আট দরোজা আর ভ্যাকসিনের মহাপুরুষ

ইজেল

15 August, 2020, 12:15 am
Last modified: 15 August, 2020, 01:24 am
১৯৫৪ সালে চিকিৎসক ও নার্সরা ৪ লাখ শিশুকে সাল্কের ভ্যাকসিন দিলেন এবং আরও দু-লাখ শিশুকে দিলেন প্রাসিবো লিকুইড যা দেখতে অনেকটা ভ্যাকনিসের মতো হলেও আসলে ভ্যাকসিন ছিল না, বিষয়টা কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত এটাই সবচে বড় আয়োজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যখনই জানা গেল যে ভ্যাকসিনটি কার্যকর হয়েছে, তখনই আমেরিকানরা হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, রাস্তা এবং তাঁদের বাচ্চাদের নামকরন করতে থাকেন সাল্কের নামে এবং তার কাছে তারা পাঠাতে থাকেন অজস্র উপহার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তাঁকে সম্মানসূচক ডিগ্রি দিতে থাকে এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পদক পুরস্কারেও তাঁকে ভূষিত করা হয়। সাল্ক গণ্য হতে থাকেন পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ সম্মানিত মানুষ হিসেবে।

মরিস হিলম্যানকে তার মেয়ের মাম্‌স্‌ (গলায় বেদনাদায়ক স্ফীতিযুক্ত ছোঁয়াচে রোগ বিশেষ) থেকে ভাইরাস নিতে এবং সেই ভাইরাসকে মুরগির ডিম এবং ছানা ভ্রূণে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করাতে কী তাঁকে তাড়িত করেছিল? তারপর, কেন মুরগির ছানাগুলির মাথা কেটে ফেললেন তিনি? আর সবচেয়ে বড় কথা, '৬০-এর দশকে কেন তিনি আপাতদৃষ্টিতে এতো স্থূল, গোপনীয় কিন্তু রহস্যময়, জটিল একটি প্রক্রিয়া অবলম্বন করলেন? পূর্ববর্তী শতাব্দীতে আটটি জটিল পরীক্ষাই তো হিলম্যানের এমন প্রক্রিয়াকে নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

এডওয়ার্ড জেনারের কাছ থেকেই মরিস হিলম্যান ভ্যাকসিনের শক্তি সম্পর্কে জেনেছিলেন। জেনারের ভ্যাকসিন পৃথিবী থেকে মানবজাতির সবচেয়ে মারাত্মক প্রাণঘাতী সংক্রমণ- গুটি বসন্তকে নির্মূল করেছিল।  

রোগটি খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ছিল মানুষের লালার মাধ্যমে যাতে মিশে ছিল মিলিয়ন মিলিয়ন ভাইরাস। গুটি বসন্তের সংক্রমণ ছিল একটি সাধারণ সংক্রমণের মতো কিন্তু দ্রুতই মারাত্মক হয়ে পড়ছিল। এই ভাইরাসটি উচ্চমাত্রার জ্বরের সঙ্গে মানবদেহে গন্ধযুক্ত পুঁজভরা ফুসকুড়ি সৃষ্টি করে। গুটিবসন্তের নির্মম শিকারে পরিণত হয়, আক্রান্ত প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন আর যারা টিকে থাকতে পারে তাদের বহুসংখ্যক অন্ধ হয়ে যায়। ১৪৯২ সালে, কলম্বাস যখন আটলান্টিক পাড়ি দিচ্ছিলেন, তখন বাহাত্তর মিলিয়ন ইন্ডিয়ান বাস করছিলেন উত্তর আমেরিকায়, প্রথমে ১৮০০ জন সংক্রমণের শিকার হন, পরে, তাদের মাধ্যমে, মহামারী ছড়িয়ে পড়ে, টিকতে পারেন মাত্র ৬ লাখ! গুটি বসন্ত যা ইউরোপীয় স্যাটেলাররা বহন করে এনেছিল, বেশিরভাগ ইন্ডিয়ানকে নিশ্চিহ্ন করেছিল। 

