উল্কি সংগ্রাহক
ট্যাটু বা উল্কি শিল্পের ইতিহাস বহু পুরনো। বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ট্যাটু প্রায় ৫ হাজার বছরের প্রাচীন। ৩৩৭০ থেকে ৩১০০ খ্রিষ্টপূর্বের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে মমি হয়ে যাওয়া ওটজি নামের এক ব্যক্তির শরীরে পাওয়া যায় কয়লা দিয়ে আঁকা উল্কি। একেই পৃথিবীর প্রাচীনতম উল্কি বলে ধরে নেয়া হয়।
মানুষের ত্বকে আঁকাআঁকির এই ইতিহাস বেশ জটিল। শিল্পের অন্যান্য রূপগুলোর মতো এই শিল্পেরও নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। আছে প্রাচীন সরঞ্জাম, ঐতিহাসিক চিত্রকর্ম, নৃতাত্ত্বিক ফটোগ্রাফ এবং 'ফ্ল্যাশ শিট' নামক ডিজাইনের চিত্র।
উল্কি শিল্পেরও নিজস্ব বাজার রয়েছে, আছে জাদুঘরও। নিউ ইয়র্ক সিটির ডেয়ারডেভিল মিউজিয়াম এবং স্যান ফ্রান্সিসকোর লাইল টাটল ট্যাটু স্টুডিও এমন কয়েকটি উল্কি জাদুঘর।
ডাচ ট্যাটু শিল্পী হেনক শিফম্যাচার—যিনি লেডি গাগা, কার্ট কোবেইন ও কিথ হ্যারিংদের গায়ে উল্কি এঁকেছেন—সম্প্রতি একটি ভিডিও সাক্ষাৎরে জানান, ইন্টারনেটের কল্যাণে ট্যাটু শিল্পের জন্য সম্পূর্ণ নতুন এক ভোক্তাশ্রেণি তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, 'হুট করেই কারও খেয়াল চাপল যে, ছোট্ট সংগ্রহশালা বানাবে...কিংবা ট্যাটু শিল্পের ইতিহাস সম্পর্কে জানবে।'
শিফম্যাচার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উল্কি শিল্প সংগ্রাহকদের একজন। উল্কি শিল্প সংক্রান্ত ৪০ হাজারেরও বেশি জিনিস ও শিল্পকর্ম রয়েছে তার সংগ্রহে। সেসবের ছবি স্থান পেয়েছে 'ট্যাটু ১৭৩০-১৯৭০ হেনক শিফম্যাচার'স প্রাইভেট কালেকশন' নামক বইয়ে।
তার সংগ্রহে রয়েছে ১৯ শতকের কাবুকি চরিত্রের উল্কি আঁকা জাপানি কাঠের ব্লক প্রিন্ট; ১৯০০-র দশকের গোড়ার দিকের উল্কি আঁকা কাঠ ও হাড়; কার্নিভালে ভ্রমণরত নারীদের শরীরে আঁকা উল্কির সাদা-কালো ছবি; এবং শতাব্দীপ্রাচীন আরও অনেক ছবি।
শিফম্যাচার উল্কি আঁকার কাজ করছেন ১৯৭০-এর দশক থেকে। তিনি জানিয়েছেন, 'এখন অনেকেই ট্যাটু সংগ্রহ করছে। ইন্টারনেটের একটা ভালো দিক হচ্ছে, অন্যদের সংগ্রহে কী আছে তা আমরা ঘরে বসেই দেখতে পারি।'
শিফম্যাচার আমস্টারডাম ট্যাটু মিউজিয়াম-এ নিজের শিফম্যাচার ট্যাটু হেরিটেজ গড়ে তোলেন। যদিও পরে অর্থাভাবে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। তার বাড়িতে এখন ইতিহাসের বিভিন্ন যুগের মূল্যবান উল্কির নিদর্শন রয়েছে। জাপানের এদো আমলের উল্কি, ১৯ শতকের মাওরি আদিবাসীদের উল্কি থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রচলিত ট্যাটুও রয়েছে তার সংগ্রহশালায়।
তার মতে, উল্কি হলো সাধারণ মানুষের শিল্প। এতে অতি উচ্চমার্গীয় কোনো চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ ঘটে না। এই উল্কির অর্থ বোঝা সহজ, এবং এটি সাধারণ মানুষের প্রতীক হিসেবে কাজ করে। সাধারণ একটি উল্কি হলো—নোঙর বা হৃদয় কিংবা গোলাপের হলো—এক ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা।
আমৃত্যু সংগ্রাহক
শিফম্যাচারের বাবা ছিলেন কসাই। শিফম্যাচার শৈশবেই উল্কি সংগ্রহে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তারপর একসময় নিজেই উল্কি শিল্পী বনে যান। সেই ছোটবেলা থেকেই তিনি নানা ধরনের চকমকি পাথর, তিরের ফলা, পাখির ডিম সংগ্রহ করতেন। নিজের ঘরের দরজায় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখতেন—'মাই মিউজিয়াম'।
