আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে

ইজেল

27 February, 2021, 09:25 am
Last modified: 27 February, 2021, 09:23 am
মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে জোরদার ম্যাগনেটোস্ফেয়ার না থাকায় সৌর কণা ও মহাজাগতিক রশ্মি সহজেই মঙ্গলের পৃষ্ঠদেশে চলে আসে। এটি জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। মঙ্গলে স্বাভাবিক মানুষের অবস্থান কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ তা বোঝাতে এটা বলাই যথেষ্ট যে সেখানকার বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড ৯৫ ভাগ, নাইট্রোজেন ৩ ভাগ, আর্গন ১.৬ ভাগ অন্যান্য গ্যাসসহ অক্সিজেন ০.৪ ভাগ। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন ২১ ভাগ আর কার্বন ডাই অক্সইড ০.০৪ ভাগ। তাপমাত্রা গরমে ৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড যেমন হাতে পারে ঠান্ডায় তা নেমে মাইনাস ৮৭ ডিগ্রিও হতে পারে। মঙ্গলে মেঘ বৃষ্টি নেই, তবে ধুলোর ঝড় লেগেই আছে।

এখন আনন্দলোকের বন্দনাও নয়, রবীন্দ্রনাথের গুণকীর্তনও নয়, এবার রেড অইডের অক্সাডের আধিক্যে লালচে রঙ ধরা পাথুরে শীতল মঙ্গল গ্রহের কথা লিখতে হবে। এই নিবন্ধে মঙ্গল মানে  নেহায়েতই মঙ্গল গ্রহ, কল্যাণ নয়, মঙ্গলবারও নয়।

৪১১ বছর আগে ১৬১০ সালে টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে মঙ্গলগ্রহ দেখলেন সে যুগের শ্রেষ্ঠ মহাকাশ বিজ্ঞানী মহামতি গ্যালিলি গ্যালিলিও। কিন্তু তারও প্রায় ৪ হাজার বছর আগে মিশরীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মঙ্গল পর্যবেক্ষণ করেছেন। ৩ হাজার বছর আগে চীনের 'ঝু' রাজত্বে প্রণীত মহাকাশ দলিলে মঙ্গলের উপস্থিতি রয়েছে। খ্রিস্টজন্মের সাড়ে ৬শ' বছর আগে গ্রিক দার্শনিক প্ল্যাটো পৃথিবীর নিকটবর্তী যে সব গ্রহ নক্ষত্রের উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে চাঁদ সূর্য ভেনাস মার্স বা মঙ্গল জুপিটার ও স্যাটার্ন বা শনির নাম ছিল। তার সুযোগ্য ছাত্র এরিস্টোটল খ্রিষ্টজন্মের ৩৫৭ বছর আগে মে মাসের ৪ তারিখে আকাশটা ভালো করে দেখেশুনে লিখলেন, পৃথিবী থেকে চাঁদের যা দূরত্ব মঙ্গলের দূরত্ব তার চেয়ে অনেক বেশি। তিনি যে ইঙ্গিত দিলেন তাতে মনে হয় এ ধরনের আকাশবাসীরা একই গতিতে আবর্তিত হয়, কিন্তু দ্বিতীয় শতকে রোমানদের শাসনাধীন মিশরের বিজ্ঞানীরা এরিস্টোটলকে নাকচ করে বললেন, তারা নিজস্ব গতিতে ঘুরে, মঙ্গলের বেলায় কক্ষের একদিকে হেলে ৪০ ভাগ অধিক গতিতে ঘুরে। ১৫৪৩ সালে আধুনিক জ্যেতির্বিদ্যার জনক কোপার্নিকাস দেখালেন সূর্যটা আসলে পৃথিবী কিংবা মঙ্গল কিংবা জুপিটারের মতো নয়; তারা বরং নিজেদের গতি নিয়ে সূর্যের চারদিকে ঘুরে। 

