ইলিশনামা: মুজতবা আলী, বিভূতিভূষণ, হুমায়ূন আহমেদের ইলিশকাণ্ড...

ইজেল

06 December, 2021, 02:20 pm
Last modified: 06 December, 2021, 06:06 pm
পাকশীতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের স্প্যানে ধাক্কা খেয়ে ইলিশের নাক নাকি থেঁতো হয়। নাকভাঙা সেই ইলিশই হলো আসল পদ্মার ইলিশ!
পটচিত্র

হুমায়ূন আহমেদ তখন আমেরিকার ফার্গো শহরে থাকেন। ঘরে ইলিশ রান্না উপলক্ষে স্টেট ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশি ছাত্ররা সবাই আমন্ত্রণ পেয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে সিল করা টিনে আসা ইলিশ রান্না হবে। কৌটা খুলে দেখা গেল ভেতরে আলুভর্তা জাতীয় পদার্থ। সেই জিনিস তেলে ভাজা হলো। সবাই চায়ের চামচের ছয় চামচ করে পেলেন। খুব তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া হলো সেই জিনিস।

খাওয়া শেষে কোন নদীর ইলিশের স্বাদ বেশি সেই আলোচনা শুরু। জানা গেল সুরমা নদীতে যে ইলিশ ধরা পড়ে, তার স্বাদ গভীর সমুদ্রের ইলিশের মতো। একজন আবার শোনালেন পাকশীতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের স্প্যানে ধাক্কা খেয়ে ইলিশের নাক নাকি থেঁতো হয়। নাকভাঙা সেই ইলিশই হলো আসল পদ্মার ইলিশ!

পদ্মা আর গঙ্গার ইলিশের মধ্যে কোনটি সেরা, তা নিয়ে দুই বাংলায় তর্কের শেষ নেই।

লেখক কমলকুমার মজুমদারের প্রিয় গঙ্গার ইলিশ। তার কথা গঙ্গার ইলিশ দুশো বছর কোম্পানির তেল খেয়েছে। এই ইলিশের সঙ্গে অন্য ইলিশ পাল্লা দিবে কী করে?

চৌরঙ্গীর লেখক শংকরকে একবার জিজ্ঞেস করা হয় কোন নদীর ইলিশ বেশি সুস্বাদু। কৌশলে পদ্মা আর গঙ্গার তর্ক এড়িয়ে তিনি বলেন, 'আমি বহু পেশাদার রন্ধনশিল্পীকে বলতে শুনেছি টাইগ্রিসের ইলিশই সেরা।'

শংকর ওরফে মণিশংকর মুখোপাধ্যায়ের এই বক্তব্য নিছক রসিকতা ছিল কি না, তা জানার উপায় নেই। ইরাকে যখন হারুনুর রশীদের স্বর্ণযুগ নেই, আমাদেরও সম্ভবত টাইগ্রিসের ইলিশ খাওয়ার সৌভাগ্য হবে না।

ইলিশ প্রীতি থেকেই হুমায়ূন আহমেদ ইলিশের শতাধিক পদের রান্নার বইয়ে ভূমিকা লিখেছিলেন। তার নিজের উদ্ভাবিত ইলিশ রান্নার রেসিপি মিলবে 'মিসির আলির চশমা' বইয়ে। পদের নাম 'ইস্ত্রি ইলিশ'। ইলিশ মাছে সর্ষে বাটা, কাঁচামরিচ এবং লবণ দিয়ে লাউপাতায় মুড়ে গরম ইস্ত্রির নিচে বসিয়ে দিতে হবে। এভাবেই চলবে রান্না। কিছুক্ষণ পর মাছ উলটে আবার ইস্ত্রি চাপা। তবে কতক্ষণ এই ইস্ত্রি চাপা দিতে হবে তা বলা নেই।

হুমায়ূন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

হুমায়ূন আহমেদের মতোই ভোজন রসিক ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। বেহেশতি খাবারে ইলিশের নাম না থাকায় তিনি হতাশ হয়েছিলেন।