১৭৬৮ সালে, কিশোর এডওয়ার্ড জেনার যখন ইংল্যান্ডের সাডবারি ওষুধ কারখানায় শিক্ষানবিশ হিসাবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন, তখন তিনি এক গোয়ালিনীর দেখা পেয়েছিলেন যিনি ছিলেন অসুস্থ। জেনার জানতে চাইলেন- আপনি কি গুটি বসন্তে আক্রান্ত?' উত্তরে গোয়ালিনী বলেছিলেন, 'না, আমাকে গুটি কখনই আক্রমণ করতে পারবে না, কারণ আমার ইতোমধ্যে কাউপক্স হয়েছে। এডওয়ার্ড জেনার কথোপকথনটি সারা জীবন মনে রেখেছিলেন। ক'বছর পর লন্ডনে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় জেনার বিখ্যাত সার্জন জন হান্টারকে গোয়ালিনীর পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে বলেছিলেন। হান্টার জেনারকে তত্ত্বটি পরীক্ষা করতে উৎসাহিত করেছিলেন- বের করার চেষ্টা করুন। ধৈর্য ধরুন, নির্ভুল ফলাফল বের করুন।

জেমস ফিপসকে জেনার তার টিকার প্রথম প্রয়োগ করছেন। ১৪ মে, ১৭৯৬

১৭৯৬ সালের ১৪ মে জর্জ ওয়াশিংটন তার বিদায়ী বক্তব্য দেওয়ার মাস কয়েক মাস আগে, অ্যাডওয়ার্ড জেনার সে সুযোগটি পেয়ে গেলেন। জেনারের বাড়িতে কাজ করতে আসা গোয়ালিনী সারাহ নেলম্‌সের হাতে এবং কব্জিতে কাউপক্সের ফোস্কা ছিল। জেনার করলেন কী, মেয়েটির হাতের পক্সের একটি ফোস্কা থেকে পুঁজ নিয়ে স্থানীয় এক শ্রমিকের আট বছরের ছেলে জেমস ফিপসের বাহুতে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ভরে দিলেন। তার ছ'সপ্তাহ পর, জেনার গুটি বসন্তের পুঁজ আবার তার বাহুতে ইঞ্জেকশন করলেন এটা দেখতে যে তার শরীরে কোনো প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয় কি না। ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার পর গুটি বসন্তের ভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিরাপদ কি না! সাধারণত, গুটির টিকা দেওয়ার ফলে উচ্চমাত্রার জ্বর হয়; শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়; প্রচণ্ড চুলকানি এবং যন্ত্রণাদায়ক ফুসকুড়ি দেখা দেয়, সাধারণত, এরপরই মৃত্যু।

জেমস ফিপ্‌সের বেলায় এর কিছুই ঘটেনি। পরে, জেনার গুটি আক্রান্তদের কাছ থেকে পুঁজ নিয়ে আরও বিশ বার ফিপ্‌সকে ইঞ্জেকশন দেন; প্রতিবার ফিপস্‌ কোনও সংক্রমণ ছাড়াই বেঁচে থাকে। দু'বছর পর, জেনার তার দীর্ঘ পর্যালোচনা প্রকাশ করেছিলেন 'An Inquiry into the Causes and Effects of Variolae Vaccinae, a Disease Discovered in Some of the Western Counties of England, Particularly Gloucestershire, and Known by the Name of Cow Pox'-এই নামে। জেনার ভ্যারিওলা ভ্যাকসিন টার্মটি ব্যবহার করলেন, আক্ষরিক অর্থে- গরুর গুটি বসন্ত। পরবর্তীতে ভ্যাকসিন শব্দের উৎপত্তি হয় এই টার্ম থেকে। 

