অবরোধের ইতিহাস ও ভূগোল

ইজেল

ফিরোজ আহমেদ
24 July, 2020, 09:55 pm
Last modified: 24 July, 2020, 10:29 pm
সাম্প্রতিক ইতিহাসেও আমরা যুগোশ্লাভীয় গৃহযুদ্ধের সময়ে অবোরোধের ঘটনা দেখেছি, আমরা জানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্তালিনগ্রাদ অবরোধের শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী। ১৯৭১ সালে ঢাকাও প্রায় অবরুদ্ধই ছিল। এরকম অবরোধ কাহিনি-ইতিহাসের সমাপ্তি আজও ঘটেনি, আজও অর্থনীতির ঘনীভূত রূপ আকারেই রাজনীতি এবং রাজনীতির সম্প্রসারণ আকারেই যুদ্ধের মহড়া চলছে দুনিয়া জুড়ে। রোধ-অবরোধের তাই বিরাম নেই, দামামা বেজেই চলেছে।

 "রোধ—অবরোধ—ক্লেশ—কোলাহল শুনিবার নাহিকো সময়,

জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোন্‌খানে—

কোথায় নতুন ক'রে বেবিলন ভেঙে গুঁড়ো হয়;

আমার চোখের পাশে আনিও না সৈন্যদের মশালের আগুনের রং;

দামামা থামায়ে ফেল—পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক্

রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ।''

গত শতকের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন ঘোষণা করেছিলেন যে, রাজনীতি হলো অর্থনীতির ঘনীভূততম প্রকাশ। ওদিকে ঊনিশ শতকের আরেক জার্মান সমরকৌশলবিদ কার্ল ফন ক্লাউসেউইৎজ বলেছিলেন, যুদ্ধ রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা, কেবল পথটা ভিন্ন। সোজা বাংলায় আমরাও এটাই আসলে বলি: আঙুল বাঁকা করা। ফলে দেখা যাচ্ছে, রাজনীতি, যুদ্ধ আর অর্থনীতির ক্ষেত্রগুলো আলাদা হলেও এরা আসলে একই দেবতার রূপভেদ মাত্র। বলা চলে, যুদ্ধ হলো রাজনীতির ঘনীভূত রূপ, আর রাজনীতি হলো অর্থনীতির ঘনীভূত রূপ। অবরোধ, সে সামরিক হোক আর অর্থনৈতিক হোক, এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিবেচনার বাইরে অন্য কিছু সে নয়। এই কারণেই ইংরেজি 'এমবার্গো/স্যাংশন' আর 'সিজ' এই্ দুটি ভিন্ন পরিভাষারই বাংলা অর্থ অবরোধ, প্রথমটি অর্থনৈতিক অবরোধ বোঝাতে আর দ্বিতীয়টি সামরিক অবরোধ বোঝাতে ব্যবহার করা হয়।

 

১.

প্রাচীন পৃথিবীতে সামরিক অবরোধ মানেই প্রাচীরের উপস্থিতি। অর্থাৎ নগরসভ্যতা পরবর্তী প্রপঞ্চ এটি, আশেপাশের নগরসভ্যতার বিকাশ হয়নি এমন পশুপালক জনগোষ্ঠীর হঠাৎ আক্রমণ কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী নগর বা রাষ্ট্রের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য বিশাল এই সব দেয়াল নির্মাণ করা হতো। নগরের গুরুত্ব ও ঝুঁকি অনুযায়ী নগরপ্রাচীরের আকার নির্ধারিত হতো।

প্রাচীন সাহিত্যে অন্যতম পুরনো দেয়াল ঘেরা নগরী হিসেবে খ্যাত দজলা-ফোরাত অববাহিকার উরুক নগরীর, অমরত্বের সন্ধানে বের হওয়া রাজা গিলগামেসের মহাকাব্যের সাথে সংশ্লিষ্ট এই নগরটি। দজলা-ফোরাত অববাহিকার আরেকটি নগরী ব্যাবিলন যখন তার প্রভাবের চূড়াতে ছিল, তার নগরপ্রাচীরটি এত উঁচু ছিল যে, পারস্য সম্রাট সাইরাস কর্তৃক ব্যাবিলন অবরোধের কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস লোকশ্রুতি থেকে সেটি তিনশো ফুটেরও বেশি ছিল বলে উল্লেখ করেন। নিশ্চিতভাবেই এটি অতিরঞ্জন, কিন্তু নিয়মিত অবরোধের শিকার হওয়া মেসোপটেমীয় সভ্যতায় নগরপ্রাচীরের গুরুত্বটা তাতে পরিস্কারভাবেই বোঝা যায়।

সত্যি বলতে কী, প্রাচীন দুনিয়ার যতগুলো অবরোধের খবর আমরা পাই, তার সিংহভাগ মেসোপটেটিয়ার এই উর্বর বাঁকা চাঁদ আকৃতির ভূখণ্ডেই ঘটেছে। বাকি অল্প কিছু মিশর ও এশিয়া মাইনরে ও চীন দেশে। চীনে তো প্রতিবেশী যাযাবর ঘোড়সওয়ার জাতিগুলোর সামরিক অভিযান থেকে রক্ষা পাবার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তার সীমান্তে দেয়াল তুলে নিজেদেরই অবরুদ্ধ করেছিল। বোধগম্য কারণেই প্রাচীরে ঘেরা ছিল সিন্ধুসভ্যতার হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর নগরগুলোও।

প্রাচীন দুনিয়ার অবশ্য একটি ব্যতিক্রমী নগর মিলবে যারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু তাদের নগরপ্রাচীরের বালাই ছিল না। কেননা অবরুদ্ধ হওয়াটি তার অভিজ্ঞতায় নেই, যদিও অন্যদের বহুবার অবরোধ করেছে তারা। সেটি গ্রিসের স্পার্টা। প্রতিদ্বন্দ্বীরা স্পার্টার গৌরবের কালে এটিকে অবরোধ করবার কথা কল্পনাও করতে পারতো না। আলেকজান্ডার পরবর্তীকালের বিখ্যাত সমরকুশলী রাজা পিররাস (৩১৯/৩১৮-২৭২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) --যার নামে 'পিররিক ভিকটরি' বা পরাজয়তুল্য বিজয় প্রবাদটির জন্ম হয়েছে-- স্পার্টার অবনতির কালে এবং স্পার্টার সেনাবাহিনীর বিদেশে অবস্থানের সুযোগ নিয়ে, সর্বোপরি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দেয়ালহীন এই নগরটি দখল করতে ব্যর্থ হন। বিশেষত স্পার্টার নারীরাও যে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তাতে তাকে পিছু হটতে হয়।