সম্রাট মুহাম্মদ বিন তুঘলকের ইলিশকাণ্ডের কথা লিখেছেন মুজতবা আলী। ইতিহাসে সম্রাট তুঘলক পাগলা রাজা হিসেবে পরিচিত। সেই তুঘলক গুজরাটে গেলেন বিদ্রোহীর দমন করতে। নৌকাবহর নিয়ে চলেছেন সম্রাট। এক বিকালে ঝকঝকে রুপালি এক মাছ লাফিয়ে নৌকায় উঠল। সম্রাট তক্ষুনি সেই মাছ কেটে রান্নার হুকুম দিলেন। কিন্তু এ জাতের মাছ তাদের কাছে অপরিচিত। আমির-উমরাহরা সেই মাছ খেতে বারণ করলেন। কিন্তু সম্রাটের সেই এক গোঁ। তার কথা, শাস্ত্রে যেহেতু এই মাছ খেতে বারণ নেই তিনি তা খাবেনই।

তারপর আর কী। সেই মাছ রান্না হলো। দারুণ তেলওয়ালা মাছ ছিল। কিন্তু সেই মাছ দিল্লিনিবাসী সম্রাটের পেটে সইলো না। পেট ছেড়ে দিল এবং খুব সম্ভবত সেই কারণেই তার মৃত্যু হলো।

সম্রাটের মৃত্যুতে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানি লিখলেন, এভাবে হুজুর তার অবাধ্য প্রজাকুলের হাত থেকে মুক্তি পেলেন, প্রজাকুলও হুজুরের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে বাঁচল।

সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষ্যমতে সম্রাট তুঘলকের খাওয়া সেই মাছ ছিল ইলিশ। অনেকেই হয়তো ইলিশ বলতে কেবল বঙ্গদেশকেই বুঝেন। তবে গুজরাটেও ইলিশ মিলে। সেখানে আবার নারী-পুরুষ ইলিশের নামও আলাদা। স্ত্রী ইলিশ মোদেন আর পুরুষ ইলিশ পালভা। কোনো এক জায়গায় পড়েছিলাম ইলিশের লিঙ্গ পরিচয় শনাক্ত করা খুবই শক্ত। গুজরাটে এই কাজ কীভাবে করে তাও এক প্রশ্ন।

মুজতবা আলীর ইলিশপ্রীতির আরও গল্প আছে। একবার ইলিশ নিয়ে পাঞ্জাবী এক অধ্যাপকের সঙ্গে তার তর্ক বাধে। মুজতবা আলীর মতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার হলো সরু চালের ভাত আর ইলিশ। অন্যদিকে, সেই অধ্যাপকের মতে বিরিয়ানিই শ্রেষ্ঠ। এই নিয়ে রাগ করে আলী সাহেব সেই অধ্যাপকের সঙ্গে সাতদিন কথা বলেননি। একেই বোধহয় প্রকৃত ইলিশপ্রেমী বলে।

সৈয়দ মুজতবা আলী। ছবি: প্রথম আলোর সৌজন্যে

ইলিশের রেসিপি দিয়েছেন মুজতবা আলীও। আস্ত ইলিশ মাঝে কেটে বাটা মশলা মেখে কলা পাতায় মুড়ে আগুনে সেঁকতে হবে। তার ভাষায়, এই মাছ দেবভোগ্য তো বটেই এবং এতটাই স্বাস্থ্যকর যে এক আস্ত কড়াই তিন কিলোর গোটা ইলিশ খেলেও কোনো রকম শরীর খারাপ হয় না।

তবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে ইলিশের আসল স্বাদ মিলবে দেড় কিলো থেকে পৌনে দেড় কিলো ওজনের মাছে। সুনীলও ইলিশের ভক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পদ্মার বুকে চষে বেড়ালেও ইলিশ নিয়ে তার সাহিত্যে তেমন আলোচনা নেই দেখে আক্ষেপ করেছিলেন সুনীল।

গরম তেলের মচমচে ইলিশ ভাজার কথা শুনলে জিভে জল আসবেই। সাহিত্যিক পরিমল গোস্বামী বলেছিলেন, ঈশ্বর বলেছেন যে আমাকে যেমনই ভজুক আমি তাকে তুষ্ট করি, আর আমাদের ইলিশ বলে যে আমাকে যেমন করেই ভাজুক, আমি তাকে তুষ্ট করি।

