এন৯৫ মুখোশের পেছনের কথা

ইজেল

01 May, 2021, 01:25 pm
Last modified: 01 May, 2021, 01:34 pm
এন ৯৫ রেসপিরেটর নিখুঁত নয়। শিশু কিংবা শ্রশ্রূধারীদের মুখ ঢাকার উপযোগী করে এর নকশা করা হয়নি। উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অপারেটিং রুমে ব্যবহার করা এন৯৫ মাস্কের নিঃশ্বাস ছাড়ার ভাল্ব নেই বলে গরম অনুভূত হয়। কিন্তু নানান সঙ্কটের ভেতর দিয়ে শত শত বছরের পরিক্রমায় এন৯৫ মাস্ক বিকশিত হয়েছে।

আমাদের এই সময়ের সবচেয়ে নকশাদার বস্তুটি অস্তিত্ব পেতে একশো বছরেরও বেশি সময় নিয়েছে। এন৯৫ বাদে কোভিড-১৯ এরচেয়ে বেশি তাৎপর্যময় রেসপিরেটরের প্রতীকের কথা ভাবা কঠিন। এই মুখোশটি শক্তভাবে মুখের চারপাশে এঁটে বসে ভাইরাসের মতো বাতাসে ভাসমান শতকরা ৮৫ ভাগ বস্তুকণা আটকে দিতে পারে, সার্জিকাল মাস্ক জাতীয় অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রীর পক্ষে যেটা সম্ভব নয়। জীবন রক্ষাকারী এই জিনিসটি এখন বিপজ্জনকভাবে ঘাটতির মুখে পড়ায় কোভিড ১৯-এর মোকাবিলা মারাত্মক বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

এই পাতলা পলিমার কাপটি কিভাবে একুশ শতকের সবচেয়ে তাৎপর্যময় স্বাস্থ্য-সুরক্ষা সামগ্রীতে পরিণত হলো? ১৯১০ সালে এযাবৎকালের সবচেয়ে মারাত্মক রোগের কবল থেকে দুনিয়াকে বাঁচাতে স্বল্প পরিচিত একজন ডাক্তারের হাতেই এর শুরু। 

দুর্গন্ধ ঠেকাতেই প্রথম মুখোশের ব্যবহার হয়েছিল

আরও পেছনে গেলে--ব্যাক্টেরিয়া এবং ভাইরাসের ভাতাসে ভেসে বেরিয়ে আমাদের আক্রান্ত করার বিষয়টি জানার আগেই--মুখ ঢাকতে মানুষ মুখোশ ব্যবহার করেছে, বলেছেন মেডিক্যাল মাস্কের ঠিকুজির বেলায় একজন বিশেষজ্ঞ সেইন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অভ সোশ্যাল অ্যান্থ্রোপলজি বিভাগের সিনিয়র লেকচারার ক্রিস্টোস লিন্টেরিস। রেঁনেসা কালের বিভিন্ন চিত্রকর্মের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। এইসব ছবিতে লোকজনকে অসুস্থতা এড়াতে রুমালে মুখ ঢেকে রাখতে দেখা যায়। এমনকি ১৭২০-এর দশকের মার্সেইয়ের--বিউবোনিক প্লেগের কেন্দ্রভূমি--বিভিন্ন চিত্রকর্মে গোরখাদক এবং সাধারণ লোকজনকে কাপড়ে মুখ ঢেকে লাশ দাফন করতে দেখা যায়--যদিও তখন প্লেগটি ইদুরের পিঠে বসা মাছির কামড়ে দেখা দিয়েছিল। 

'এটা সংক্রমণের বিরুদ্ধে ছিল না,' এ সম্পর্কে বলেন লিন্টেরিস, 'সাধারণত জমিন থেকে উঠে আসা দুর্গন্ধ বা গ্যাসই প্লেগের মতো রোগের কারণ ভেবেই এইসব লোকজন কাপড়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখত, অন্যের কাছ থেকে নিজেকে বাঁচাতে নয়। আবহাওয়ায়--দুষিত বাতাসেই প্লেগের অস্তিত্ব বলে বিশ্বাস ছিল তাদের।'