বাঁশির শব্দ শুনে যুদ্ধেক্ষেত্রের দিকে যাচ্ছে স্পার্টার নারী সৈনিকরা

অন্যদিকে স্পার্টার প্রতিদ্বন্দ্বী সবগুলো নগরই ছিল দেয়ালঘেরা, যেমন আর্গস,করিন্থ, এথেন্স বা থিবস। দেয়ালহীন নগরগুলোকে অগুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই ভাবা হতো। কোনো জনপদ নতুন করে দেয়াল তুলছে কথাটার মানে হলো তার প্রভাবশালী হয়ে উঠবার বাসনা তৈরি হয়েছে। যুদ্ধে পরাজিত নগরীকে দেয়াল ভেঙে ফেলতে হতো প্রায়ই, পারস্য সম্রাট দারায়ূস (৫৫০-৪৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এশিয়া মাইনরের গ্রিক নগরীগুলোকে দেয়াল ভেঙে ফেলবার হুকুম করেছিলেন তাদের বিদ্রোহ করবার সম্ভাবনা ঠেকাতে। এথেন্স তার নৌ সাম্রাজ্যের কালে পর্যুদস্তু শত্রু নগরীগুলোকে বাধ্য করতো তাদের নগরপ্রাচীর ভেঙে ফেলতে-- এতে বিনা অবরোধে শত্রুর সামনে ভেঙে পড়তে হতো বলে বিদ্রোহের সম্ভাবনা যেতো কমে। 

কামান-গোলা-বারুদহীন সেই দুনিয়াতে দেয়াল বিরাট পার্থক্য গড়ে দিতো বলেই অবরোধগুলো প্রায়ই দীর্ঘস্থায়ী হতো। স্পার্টার সাথে সম্মুখ যুদ্ধে টিকবে না বলে বহুবার এথেনীয়রা আশ্রয় নিয়েছিল নগরপ্রাচীরের  পেছনে। পেলোপনেশীয় যুদ্ধের সূচনাতেই ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভয়াবহ প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে স্পার্টার হাতে অবরুদ্ধ নগরীতে। সম্ভবত এই মহামারীর কারণ ছিল অবরোধের কারণে গোটা জনগোষ্ঠী দেয়ালের মাঝে চলে আসায় জনঘনত্ব বৃদ্ধি। অবরোধকারীরা সাধারণত শত্রুপক্ষের খাদ্যভাণ্ডার শেষ হওয়া কিংবা লোকক্ষয় বা মহামারী কিংবা ষড়যন্ত্র ইত্যাদির অপেক্ষা করতো। অবরোধ-প্রকৌশলের বিকাশের আগেকার যুগে দেয়ালের পাশে মই ঠেকিয়ে কিংবা উঁচু মাচা বানিয়ে অথবা মাটির স্তুপ তৈরি করে সেখান থেকে শহরটাতে ঢুকে পরার চেষ্টাও হতো। রোম পূর্ববর্তী যুগে এগুলো প্রায়ই সফল হতো না, তুলনামূলক ছোট জনবল নিয়েও অবরুদ্ধ নগরীকে রক্ষার ঐতিহাসিক কাহিনী অজস্র।

 

২.

হোমারের মহাকাব্যের ১০ বছর ধরে চলা গ্রিক-ট্রয়ের যুদ্ধও একটা দীর্ঘ অবরোধেরই কাহিনী। এই অবরোধের সমাপ্তি ঘটে গ্রিকদের বানানো কাঠের ঘোড়াটিকে ট্রোজানরা নগরের ভিতরে নিয়ে যাবার ফাঁদটিতে পা দেয়ার মধ্য দিয়ে। ঘোড়ার পেটে লুকিয়ে থাকা গ্রিক সৈনিকেরা রাতের বেলা নগরদ্বার খুলে দেয়, ওদিকে চলে যাবার ভান করা বাকি  গ্রিক সৈন্যরা জাহাজ থেকে নেমে এবার সহজেই ট্রয় নগরী ধ্বংস করে।

প্রতীকি অর্থে হলেও এত দীর্ঘ মরিয়া অবরোধের তাৎপর্য আছে। ট্রয় নগরটি কিন্তু অনৈতিহাসিক নয়। আধুনিক তুরস্কের দার্দানালিস প্রণালীর কাছেই এশীয় অংশে প্রত্নতত্ত্ববিদরা খুঁজে পেয়েছেন একের ওপর গড়ে ওঠা ৯টি নগরীর ধ্বংসস্তুপ। তাদের অনুমান নিচের দিক থেকে ষষ্ঠ নগরটি আলোচ্য ট্রয়ের যুদ্ধের ট্রয়, যেটি দীর্ঘ অবরোধের শিকার হয়েছিল ১২৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে।  বাইজানটিয়াম, পরবর্তীতে কন্সটান্টিনোপল হয়ে আজকে ইস্তাম্বুল নামের বসফরাসের ইউরোপীয় অংশে নগরটি যে কারণে আজকেও গুরুত্বপূর্ণ-- এটি একদিকে সংযুক্ত করেছে এশিয়া ও ইউরোপকে, এবং এই দার্দানালিস ও বসফরাস প্রণালীদ্বয় যুক্ত করেছে ভূমধ্যসাগরকে মর্মর সাগর ও কৃষ্ণসাগরের সাথে-- সেই একই কারণে ট্রয়েরও ভৌগোলিক অবস্থানটি নির্ধারক ছিল। সময়টি তখনকার প্রবলপ্রতাপ একটি সাম্রাজ্য হিট্টাইটদের অব্ক্ষয়ের কাল; হিট্টাইটদের একটি অধীনস্ত নগরী ছিল ট্রয়। পূবে হিট্টাইটরা যখন দুর্বল হচ্ছে, পশ্চিমে তখন জেগে উঠছে মাইসেনীয় গ্রিকরা। ফলে পূর্বপশ্চিমের ভূখণ্ডের এবং দুই গুরুত্বপূর্ণ সাগরের সংযোগপথে অবস্থিত ট্রয়কে নিয়ে যুদ্ধ হবারই কথা। প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করেন ট্রয়ের ঘোড়াটি আসলে নগরপ্রাচীর ভাঙার জন্য ব্যবহৃত হাতিয়ার। মেসোপটেমিয়াতেও ঘোড়া কিংবা গাধার সদৃশ্য বিশালাকার মুগুর বানানো হতো যার ধাতব অগ্রভাগের আঘাতে আঘাতে শত্রুপক্ষের মাটির প্রাচীর ভাঙা হতো। মহাকাব্যের হেলেন আর প্যারিসের প্রেমকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া এই ট্রয়ের অবরোধের বাস্তব অর্থনৈতিক- রাজনৈতিক-সামরিক তাৎপর্যটা তাই ফেলনা নয়। 

 

৩. 