জেনারের প্রকাশনার এক বছরের মধ্যেই চিকিৎকরা কাউপক্সসহ এক হাজার মানুষকে টিকা দিয়েছিলেন এবং তার পর্যবেক্ষণকে অনুবাদ করেছিলেন বিভিন্ন ভাষায়। পৃথিবী থেকে গুটি বসন্ত নির্মুলে জেনারের এই টিকা ব্যবহারের মাধ্যমে নির্মূল করতে প্রায় দুশো বছর সময় লেগেছে। (যদিও রোগটি নির্মূল হয়ে গেছে, ভাইরাসটি থেকে গেছে। ভাইরাসটিকে গোপনে রক্ষা করা হয়েছে। ইরাক যুদ্ধে কৌশলে তাঁকে ব্যবহার করা হয়েছে।)

ফরাসি কেমিস্ট লুই পাস্তুরের কাছ থেকে হিলম্যান শিখলেন বিপজ্জনক হিউম্যান ভাইরাস থেকে অতি জরুরি ভ্যাকসিন তৈরি করা যাবে। 

১৮৮৫ সালের জুলাই মাসের চার তারিখ ফ্রান্সের একটি ছোট শহরে নয় বছরের বাচ্চা ছেলে জোসেফ মাইস্টার স্কুলে যাচ্ছে তখন কোথা থেকে বিশাল এক কুকুর এসে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। বাচ্চাটিকে আঁচড়ে-কামড়ে শরীরের নানা জায়গায় ক্ষত সৃষ্টি করে দিল। এই পাগলা কুকুরটা ভয়ংকর রেবিজ ভাইরাস বা জলাতঙ্কে ভুগছে। যেভাবে কুকুরটা বাচ্চাটিকে কামড় দিয়েছে তাতে বাচ্চাটিও যে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৮৮৫ সালে জলাতঙ্কের চিকিৎসা ছিল না। এটি যে একটি ভাইরাস বাহিত রোগ সেটাও কেউ জানতো না। এখনকার মানুষ যেমন জানে, তখনকার মানুষও তেমনি জানতো রেবিজ ভাইরাস বা জলাতঙ্কের রোগের মৃত্যু থেকে ভয়ংকর কোনো মৃত্যু হতে পারে না। জ্বর দিয়ে শুরু হয়, অস্বাভাবিক এক ধরনের বিষণ্নতা ভর করে সেটা পাল্টে যায় অনিয়ন্ত্রিত একধরনের উত্তেজনায়। গলার মাংসপেশীতে এক ধরনের খিঁচুনী শুরু হয়। মুখ থেকে ফেনা বের হতে শুরু করে। প্রচন্ড তৃষ্ণায় বুক ফেটে যেতে চায় কিন্তু একবিন্দু পানি খেলেই খিঁচুনি শুরু হয়ে যায়। শেষের দিকে পানি খেতে হয় না। পানি দেখলেই উন্মত্ত এক ধরনের খিঁচুনি ভর করে।

স্মলপক্স আর কাউপক্সের তুলনামূলক চিত্র. ১৮৯৬

জোসেফ মাইস্টারের মা তার ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার তার ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে বললেন, তার কিছুই করার নেই। শেষ চেষ্টা হিসেবে প্যারিসের লুই পাস্তুরের কাছে নেওয়া যেতে পারে। যে বিষয়টি সবচেয়ে বিচিত্র সেটি হচ্ছে লুই পাস্তুর কোনো ডাক্তার নন, তিনি একজন রসায়নবিদ। তার বয়স তখন তেষট্টি, স্ট্রোকে শরীরের অর্ধেক অংশ অবশ। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে গেছেন কিন্তু তখনও সারা দেশের মানুষের তার ক্ষমতার উপর অগাধ বিশ্বাস।