বাংলা সাহিত্য ঘাটলে ভাজা ইলিশ ছাড়াও ইলিশের হরেক পদের সন্ধান মিলে। কল্লোল লাহিড়ীর 'ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে' খুলনার মেয়ে ইন্দুবালা জোড়া ইলিশের তত্ত্ব নিয়ে কলকাতায় শ্বশুর বাড়ি যায়। বউভাতে নববধূ পুঁইশাকের সঙ্গে ইলিশের ছ্যাঁচড়া রান্না করে। ইন্দু তখনও জানে না পাড়ার লোকে তার দোজবর স্বামীকে 'ছ্যাঁচড়া' নামেই ডাকে। নতুন বউয়ের হাতের দারুণ স্বাদের রান্না খেয়ে বাসর ঘরে স্বামীর সোহাগ বেড়েছিল দ্বিগুণ।

কালীঘাটের পটচিত্র

মনসামঙ্গলেও ইলিশের একটি পদ পাওয়া যায়। তারকা তার নন্দাই লক্ষীন্দরের জন্য সরিষার শাক দিয়ে ইলিশের মাথা রান্না করেন। বাঙালি কোনো পরিবারে আদৌ সরিষার শাক দিয়ে ইলিশের মুড়ো রান্না হয় কি না, জানা নেই। অন্তত নেট ঘেটে এমন কোনো রেসিপি চোখে পড়ল না।

প্রাচীন পুঁথিতে অবশ্য ইলিশের বিবরণ তেমন মিলে না। মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যগুলোতে অন্যান্য মাছের বর্ণনা পাওয়া গেলেও ইলিশের চর্চা খুব একটা দেখা যায় না। মঙ্গলকাব্যগুলো সাধারণ মানুষের জীবন-নির্ভর। সম্ভবত সেই আমলেও ইলিশ ছিল বাদশাহী খানা। সাধারণ মানুষ তার স্বাদ নেওয়ার সুযোগ কমই পেত।

অন্নদামঙ্গলে ভারতচন্দ্রও বিভিন্ন মাছের বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে সর্বশেষ মাছটি ছিল ইলিশ। তবে রাজসভায় যাতায়াত ছিল বলেই সম্ভবত ভারতচন্দ্র ইলিশের স্বাদ জানতেন।

রাজা-বাদশাহদের ইলিশ নিয়ে মনে হয় একটু বেশিই আগ্রহ ছিল। এককালে ইলিশ কিনে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার মোড়ে মোড়ে লোকে ইলিশের দাম জিজ্ঞেস করত। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র একবার গোপালের সঙ্গে বাজি ধরলেন। বাজার থেকে ইলিশ নিয়ে লোকালয় হয়ে রাজ দরবারে ফিরতে হবে। তবে পথে কেউ ইলিশের দাম জিজ্ঞেস করলেই গোপাল হারবে। সইতে হবে ২৫ ঘা চাবুক।

গোপাল করলেন কী, ইলিশ হাতে ঝুলিয়ে পরনের ধুতি খুলে মাথায় পাগড়ি বাঁধলেন। ব্যস, লোকে আর তার কাছেও ঘেষল না। এভাবেই বাজির সঙ্গে টাকাও জিতে নিলেন।

নাসিরুদ্দিন হোজ্জার গোপাল ভাঁড়েও মিলবে ইলিশের গল্প। ছবি: সংগৃহীত

ইলিশের দাম নিয়ে প্রমথনাথ বিশীরও একটি গল্প আছে। ছাপোষা এক মাস্টারমশাই একবার শখের বশে ইলিশ কিনলেন। থলের ফাঁক দিয়ে মাছের লেজ গোঁফের মতো বেরিয়ে রইল। ট্রামে ভীষণ ভিড়। পা ফেলায় জায়গা নেই। কিন্তু ইলিশের লেজ অতো ভীড়েও নজর এড়াল না। উঠতে না উঠতেই লোকের দাম পুঁছা শুরু। নোবেল প্রফেশনের লোক যদিও মিথ্যা বলে না, তবে সেদিন ভাবের বশে মাস্টারমশাই দামখানা একটু কমিয়েই বললেন। আর যায় কোথায়। পরের স্টেশনে পুরো ট্রাম খালি। সবাই একযোগে উল্টো পথে বাজারের দিকে ছুটল। নিতান্ত কর্তব্যবোধ না থাকলে বোধহয় কন্ডাক্টরও যেত।

