আরব ও ইসলামে পশুপাখির অবস্থান

ইজেল

04 September, 2020, 11:40 pm
Last modified: 13 September, 2020, 11:14 pm
ইসলামি শিল্প সংস্কৃতিতে সরাসরি পশুপাখির চিত্র থাকে না। মুসলিম সভ্যতার বৈশিষ্ট্য হলো বিমূর্ত চিত্র অংকন। আরব সমাজ সংস্কৃতিতে পশুপাখির গুরুত্ব ফুটে ওঠে তাদের সাহিত্যে, দৈনন্দিন জীবনে এবং জাদুটোনায় ব্যবহৃত পশুর মর্যাদার উপর ভিত্তি করে। উমাইয়া খিলাফতের প্রথম থেকেই পশুর ছবি আঁকা হতো এবং এসব ছবি ব্যবহৃত হতো রাজকীয় শান শওকত বোঝাতে। সিংহ এবং শিকারী পাখিদের প্রতীক হিসেবে নেয়া হতো রাজকীয় ভবনের সাজসজ্জায় খুব স্বাভাবিকভাবেই।

ইসলামে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ রাত হলো লাইলাতুল কদর(ভাগ্য রজনী), যে রাতে কুরআন অবতীর্ণ হয় এবং লাইলাতুল ইসরা বা মিরাজ(মুহাম্মদ সাঃ এর রাত্রিকালীন সফর, মক্কা থেকে জেরুজালেম এবং তাঁর উর্ধাকাশে গমন)। এই অভূতপূর্ব সফরে মুহাম্মাদ সাঃ এর পক্ষে কিভাবে সম্ভব হয়েছিল চোখের পলকে মক্কা থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া?

অনেক ঐতিহাসিক এবং মুফাসসির বর্ণনা করেছেন, এই রাতে রাসুলুল্লাহ সাঃ বুরাক নামক একটি প্রাণীতে সওয়ার হয়ে সফর করেছিলেন। এই বাহনটি তাঁকে নিয়ে এক নিমিষে এই দুরত্ব অতিক্রম করেছিল।

তাসফীরকারকদের মতে এই বুরাক এক ধরণের ঘোড়া যা খচ্চর এবং গাধার মাঝামাঝি দেখতে। কেউ কেউ বলেন সাদা রঙের এই প্রাণীটির পিঠটি চওড়া এবং লম্বা কান বিশিষ্ট ছিল।

প্রতীকী রূপে চিন্তা করা বুরাক

পরবর্তীতে বুরাকের ধারণা আরো উন্নতরূপ লাভ করে এবং প্রতীকী চরিত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বহুমতের মধ্যে এমন ধারণাও পাওয়া যায় যে বুরাকের মুখটি ছিল মানুষের মতো দেখতে।

আব্বাসীয় যুগের প্রখ্যাত সাহিত্যিক আল জাহিয, যিনি কিতাবুল হাইওয়ান বা পশুপাখি সম্পর্কিত গ্রন্থে লিখেছেন, মাকড়সার বিস্ময়কর কিছু বিষয় আছে। কোনো রকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই সে নিখুঁতভাবে জাল বুনতে পারে।

আমরা হাদিসের বর্ণনায় পেয়েছি একটি মাকড়সার কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিপদ এড়াতে পেরেছিলেন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের সময়। সফরসঙ্গী আবুবকর রাঃ কে নিয়ে গোপনে যাবার পথে তাঁরা এক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেন, এমন সময় একটি মাকড়সা সে গুহার মুখে জাল বিস্তার করে। তাঁদের পিছু ধাওয়া করে আসা কুরাইশরা যখন সে গুহার কাছে আসে তখন মাকড়সার জাল দেখে নিশ্চিত হয় সেখানে কেউ লুকিয়ে নেই। কারণ জাল না ছিঁড়ে তো কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। এই পতঙ্গটির নাম কুরআনেও উল্লেখ করা হয়েছে এবং কুরআনের ২৯ নাম্বার সুরাটির নামকরণ করা হয়েছে আনকাবুত বা মাকড়সার নামে।
 
ইসলাম আগমনের পরেও আরবে ঘোড়া, উট এবং ছাগলের মতো গৃহপালিত পশু খুব প্রয়োজনীয় ছিল। মোরগকে উদারতা, সরীসৃপ অনিষ্টকারী, বুস্টার্ড পাখি বোকামী আর সিংহকে সাহসের প্রতীক মনে করা হতো। বিখ্যাত অনেক আরব ও তুর্কি গোত্রের নাম পশুপাখির নামে। যেমন আসাদ(সিংহ), কালব(কুকুর), এবং কুরাইশ(হাঙর)। অনেক পশুপাখিকে শয়তানের প্রতিরূপ মনে করা হতো কুসংস্কারবশত।