লুই পাস্তুর খুব বড় একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। বলা যায়, তাকে দিয়েই মাইক্রোবায়োলজি বা আধুনিক চিকিৎবিজ্ঞান শুরু হয়েছে। ১৮৮০ সালে যখন লুই পাস্তুর তার অর্ধেক অবশ শরীর নিয়ে রেবিজ ভাইরাস বা জলাতঙ্কে রোগের উপর গবেষণা শুরু করেছেন তখন এটি সম্পর্কে তিনটি বিষয় জানা ছিল। এক. রেবিজ আক্রান্ত পশুর লালায় এই ভাইরাসের অস্তিত্ব আছে। দুই. পশুর কামড়ে ক্ষতস্থান তৈরি হলে এই রোগের সংক্রমণ হয়। এবং তিন. সংক্রমণের পর কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পরে এই রোগের উপসর্গগুলি দেখা যায়। এর বাইরে পুরোটাই একটা রহস্য।

লুই পাস্তুর খাঁটি বিজ্ঞানীর মতো সমস্যাটি নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। প্রথমেই চেষ্টা করলেন জলাতঙ্কের কারণটি আলাদা করতে। একটা রোগ নিয়ে গবেষণা করতে গেলে তার রোগীর প্রয়োজন তাই লুই পাস্তুরের প্রথম কাজ হলো নিয়ন্ত্রিতভাবে পশুদের মাঝে জলাতঙ্ক রোগের সংক্রমণ করানো। বিপজ্জনক ঝুঁকি নিয়ে রেবিজ আক্রান্ত হিংস্র পাগলা কুকুরের মুখ থেকে লালা সংগ্রহ করে সেটা দিয়ে খরগোশ বা কুকুরকে আক্রান্ত করার চেষ্টা করে দেখা গেল এই পদ্ধতিটা খুব নির্ভরযোগ্য নয়। তাছাড়া, সেটি ছিল খুব সময় সাপেক্ষ একটা ব্যাপার। একটা পশুর মাঝে রোগের উপসর্গ দেখা দিতে যদি মাসখানেক লেগে যায় তাহলে সেটা নিয়ে তো আর ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করা যায় না। দ্রুত আক্রান্ত একটা পদ্ধতি বের করতে হবে।

লুই পাস্তুর চিন্তা করতে লাগলেন, রোগের উপসর্গ দেখে মনে হয় এটি স্নায়ুরোগ, মস্তিষ্কের সাথে যোগাযোগ আছে।জলাতঙ্ক আক্রান্ত পশুর লালা না নিয়ে যদি স্পাইনাল কর্ডের অংশবিশেষ সরাসরি পশুর মস্তিষ্কে ইনজেকশন দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয় তাহলে কী হয়? যেরকম চিন্তা সেরকম কাজ এবং লুই পাস্তুর আবিষ্কার করলেন তার ধারণা সত্যি। সরাসরি পশুর মস্তিষ্কে ইনজেকশন দিয়ে খুব নির্ভরযোগ্য ভাবে দ্রুত তিনি পশুকে রেবিজ রোগে আক্রান্ত করিয়ে দিতে পেরেছেন। এখন তিনি গবেষণার পরের ধাপে পা দিতে পারেন; রোগের কারণটিকে আলাদা করে বের করা।

পক্স বিরোধী আন্দোলন

এখানে এসে তিনি যেন এক শক্ত পাথরের দেয়ালের মাঝে ধাক্কা খেলেন। কিছুতেই এই অদৃশ্য কারণকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। একটা ব্যাক্টেরিয়াকে কৃত্রিম পুষ্টি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা যায়, বংশবৃদ্ধি বা কালচার করা যায় কিন্তু এই অদৃশ্য পরজীবী প্রাণটিকে কোনো ভাবেই ল্যাবরেটরির টেস্টটিউবে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। লুই পাস্তুর আবার খাঁটি বিজ্ঞানীর মতো ভাবলেন যদি তাকে কৃত্রিম অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখা না-ই যায়, তাহলে তাকে জীবন্ত কোথাও বাঁচিয়ে রাখা হোক। সেই জীবন্ত অংশটুকু হলো খরগোশের মস্তিষ্ক। আবার লুই পাস্তুরের ধারণা সত্যি প্রমাণিত হলো, খরগোশের মস্তিষ্কে এই অদৃশ্য জীবাণু শুধু বেঁচেই থাকে না, আরো ভয়ংকর আরও সর্বনাশী হয়ে ওঠে, ছয়দিনের মাঝে এই রোগ তার সর্বগ্রাসী উপসর্গ নিয়ে দেখা দেয়।