প্রাচীন গ্রিসের দুই প্রধান ইতিহাসবিদ হিরোডোটাস ও থুসিডিডিস অজস্র অরোধের বিবরণ দিয়েছেন তাদের গ্রন্থে। প্রথমজন পারস্য-গ্রিক যুদ্ধের বিবরণ দিয়েছেন, পরেরজন স্পার্টা-এথেন্সের মাঝে অনুষ্ঠিত কয়েক দশকব্যাপী পেলোপনেশিয় যুদ্ধের। থুসিডিডিসের কল্যাণে ৪১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্স কর্তৃক এজিয়ান সাগরের নিরপেক্ষ নগরী মেলোস অবরোধের বিবরণটি অমর হয়ে আছে। অবরোধের আগে উভয়পক্ষের মাঝেকার দীর্ঘ সংলাপে মেলীয়রা দাবি করে যে তারা ঈশ্বরের সহায়তা পাবে, কেননা তাদের অবস্থানটি নীতিনিষ্ঠ। এথেনীয়রা প্রত্যুত্তরে জানায় যে ঈশ্বর হস্তক্ষেপ করবেন না, কেননা দুর্বলদের সবলরা শাসন করবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম।

বিজয়ী স্পার্টান সৈন্যদের হর্ষধ্বনি-উল্লাসের সঙ্গে বরণ করে নিচ্ছে নগরবাসী

কয়েকমাসের অবরোধের পর মেলীয়রা অনাহারের মুখোমুখি হয়ে আত্মসমর্পণ করে। এথেনীয় সৈন্যরা মেলোসের সকল পুরুষকে হত্যা  এবং নারী ও শিশুদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। এথেন্স এই দৃষ্টান্তটি স্থাপন করে শত্রুদের ভীতি ও মিত্রদের আনুগত্য নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু সমকালেও মেলোস এথেন্সের নিষ্ঠুরতার উদাহরণ হিসেবেই বিবেচিত হতো, একটা গ্রিক নগরী আরেকটা নগররাষ্ট্রের গ্রিক নাগরিকদের দাস হিসেবে বিক্রি করবে এটা তখন কল্পনাতীত ছিল। পেলোপনেশীয় যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ৪০৫ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে এথেন্সের নৌবাহিনী প্রথমবারের মত স্পার্টার কাছে নৌযুদ্ধে পরাস্ত হয়, এরপর স্পার্টার নৌ ও স্থল উভয় অবরোধে অনাহারের মুখে পড়া নৌশক্তিহীন এথেন্স আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের শর্ত ছিল যথেষ্টই শিথিল: এথেন্সের নগরপ্রাচীর ভেঙে ফেলতে হবে এবং তার  নৌবাহিনী বিলুপ্ত করে তাকে স্পার্টার মিত্রজোটে অংশে নিতে হবে। অবশ্য স্পার্টার তখনকার দুই প্রধান মিত্র থিবস ও করিন্থ দাবি করেছিল এথেন্সকে গুড়িয়ে দিয়ে এথেনীয়দের দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়ার, মেলোস দ্বীপের পুনরাবৃত্তি চাই্ছিলেন তারা।

৪. 

প্রাচীন পৃথিবীর সাত আশ্চর্যের মাঝে একটি ছিল রোডস দ্বীপের মূর্তি। 

এই ভাস্কর্যটির সাথেও সম্পর্ক আছে একটি অবরোধের ঘটনার। বা বলা উচিত, একটি অবরোধ, পাল্টা অবরোধ আর বিশাল সব সংঘর্ষের যুগের সাথে। ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার বিপুল সাম্রাজ্য নিয়ে সমরপতিদের মাঝে কয়েক প্রজন্মের যে বহুমুখী যুদ্ধের কালের সূত্রপাত হয়, ইতিহাসে এই পর্বটি (৩২২-২৮১ খ্রিস্টপূর্ব) উত্তরাধিকারের যু্দ্ধ হিসেবে পরিচিত। অবরোধের যন্ত্রপাতি ও প্রকৌশল এই যুদ্ধের সময়ে বিপুল উন্নতি লাভ করে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের একজন ছিলেন প্রথম অ্যানটিগোনাস, একচোখা অ্যানটিগোনাস নামে খ্যাত, তার দখলে ছিল এশিয়া মাইনর। সমুদ্রে প্রাধান্য পেতে তিনি ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোডস দ্বীপটি দখল করতে পাঠান তার পুত্র দিমিত্রিয়াসকে। নৌ ও স্থল উভয় দিক দিয়ে অবরুদ্ধ অবস্থায় দ্বীপবাসী নগরদেয়াল এবং পোতাশ্রয়ের ওপর একের পর এক হামলা রুখে দেয়। 

আলেকজান্ডার

 রোডসের প্রাচীর ভেদ করবার জন্য দিমিত্রিয়াসের কয়েকটি অবরোধ-যন্ত্র ব্যর্থ হবার পর তিনি দৈত্যাকার যে অবরোধ-যন্ত্রটি বানিয়েছিলেন, তার নাম ছিলো হেলেপোলিস, বাংলায় বলতে পারি নগরদখল-যন্ত্র। ওপর দিকে সরু হয়ে ওঠা বহুতল এই যন্ত্রটির উচ্চতা ছিল ৬৫ ফুট। ১৫ ফুট উঁচু ৮টি চাকার ওপর এটি স্থাপিত ছিল। ১৬০ টনের এই যন্ত্রটিকে পালাক্রমে নড়াচড়া করাবার জন্য তিন হাজার চারশো মানুষ কাজ করতেন। এর প্রতিটি তলায় শত্রুর দিকে ছিল নানান ওজনের পাথড় ছুড়ে মারবার উপযোগী যন্ত্রপাতি। ছিল একটি বাইরের দিকে বেড়িয়ে আসা সিঁড়ি যেটি সৈন্যদের নগরপ্রাচীরের ওপর নামতে সাহায্য করবে। 