দুর্গন্ধ তত্ত্বই ১৬০০ দশকের দিকে গোটা ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া কুখ্যাত প্লেগ মাস্কের নকশার দিকে নিয়ে যায়। প্লেগ শনাক্তকারী ডাক্তাররা এটি পরতেন। লাঠির আঘাতে আক্রান্তদের শনাক্ত করতেন তারা। লম্বাটে এই মুখোশটি কিঞ্চিৎ পাখীর দীর্ঘ ঠোঁটের মতো ছিল, মুখোশের প্রান্তে নাকের দুটো ফুটো থাকতো। সুগন্ধীতে ভরে রাখা যেত এই ফুটোগুলো। প্লেগের গন্ধ থেকে নিজেদের রক্ষা করেই খোদ প্লেগের কবল থেকে বাঁচতে পারবে বলে বিশ্বাস করত লোকে।  

'দুর্গন্ধই রোগের কারণ। ১৯ শতকের গোড়ার দিক অবধি এমনি ভাবনা চালু ছিল,' বলছেন লিন্টেরিস। এখানে উল্লেখ্য, ২০০ বছর বাদে আন্তোনে বার্থেলিমে ক্লোত-বে নামে জনৈক ফরাসী ডাক্তার খোদ পাখী-সদৃশ প্লেগ-মুখোশই প্লেগের বিস্তারের জন্যে দায়ী বলে মত প্রকাশ করেন, কারণ এই মুখোশ দেখে লোকে ভয় পেত এবং সন্ত্রস্ত দেহই নাকি রোগের পক্ষে বড় ধরনের ঝুঁকি ছিল।

১৮৭০-র দশকের শেষদিকে ব্যাক্টেরিয়ার কথা জানতে পারেন বিজ্ঞানীরা। অণূজীববিজ্ঞানের আধুনিক শাখার আবির্ভাব ঘটায় দুর্গন্ধের ধারণা বাতিল হয়ে যায়। তবু এরপর দেখা দেওয়া মুখোশটিও হুবহু প্রায় আগেরটির মতোই ছিল: স্রেফ পাখীর আদল বাদে। 'আমরা প্রায়ই নতুন উদ্ভাবনের দিকে চালিত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তনের কথা ভাবি, কিন্তু ১৯ শতকের শেষাশেষি নাগাদ জীবাণুর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত সমস্ত প্রযুক্তিই গন্ধের ধারণা ভিত্তিক ছিল।'

একটি অনন্য রুমাল

১৮৯৭ সালে ডাক্তাররা প্রথম সার্জিক্যাল মাস্ক পরতে শুরু করেন। এগুলো অবশ্য মুখের চারপাশে বাঁধা ভিন্ন ধরনের রুমালের চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। বাতাসে ভাসমান রোগ ঠেকাতেও এসবের নকশা করা হয়নি। আজকের দিনেও সার্জিক্যাল মাস্কের লক্ষ্য তা নয়: সার্জারির সময় ক্ষতস্থানে কাশি বা হাঁচি দেওয়া থেকে ডাক্তারদের বিরত রাখতেই এগুলো ব্যবহৃত হতো, আজও হচ্ছে।

মুখোশ এবং রেসপিরেটরের ভেতরের এই পার্থক্যটুকু গুরুত্বপূর্ণ। একারণেই স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞরা রেসিপরেটরের অভাবে সার্জিক্যাল মাস্ক পরার নির্দেশ দেওয়ায় বিচলিত হয়েছেন। মুখোশ কেবল ভিন্ন কাঁচামালেই তৈরি হয় না, এগুলো মুখে শিথিলভাবে আটকে থাকে, ফলে দুপাশ থেকে বস্তুকণা ঢুকে পড়ে। রেসপিরেটর এক ধরনের এয়ারটাইট রুদ্ধ অবস্থা তৈরি করে শ্বাসপ্রশ্বাস ফিল্টার করতে পারে। 