লুই পাস্তুর এখন গবেষণার শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছেন, এখন এমন একটা প্রক্রিয়া খুঁজে বের করতে হবে যেটা দিয়ে এই রোগের প্রতিষেধক বের করা যায়। একদিন ল্যাবরেটরিতে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে দেখলেন একজন সহকারী জলাতঙ্ক আক্রান্ত একটা খরগোশের স্পাইনাল কর্ড কাচের ফ্লাস্কে ঝুলিয়ে রেখেছেন, কতদিন এই ভয়ংকর জীবাণু বেঁচে থাকতে পারে সেটাই হচ্ছে পরীক্ষার উদ্দেশ্য। লুই পাস্তুর কাচের ফ্লাস্কের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন, কিছুদিন আগেই মোরগের কলেরা রোগের ব্যাক্টেরিয়াকে অক্সিজেন দিয়ে দুর্বল করে ভ্যাক্সিন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এখানেও সেটি কি করা যায় না? যে অদৃশ্য জীবাণু তিনি দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু যার অস্তিত্ব নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই সেটাকে কী দুর্বল করে এর প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা যায় না।

পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ ব্যবহারিক বিজ্ঞানী তখন কাজে লেগে গেলেন। খরগোশের স্পাইনাল কর্ডে বেঁচে থাকা জীবাণুকে অক্সিজেন দিয়ে দুর্বল করতে লাগলেন। প্রতিদিন সেখান থেকে একটা অংশ নিয়ে সেটাকে গুঁড়ো করে সুস্থ খরগোশের মাথায় ইনজেকশন দিতে শুরু করলেন। যতই দিন যেতে লাগলো এই ভয়ংকর জীবাণু ততই দুর্বল হতে শুরু করলো, বারো দিন পর জীবাণু এত দুর্বল হয়ে গেল যে, সেটা সুস্থ প্রাণীকে সংক্রমণ করতেই পারলো না।

এখন আসল পরীক্ষাটি বাকি, এই প্রক্রিয়ায় সত্যিই কি জলাতঙ্কের প্রতিষেধক তৈরি করা সম্ভব? লুই পাস্তুর পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করলেন। একটা কুকুরের মস্তিষ্কে প্রথমে বারো দিনের দুর্বল জীবাণু প্রবেশ করানো হলো, তার পরের দিন এগারো দিনের জীবাণু তার পরেরদিন দশ দিনের জীবাণু। এভাবে প্রত্যেক দিনই আগের থেকে একটু বেশি ভয়ংকর জীবাণু কুকুরের মস্তিষ্কে ইনজেকশন দেওয়া হলো কিন্তু এত দিনে কুকুরটির দেহে জলাতঙ্কের প্রতিষেধক তৈরি হয়ে গেছে। এই ভয়ংকর জীবাণু নিয়েও সেটি বহাল তবিয়তে বেঁচে রইলো। লুই পাস্তুর জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক বের করেছেন তবে মানুষের জন্য নয় পশুর জন্যে।

ঠিক এরকম সময়ে নয় বছরের জোসেফ মাইস্টারকে নিয়ে তার মা এলেন লুই পাস্তুরের কাছে, আকুল হয়ে লুই পাস্তুরকে বললেন, তার ছেলেকে বাঁচিয়ে দিতে। লুই পাস্তুর খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন, নয় বছরের এই বাচ্চার মাঝে নিশ্চিতভাবেই জলাতঙ্ক রোগের জীবাণু ঢুকে গেছে, একজনের শরীরে জীবাণু ঢোকার পর তার শরীরে কী প্রতিষেধক তৈরি করা যাবে? যে প্রক্রিয়া কখনো কোনো মানুষের শরীরে পরীক্ষা করা হয়নি সেটি কি একটা শিশুর শরীরে পরীক্ষা করা যায়?