পৃথিবী ও মঙ্গলগ্রহের কক্ষপথ

কিন্তু পৃথিবী কেনো ঘুরতে যাবে? এই জ্ঞান পুরোহিতদের বিশ্বাস ও ধর্মচর্চার পরিপন্থী, এ তো রীতিমতো ধর্মদ্রোহিতা, তারা চটে গেলেন। সে বছরই ২৪ মে ধর্মদ্রোহী কোপার্নিকাস মৃত্যুবরণ করায় চার্চের পুরোহিতদের হাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করার হাত থেকে বেঁচে গেলেন। 

জোহানেস কেপলার এসে গ্রহসমূহের আবর্তনের তত্ত্ব দিলেন।

গ্যালিলিও যে টেলিস্কোপে মঙ্গল দেখলেন তা এতোই পুরোনো ধাচের যে তা পৃষ্ঠদেশের বিস্তারিত দেখতে সক্ষম ছিল না। ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ও পুরোহিতদের উন্মাদনার মধ্যেই জিওভান্নি ডোমিনিকো ক্যাসিনি ১৬৬৬ সালে আবিষ্কার করলেন মঙ্গলের নিজ বৃত্তপথে পুর্ন ঘুর্ণনকাল ২৪ ঘন্টা ৪০ মিনিট। ১৭৭৭ সালে উইলিয়াম হার্শেল সঙ্গীতজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী মঙ্গলের অনেক খাটি বর্ণনার সাথে সেখানকার মহাসাগরের বর্ণনাও দিলেন। মঙ্গলের যে অংশ অন্ধকার মনে হয়েছে, সেই অংশকে মহাসাগর মনে করেছেন। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই মঙ্গলের মানচিত্র প্রণয়ন শুরু হল। ১৮৭৭ সালে ইতালিয় বিজ্ঞানীর জিওভান্নি শিয়াপারেল্লি ২২ সেন্টিমিটার টেলিস্কোপ ব্যবহার করে অপটিক্যাল ইল্যুশন বা দৃষ্টি বিভ্রমের কারণে অনেক খাল দেখলেন এবং তা এঁকেও দেখালেন। টেলিস্কোপের উন্নয়ন হলো নতুন নতুন অবজার্ভেটরি সৃষ্টি হলো, রিমোট সেন্সিং বিকশিত হলো। পৃথিবীর মানুষ মায়াবী মঙ্গলালোকের পাশাপাশি মূর্ত সত্যও জানতে শুরু করল। প্রতিবেশীকে জানতেই হয়, মঙ্গলকে কেনো নয়।

সৌরজগত সূর্যের পরিবার, পৃথিবীর নিকটতম প্রতিবেশী মঙ্গল

মঙ্গলের সৌর দিবস আর পৃথিবীর সৌর দিবস সবচেয়ে কাছাকাছি। মঙ্গলের বেলায় ২৪ ঘন্টা ৩৯ মিনিট ৩৫.২৪ সেকেন্ড। মঙ্গলের পৃষ্ঠদেশের আয়তন পৃথিবীর ২৮.৪ ভাগ- পৃথিবীর শুকনো অঞ্চলের সামান্য কম। পৃথিবীর বেলায় শুকনো অঞ্চল ২৯.২ ভাগ, বাকীটা সাগর। মঙ্গলের ব্যাসার্ধ পৃথিবীর অর্ধেক আর ওজন পৃথিবীর এক দশমাংশ। মঙ্গল তার কক্ষে ২৫.১৯ ডিগ্রি ঝুঁকে থাকে আর পৃথিবীর বেলায় তা ২৩.৪৪ ডিগ্রি। মওসুম বদল মঙ্গলে ঘটে, তবে প্রতিটি মওসুম দীর্ঘকালীন। মঙ্গলের পৃষ্ঠদেশে মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর ৩৮ ভাগ। সুতরাং মঙ্গলে বস্তুর ওজনও আনুপাতিক। মঙ্গলের পৃষ্ঠদেশ সম্পর্কে একালের বিজ্ঞানীরা অনেক জানেন কিন্তু তলদেশের অবস্থা কেমন তা এখনো জানা হয়ে উঠেনি। 

মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে জোরদার ম্যাগনেটোস্ফেয়ার না থাকায় সৌর কণা ও মহাজাগতিক রশ্মি সহজেই মঙ্গলের পৃষ্ঠদেশে চলে আসে। এটি জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। মঙ্গলে স্বাভাবিক মানুষের অবস্থান কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ তা বোঝাতে এটা বলাই যথেষ্ট যে সেখানকার বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড ৯৫ ভাগ, নাইট্রোজেন ৩ ভাগ, আর্গন ১.৬ ভাগ অন্যান্য গ্যাসসহ অক্সিজেন ০.৪ ভাগ। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন ২১ ভাগ আর কার্বন ডাই অক্সইড ০.০৪ ভাগ। তাপমাত্রা গরমে ৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড যেমন হাতে পারে ঠান্ডায় তা নেমে মাইনাস ৮৭ ডিগ্রিও হতে পারে। মঙ্গলে মেঘ বৃষ্টি নেই, তবে ধুলোর ঝড় লেগেই আছে। 

সৌরজগত সূর্যের পরিবার, পৃথিবীর নিকটতম প্রতিবেশী মঙ্গল

মঙ্গলের মহাসাগর

১৭৮৪ সালে সেকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাকাশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম ফ্রেডেরিখ হার্শেল (১৭৩৮-১৮২২), টেলিস্কোপে নিজের চোখে দেখে মঙ্গল গ্রহে যে মহাসাগর রয়েছ তা নিশ্চিত করেছেন। শুধু মুখে বলেননি, বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে লিখিতভাবে জানিয়েছেন। উইলিয়াম হার্শেল একইসঙ্গে দেশের নামকরা মহাকাশ বিজ্ঞানী ও মিউজিশিয়ান। সুরস্রষ্টা হিসেবে তিনি মহান জার্মান শিল্পীদের কাছাকাছি নাম। পৃথিবীর প্রথম বৃহত্তম টেলিস্কোপেরও তিনি নির্মাতা। জন্ম জার্মানিতে হলেও ব্রিটিশ নাগরিক; ইউরেনাস নামের সৌরজগতের সপ্তম গ্রহটির তিনিই আবিষ্কারক। এছাড়া অনেকগুলো উপগ্রহ- টিটানিয়া, ওবেরন, মিরান্ডা, আমব্রিয়েল, ডেসডিমোনা, ক্রেসিডা, এরিয়েল এবং আরো বেশ ক'টারও তিনিই আবিষ্কারক। তিনি যখন মহাসাগর দেখেছেন এ কী আর মিথ্যে হতে পারে। তার সেই বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের অনেক কিছুই সঠিক, বিশেষ করে মঙ্গলের অক্ষীয় বাঁক ৩০ ডিগ্রি (অবশ্য একালের অত্যাধুনিক টেলিস্কোপে এই মাপটি ২৫.১৯ ডিগ্রি)। ১৮০০ শতকের প্রায় পুরোটাই হার্শেল হাইপোথিসিসের উপর নির্ভর করেছে। উন্নত টেলিস্কোপে আরো নিবিড় ভাবে তাকিয়ে আরো শতবর্ষ পর বিজ্ঞানীরা বের করলেন স্যার হার্শেল ভুল করেছিলেন, তার টেলিস্কোপে যে অংশটা অন্ধকার দেখা গেছে তিনি সেটাকে মহাসাগর মনে করেছেন। আসলে তা শুকনো অঞ্চল।