প্লেগ এবং বর্ণবাদের ফলেই প্রথম আধুনিক রেসপিরেটরের জন্ম

১৯১০ সালের বসন্তে গোটা মাঞ্চুরিয়ায়--এখন উত্তর চীন হিসাবে পরিচিত--প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। চীন এবং রাশিয়ার যৌথ মালিকানার জটিল রাজনৈতিক পরিবেশে এটির বিস্তার ঘটে। 

'ভয়ঙ্কর ছিল এটি। অবিশ্বাস্য। আক্রান্তদের ১০০%ই এতে প্রাণ হারায়। কেউ বাঁচেনি। প্রথম লক্ষণ দেখা দেওয়ার ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই তাদের মৃত্যু ঘটে,' বলেছেন লিন্টেরিস। 'আধুনিক কালে এই ধরনের কিছু কেউ কখনও দেখেনি। ব্ল্যাক ডেথের বর্ণনার সাথে এর মিল রয়েছে।'

প্লেগের কারণ জানা এবং একে ঠেকাতেই এরপর বৈজ্ঞানিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। 'রাশিয়া এবং চীন, দুদেশই নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগে, কারণ তাহলে স্বাধীনতার দাবি জোরালো হতো' বলেছেন লিন্টেরিস। 'যার বৈজ্ঞানিক ক্ষমতা বেশি তাকেই এই সমৃদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকার নিয়ন্ত্রণ দেওয়া উচিত।'

চীনা রাজ দরবার দেশটির প্রয়াসে নেতৃত্ব দিতে লিয়েন-তেহ উ নামে এক ডাক্তারকে নিয়োগ দেয়। তরুণ ছিলেন উ, আনাড়ী ম্যান্ডারিন ভাষায় কথা বলতে পারতেন। লিন্টেরিসের মতে দ্রুত আন্তর্জতিক মনোযোগ এবং ডাক্তারদের আকৃষ্ট করা এক ধরনের প্লেগের বেলায় তিনি 'নেহাতই' গুরুত্বহীন ছিলেন। কিন্তু একজন আক্রান্তের অটোপসি করে উ এই প্লেগটি অনেকের ধারণামতে মাছি মারফত নয়, বরং বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হন। 

পশ্চিমে দেখা সার্জারি মাস্কের উপর ভিত্তি করে গজ এবং তুলোর আরও শক্ত একটি মুখোশ তৈরি করেন উ। এটি মুখের চারপাশে চমৎকারভাবে এঁটে বসে এবং শ্বাসপ্রশ্বাস ফিল্টারের জন্যে কয়েক পরত কাপড় যোগ করে। তার এই উদ্ভাবনটি সফল হলেও অনেক ডাক্তারই এটির ফলপ্রসূতায় সন্দিহান ছিলেন। 

১৯১১ সালে মাঞ্চুরিয়ান প্লেগের সময় মাস্ক পরিহিত দু'জন স্বাস্থ্যকর্মী

'দারুণ একটা ব্যাপার ঘটেছিল। অঞ্চলের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি এক ফরাসী ডাক্তারের [জেরল্ড মেসনি] সাথে তার মোকাবিলা হয়। উ ফরাসী ডাক্তারের কাছে প্লেগটির নিউমোনিক এবং বাতাসে ছড়ানোর তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন,' বলেছেন লিন্টেরিস।

'ফরাসী তাকে অপমান করেন...রীতিমতো বর্ণবাদী ভাষায় তাকে বলেন, "একজন চীনার কাছ থেকে কি আশা করা যায়?" নিজের কথা প্রমাণ করতে [মেসনি] উর মুখোশ না পরেই একটা প্লেগ হাসপাতালে অসুস্থদের কাছে হাজির হন। দুদিন বাদেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।'