লুই পাস্তুর তার গবেষণাগারে।

অনেক ভেবে-চিন্তে তিনি পরীক্ষাটি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রথমে দুই সপ্তাহের পুরোনো জীবাণু তারপর তেরো দিনের, তারপর বারো দিনের। এভাবে যতই দিন যেতে লাগলো ততই আগ্রাসী জীবাণু বাচ্চাটির শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। একে বারে শেষদিন তার শরীরে জলাতঙ্ক রোগের যে জীবাণু ঢোকানো হলো সেটি অন্য যে কোনো পশু বা মানুষকে এক সপ্তাহের মধ্যে মেরে ফেলার ক্ষমতা রাখে। সেই সময়টা সম্ভবত ছিল লুই পাস্তুরের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় -- তিনি খেতে পারেন না, ঘুমাতেও পারেন না, তার মাথায় শুধু একটা চিন্তা ছেলেটি কি বাঁচবে না মারা যাবে?

ছেলেটি মারা যায়নি। লুই পাস্তুরেরর চিকিৎসায় প্রথম জলাতঙ্ক রোগীটি বেঁচে উঠলো। বিজ্ঞানের ইতিহাসে লুই পাস্তুরের এই অবিস্মরণীয় অবদানটি সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।

জোসেফ মাইস্টার তার প্রাণ বাঁচানোর কারণে সারা জীবন লুই পাস্তুরের কাছে কৃতজ্ঞ ছিল৷ সে বড় হয়ে লুই পাস্তুরের ল্যাবরেটরির দ্বাররক্ষীর দায়িত্ব নিয়েছিল। নাৎসি জার্মানি যখন ফ্রান্স দখল করে নেয় তখন নাৎসি বাহিনী লুই পাস্তুরের ল্যাবরেটরি দখল করতে আসে। জোসেফ মাইস্টার গেটের দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে ল্যাবরেটরি রক্ষা করার চেষ্টা করে।

জেনারের গুটি বসন্তের টিকা তৈরির জন্য দরকার হয়ে পড়েছিল গরুর, পাস্তুরের কুকুর এবং খরগোস; আলেক্সি কারেলের কাছ থেকে হিলম্যান জানতে পারলেন প্রাণিদেহের বিভিন্ন অঙ্গকে বাইরেও জীবিত রাখা সম্ভব। 

হিলম্যান নেদারল্যান্ড ব্যাক্টিওরোলজির অধ্যাপক মার্তিনুস বেজেরিঙ্ক-এর কাছ থেকে জেনেছেন ভাইরাস সম্পর্কে আদোপান্ত। 

লুই পাস্তরের ওপর বিশেষ সংখ্যা ফরাসী পত্রিকার , ১৮৯৫

আর্নেস্ত গপাস্তুরো ১৯৩০ সালের ভাইরাস গবেষণায় খ্যাতি আর্জন করেন। গপাস্তুর জানলেন ভাইরাস ডিমের জন্ম নিতে পারে। তার এই আবিষ্কারের ফলে ভাইরাসবীদ এবং মুরগির খামারিদের মধ্যে খুবই ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। টেনেসির ক্লার্কসভিলে জন্ম নেওয়া এই বিজ্ঞানী ছিলেন ফৌলপক্স নিয়ে আগ্রহী যা মুরগির দেহে সঙ্ক্রমিত হতো, যে ভাইরাসটির সঙ্গে গুটি বসন্তের বহু মিল পাওয়া গেছে। তিনি তা-দেয়া মুরগির ডিমে ভাইরাসের জন্ম দিলেন, সেই ভাইরাস ডিমে থাকা ভ্রুণেও ছড়াল। হিলম্যান এই পদ্ধতিতে তার প্যানডেমিক ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং মামপস এর ভ্যাকসিনের জন্য এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করলেন।   