এ কালের বিজ্ঞানীরা ঠিক সাগর না হলে জমাট বাধা বরফ পেয়েছেন। রুশ মহাকাশ প্রকৌশলী সের্গেই করোলেভের নামে চিহ্নিত প্রায় চতুর্ভুজ আকৃতির করোলেভ ক্রেটারে ২২০০ ঘন কিলোমিটার বরফ পেয়েছেন। বিংশ শতকের বিজ্ঞানীরা সবাই একমত হয়েছেন যে, মঙ্গলগ্রহ পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি শুকনো এবং অনেক বেশি শীতল। মঙ্গলে সনাক্ত করা বরফের পরিমাণ ৫ মিলিয়ন ঘন কিলোমিটার। মঙ্গল পৃষ্ঠদেশের আরো বেশি গভীরে বিপুল পরিমাণ বরফ রয়েছে বলে মনে করা হয়। মঙ্গলে জীবনের অস্তিত্ব আছে কিনা কিংবা জীবনের উপযোগী গ্রহ কিনা তা জানতে পানি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা অনিবার্য। একবিংশ শতকে নাসার অভিযান 'ফলো দ্য ওয়াটার' কেন্দ্রিক।

মাঙ্গলিক ধাপ্পা

মার্স হোয়াক্স-এর ভালো  কোনো বাংলা শব্দ খুঁজে পেলাম না। ২০০৩ সালে বৈজ্ঞানিক গাণিতিক বিশ্লেষণসহ একটি ই-মেইল অনেকেই পেয়েছেন, ই-মেইলের সূত্র ধরে খবরের কাগজের ছাপা হয়েছে ২৭ আগস্ট ২০০৩ মঙ্গল গ্রহকে আকাশে পূর্ণ চাঁদের মতো বড় দেখা যাবে। কারণ তখন মঙ্গল পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে চলে আসবে। দুটি গ্রহের দূরত্ব ৫৫,৭৫৮,০০০ কিলোমিটার, সে সময় তা হ্রাস পেয়ে ৫৫,৭১৮,০০ কিলোমিটারে নেমে আসবে।

পৃথিবী ও মঙ্গল উভয় গ্রহই প্রায়ই একই সমতলে সূর্যের চারদিকে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে। ভ্রমণ কালে নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব সূর্য প্রদক্ষিণে সময়ের ভিন্নতার কারণে কমে আসে এবং বেড়ে যায়। যখন দুই গ্রহ সূর্যের কক্ষে উপবৃত্তের বিপরীত দিকে অবস্থান করে তখন দূরত্ব সবচেয়ে বেশি। ই-মেইলের তথ্যের আংশিক সঠিক, আংশিক ভ্রান্ত। ৬০০০০ বছরে এমন ঘটনা একবার ঘটে এটা সত্যি নয়, আর খালি চোখে যদি চাঁদের সমান দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে পৃথিবী, চাঁদ সব লণ্ডভন্ড হয়ে যাবে--এমনিতে মঙ্গল মহাকাশে একটি বিন্দুর চেয়ে বড় কিছু মনে হয় না, চাঁদের চেয়ে দ্বিগুণ ব্যাসার্ধে এবং নয় গুণ ওজনের মঙ্গল এতোটা কাছে আসতে হলে কক্ষচ্যুত হয়ে ছুটতে হবে, জোয়ার ভাটা মাধ্যাকর্ষণ সব মিলিয়ে পৃথিবীতে একটি ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে যাবে। তারপরও মানুষ ক্যালেন্ডারে টিক দিয়ে দিনটির জন্য বসে ছিল। নাসা  (ন্যাশনাল এরোনোটিক্স অ্যান্ড স্পেস এডমিনিস্ট্রেশন) বলেছে মঙ্গল নিয়ে এরকম আরবান মিথ বিশ্বাস করতে নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটবর্তী গ্রহ হলেও দেখা যাবে যখন মঙ্গল অভিযান চালানো হয়, যখন স্পেস ক্রাফট মঙ্গলের পৃষ্ঠদেশে গিয়ে নামবে তখন যেন পৃথিবীর সাথে দূরত্বটা কম থাকে, নতুবা ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে, সময়ও বেশি লাগবে। আর মঙ্গলকে সত্যি চাঁদের মতো বড় দেখালে বুঝতে হবে পৃথিবী আর আগের অবস্থায় নেই, সৌরজগত লণ্ডভন্ড হয়ে গেছে।