কিন্তু নগর-পরিকল্পনাবিদের দেয়া বুদ্ধি প্রয়োগ করে রোডস এই মহাআতঙ্কটিকে অকেজো করতে সক্ষম হয়। অবশেষে একবছরের দীর্ঘ অবরোধ শেষে দিমিত্রিয়াস অবরোধ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। রোডসবাসী এই অবরোধ প্রতিহত করবার ইতিহাসকে উদযাপন করবার জন্য পরিত্যক্ত হেলেপোলিসের ধাতব উপাদানগুলোকে বিক্রি করে সেই টাকায় সূর্যদেবতা হেলিওসের ভাস্কর্য নির্মাণ করেন যা ছিল প্রাচীন পৃথিবীর বৃহ্ত্তম ভাস্কর্য, ১০৮ ফুট উঁচু এই্ ভাস্কর্যটি স্ট্যাচু অব লিবার্টির সমান।

স্বাধীনতার স্পৃহার স্মারক হিসেবে এই মূর্তিটি টিকেছিল বহুকাল। ২২৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের ভূমিকম্পে এটি ভূমিস্মাৎ হয়। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো, প্রাচীন পৃথিবীর এই সাত আশ্চর্যের মাঝে একটি মাত্র ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী নয়, সেটি ব্যবিলনের শূন্য উদ্যান, প্রতিবেশী পারসিক সাম্রাজ্যে ছিল এই বিলুপ্ত আশ্চর্যকীর্তিটির অবস্থান। কারণটি সোজা, এই সাত আশ্চর্যের তালিকাটা আসলে তৈরি করা হয়েছিল রোমান সাম্রাজ্যের ধনী নাগরিকদের জন্য তখনকার দিনের একটি পর্যটন-নির্দেশিকা হিসেবেই।

অবরোধ-যন্ত্রের গ্রিক ও কার্থেজিয় ঐতিহ্য বিশেষভাবে বিকশিত হয় রোমান সাম্রাজ্যে এসে। শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে বিশেষ ধারাবাহিকতার কারণেই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেও দীর্ঘদিন এক একটা অবরোধ চালিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। অবশ্যই এতে রোমান প্রকৌশল ও সমরবিদ্যারও কৃতিত্ব আছে। ঘুষ-অভ্যন্তরীণ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র ব্যবহারের রোমান সুখ্যাতিও তাদের অবরোধগুলোকে সফল করতে ভূমিকা রেখেছে।

অবরোধের প্রাক্কালে ব্যাবিলন

রোমের ইতিহাসের সবচাইতে বড় সাফল্য ছিল ১৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধে কার্থেজ অবরোধ ও নগরটিকে সমূলে ধ্বংস করে সেখানে প্রতীকি গমের বীজ বপন করা। রোমের উত্থানের আগে বর্তমান তিউনিশিয়ার কার্থেজ নগরটি পুরো ভূমধ্যসাগরের নিয়ন্ত্রক ছিল, তারা বাইবেলের কেনান জাতিভুক্ত ফিনিসীয়দের একটি শাখা। এখনকার স্পেন, সিসিলি ও উত্তর আফ্রিকার বিপুল এলাকা তার নিয়ন্ত্রণে ছিল, উপকূল ধরে ধরে ছিল তাদের বাণিজ্যকেন্দ্র। উদীয়মান রোমকে একাধিকার বিপর্যস্ত করেছে তারা, ২১৮-২০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের এক পর্যায়ে তাদের বিখ্যাত সেনাপতি হ্যানিবল রোমের সীমানায় চলে এসেছিলেন অভাবিত সব বিজয় আর্জন করে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কার্থেজ পরাজিত হলে বিপুল ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি নগরটির ওপর অসামরিকীকরণের শর্ত চাপিয়ে দেয়া হয়। এরও ৫০ বছর পর রোমের সিনেট সিদ্ধান্ত নেয় নগরটিকে আমূলে উপড়ে ফেলবার। সামরিক ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলা কার্থেজ আত্মসমর্পণ করতে চাইলেও রোমান সেনাপতি জানিয়ে দেন সিনেটের আদেশ: সমুদ্রতীর থেকে ৫০ মাইল গভীরে নগরটি সরিয়ে নিতে হবে। বিপুল রোমান সেনা ও তাদের সুদক্ষ সব অবরোধ-যন্ত্রপাতির মুখোমুখি হয়ে দুই বছরেরও বেশি সময় কার্থেজের নাগরিকরা শহরটিকে রক্ষা করেন। অবশেষে একটা ভাঙা দেয়াল দিয়ে ঢুকে পড়া রোমানরা একটা একটা করে দালান দখল ও অগ্নিসংযোগ করে পুরো নগরটি ধ্বংস করে। বেঁচে যাওয়া ৫০ হাজার মানুষকে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়।

কার্থেজের সাথে রোমের যুদ্ধটি ছিল দুটো বড় শক্তির ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ওপর আধিপত্য নিয়ে, যেখানে একজনকে বিদায় নিতেই হতো। কার্থেজ নৌ শক্তি, নৌবানিজ্যকেন্দ্রগুলোই ছিল তার খুঁটি। রোম সাম্রাজ্য প্রধানত ছিল স্থলশক্তি, সেই্ সময়ের নৌ শক্তিগুলোর পক্ষে রোমের মত সাম্রাজ্যিক গভীরতা অর্জন করা কঠিন ছিল। খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, বিপদের সময়ে রোমের মিত্ররা বড় অংশই রোমের প্রতি অনুগত ছিল, হানিবল তাই যুদ্ধে জিতেও রোম অবরোধ করতে পারেননি। অন্যদিকে কার্থেজের প্রতিবেশী লিবীয় ও নুবীয়রা নগরটির পতনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। কার্থেজের সাথে সাথে মানব সভ্যতার এখনকার চালু লিখন পদ্ধতিসহ অজস্র নতুন কিছু যুক্ত করা ফিনিশীয় নৌ-বনিক সভ্যতার বিদায় ঘটে।