এলাকার অন্য ডাক্তাররা ঝটপট নিজেদের মুখোশ তৈরি করে নেন। 'এগুলোর কোনও কোনওটা--ডাইভিং মাস্কের মতো চশমা আর হুডঅলা--রীতিমতো অদ্ভুত জিনিস ছিল,' বলেছেন লিন্টেরিস।'

কিন্তু, ব্যবহারকারীদের ব্যাক্টেরিয়া থেকে সুরক্ষা দিয়ে প্রায়োগিক পরীক্ষায় উর মুখোশ উৎরে যায়। লিন্টেরিসের মতে, এটির নকশাও দারুণ ছিল। সস্তা এবং সহজলভ্য কাঁচামালে হাতেই বানানো যায়। ১৯১১ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসের ভেতর মুখোশের উৎপাদন অজ্ঞাত পরিমাণে বেড়ে উঠেছিল। মেডিকেল স্টাফ, সৈনিকসহ সবাই এটি পরেছে। তাতে কেবল প্লেগের বিস্তার রোধই সম্ভব হয়নি, সরাসরি মহামারির মোকাবিলায় এই মুখোশ আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতীকেও পরিণত হয়েছিল মুখোশটি। 

আন্তর্জাতিক পত্রিকার বিভিন্ন প্রতিবেদনের সুবাদে উর মুখোশ দ্রুত আইকনে পরিণত হয়। 'একেবারে আনকোরা জিনিস ছিল মুখোশটি...এটার অদ্ভুত চেহারা পত্রিকার মনে ধরেছিল। শাদা মুখোশ পরা শাদাকালো ছবির কথা ভেবে দেখুন তো-চমৎকার লাগে,' বলেছেন লিন্টেরিস। 'বিপণন সাফল্য এটা।'

১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু দেখা দিলে উর মুখোশ বিজ্ঞানী তো বটে, বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের কাছেও যথেষ্ট পরিচিত ছিল। দুনিয়া জুড়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ফ্লুর বিস্তার ঠেকাতে সাহায্য করার লক্ষ্যে একই ধরনের মুখোশের উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছিল। 

এন৯৫ মুখোশ উর সেই নকশারই উত্তরসুরি। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বিজ্ঞানীরা বাতাসের সরবরাহ পরিষ্কার করতে গোটা মাথা ঢেকে রাখা এয়ার ফিল্টারিং গ্যাস মাস্ক আবিষ্কার করেন। ফাইবার গ্লাস ফিল্টার সমেত একই ধরনের মুখোশ ফুসফুসে কয়লা কণা জমা ঠেকাতে খনি শিল্পে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। 

'সমস্ত রেসপিরেটরই এমনি বিশাল গ্যাস মাস্কের মতো ছিল,' বলেছেন থ্রি এম-এর পেশাগত স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা নেতা নিক্কি ম্যাককুলা। এই প্রতিষ্ঠানটিই এন৯৫ রেসপিরেটর তৈরি করে। 'রাতে ধুয়ে এগুলো আবার পরতে পারেন আপনি।'

জীবন রক্ষা করলেও এই জিনিসটি ভারী ছিল। ফিল্টার তার একটা বড় কারণ। ফাইবার গ্লাসের কারণে শ্বাস নিতে কষ্ট হতো, এবং গোটা মাথা ঢাকা থাকায় গরম লাগতো। ১৯৫০-র দশক নাগাদ বিজ্ঞানীরা শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে অ্যাসবেস্টস গ্রহণের বিপদের কথা জানতে পারেন, কিন্তু অ্যাসবেস্টসের সাথে সম্পর্কিত লোকজন বড় আকারের রেসপিরেটর মুখোশ পরার পক্ষে ছিলেন না। অদৃশ্য হুমকি থেকে বাঁচতে ৮৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাবারে গোটা মাথা ঢাকা অবস্থায় কাজ করার কথা ভেবে দেখুন। 

