর্ঘ মেয়াদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বোঝাতে ব্যবহার করা হয়।
একইভাবে এলবো বাম্প (elbow bump) দিয়ে আগে 'হাই ফাইভ' করা বোঝানো হতো। বর্তমানে এর অর্থ নিরাপদ উপায়ে একজন আরেকজনকে অভিবাদন জানানো।
কিছু আঞ্চলিক ভাষাও জায়গা করে নিচ্ছে কোভিড-১৯-এর ভাষায়। 'সেলফ-আইসোলেট' বেশি ব্যবহার করা হয় ব্রিটিশ ইংরেজিতে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশি ব্যবহার করা হয় 'সেলফ-কোয়ারেন্টিন' পরিভাষাটি। 'করোনা'র অপভ্রংশ 'রোনা' (rona) বা 'দ্য রোনা' (the rona) শব্দটি আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় গালি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সম্পাদকরা অবশ্য শব্দটিকে এখনও অভিধানভুক্ত করেননি। কারণ, তাদের মতে, শব্দটি এখনও ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হতে শুরু করেনি।
সম্পাদকদের আতশকাচের নিচে
অভিধান-লেখকদের জন্য বহু প্রাচীন একটা সমস্যা হচ্ছে, একটি শব্দ অভিধানে স্থায়ীভাবে অন্তর্ভুক্ত থাকার মতো ক্ষমতা রাখে কি না সেই সিদ্ধান্ত নেয়া। কোভিড-১৯ মহামারি পুরনো শব্দের মিশ্রণে অনেকগুলো নতুন শব্দের তৈরি করেছে। শব্দগুলো সম্পাদকদের আতশকাচের নিচে আছে। অভিধান-লেখকদের বিবেচনাধীন শব্দগুলোর মধ্যে রয়েছে 'maskne' বা 'মাস্কনি' (মাস্ক পরার ফলে মুখে সৃষ্টি হওয়া ব্রণ), 'zoombombing' বা 'জুমবম্বিং' (কয়েকজন অপরিচিত মানুষের ভিডিও কনফারেন্স), এবং 'quarantini' বা 'কোয়ারেন্টিনি' (আইসোলেশনে থাকার সময় পান করা ককটেলের নাম)।
অন্যান্য নতুন মিশ্র শব্দের মধ্যে রয়েছে 'covidiot' বা কোভিডিয়ট (স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে না যে ব্যক্তি), 'doomscrolling' বা 'ডুমস্ক্রলিং' (স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্রাউজ করার সময় মহামারি সংক্রান্ত উদ্বেগ সৃষ্টিকারী সমস্ত খবর এড়িয়ে যাওয়া), এবং জার্মান শব্দ 'hamsterkauf' বা 'হ্যামস্টারকফ' (আতঙ্কের চোটে জিনিসপত্র কিনে জমিয়ে রাখা)। মহামারির পরও এই পরিভাষাগুলো সাধারণ মানুষ ব্যবহার করবে কি না সেটাই এখন দেখার ব্যাপার।
'COVID' নাকি 'Covid'?
COVID-19-এর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়াই বাকি রয়ে গেছে এখনও।
অভিধানের সম্পাদকদের মতে, এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয় ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিস্থিতি প্রতিবেদনে 'coronavirus disease 2019'-এর সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেনে শব্দটি লেখা হয়েছিল।
কিন্তু একে COVID-19 নাকি Covid-19 হিসেবে লেখা উচিত সে ব্যাপারে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে সম্পাদকদের মধ্যে। কেননা শব্দটি একেক অঞ্চলে একেক বানানে লেখা হচ্ছে।
অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি ইংল্যান্ড থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত হওয়ায় ব্রিটিশ রীতিটাই তাদের কাছে প্রাধান্য পেয়েছে। অভিধানটির অনলাইন সংস্করণে একে 'Covid-19' বানানেই দেখা যায়।
আগের স্বাস্থ্য সংকটগুলোও নতুন নতুন সংক্ষিপ্ত শব্দ ও পরিভাষার জন্ম দিয়েছিল। প্রায় ৪০ বছর আগে, এইডস (AIDS) ও এইচআইভি (HIV) শব্দগুলো ভাষায় প্রবেশ করে। তবে এরা কাগজের অভিধানে জায়গা পায় ১৯৮০-র দশকের শেষের দিকে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণে।
অনলাইনে আপডেট প্রকাশের মাধ্যমে সম্পাদকরা ভাষার পরিবর্তনগুলো প্রায় তাৎক্ষণিকভাবেই চিহ্নিত করতে পারছেন। ফলে নতুন শব্দের অন্তর্ভুক্তির জন্য আগের মতো বছরের-পর-বছর অপেক্ষা করতে হয় না।