রোমের আরও দুটি বিখ্যাত অবরোধ ইতিহাসে আলোচিত, যদিও সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিপক্ষ ছিল নগণ্য, তারা বনি ইসরায়েল সম্প্রদায়। অভ্যন্তরীণ অনেকগুলো ধর্মীয় উপদলের পারস্পরিক খুনোখুনি সত্ত্বেও প্রকৃতিপুজারী রোমানদের বিরুদ্ধে একেশ্বরবাদী ইহুদী ধর্মোন্মাদনা এই অবরোধ দুটিকে রক্তক্ষয়ী করেছিল, ভূগোলও অবশ্য বিশাল সুবিধা দিয়েছিল। ৬৬ থেকে ৭৩ খ্রিস্টাব্দে চলা এই প্রথম ইহুদী বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়ে রোম ইহুদিদের বাকি সবগুলো জনপদকে সামরিক শক্তিতে দ্রুতই দমন করতে পারলেও জেরুসালেম তার বিপুল প্রাচীর নিয়ে অমানুষিক একটি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এই অবরোধ ও প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রায় প্রতিটি দিনই ঘটনাপূর্ণ। রোমানরা নগরপ্রাচীরের চারদিকে আরেকটি প্রাচীর নির্মাণ করে যাতে জেরুসালেমের কেউ গোপনে বাইরে থেকে খাবার আনতে না পারে, ধরা পড়া সকলকে শূলবিদ্ধ করে ঝুলিয়ে রাখা হতো। অন্যদিকে রোমানদের বিপুল আকারের অবরোধ-যন্ত্রকে ইহুদীরা নিপুন বুদ্ধিতে ধ্বংস করে দেয়।

আক্রেইর অবরোধ এবং হত্যাযজ্ঞ

প্রায় পাঁচ মাসের এই অবরোধের শেষভাগে ইঞ্চি ইঞ্চি করেই রোমানদের অগ্রসর হতে হয়, আগুনও একটা বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। পরাজিত নগরটির অধিকাংশ অধিবাসীকে হত্যা করা হয়, যে লাখ খানেক মানুষ বেঁচে গিয়েছিলেন কম বয়েসের কারণে, তাদের দাস হিসেবে বিক্রি হয়ে  রোমান সাম্রাজ্যের নানান প্রান্তে চলে যেতে হয়। বিদ্রোহের ধর্মীয় তাৎপর্যের কারণেই জেরুসালেমের ইহুদীদের প্রধান উপাসনাগৃহের সামনে শুকর বলি দিয়ে রোমানরা ইহুদী একেশ্বরবাদের ওপর তাদের দেবতাদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে। শেষ ইহুদি দুর্গ মাসাদা অবস্থিত ছিল একদম খাড়া একটি পাহাড়ের ওপর। ভৌগোলিক সুবিধার কারণে হাজারেরও কম মানুষ দুর্গটি রক্ষা করেছিলেন কয়েক মাস ধরে। অবরোধ শেষে ৯৬০ জন আত্মহত্যা করেন, ৭ জনকে জীবিত ধরা হয়, যাদের মাঝে ৫টি শিশু আর দুজন নারী। জেরুসালেম এর আগে ব্যাবিলনীয়, অ্যাসিরীয় ও পারসিক অবরোধের মুখে বিপর্যস্ত হলেও, এমনকি কোন কোন ঘটনাতে আস্ত জনগোষ্ঠীকে দূর দেশে স্থানান্তরিত করা হলেও এত বিপুল হত্যাকাণ্ড ঘটেনি এর আগে। জেরুসালেমের এই ধ্বংস ইহুদী ধর্মের জন্য রীতিমত অস্তিত্ব সংকট তৈরি করে।

 

জেরুসালেম অবশ্য পৃথিবীর ইতিহাসে সবচাইতে বেশি অবরোধের শিকার হওয়া নগরগুরোর মাঝে একটি। ১০৯৯ সালে ক্রুসেডাররা শিয়া ফাতেমীয় খলিফাদের দখলে থাকা জেরুসালেম অবরোধ শেষে দখলের পর নগরটির সকলকে হত্যা করে-- মুসলিম, ইহুদী এবং অর্থডক্স খ্রিস্টান সকলেই এই গণহত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এর অনতিকাল পর সালাউদ্দীন আবার জেরুসালেম পুনর্দখল করেন।

১১৮৯-১১৯১ সালের তৃতীয় ক্রুসেডে সমুদ্রতীরবর্তী অ্যাক্রে অবরোধ ইতিহাসে বহু কারণে স্মরণীয় হয়ে আছে। নগরটির দুর্গের ভেতরে হাজার তিনেক সালাউদ্দীনের সৈন্য, দেয়ালের চারপাশে খ্রিস্টান বাহিনী। এই ক্রুসেডারদের আবার ঘিরে রেখেছে সালাউদ্দীন এর মূল বাহিনী।

পারস্য সম্রাট সাইরাস কর্তৃক ব্যাবিলন অবরোধের কাহিনী বর্ণনা করেছেন ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস

ক্রুসেডাররা যখনই আক্রের নগরদেয়ালে আক্রমণ করে, সালাউদ্দীন তার ঘোরসওয়ারদের নিয়ে ক্রুসেডারদের পেছন দিকে হামলে পড়েন। আত্মরক্ষার্থে আবারো হামলা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয় ক্রুসেডাররা-- এই ভাবে বছর পেরিয়ে চলল অবরোধ। অবরোধকে এভাবে দীর্ঘস্থায়ী করতে অ্যাক্রের যোদ্ধাদের সাহায্য করেছিল একটি বিশেষ প্রযুক্তি, সেটি গ্রিক ফায়ার। এর সাহায্যে অবরোধের জন্য ক্রুসেডারদের দীর্ঘ পরিশ্রমে বানানো বিশালাকার যন্ত্রপাতি পুড়িয়ে দিয়ে এবং আগুনে গোলা নিক্ষেপ করে অ্যাক্রের হাতে গোণা রক্ষীরা টিকে থাকতে পেরেছিল। এত দীর্ঘ এই অবরোধের অন্য একটি দিক নিয়ে  বাহাউদ্দীন নামের সমকালীন একজন লেখকের বর্ণনাটি এমন: 'দু পক্ষ পরস্পরের চেহারা দেখে এতটা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে অনেক সময় মুসলিম এবং ফ্রাঙ্কিশ সেনারা যুদ্ধ রেখে আলাপে মেতে উঠতো। দুটো দল মিলেমিশে গাইত, নাচত তারপর আবার ফিরে যেত যুদ্ধে"। ক্রুসেডের ইতিহাস লিখতে গিয়ে হ্যারল্ড ল্যাম্ব অভিযানের সময়ে উপস্থিত অন্য একজন ক্রিশ্চান পাদ্রীর উদ্ধৃতি দিয়েছেন, 'ওরা যদি বিধর্মী না হত, তাহলে বলতাম ওরা আমার দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষ।'