এই জায়গায় লেখক বলেন, 'কে বলে বাঙালিদের মধ্যে একতার অভাব! তবে তেমন উপলক্ষ্য তো চাই।' যা হোক, সেই মাছের কম দাম নিয়ে মাস্টারমশাইকে পরে আরও বহু হ্যাপা সামলাতে হয়েছিল। তবে ইলিশের প্রসঙ্গ আসলে যে বাঙালি এক একথা অনস্বীকার্য।

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের পটলডাঙার বাড়িতেও জমিয়ে ইলিশ রান্না হতো। একবার নারায়ণের বাড়িতে আরেক বিখ্যাত সাহিত্যিকের আগমন ঘটল। ঘড়িতে বেলা এগারোটা কি বারোটা। তাকে দেখে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বেজায় খুশি। ভদ্রলোক বললেন, পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম তাই এলাম। আধঘণ্টা পরেই চলে যাব।

নারায়ণ গিন্নি আশাদেবী বললেন, সেটা হবে না। আজ বাজার থেকে ইলিশ এসেছে। ইলিশ না খেয়ে যাওয়া চলবে না।

ইলিশের কথা শুনে খাদ্যরসিক মানুষটি রয়েই গেলেন। এদিকে ইলিশ ভোজন সেরে আয়েশ করে গল্প করতে গিয়ে বেলা সাড়ে চারটা। সময় খেয়াল হতেই তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়লেন। যাবেন শিয়ালদহ। ট্রামে চড়েও বসলেন। পেছন থেকে নারায়ণ হঠাৎ করেই চিৎকার করে উঠলেন, 'ও দাদা, ও যে হাওড়ার ট্রাম'।

ইলিশের খাতিরে যেখানে যাওয়ার কথা তার ঠিক উল্টো পথে রওনা দেওয়া বেখেয়ালি এই মানুষটি বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়।

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত

ইলিশ নিয়ে বুদ্ধদেব বসুও চমৎকার একটি কবিতা লিখেছেন-

'রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে

জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি রাশি ইলিশের শব।'

ইলিশ নিয়ে বেশি ভাব-গাম্ভীর্যপূর্ণ আলোচনায় যেতে চাই না। এরচে বরং ইলিশের ছড়া শোনা যাক। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে ইলিশের একটি ছড়া জনপ্রিয় স্লোগানে পরিণত হয়-

'ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা,

বোয়াল মাছের দাঁড়ি

ইয়াহিয়া খান ভিক্ষা করে

শেখ মুজিবের বাড়ি।'

ইলিশ মাছের কাঁটা আদৌ কয়টি তা গুণতে বসলে খবর হয়ে যাবে। তাই কবি নির্মলেন্দু গুণের কাহিনী দিয়ে শেষ করি। কবি তখন তরুণ। রাতের ঢাকা দাপিয়ে বেড়ান। এক গভীর রাতে পুলিশের খপ্পড়ে পড়লেন। পুলিশ তো থানায় চালান দিতে তৈরি। কবি বললেন, আমায় নিয়ে কেন টানাটানি করছেন। আমি এক নিরীহ কবি। কিন্তু পুলিশ এত সহজে মানতে নারাজ। জিজ্ঞেস করল, আপনি কবি তার প্রমাণ কী? নির্মলেন্দু গুণ এক মুহূর্ত দেরী না করে দুলাইন শুনিয়ে দিলেন- মাছের রাজা ইলিশ, মানুষের রাজা পুলিশ। ব্যস আর যায় কোথায়, পুলিশ তো ডগমগ খুশি। এভাবেই ইলিশের কল্যাণে কবি ছাড়া পেলেন।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.