মোটামুটি একই সময়ে হাউস বিউটিফুল সাময়িকীর সাবেক রূপসজ্জা সম্পাদক সারা লিটল টার্নবুল থ্রি এম-এর উপহার মোড়ককারী বিভাগের সাথে পরামর্শ শুরু করেন। শক্ত ফিতে তৈরির জন্যে প্রতিষ্ঠানটি গলিত পলিমার এবং এয়ার ব্লাস্টকে ক্ষুদে আঁশের বুননে পরিণত করতে এক ধরনের প্রযুক্তির সহায়তা নিচ্ছিল। টার্নবুল এই প্রক্রিয়ার বিপুল সম্ভাবনার কথা বুঝতে পারলেও পরামর্শের জন্যে ফ্যাশন শিল্পের সাথে যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে শোল্ডার প্যাডের রসদ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেছিলেন। এরপর ১৯৫৮ সালে তিনি 'হোয়াই?' শিরোনামে থ্রি-এম-এর সামনে থ্রি-এম-এর বৃহত্তর উপায়ে নন-উভেন পণ্যের ব্যবসায়ে যাওয়ার পক্ষে প্রতিবেদন তুলে ধরেন। এই প্রযুক্তির পক্ষে ১০০ টি পণ্যের ধারণা তুলে ধরেন তিনি। একটি মোল্ডেড ব্রার নকশা করার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। 

কিন্তু ৫০-র দশকের শেষদিকটা টার্নবুলের পক্ষে কঠিন ছিল। হাসপাতালে পরিবারের অসুস্থ সদস্যদের দেখাশোনার পেছনে প্রচুর সময় দিতে হচ্ছিল তাকে। পরপর তিন প্রিয়জনকে হারান তিনি। সেই শোক থেকেই আসে নতুন একটি উদ্ভাবন: ১৯৬১ সালে থ্রি-এম-এর চালু করা 'বাবল' সার্জিক্যাল মাস্ক, হ্যাঁ, ব্রার কাপ থেকেই অনুপ্রেরণা নিয়েছিল এটি। এটি প্যাথোজেন ঠেকাতে পারবে না জানার পর থ্রি-এম 'ডাস্ট' মাস্ক হিসাবে একে নতুন করে ব্র্যান্ডিং করে।  

ব্রার কাপ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ট্রার্নবুলের আঁকা মাস্কের নকশা

তখনও অস্তিত্বহীন--চিকিৎসা বা কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা--ঘিরে প্রমিত মান তৈরি কঠিন ছিল। ১৯৭০-র দশক নাগাদ ব্যুরো অভ মাইনস এবং ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর অক্যুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেল্থ তাদের মতে 'একক ব্যবহারের রেসপিরেটর'-এর প্রথম মানদণ্ড স্থির করতে একজোট হয়। থ্রি-এম-র হাতেই আমাদের চেনা প্রথম একক ব্যবহারের এন৯৫ 'ডাস্ট' রেসপিরেটরের উদ্ভাবন ঘটে। ১৯৭২ সালের ২৫ শে মে এটি অনুমোদন পায়। ফাইবার গ্রাসের বদলে শক্ত উপহারের ফিতে তৈরির জন্যে উদ্ভাবিত প্রযুক্তিকেই লাগসই ফিল্টার তৈরির কাজে ব্যবহারের প্রস্তাব রাখে প্রতিষ্ঠানটি। অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে, 'দেখে মনে হবে কেউ বুঝি অনেকগুলো কাঠি ফেলে রেখেছে--এগুলোর মাঝখানে বিপুল ফাঁকা জায়গা থাকে,' বলেছেন ম্যাকগুলা। 