অবশেষে অ্যাক্রে আত্মসর্পণ করে রসদ ফুরিয়ে যাওয়ায়, সাগরপথটি রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় সালাউদ্দীন সেখানে জনবল ও অন্যান্য সামগ্রি পাঠাতে পারছিলেন না। আত্মসমর্পণের শর্ত বাস্তবায়ন ও উভয়পক্ষের বন্দি বিনিময়ের উপায় নিয়ে বনিবনা না হওয়াতে লায়নহার্ট হিসেবে খ্যাত রাজা রিচার্ড অ্যাক্রেতে আত্মসমর্পণ করা প্রায় তিন হাজার যুদ্ধবন্দীকে শিরোচ্ছেদ করে হত্যার নির্দেশ দেন।

৬. 

প্রাচীন অবরোধ ও নগরপ্রাচীরের এই পুরনো ব্যকরণ বেশ খানিকটা গুড়িয়ে যায় কামানের আবিষ্কারের কল্যানে। অবশ্য এই কামান আসবার আগেও অবরোধ যন্ত্রপাতির বিপুল উন্নতি হয়ে গিয়েছিল। সঙ রাজবংশের হাত থেকে চীনের অধিকাংশটা দখল করবার পর চেঙ্গিস খানের নাতি কুবলাই খান (১২১৫-১২৯৪) জিয়াঙইয়াঙ নগরীর ক্লান্তিকর অবরোধ (১২৭১-১২৭৩) সফল করতে ইরাক থেকে দুই আরব প্রকৌশলকে ডেকে পাঠান। তারা এমন নিক্ষেপক যন্ত্র বানিয়ে দেন কুবলাই খানকে, যেটি ১৫০০ ফুট দূরে ৩০০ কেজি ওজনের পাথড় ছুড়তে পারে। দুই বছর মোঙ্গল অবরোধ মোকাবিলা করলেও এই ভয়াবহ অস্ত্রের সামনে টিকে থাকতে পারেনি নগরটি, আত্মমর্পণ করে। এর মধ্য দিয়েই চীনে সঙ রাজত্বের শেষ বড় ঘাটির পতন হয়, দ্রুতই অবশিষ্ট সঙ তাসের মতই ভেঙে পড়ে। পুরো চীনকে একীভূত করেন বহিরাগত কুবলাই খান।

কিন্তু মোঙ্গলদের চীন আক্রমণের সূত্রেই রেশম পথ ধরে একটি চীনা প্রযুক্তি ক্রমাগত আরও বিকশিত হয়ে যুদ্ধের পুরনো ছক বদলে দেয়া এই ভয়াবহ প্রযুক্তিটি দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে যায়, সেটি ওই বারুদ ও কামান।

আজকের তুরস্কের জন্মের ইতিহাস ও ভূগোলের পেছনে কামানের বিরাট ভূমিকা আছে। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের এই মহানগরীটির প্রাচীর ও রক্ষণব্যবস্থা এর আগে অজস্র জাতিগোষ্ঠীর হামলা ও অবরোধ প্রতিহত করেছে; এই হামলাকারীদের মাঝে আছে গ্রিক, মেসেডোনীয়, রোমান, রুশ, আভার, বুলগার, আরব উমাইয়াসহ অজস্র শত্রু। এই তালিকার অধিকাংশ অবরোধই ব্যর্থ হয়েছে, কারণ সম্রাট থিওডোসিয়ানের বানানো বিশাল এর সুরক্ষা দেয়াল, সমুদ্র ও স্থল সকল দিক দিয়েই যা নগরটিকে ঘিরে ছিল। এর ন্যূনতম উচ্চতা ছিল ৩০ ফুট। অটোমানদের কামানের গোলাতে কন্সটান্টিনোপলের পতন হয় ১৪৫৩ সালে, ৫৩ দিনের অবরোধ শেষে, এটি আজ তুরস্কের ইস্তাম্বুল নগরী। এর আগেই আনাতোলিয়া দখল করে নেয়া তুরস্ক এরপর ইউরোপের বিরাট ভূখণ্ড নিজের দখলে নিতে সক্ষম হয়, হানা দেয় ভিয়েনার নগরপ্রাচীর পর্যন্ত। বলে রাখা ভালো, জেরুসালেমের মতই ইস্তাম্বুলও অন্যতম বেশিবার অবরোধের শিকার হওয়া নগরী।

ব্যাবিলন অবরুদ্ধ

কামানের আবির্ভাবের সাথে সাথে নগর প্রাচীরের তাৎপর্য যেমন ক্রমশঃ হ্রাস পেতে থাকে, নগর অবরোধের সংখ্যাও কমে আসতে থাকে। যুদ্ধের সংখ্যা কিন্তু কমেনি, প্রযুক্তি যুদ্ধোন্মাদনা বাড়িয়েই তুলতে থাকে। ষোড়শ শতকের পরেরকার নগরগুলো সাধারণত দেয়াল ঘেরা থাকতো না, কামানের সামনে দেয়াল যেহেতু আর সুরক্ষা দেবে না। বহুক্ষেত্রে তাই নগরের বাইরেই যুদ্ধটাকে নিয়ে যাবার চেষ্টা চলতো। তবে এটা সর্বক্ষেত্রে ঠিকও নয়, সাম্প্রতিক ইতিহাসেও আমরা যুগোশ্লাভীয় গৃহযুদ্ধের সময়ে অবোরোধের ঘটনা দেখেছি, আমরা জানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্তালিনগ্রাদ অবরোধের শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী।