২০০৩-এর পরও মাঙ্গলিক ধাপ্পা আরও কয়েকবার এসেছে, সঙ্গত কারণেই এখন ধাপ্পা ধরা পড়তে বেশি সময় লাগছে না। 

মঙ্গলযাত্রা

সবটাই যে মঙ্গলজনক ছিল এমন নয়। বহু অমঙ্গল পেরিয়ে এ পর্যন্ত এসেছে মানুষের মঙ্গলাভিযান। মহাকাশে শুরুটা যেমন তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের, মঙ্গলেরটাতেও তাদেরই হাকডাক ছিল। অভিযানের একটি সার সংক্ষেপ উপস্থাপন করা হলো:

কেইপ কার্নিভাল থেকে পারসিভিয়ারেন্স উৎক্ষেপনের ৩০ জুলাই ২০২০

১৯৬০ মার্সনিক ১ (১০ অক্টোবর) উৎক্ষেপিত সোভিয়েত মহাকাশযান পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছেনি।  

১৯৬৯ মার্সনিক ২ (১৪ অক্টোবর) সোভিয়েত, পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছেনি।

১৯৬২ স্পুটনিক ২২ (২৪ অক্টোবর) সোভিয়েত, কেবল পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছে। 

১৯৬২ মার্স ১ (১ নভেম্বর) সোভিয়েত, ১০৬ মিলিয়ন কিলোমিটার পর রেডিও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

১৯৬২ স্পুটনিক ২৪ (৪ নভেম্বর) সোভিয়েত, কেবল পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছে।

১৯৬৪ মেরিনার ৩ (৫ নভেম্বর) যুক্তরাষ্ট্র, যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে ব্যর্থ।

১৯৬৪ মেরিনার ৪ (১৮ নভেম্বর) যুক্তরাষ্ট্র, প্রথম সাফল্য, মঙ্গলের কক্ষে প্রবেশ ২১টি ফটোগ্রাফ পাঠায়।

১৯৬৪ জন্ড ২ (৩০ নভেম্বর), জন্ড ৩ (১৮ জুলাই ১৯৬৫)  সোভিয়েত, মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশ করে কিন্তু রেডিও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

১৯৬৯ মেরিনার ৬ (২৪ ফেব্রুয়ারি) যুক্তরাষ্ট্র, ৩১ জুলাই মঙ্গলের কক্ষপথে ঢুকে, ৭৫টি ফটোগ্রাফ পাঠায়।

১৯৬৯ মেরিনার ৭ (১৭ মার্চ) যুক্তরাষ্ট্র, ৫ আগস্ট কক্ষপথে ঢুকে, ১২৬টি ফটোগ্রাফ পাঠায়।

১৯৬৯ মার্স এ (২৭ মার্চ) সোভিয়েত, পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছেনি। 

১৯৬৯ মেরিনার ৮ (৮ মে) যুক্তরাষ্ট্র, উৎক্ষেপনঞ্চালেই ব্যর্থতা।

১৯৭১ কসমস ৪১৯ (১০ মে) সোভিয়েত, কেবল পৃথিবীর কক্ষে প্রবেশ করে।

১৯৭১ মার্স ২ (১৯ মে) সোভিয়েত, মার্স অর্বিটার ও  লেন্ডার পৌঁছে, কিন্তু লেন্ডার জ্বলে যায়।

১৯৭১ মার্স ৩ (২৮ মে) সোভিয়েত, মঙ্গলের পৃষ্ঠদেশে পৌঁছে, ২০ সেকেন্ড পর ধ্বংস হয়ে যায়।

১৯৭১ মেরিনার ৯ (৩০ মে) যুক্তরাষ্ট্র, ৭৩২৯টি ফটোগ্রাফ পাঠায়। 

১৯৭৩ মার্স ৪ (২১ জুলাই) সোভিয়েত, মার্স অর্বিটার ব্যর্থ হয়। মার্স ৫, মার্স ৬, মার্স ৭ ব্যর্থ হয়।