ম্যাক্স থেইলারের কাছ থেকে হিলম্যান জেনে গেলেন মানব ভাইরাস দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন প্রাণি দেহের কোষে তাদের বেড়ে তুলতে হয়। হিলম্যান তার মেয়ের মামপসের ভাইরাসটি দুর্বল করেছিলেন মুরগির বাচ্চার কোষে ভাইরাসের জন্ম দিয়ে। ১৯২৭ সালে সকল ভাইরাসের মধ্যে ইয়েলো ফিভার বা পীতজ্বরের ভাইরাসকেই প্রথমবারের মতো পৃথক করা সম্ভব হয়েছিল।পীতজ্বর শরীরে লুকিয়ে থাকে ৩ থেকে ৬ দিন। জ্বর, ক্ষুধামন্দা, বমিভাব, বমি, পিঠের মাংসপেশিতে ব্যথা পেটব্যথা, ক্লান্তি, মাথাব্যথা ও জন্ডিস। লক্ষণগুলো উন্নতি হওয়ার একদিনের মধ্যে পুনরায় জ্বর হতে পারে, পেটব্যথা শুরু হয় ও যকৃৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে জন্ডিস হতে পারে ও শরীর হলুদ হয়ে যায়। পীতজ্বরের পর আরও যে প্রাণঘাতি ভাইরাসের দ্বারা মানবজাতি আক্রান্ত হচ্ছে, তার নাম ইবোলা ভাইরাস। 

জন এন্ডার্স, টমাস উইলার এবং ফ্রেডরিখ রবিনসদের রিসার্চ টিমের কাছ থেকে, যারা ১৯৪০-এর শেষ দিকে কাজ করতেন বোস্টন শিশু হাসপাতালে, তাঁদের কাছ থেকে হিলম্যান শিখলেন কীভাবে ল্যাবে প্রাণি ও মানুষের শরীরের কোষ বৃদ্ধি পায়। বোস্টনের একটি গবেষক গ্রুপ প্রথম মানবভ্রুণ থেকে সেল কালচার তৈরি করে। ৩০ মার্চ ১০৪৮, সকাল সাড়ে ৮ টা, টমাস উইলার হাঁটছিলেন বোস্টন শিশু হাসপাতালের সামনের প্রশস্ত রাস্তা ধরে, এদিকে ধাত্রীর কাজ করা ডানকান রীদ একটি গর্ভপাত ঘটালেন। মা চাইছিলেন না গর্ভধারণ। কারণ তিনি রোবেলায় আক্রান্ত ছিলেন। রোবেলা এমন এক ভাইরাস যা সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। রীদ উইলারকে ভ্রুণটি দিয়ে দিলেন। ল্যাবের ফ্লাক্সে সেলটি পুনরুৎপাদন করা হলো, দেখা গেল পোলিও ভাইরাস জন্ম নিয়েছে। উইলিয়াম রবিন্স এবং এন্ডার্স খুঁজে পেলেন পোলিও ভাইরাস বিভিন্ন রূপে প্রাণিদেহে জন্ম নিতে পারে। আমেরিকার রকফেলার ইনস্টিটিউটে কাজ করার সময় জোনাস সাল্ক হলেন সেই গবেষক, যিনি প্রথম পোলিও প্রতিরোধের পথের সন্ধান পান। হিলম্যান উপলব্ধি করেন ভ্যাকসিন আমেরিকানদের হৃদয় জয় করতে পেরেছিল।