১৯৭১ সালে ঢাকাও প্রায় অবরুদ্ধই ছিল। তবু বলা যায়, নগর বা দুর্গ অবরোধ করবার সামরিক কৌশলের যুগটির শেষের সূচনা ঘটেছে কামানের আবির্ভাবের সাথে। নেপোলিয়ন (১৭৬৯-১৮২১) এর পরিচালিত যুদ্ধগুলোতে যেমন দেখা যাবে তার সৈন্যবাহিনীর মুখোমুখি হতে অনিচ্ছুক কিংবা বাধ্য হয়ে মুখোমুখি হওয়া বাহিনীগুলো ভিয়েনা কিংবা এমনি সব বড় শহরের বাইরে যুদ্ধ করার চেষ্টা করছে শহরের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে। 

এমনকি ১৮১৩ সালে ৬ জাতির মিত্রসংঘের সাথে যুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর অচিরেই কামানের ভয়াবহ ক্ষত এড়াতে প্যারিস প্রতিরোধ না করে আত্মসমর্পণের পথ নেয়, নেপোলিয়নকে পদচ্যুত করে ফরাসি প্রতিনিধিসভা। নেপোলিয়ন শত্রুঅধিকৃত প্যারিস আক্রমণ করবার সিদ্ধান্ত নিলে তার বিশ্বস্ত সেনাপতিরাও বিদ্রোহ করেন। তবু কিন্তু এই নেপোলিয়নের যুগেও বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়েছে যেখানে নগরের রাস্তায় রাস্তায় বেয়নেট ও তলোয়ার যুদ্ধেই অবরোধের সমাপ্তি ঘটেছে, বিশেষ করে সেগুলো ঘটেছে স্পেনে।

 

৭.

এই সময়ের স্থলযুদ্ধে নেপোলিয়নের শ্রেষ্ঠত্ব আর নৌযুদ্ধে ইংলান্ডের শ্রেষ্ঠত্ব একটা সামরিক অচলাবস্থা  সৃষ্টি করে। ফ্রান্সের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেয়া ইংল্যান্ডকে শায়েস্তা করতে ১৮০৬ সালে ফ্রান্সের জারি করা পাল্টা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাটি নেপোলিয়ন একের পর এক ইউরোপীয় রাষ্ট্রকে মেনে নিতে বাধ্য করেন। তখনকার সবচাইতে শিল্পোন্নত দেশ, এবং একইসাথে পৃথিবীর সবচাইতে বড় নৌবাণিজ্যের অধিকারী ইংল্যান্ড সারা দুনিয়ার পণ্যসামগ্রী এবং নিজের কারখানার মালামাল পুরো ইউরোপজুড়ে বিক্রি করতো, এবং এদের কাছ থেকে ভেড়ার পশম, খাদ্যসামগ্রী ও আরও নানান পণ্য সংগ্রহ করতো। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তার কৃষিজাত নানান কাঁচামাল-- যাদের মাঝে তামাক ও তুলা অন্যতম-- ইংল্যান্ডের কাছে বিক্রি করতো, আমদানি করতো প্রক্রিয়াজাত পণ্য।

নেপোলিয়নের অসাধারণ সব সামরিক কৌশল সত্ত্বেও একসাথে সকলকে শত্রু বানিয়ে ফেলবার ভুল রাষ্ট্রনীতির পাশাপাশি এই মহাদেশীয় বাণিজ্য অবরোধের বন্দোবস্ত শেষপর্যন্ত তার পরাজয়ের সূচনা ঘটিয়েছিল বলে অনেকেই মনে করেন। এই রকম একটি অসম্ভব অবরোধ কায়েম করবার মত কোন নৌবাহিনী নেপোলিয়নের ছিল না, ফলে প্রতিটি রাষ্ট্রই গোপনে ইংল্যান্ডের সাথে চোরাকারবারে বিকল্প বন্দোবস্ত করে নেয়। নৌশক্তিতে ইংল্যান্ডের আধিপত্য এতদূর ছিল যে স্থলযুদ্ধে তারা মার্কিনীদের সাথে বহুবার পরাজিত হলেও ফ্রান্সের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাকে মেনে নিতে মার্কিনীদের বাধ্য করতে তারা স্থিরপ্রতিজ্ঞ ছিল। পরিণতিতে এত দিন নিরপেক্ষ থাকা মার্কিনীদের সাথে ইংল্যান্ডের নতুন করে যুদ্ধ (১৮১২-১৫) শুরু হলেও ইউরোপের মহাদেশীয় অবরোধের যুদ্ধমঞ্চে শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডেরই বিজয় ঘটে।

আধুনিককালের অবরোধগুলো মাঝে বিখ্যাত হয়ে আছে ১৯৬২ সালে সোভিয়েত ই্‌উনিয়নের ক্ষেপনাস্ত্র ঘাটি স্থাপনকে কেন্দ্র করে কিউবার ওপর আরোপিত মার্কিন নৌ অবরোধ। আলোচনার মাধ্যমে সেবারের মত মিমাংসা হলেও পৃথিবীর ইতিহাসের দীর্ঘমেয়াদী বাণিজ্য অবরোধের মুখোমুখি হয়ে টিকে থাকার ইতিহাসটি কিউবার ঝুলিতেই আছে। এই প্রবল অবরোধের মাঝে থেকেও শিক্ষা-গবেষণা-স্বাস্থ্যখাত-জৈবপ্রযুক্তি-বিষমুক্ত কৃষিতে দেশটি অসাধারণ সব বিকল্প পথ ও পদ্ধতি নির্মাণ করেছে।

পলোপশিয়ান যুদ্ধ

১৯৭৩ সালে ইসরায়েলের ভূমিগ্রাসের প্রতিবাদে ওপেকের জ্বালানি তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা একটা বড় ঘটনা, যা শেষবিচারে শুধু ব্যর্থই হয়নি, মধ্যপ্রাচ্যের ওপর পশ্চিমের দখলদারিত্ব এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহকে আরও গভীর ও বহুমুখী করেছে। তবু এটা অবরোধেরই ভিন্ন একটি মাত্রা হিসেবে উল্লেখযোগ্য।

