ডুবছে মালদ্বীপ, তাই সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধারের পরিকল্পনা, প্রকল্প ঘিরে বিতর্ক

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
29 May, 2022, 04:50 pm
Last modified: 29 May, 2022, 06:22 pm
পর্যটন বাড়াতে সম্প্রতি এক প্রবাল প্রাচীর ভরাট করে ভূমি উদ্ধারের পরিকল্পনা করছে দেশটির সরকার। তবে এতে প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান বিপন্ন হওয়ারই শঙ্কা করছেন পরিকল্পনার বিরোধীরা।

ভারত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ রাষ্ট্র- মালদ্বীপ। নয়নাভিরাম এ দেশে এসে অনন্য প্রবাল প্রাচীর আর সমুদ্রসঙ্গ পছন্দ দেশ-বিদেশের পর্যটকদের। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে হারিয়ে যেতে চলেছে এ স্বর্গ। ডুবে যাচ্ছে অনেক দ্বীপ।

পর্যটন বাড়াতে সম্প্রতি এক প্রবাল প্রাচীর ভরাট করে ভূমি উদ্ধারের পরিকল্পনা করছে দেশটির সরকার। তবে এতে প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান বিপন্ন হওয়ারই শঙ্কা করছেন পরিকল্পনার বিরোধীরা।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মালদ্বীপের উচ্চতা খুবই কম। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতি-বিপন্ন দেশের কাতারে রয়েছে। সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ায় এরমধ্যেই উল্লেখযোগ্য উপকূল রক্ষা স্থাপনা নির্মাণ এবং সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধারের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।। এজন্য সামুদ্রিক খাঁড়ি থেকে উত্তোলন করা বালু দিয়ে সাগরের স্বল্প গভীর অংশ ভরাট করা হবে।

তবে যেখানে এ প্রকল্প করা হবে সেটি ইউনেস্কো ঘোষিত জীবমন্ডল রিজার্ভের অংশ। এতে সেখানকার প্রাণবৈচিত্র্য চরম ক্ষতির মুখে পড়বে।  

প্রকল্প এলাকাটি হচ্ছে মালদ্বীপের আদ্দু সিটি। দেশটির দক্ষিণের আদ্দু প্রবাল প্রাচীরের একটি অংশে গড়ে উঠেছে এ শহর। এখানেই সমুদ্র ভরাট করে ১৯৪ হেক্টর ভূমি সাগর থেকে উদ্ধার করা হবে। ঠিকাদারি প্রাপ্ত ডাচ প্রতিষ্ঠান ভ্যান ওর্ড এ ঘোষণা দিয়েছে। ভরাট করা জমিতে গড়ে উঠবে তিনটি নতুন রিসোর্ট দ্বীপ।

স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখাসহ ভূমি স্বল্পতা দূর করা এবং উপকূলীয় সুরক্ষা বাড়াতে এ উদ্যোগের কথা জানিয়েছে মালে। প্রায় ১৪৭ মিলিয়ন ডলারের এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে ভারতের একটি ব্যাংক।

আদ্দু প্রবাল প্রাচীরে বর্তমানে ২০ হাজার মানুষের বসবাস এমন ছয়টি দ্বীপের মাঝখানের এক খাঁড়ি থেকে ৫০ লাখ ঘনমিটার বালু উত্তোলন করা হবে বলে জানিয়েছে ভ্যান ওর্ড। তবে অনু সূত্রগুলির অনুমান, কমপক্ষে ৬৯ লাখ ঘনমিটার বালু তুলবে সংস্থাটি।  

আদ্দু সিটির মেয়র আলি নিজার দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ছোট ছোট অনেক প্রকল্প করার চেয়ে এভাবে একটি বড় প্রকল্প করায় ক্ষতি অনেক কম হবে। এতে এই অঞ্চলের একটি অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ ও আগামী প্রজন্মের বসবাসের ভূমি সৃষ্টি করা হবে।

তিনি অবশ্য স্বীকার করে বলেন, "বর্তমানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও শিল্পকাজে ব্যবহারের মতো যথেষ্ট জমি আদ্দুতে নেই। তাই আমাদের এ কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।"