১৯৭৫ ভাইকিং ১ (২০ আগস্ট), ভাইকিং ২ (৯ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্র, উভয়ই সফল। ভাইকিং ১-এর ল্যান্ডার ১৯৭৬-১৯৮২ এবং ভাইকিং-২ এর ল্যান্ডার ১৯৭৬-১৯৮০ কার্যকরী ছিল। ৫০,০০০ ফটোগ্রাফ পাঠিয়েছে।

১৯৮৮ ফোবোস ১ (৭ জুলাই) ফোবোস ২ (১২ জুলাই) সোভিয়েত, অর্বিটার ও ল্যান্ডারের হদিস হারিয়ে যায়।

১৯৯২ মার্স অবজার্ভার (২৫ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্র মঙ্গলে পৌঁছার আগমুহূর্তে মহাকাশযানের হদিস হারিয়ে যায়।

১৯৯৬ মার্স ৯৬ (১৬ নভেম্বর) রাশিয়া, রকেট ফেলিউর।

১৯৯৬ মার্স পাথ ফাইন্ডার (৪ ডিসেম্বর) যুক্তরাষ্ট্র, গ্রাউন্ড স্টেশনের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

১৯৯৮ নোজোমি (৪ জুলাই) জাপান, মার্স অর্বিটার কক্ষে ঢুকতে ব্যর্থ।

১৯৯৯ মার্স পোলার/ডিপ  স্পেস ২ (৩ জানুয়ারি) যুক্তরাষ্ট্র পৌঁছার পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ।

২০০১ মার্স অডেসি (৭ মার্চ) যুক্তরাষ্ট্র, ৩৫০.০০০ ফটোগ্রাফ পাঠায়।

২০০৩ মার্স এক্সপ্রেস/বিগল ২ (২ জুন) পৌঁছার পর ল্যান্ডার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

২০০৩ মার্স এক্সপ্লোরেশন রোভার স্পিরিট (১০ জুন) যুক্তরাষ্ট্র ২০০৪ থেকে ২০১০ পর্যন্ত সক্রিয় থেকে, তারপর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

২০০৩ মার্স এক্সপ্লোরেশন রোভার অপুর্চুনিটি (৭ জুলাই) যুক্তরাষ্ট্র, সফল, এখনও ল্যান্ডার কাজ করে যাচ্ছে।

২০০৫ মার্স রিকনাইসেন্স অর্বিটার (১২ আগস্ট) যুক্তরাষ্ট্র, কক্ষপথে ঘুরছে ২৫,০০০ ছবি এবং ৩৫০০ রাডার পর্যবেক্ষণ পাঠিয়েছে।

২০০৭ ফিনিক্স মার্স ল্যান্ডার (আগস্ট ৪) যুক্তরাষ্ট্র, মঙ্গলের ঠান্ডায় ক্ষতিগ্রস্ত, ২০১০ থেকে মৃত ঘোষিত।

২০১১ ফোবাস গ্রান্ট (৮ নভেম্বর) রাশিয়া, পৃথিবীর কক্ষে আটকে যায় এবং প্রশান্ত মহাসাগরে পতিত হয়।

২০১১ মার্স সায়েন্স ল্যাবরেটরি (২৬ নভেম্বর) যুক্তরাষ্ট্র, সবচেয়ে সফল। পরীক্ষাগার, মঙ্গলে অবস্থান করছে। এটাই কিউরিওসিটি রোভার।