কিন্তু মানবিক বিপর্যয়ের দিক দিয়ে ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের পর ১৯৯০-২০০৩ পর্যন্ত ইরাকের ওপর জাতিসংঘের নামে আরোপিত বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার-- কার্যত একটি মহাঅবরোধ-- তুলনা আধুনিক ইতিহাসে বিরল। তখনকার একমেরু দুনিয়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতি একতরফা ভাবে পৃথিবীর ওপর আরোপ করেছিল। অবরোধের পরিণামে ৫ লাখের বেশি ইরাকি শিশু বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করে, পোলিওর মত অসুখ দেশটিতে ফিরে আসে। সুপেয় জলের অভাবে আমাশয় নৈমত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এর আগ পর্যন্ত ধনী দেশটির নাগরিকদের গড় আয়ু তখন দরিদ্র দুনিয়ার চাইতেও কমে যায়। এই দীর্ঘ অবরোধকে, ওই সময়ে বেড়ে ওঠা প্রজন্মটি পরবর্তীকালের উগ্র পশ্চিম বিদ্বেষী ধর্মান্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিভূমি হিসেবে করেছিল, যার পরিনাম গোটা দুনিয়াকে ভোগ করতে হয়েছে।  

 

৮.

কিন্তু ইরাকের মধ্য দিয়েও পৃথিবীতে বাণিজ্য অবরোধের সমাপ্তি ঘটেনি। বরং নতুন একটি বাণিজ্য অবরোধের যুগের সূচনা ঘটার সকল বাস্তবতাই আমাদের সামনে উ্পস্থিত। হুয়াওয়ের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা মেঙ ওয়াঙঝু ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কানাডায় নজরবন্দি ও বিচারের সম্মুখীন, কারণ অন্য একটি রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্দেহ হুয়াওয়ে কোম্পানিটি ইরানের কাছে তার নিষেধ করা প্রযুক্তি বিক্রি করেছে! ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করার ফলে কোন রাষ্ট্র ইরানের কাছ থেকে তেল কিনতে চাইছে না, দেশটির অর্থনীতিকে এটা প্রায় তলানিতে নিয়ে ঠেকিয়েছে। পাকিস্তানকে এড়িয়ে আফগানিস্তানের সাথে ব্যবসা করবার বাসনায় ভারত ইরানের চাবাহার বন্দর ও অনেকগুলো রেলওয়ে প্রকল্পে যুক্ত হতে চাইছিল, ইরান থেকে সস্তায় তেলও পেতো রাষ্ট্রটি। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জটিলতা এড়াতে ভারত সেখানে শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগ করেনি।

কিন্তু পৃথিবী তো এখন আর একমেরু নেই। প্রবল অর্থনৈতিক পক্ষ হিসেবে চীন ও সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাশিয়ার পুনরাবির্ভাব ঘটেছে মঞ্চে। সম্প্রতি ইরান ভারতকে খানিকটা পাশে সরিয়ে রেখেই প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সাথে সস্তায় তেল সরবরাহ করবার এবং বন্দর ও রেলপথে বিনিয়োগসহ বহু খাতে সম্পর্ক উন্নয়নের ঘোষণা দিয়েছে। ইরানের চাবাহার ও পাকিস্তানের গওদর বন্দর স্থলবেশিষ্ট মধ্য-এশিয়ার বিপুল খনিজ সম্পদ ও সম্ভাবনাময় বাজারের রাস্তাটি সমুদ্রপথে খুলে দেবে চীনের জন্য । ফলে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র কি ইরানের সাথে ব্যবসা করবার দায়ে চীনের ওপর সামগ্রিক বাণিজ্য অরোধ জারি করার সামর্থ্য রাখে? যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যত সরকার কি মধ্য-এশীয় রঙ্গমঞ্চে চীনের একক কর্তৃত্ব বিফল করতে ইরানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যবস্থা করবে না? ইরান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ইতিমধ্যেই অসন্তুষ্ট ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো এই অবরোধের কারণে মধ্য এশীয়াতে চীনের একচেটিয়া কর্তৃত্ব বৃদ্ধির সম্ভাবনাটাকে কিভাবে দেখবে? এইখানে অবরোধের ভবিষ্যত কার্যকারিতা বিষয়ে অনেকগুলো বিবেচনার মাঝে দেখা যাচ্ছে মধ্যএশীয়ার উপস্থিতি, ইরান বা পাকিস্তান-আফগানিস্তান কোন একটি পথে যেখানে পৌঁছুতে হয়। 

 

৯.

 "নিজের অবরোধের পরিনামে পুড়ে ছাই হওয়া কার্থেজের দিকে তাকিয়ে বিজয়ী স্কিপিও নিহত শত্রুর জন্য কেঁদেছিলেন। বহুক্ষণ বিষয়টি নিয়ে চিন্তামগ্ন থেকে এবং সকল নগর, জাতি এবং কর্তৃত্ব যে মানুষের মতই বিনাশের শিকার হবে এটা উপলদ্ধি করে-- কেননা এটা ঘটেছে একদা সমৃদ্ধ নগরী ইলিয়ামের বেলায়, ঘটেছে অ্যাসিরীয়া, মিডিয়া এবং পারসিকদের বেলায়, এবং স্বয়ং মেসেডোনিয়ার বেলাতে যার কীর্তি অতিসম্প্রতিকালের-- স্কিপিও হোমারের ভাষা ধার করে বললেন: একদিন আসবে যখন পবিত্র ট্রয়ও ধ্বংস হবে,/আর প্রিয়াম ও তার মানুষেরা নিহত হবে। 

স্কিপিও কী বোঝাতে চাইলেন এটা বলে, জানতে চাইলে তার শিক্ষক ও পরামর্শদাতা পলিবিয়াসকে বলেন, তিনি তার নিজের দেশের কথা ভেবেই কেঁদেছেন, মানবিক আর সকল কিছুর পরিণাম বিষয়ে চিন্তা করে নিজের জাতির ভবিষ্যত বিষয়েও তিনি একই আশঙ্কা বোধ করছেন।"

রোমের বিষয়ে স্কিপিওর আশঙ্কা যথাসময়ে পূর্ণ হয়েছিল। ইতিহাসের সমাপ্তি যেহেতু ঘটেনি, আজও অর্থনীতির ঘনীভূত রূপ আকারেই রাজনীতি এবং রাজনীতির সম্প্রসারণ আকারেই যুদ্ধের মহড়া চলছে দুনিয়া জুড়ে।

রোধ-অবরোধের তাই বিরাম নেই, দামামা বেজেই চলেছে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.