জোনাস সাল্ককে বলা হত জনগণের বিজ্ঞানী

 সাল্ক ১৯৫০-এর গোঁড়ার দিকে তিনি যখন পিটসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ কর্মরত, তখন তিনি বিজ্ঞানী এন্ডার্স গ্রুপের কৌশল প্রয়োগ করলেন বানরের কিডনি কোষে পোলিও ভাইরাসের জন্ম দিলেন। পরিশোধিত সেই ভাইরাস প্রয়োগ করা হলো পিটসবুর্গের ৭০০ শিশুর শরীরে। দারুণ ফল এলো। আক্রান্ত শিশুদের পোলিও ভাইরাস মারা গেল এবং তাদের শরীরে তৈরি হলো এন্টিবডি। ১৯৫৪ সালে চিকিৎসক ও নার্সরা ৪ লাখ শিশুকে সাল্কের ভ্যাকসিন দিলেন এবং আরও দু-লাখ শিশুকে দিলেন প্রাসিবো লিকুইড যা দেখতে অনেকটা ভ্যাকনিসের মতো হলেও আসলে ভ্যাকসিন ছিল না, বিষয়টা কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত এটাই সবচে বড় আয়োজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যখনই জানা গেল যে ভ্যাকসিনটি কার্যকর হয়েছে, তখনই আমেরিকানরা হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, রাস্তা এবং তাঁদের বাচ্চাদের নামকরন করতে থাকেন সাল্কের নামে এবং তার কাছে তারা পাঠাতে থাকেন অজস্র উপহার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তাঁকে সম্মানসূচক ডিগ্রি দিতে থাকে এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পদক পুরস্কারেও তাঁকে ভূষিত করা হয়। সাল্ক গণ্য হতে থাকেন পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ সম্মানিত মানুষ হিসেবে। আজকের দিনের মানুষ যখনই কোনো প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিনের নাম শুনে, প্রথমেই তাঁদের যার নামটি মনে আসে তিনি হচ্ছেন জোনাস সাল্ক।

সাল্কের টিকার সফলতার খবর সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে

কিন্তু তার আগের জেনার, পাস্তুর এবং থেলারের মতো সাল্কও তার ভ্যাকসিনের এক ট্রাজেডি হতে দেখেন। ক্যালিফোর্নিয়ার কাটার ল্যাব অফ বার্কলি খুব নিম্নমানের ভ্যাকসিন উৎপাদন করে। কিন্তু তারা ধরে নেয় ভ্যাকসিনটি সাল্কের ফর্মুলা মতোই উৎপাদিত হয়েছে। তারা তাঁদের সাড়ে চারশ কর্মীর বাচ্চাদের শরীরে পোলিওর টিকা প্রয়োগ করে।  কিন্তু কাটার ল্যাবের ভুল হয়েছিল তারা যথাযথভাবে পরিশোধন করছিল না। কাটারের উৎপাদিত ভ্যাকসিনের মাধ্যমে প্রায় এক লক্ষ শিশু প্রাণঘাতি পোলিওতে আক্রান্ত হয়। যারা কাটারের ভ্যাকসিন নিয়েছিল তাঁদের মাধ্যমে রোগটি ছড়াতে শুরু করে, ইতিহাসে এটাই মানব সৃষ্ট প্রথম এবং একমাত্র পোলিও মহামারী। পরে পরিশোধিত পোলিও ভ্যাকসিন ব্যবহারের মাধ্যমে মানবজাতি এই মহামারী থেকে রক্ষা পায়।      

হিলম্যানের জানা হয়ে গেছে তার আগে কী সঠিক হয়েছে আর কোথায় ভুল। ঠিক যে সময় তিনি তার মামপস ভ্যাকসিন বানিয়েছেন, তখন সামনে অনেকগুলি পথ খুলে গেছে, অন্ধকারের বুক কেটে তখন পথও অনেক। তিনি বললেন- এখন জিনিয়াসদের সময়। আমি যা করতে চেয়েছি তা করতে সক্ষম হয়েছি কারণ তারাও এভাবে কাজ করেছেন। 

সাল্কের পোলিও টিকা

সূত্র: পল এ. অফিটের এইট ডোরস অবলম্বনে

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.