২০১৩ ম্যাভেন (১৮ নভেম্বর) রোভার যুক্তরাষ্ট্র, মঙ্গলে অবস্থান করছে সক্রিয়। 

২০১৩ মার্স অর্বিটার মিশন (১৪ মার্চ) য্ক্তুরাষ্ট্র মঙ্গলে অবস্থান করছে সক্রিয়। 

২০১৩ মার্স অর্বিটার মিশন (১৪ মার্চ) যুক্তরাষ্ট্র, মঙ্গলে অবস্থান করছে সক্রিয়।

২০১৬ এক্সেমার্স (১৪ মার্চ) যুক্তরাষ্ট্র, অবতরনের সময় ল্যান্ডার ধ্বংস।

২০২০/২১, কিউরিসিটি অ্যান্ড পারসিভিয়ারেন্স, যুক্তরাষ্ট্র, মঙ্গলের সফল অবতরণ।

কেইপ কার্নিভাল থেকে পারসিভিয়ারেন্স  উৎক্ষেপনের ৩০ জুলাই ২০২০

পারসিভিয়ারেন্স, আদুরে নাম পার্সি

মঙ্গলে কি কখনো প্রাণের অস্তিত্ব ছিল? এখনকার অবস্থায় টিকে থাকা সম্ভব নয় সবাই জানেন। কিন্তু কিউরিওসিটি রোভার নাসার বিজ্ঞানীদের যে তথ্যপ্রমাণ সরবরাহ করেছে তাতে যুক্তিসঙ্গতভাবে মনে করার কারণ রয়েছে ৪ বিলিয়ন বছর আগে জীবনকে সমর্থন করার মতো পরিবেশ মঙ্গলে ছিল। ২৬ নভেম্বর ২০১১ মার্স সায়েন্স ল্যাবরেটরি মিশনে গাড়ির আকৃতির যান কিউরিরিওসিটি ও ৬ আগস্ট ২০১২ মঙ্গলের গেইল ক্রেটারে অবতরণ করে। পারসিভিয়ারেন্সের প্রধান উদ্দেশ্য জীবনের অস্তিত্বের অনুসন্ধান। মিশন কিউরিওসিটিতে ব্যয় হয়েছিল ২.৫ বিলিয়ন ডলার আর মিশন পারসিভিয়ারেন্স এর জন্য ব্যয় নির্ধারিত ২.৮ বিলিয়ন ডলার। কেইপ কার্নিভাল থেকে পারসিভিয়ারেন্স মঙ্গলের উদ্দেশ্যে মহাকাশে উৎক্ষেপনের তারিখ ৩০ জুলাই ২০২০; প্রায় সাত মাস পরিভ্রমণ করে ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ অবতরণ করেছে। সন্ত্রস্ত শেষে সাত মিনিটের ভিডিও ক্লিপ নাসার বিজ্ঞানীদের উদ্বেগ তাদের  সাথে পৃথিবীর সকল কৌতুহলী মানুষও ভাগাভাগি করে নিয়েছে।

রোভার

এই রোভারটি ১০ ফুট লম্বা ৯ ফুট চওড়া, ৭ ফুট উঁচু, চাকা ৬টির ওজন ১ টন। রোভার টেক্সট বুক ফর্মুলায় কোনো ধরনের অঘটন না ঘটিয়ে জেজেরো ক্রেটারে অবতরণ করেছে।

২.৮ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে উৎক্ষেপন ব্যয় ২৪৩ মিলিয়ন ডলার, আগামী আড়াই বছরের মিশন অপারেশন ২৯৬ মিলিয়ন ডলার, আর ইনজেনুইটি নামের হেলিকপ্টারটির জন্য ৮০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ, এই  হেলিকপ্টার রোভার গায়েই বসানো; প্রয়োজনীয় কাজ করার জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে উড়ে যেতে পারে। অনেকটা ড্রোনের মতো।

ইনজেনুইটি নামের হেলিকপ্টারটি

এই অভিযানের উদ্দেশ্যগুলো স্পষ্ট করা হয়েছে: বাসযোগ্যতা পরীক্ষা, জীবনের সন্ধান, মঙ্গলের পৃষ্ঠদেশ থেকে মৌল নমুনা সংগ্রহ, মঙ্গলের আবহাওয়া অক্সিজেন উৎপাদন পরীক্ষা করা। সর্বাধুনিক সংবেদনশীল যন্ত্রপাতির সমাবেশ ঘটানো হয়েছে রোভারটিতে।