শিফম্যাচারের জন্ম ছোট্ট ডাচ শহর হার্ডারভিক-এ। বয়স যখন বিশ, তখন তিনি আমস্টারডামে পাড়ি জমান। সেখানে বন্ধুত্ব হয় বিখ্যাত শিল্পী ট্যাটু পিটারের সঙ্গে। সে সময় ফটোগ্রাফির প্রতিও আগ্রহ জন্মাচ্ছিল তার। বিশেষ করে ডায়ান আরবাস-এর তোলা উল্কি আঁকা মানুষজনের সাদা-কালো ছবিগুলো বেশি টেনেছিল তাকে। শিফম্যাচার অপরিচিত লোকের সন্ধান করতে শুরু করেন ছবি তোলার জন্য। একদিন হঠাৎ এক লোক তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। লোকটা পাঁড় মাতাল ছিল। দারুণ সব উল্কি আঁকা ছিল তার গায়ে। সেগুলোর ছবি তোলেন শিফম্যাচার।
কয়েক দশক আগেও সারা গায়ে উল্কি আঁকা লোকের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। গত কয়েক বছরে এই শিল্পের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। ২০১৯ সালে এক জরিপে দেখা যায়, প্রতি আমেরিকানের একজনের গায়ে উল্কি আছে। যা গত সাত বছরের তুলনায় ২১ শতাংশ বেশি।
শিফম্যাচার জানান, ৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে হল্যান্ডে উল্কি আঁকা লোকজন তেমন দেখা যেত না। দেশটিতে এ শিল্প বলতে গেলে অচেনাই ছিল। কিন্তু সেই পরিস্থিতি এখন গোটা দুনিয়াতেই বদলে গেছ। এখন এই শিল্পের প্রতি আগ্রহী অন্য মানুষদের খুব সহজেই খুঁজে নেয়া যায়।
শিফম্যাচার অন্য শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে আরম্ভ করেন। নিজের তোলা ছবিগুলো তাদেরকে দেন আঁকার জন্য। তিনি উল্কি আঁকা শুরু করার অল্পদিন পরে তিনি বাইরের দেশের উল্কি শিল্পীদের সঙ্গে দেখা করতে যেতে শুরু করেন। তিনি তাদের দোকানে যান, তাদের সঙ্গে শিল্প বিনিময় করেন, স্থানীয় অ্যান্টিক শপগুলো ঢুঁড়ে বেড়ান নতুন কিছু খুঁজে পাওয়ার আশায়।
উল্কি শিল্পী ও সংগ্রাহক হিসেবে সুনাম বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে শিফম্যাচারের সংগ্রহ এবং আয়।
দোকান থেকে জাদুঘরে
আমস্টারডামের ট্রপেনমিউজিয়াম এবং লস অ্যাঞ্জেলেসের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম-সহ আরও অনেক জাদুঘর শিফম্যাচারের সংগ্রহ থেকে জিনিস ধার নিয়েছে বিভিন্ন সময়। ২০১৫ সালে প্যারিসের মিউসি দু কুই ব্র্যানলি জ্যাক শিরাক জাদুঘরে 'Tatoueurs, Tatoués' ('ট্যাটুইস্ট, ট্যাটুড') শিরোনামের প্রদর্শনীতে তার সংগ্রহের কিছু জিনিস স্থান পেয়েছিল। টরন্টোর রয়্যাল ওন্টারিও মিউজিয়াম, দ্য ফিল্ড মিউজিয়াম শিকাগো-র প্রদর্শনীতেও স্থান পেয়েছে তার সংগ্রহের জিনিস।
সম্প্রতি আর্টিফ্যাক্ট নিয়ে কিছু বিতর্ক উঠেছে। অনেকেরই অভিযোগ, ট্যাটু করা কিছু চামড়া উপনিবেশ স্থাপনকারী এলাকা থেকে জোরপূর্বক নিয়ে আসা হয়েছে। অবশ্য শিফম্যাচার জানিয়েছেন, অনেক মানুষই মৃত্যুর পর প্রদর্শনের জন্য নিজের উল্কি করা চামড়া দান করে যান।
তবে এ জাতীয় সব নিদর্শনই স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, গত এক দশকে আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি ও স্মিথসনিয়ান তাদের সংগ্রহের অনেক মাওরি দেহাবশেষই জাতিটির কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। এ তালিকায় রয়েছে 'মোকোমোকাই' নামে পরিচিত উল্কি করা সংরক্ষিত মাথাও। শিফম্যাচার নিজেও গত দশকের গোড়ার দিকে প্যারিসের মাওরি বংশোদ্ভূত উল্কি শিল্পী গর্ডন টোই ও অভিনেতা ক্লিফ কার্টিসের সঙ্গে প্যারিসের এক আর্ট ডিলারের কাছে গিয়েছিলেন একটি মোকোমোকাই পুনরুদ্ধার করতে। 'তে পাপা' নামের সেই মাথাটি নিউজিল্যান্ডে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। মাথাটি এখন নিউজিল্যান্ডের জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
শিফম্যাচারের কাছে তার উল্কিগুলো যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তার মতে, এটি তাকে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে প্রবেশাধিকার দেয়, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের পথ সহজ করে দেয়।