সিলিকা বা ভাইরাস, কণা হিসাবে এগুলো কাঠির গোলকধাঁধায় উড়ে এসে আটকা পড়ে। আপনি যত বেশিক্ষণ এন৯৫ রেসপিরেটর পরে থাকবেন ততই বিভিন্ন কণা ফিল্টারে এটি বেশি নিপুণ হয়ে উঠবে। বেশি পরিমাণ কণা আরও কণাকে আটকাতে সাহায্য করে মাত্র। কিন্তু কণার কারণে আঁশের মাঝখানের ফোকরগুলো রুদ্ধ হয়ে আসায় সময় গড়ানোর সাথে সাথে শ্বাসপ্রশ্বাস কঠিন হয়ে পড়ে। এই জন্যেই অতিরিক্ত ধুলিময় পরিবেশে একবারে আট ঘণ্টার বেশি এন৯৫ রেসপিরেটর পরা যায় না। ফিল্টারিং বন্ধ হয় না, কিন্তু স্বস্তির সাথে শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণে বাদ সাধে।

তবে সত্যি কথা হচ্ছে, বিভিন্ন কণা ফিল্টারের বেলায় এন৯৫ মুখোশের এসব বস্তুগত বাধা গৌণ কায়দামাত্র। এন৯৫ মুখোশের ক্রিয়াশীলতার মুল রহস্য এর ভেতর লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য বৈদ্যুতিক চার্জ। ডাক্তার পিটার তাইয়ের মতো একজন প্রধান চরিত্রের  কল্যাণেই এই চার্জ তৈরি সম্ভব হয়েছিল।  

তাই বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত একজন তাইওয়ানিজ আমেরিকান বস্তু বিজ্ঞানী। টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ১৯৮০-র দশকে তার ল্যাব বহুবছর ধরে থ্রি এম এবং টার্নবুলের কাজের ধারা অনুসরণ করে একটি স্প্রে মাইক্রোফাইবার প্রযুক্তি আবিষ্কার করে। 

এই পর্যায় পর্যন্ত সমস্ত মুখোশ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফিল্টারের কাজটি সারতো। তার মানে একটু আগে উল্লেখ করা গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে কোনও কণা যাওয়ার সময় সেটি প্রায়ই কোনও একটি আঁশে আঘাত হেনে আটকা পড়ত। 'আমরা দেখলাম যে, আঁশে চার্জ যোগ করতে পারলে যান্ত্রিক শক্তির পাশাপাশি স্থায়ী শক্তিও তৈরি হবে,' বলেছেন তাই। স্থায়ী আকর্ষণের ফলে শীতকালে যেকারণে বেলুন আপনার স্যোয়েটারের সাথে সেঁটে থাকতে চায় ঠিক সেকারণেই কোনও একটি কণাকে ফিল্টারের দিকে টেনে আনা যাবে।

১৯৯২ সালে তাইয়ের ল্যাব উপকরণের সাথে ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক চার্জ যোগ করার প্রক্রিয়ার বিকাশ ঘটায়। থ্রি-এম অচিরেই ইউনিভার্সিটি অভ টেনেসি মারফত আজকাল বিখ্যাত হয়ে ওঠা এন৯৫ মুখোশ তৈরির জন্যে তাইয়ের প্রক্রিয়ার অনুমোদন দেয়। 

ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক চার্জ বিনা এন৯৫ এতটা ভালোভাবে কাজ করতে পারত না। তাইয়ের মতে এন৯৫ মুখোশের আনুমানিক ২০ মাইক্রোন আকারের ফোকর থাকে (এটা একে শ্বাসগ্রহণযোগ্য করে), যেখানে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের আকার মাত্র ০.০২ থেকে ০,০৮ মাইক্রোন মাত্র। ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক চার্জ মুখোশের কার্যক্ষমতা ১০ গুন বাড়িয়ে দিয়ে আকারের এই ফারাকের সমাধান দিয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, এন৯৫ মুখোশ কাজে আসার প্রধান কারণ এর ভেতরে লুকিয়ে থাকা বৈদ্যুাতক চার্জ, খোদ বস্তুগত আকার নয়। তবু, তাই উল্লেখ করেছেন, ১৯৯০ দশকে তেমন শোরগোল ছাড়াই বাজারজাত হয়েছিল এন৯৫।  