পার্সিকে ৪৭ কোটি কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, মঙ্গলের কক্ষে ঢোকার পর ঘন্টায় ১৯ হাজার কিলোমিটার গতিতে অগ্রসর হয়েছে। স্বাভাবিক মানুষের যত ধরনের অনুভূতি থাকে রোবোটিক রোভারে তার প্রায় সবই সঞ্চারিত করা হয়েছে। মানুষের দুর্ভাগ্য তার শরীরে স্পেয়ার পার্টস থাকে না, একবার মাথাটা অকেজো হয়ে গেলে যে স্বয়ংক্রিয়ংভাবে অন্য একটি মাথা এসে বসবে কিংবা রিমোট ইনস্ট্রাকশন অনুসরণ করে স্বস্থানে মাথার কাজ শুরু করবে সে সুযোগ মানুষের নেই, কিন্তু রোভারের মাথা খারাপ হয়ে গেলে বিকল্প মস্তিষ্কে কাজ করবে। ২৩টি স্পেশালাইজড ক্যামেরা সর্বক্ষণিক কাজ করবে। সেলফিও তুলতে পারবে।

আর্থার কোনান ডয়েলের ভূত

২২১বি বেকার স্ট্রিট, লন্ডন- এই ঠিকানা শার্লক হোমস থাকতেন। ঠিকানা বদলে যায়নি, তবে তিনি কেপ কার্নিভাল থেকে রোভারের সাথে মঙ্গলে উৎক্ষিপ্ত হয়েছেন, সাথে ওয়াটসনকে পাঠিয়েছেন আর্থার কোনান ডয়েল, তার মৃত্যুর ৯০ বছর পর। শার্লক নামের যন্ত্রটি রোভারের রোবোটিক বাহুর শেষ প্রান্তে সংযুক্ত, মঙ্গলের পাথর নুড়িতে বালিকনাতে ক্লু খুঁজে বেড়ানো শার্লকের কাজ। তবে ঝযবৎষড়প-একটি বড় বিবরণীর সংক্ষিপ্তরূপও (ঝপধহহরহম ঐধনরঃধনষব ঊহারৎড়হসবহঃং রিঃয জধসধহ ধহফ খঁসরহবংংপবহপব ভড়ৎ ঙৎমধহরপং ধহফ ঈযবসরধষং) আর ওয়াটসন হচ্ছে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি গোয়েন্দা ক্যামেরা যা পাথর-কাঠামোর ক্লোজআপ ছবিও ধারন করতে পারবে। পার্সিভিয়ারেন্স নিয়ে স্কুল জীবনে যাদের ইংরেজি বাংলা রচনা লিখতে হয়েছে তারা জানেন অধ্যাবসায় কঠিন সাধনার বিষয়, লেগে থাকতে হয়। মঙ্গলের অভিযানের সূচনা ষাট বছর আগে হলেও মঙ্গলকে জানার চেষ্টা মানুষের চার হাজার বছরের। এই লেগে থাকাই পার্সিভিয়ারেন্স। নাসার আগামী বছরগুলোর যে কর্মসূচি তাতে অধ্যাবসায়ের এই বৃত্ত থেকে  বেরোনোর কোনো উপায় নেই, লেগেই থাকতে হবে।

পুরানে যুদ্ধ ও কৃষির রোমান ঈশ্বর মার্স কিংবা মঙ্গল তাকে নিয়ে পৃথিবী যত উৎসব হয় তাতে চ্যারিয়ট থাকে ঘোড়া থাকে। আসলে উৎসবে বন্দনা হয় গতির। পার্সিভিয়ারেন্সও মঙ্গলযাত্রায় গতিরই প্রতীক।

মঙ্গলে মানুষের আরো সাফল্য চাই, কেবল তখনই শুরু হতে পারে মঙ্গলের উপনিবেশীকরণের প্রতিযোগিতা।

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.