পারস্যের শামস আল দিন ইবনে জিয়া আল-দিন আল জুসকির আঁকা উট, ১২৯৭

বিভিন্ন রূপকথার গল্প থেকে এসেছে সাধকব্যক্তিরা পশুপাখির রূপ ধারণ করে তাদের অলৌকিক শক্তিমত্তা প্রকাশ করতেন। অনেক পশুপাখি ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সাথে থেকে তাদের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নিতো এমন গল্পের সংখ্যাও অসংখ্য। এখনো বহু পশুপাখির নাম আসে যাদুটোনা বিদ্যার কাজে। আরবের বহু জ্ঞানীগুণী স্বপ্নে পশুপাখি দেখার ব্যাখ্যা নিয়ে বই লিখেছেন।

 আরবের বিস্তৃর্ণ মরুভূমি নিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প প্রচলিত আছে। মরুভূমির গুল বা গরিলা জাতীয় প্রাণী যার রূপ ধরে জীনরা মানুষের সামনে আসে। ইসলামপূর্ব যুগে আরবে জীন নারী ও পুরুষকে পরী ও দৈত্য মনে করা হতো। তাদের জগত মানুষের কাছে খুবই ভয়ঙ্কর ছিলো। এই জীন পরীরা  আরবি সাহিত্যে জনপ্রিয় চরিত্র। বিশেষ করে আরব্য রজনী খ্যাত আলফু লায়লা ও লায়লাতে জীন শক্তিশালী চরিত্র। এরা কখনো বানর, বিড়াল বা কুকুরের রূপ ধরে মানুষের ক্ষতি করেছে এ কাহিনীতে। গুল নামক প্রাণীটি বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারে এবং মরুভূমি সফররত ব্যক্তিদের ধোঁকা ও ক্ষতি করার জন্য আকর্ষণীয় রূপ ধারণ করে থাকে। তবে তাদের ঘোড়ার খুরের মতো পা কখনো পাল্টাতে পারেনা। এটাই তাদের সনাক্ত করার উপায়।

কিতাব আল হাইয়ানের প্রাণী

এ রকম আশ্চর্য ক্ষমতাধর পাখিদের মধ্যে আনকা, রক এবং বা হুমা পাখি অন্যতম। এই পাখিগুলোর উল্লেখ আছে জনপ্রিয় সব লোকগাঁথায়। বিভিন্ন উপকথায় আনকার উপস্থিতি দেখা যায়। এ পাখিকে ফিনিক্স পাখির সাথে তুলনা করা যায়। কুরআনে বর্ণিত আসহাবে রাস বা কূপওয়ালা জাতির ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে এই পাখির নাম। এ পাখি এই দুর্ভাগা জাতির ভাগ্যে এসেছিল মহামারীর কারণ হয়ে। এ সম্প্রদায়ের নবী হানযালা বিন সাফওয়ান তাদের উদ্ধার করেছিলেন এই অভিশাপ থেকে। ইসলামি যুগে এই আনকা পাখিকে হুমা পাখি বলা হয়েছে। এই হুমা পাখি পারস্য উপকথা অনুসারে গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র পাখি। 

উত্তর আফ্রিকার মুসলিম সমাজে পশুপাখির গল্প তাদের শিল্পসংস্কৃতির বিরাট অংশ জুড়ে আছে। এই গল্পগুলো কথ্যরূপেই যুগে যুগে টিকে আছে। এ গল্পগুলোর প্রধান চরিত্র হয়ে আছে ইবনে আওয়া নামে একটি প্রাণী, যে অর্ধেক শেয়াল আর অর্ধেক নেকড়ে।

নবম শতাব্দীতে ইয়াহিয়া বিন বিতরিক এরিস্টটলের হিস্টরিয়া এ্যানিমালিয়াম আরবিতে অনুবাদ করেন কিতাব আল হাইওয়ান নামে। এর আগে প্রাণীবিদ্যা মুসলিম বিজ্ঞানীদের কাছে প্রিয় কোনো বিষয় ছিলো না। জ্ঞান বিজ্ঞানের বহুবিষয় নিয়ে ব্যাপক চর্চা হলেও প্রাণীবিদ্যা ছিল উপেক্ষিত। পরবর্তীতে প্রাণীবিদ্যা গুরুত্বের সাথে চর্চিত হতে থাকে মুসলিম বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে। ইবনুল ফারাবীর ইলমুন নাফস বা আত্মার জ্ঞান নামক বইটি এ ধরনের জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রকে উন্নত করে। পরিকল্পিত গবেষণা এবং এ বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য উপাত্তের অভাবে মুসলিম বিজ্ঞানীরা প্রাণীবিদ্যাতে অগ্রসর হতে পারেননি। আল জাহিযের অসামান্য সৃষ্টি আট খণ্ডের কিতাবুল হাইওয়ানে প্রায় ৩৫০ প্রজাতির পশুপাখির উল্লেখ আছে। তবে এটা কোনো প্রাণীবিদ্যার বই নয় বরং প্রচলিত লোকগাঁথার সংকলন যা ধর্মীয় বই বলেই বেশি পরিচিত। জাহিযের বই এর মতো একই ধরণের বই সংকলন করেন মিশরের মুসা আল দামিরি চতুর্দশ শতাব্দীতে। ৯৩১ প্রজাতির পশুপাখি নিয়ে রচিত এই বিশাল আকারের বইয়ের নাম হায়াত আল হাইয়ান বা পশুপাখির জীবন। 