'আমার উদ্ভাবনটি বিশেষ কিছু নয়,' বলেছেন তাই, 'কিন্তু এটা একটা বিশেষ সময়।'

ওষুধ প্রতিরোধক যক্ষ্মা বেড়ে ওঠায় ১৯৯০ দশকে চিকিৎসার ক্ষেত্রে রেসপিরেটরের প্রত্যাবর্তনের আগেও বহু দশক ধরেই শিল্পক্ষেত্রে রেসপিরেটরের ব্যবহার চলছে। এইচআইভিতে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হারানো বহু রোগীর সাথে এর বিস্তারের সম্পর্ক রয়েছে; তবে যক্ষ্মাও বহু স্বাস্থ্যকর্মীকে আক্রান্ত করেছে। বাতাসের কারণে বিস্তার ঠেকাতে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে এন৯৫ এর মান হালনাগাদ করা হয়েছে। ডাক্তাররা যক্ষারোগীদের সাহায্য করতে এই মুখোশ পরতে শুরু করেন। এমনকি এখনও বিরল ক্ষেত্রে বিভিন্ন হাসপাতালে রেসপিরেটর ব্যবহার করা হচ্ছে, তার কারণ একমাত্র কোভিড ১৯ এর মতো রোগের প্রাদুর্ভাবই এত বেশি প্রতিরক্ষা জরুরি করে তোলে।  

লিন্টেরিস এবং আরও অনেকের মতে, চীন থেকে আসলে রেসপিরেটর কখনওই হারিয়ে যায়নি। উ সিডিসি'র চৈনিক ভাষ্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন এবং অল্পের জন্যে নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অতি সাম্প্রতিক কালে সার্স প্রাদুর্ভাবের সময় চীনের লোকজন রোগের বিস্তার ঠেকাতে মুখে আবরণ ব্যবহার করেছে। বেইজিংয়ের মতো শহরগুলোতে দূষণ দেখা দিলে দূষণ ফিল্টারে রেসপিরেটর ব্যবহার করে তারা। 

এন ৯৫ রেসপিরেটর নিখুঁত নয়। শিশু কিংবা শ্রশ্রূধারীদের মুখ ঢাকার উপযোগী করে এর নকশা করা হয়নি। কিন্তু সেটা করা না গেলে বিজ্ঞাপনের ভাষা মোতাবেক এটি কাজ করবে না। এছাড়া, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অপারেটিং রুমে ব্যবহার করা এন৯৫ মাস্কের নিঃশ্বাস ছাড়ার ভাল্ব নেই বলে গরম অনুভূত হয়।  

কিন্তু নানান সঙ্কটের ভেতর দিয়ে শত শত বছরের পরিক্রমায় এন৯৫ রেসপিরেটর বিকশিত হয়েছে। এই বিবর্তন কেবল কোভিড-১৯ মহামারির কালেই অব্যাহত থাকবে না। ম্যাককুলা বলেছেন, থ্রি-এম ক্রমাগত এন৯৫ রেসপিরেটরের মূল্যায়ন করছে, ফিল্টার থেকে শুরু করে কর্মপরিবেশে লোকের কর্মদক্ষতা পর্যন্ত সবকিছু পরখ করছে। 'আমার মা বলতেন, এগুলো দেখতে সেই ১৯৭২ সালের গুলোর মতোই, কিন্তু আমরা চেয়েছি এগুলো যেন সাধারণ চেহারার এবং সহজ ব্যবহারযোগ্য হয়্,' বলেছেন ম্যাককুলা। 'আমরা সবসময় প্রযুক্তির বিকাশ ঘটাচ্ছি। থ্রি-এম-এ হাজার হাজার বিজ্ঞানী একাজেই ব্যস্ত রয়েছেন।'
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.