আল জাহিয (৭৭৬-৮৬৮) দার্শনিক, কবি, জীববিজ্ঞানী। তাঁর কিতাব আল হাইয়ানের কুমির।

আরব মুসলিম চিকিৎসক, প্রকৃতিবিদরা পশুপাখির প্রতি আগ্রহী হলেও এ সংক্রান্ত বইয়ের অভাব ছিল। পশুপাখির মধ্যে শুধুমাত্র ঘোড়াবিদ্যা এবং ঘোড়ার রোগ সংক্রান্ত জ্ঞান নিয়েই বিস্তারিত গবেষণামূলক কাজ হয়েছে। আর পাখিবিদ্যা নিয়েও গবেষণা হয়েছে মূলত বাজ পাখিকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য।

নানা প্রজাতির পশুপাখির উল্লেখ পাওয়া যায় ইসলাম পূর্ব যুগের আরবি কবিতায়। ইসলাম আসার পরেও উট এবং ঘোড়ার বর্ণনা আরবি কবিতায় আবশ্যিক ছিল। গৃহপালিত পশু যেমন ছাগল, বিড়াল এবং পোষা পাখি নিয়ে চমৎকার সব কবিতা রচিত হয়েছে আরবিতে। পরের শতাব্দীগুলোতে কাক এবং সিংহ আরবি কবিতার জনপ্রিয় বিষয় হয়ে ওঠে। আরবদের কাছে কাক হয়ে ওঠে বিচ্ছেদের, যন্ত্রণার প্রতীক আর সিংহ  দুঃসাহস আর বীরত্বের।

কিতাব আল বুলহান, বুক অফ ওয়ান্ডারস , চৌদ্দ শতকের শেষভাগের

আরবি গদ্যেও পশুপাখি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কালিলা ওয়া দিমনা আরবি সাহিত্যে খুবই জনপ্রিয় একটি নীতি গল্পের বই। যা মূলত সংস্কৃতি থেকে ফার্সি, পরে ফার্সি থেকে আরবিতে রূপান্তরিত। ভারতীয় এই বইটি একক কারো রচিত নয়। কালিলা ও দিমনা দুইজন বুদ্ধিমান শেয়ালের নাম। এই বইয়ের মাধ্যমে রাজপুত্রদের জ্ঞান প্রজ্ঞা শিক্ষা দেয়া হতো চমৎকার সব গল্পের মাধ্যমে। গল্পের চরিত্র কোনো মানুষ নয়, পশুপাখির মুখেই বলা হয়েছে আকর্ষণীয় গল্পগুলো। এ ধরনের রচনা আরবে একেবারেই নতুন ছিল। আরবের বহু মুসলিম কবি লেখক এবং চিত্রকর পরে নতুন এ ধারায় আগ্রহী হয়ে জনপ্রিয় সাহিত্য করেছেন।

ইসলামি শিল্প সংস্কৃতিতে সরাসরি পশুপাখির চিত্র থাকে না। মুসলিম সভ্যতার বৈশিষ্ট্য হলো বিমূর্ত চিত্র অংকন। আরব সমাজ সংস্কৃতিতে পশুপাখির গুরুত্ব ফুটে ওঠে তাদের সাহিত্যে, দৈনন্দিন জীবনে এবং জাদুটোনায় ব্যবহৃত পশুর মর্যাদার উপর ভিত্তি করে। উমাইয়া খিলাফতের প্রথম থেকেই পশুর ছবি আঁকা হতো এবং এসব ছবি ব্যবহৃত হতো রাজকীয় শান শওকত বোঝাতে। সিংহ এবং শিকারী পাখিদের প্রতীক হিসেবে নেয়া হতো রাজকীয় ভবনের সাজসজ্জায় খুব স্বাভাবিকভাবেই।

মালিক আসাদের চৌদ্দ শতকে রচিত বুক অফ ওয়ান্ডার্সের জীনের সর্দার

ইরান, ইরাক এবং মিশরে পশুপাখির চিত্রণ খুবই জনপ্রিয় হয় পরবর্তীতে। উসমানীয় খিলাফতের সময় তুরস্কেও এ সংস্কৃতি চালু হয়। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিচ্ছবি, শিকার করার ছবি, পশু পাখিকে প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতার ছবি খুব স্বাচ্ছন্দ্যেই আঁকা হতো।

মুসলিম চিত্রকর ও ক্ষুদ্রচিত্রকররাও পশুপাখি চিত্রিত করেছেন অর্থপূর্ণ ভাবে, অভিনব সব নকশায়-- যার সাথে বাস্তব চিত্রের সাদৃশ্য নেই বললেই চলে।

সূত্র: ইউনেস্কো কুরিয়ার

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.