"মালদ্বীপের দ্বিতীয় বৃহৎ জনবহুল এলাকা আদ্দু। এখানে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের খুব দরকার, তাই আমাদের জমি চাই। গত ২০ বছরে আমরা এমন তিনটি ভূমি উদ্ধারের প্রকল্প নিয়েছি। কিন্তু, এভাবে কাজটি করা ঠিক নয়।"

তিনি যোগ করেন যে, "নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে আমাদের আছে আগামী ৫০-১০০ বছরের চাহিদা পূরণের মতো জমি থাকবে। যেকোনো ধরনের প্রকল্পেই পরিবেশের ক্ষতি হয়। তবে ক্ষতির মাত্রা কম রাখতেও আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে।"

প্রকল্পের বিষয়ে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা- ট্রান্সপারেন্সি মালদ্বীপের কর্মকর্তা সারা নাসিম বলেছেন, "উদ্ধারকৃত বেশিরভাগ ভূমির সুফল স্থানীয় মানুষ পাবে না। এতে তাদের আবাসন সমস্যার কোনো সমাধান হবে না।"

এ প্রকল্পের পেছনে কিছুটা জনসমর্থন থাকলেও সাম্প্রতিক এক পরিবেশগত প্রভাব বিশ্লেষণে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। ২০২০ সালে আদ্দু প্রবাল প্রাচীরকে ইউনেস্কো সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করে। এখানে রয়েছে সামদ্রিক ঘাসের আচ্ছাদনসহ উপকূলীয় শ্বাসমূলীয় বনভূমি। প্রাকৃতিক এই অঞ্চল কার্বন শোষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, একইসাথে মাছেদের আশ্রয়স্থল। এতে স্থানীয়রা মাছ ধরার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছে। এখানকার অপরূপ সমুদ্রতল দেখতেও ডুবুরি বেশে নামেন অনেক পর্যটক। স্থানীয়রা তাদের গাইড হিসেবে পর্যটন থেকে আয় করতে পারে।  

পরিবেশগত সমীক্ষার রিপোর্টটি জানিয়েছে, "ভূমি উদ্ধারের প্রকল্পে ২১ হেক্টর প্রবাল প্রাচীর ও ১২০ হেক্টর সামুদ্রিক তৃণভূমি চাপা পড়বে। পানিতে পলির পরিমাণ বাড়বে; আর তাতে চারপাশের বাস্তসংস্থানের শ্বাসরোধ করা হবে, দীর্ঘমেয়াদে এটি ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতাও হারাবে। এতে ডলফিনসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীরা হুমকিতে পড়বে।"

এই প্রেক্ষাপটে মালদ্বীপের স্থানীয় পরিবেশবাদী সংস্থাগুলোর একটি জোট সরকারের প্রতি প্রকল্পটি বন্ধের দাবি করেছে। প্রকল্প বন্ধে দেশটির আদালতে একটি জনস্বার্থ মামলাও করা হয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি মালদ্বীপের অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার সারা নাসিম বলেন, পরিবেশগত সুরক্ষার গ্যারান্টি থাকতে হবে। স্থানীয়রাও এতে খুব বেশি লাভবান হবে না এমন উদ্বেগও আছে। "অতিরিক্ত যেসব দ্বীপ নির্মাণ করা হবে সেগুলো পর্যটকদের জন্য। ধনী ও অভিজাত মানুষেরা সেখানে দেশ-বিদেশ থেকে এসে অবসর কাটাবে।"

 

"আমাদের খুব বেশি শঙ্কার কারণ- উদ্ধারকৃত বেশিরভাগ ভূমির সুফল স্থানীয় মানুষ পাবে না। এতে তাদের আবাসন সমস্যার কোনো সমাধান হবে না"- যোগ করেন নাসিম।

প্রকল্পের ঠিকাদারি সংস্থা ভ্যান ওর্ড এর আগেই মালদ্বীপে ভূমি উদ্ধার প্রকল্পে কাজ করেছে। সংস্থাটি এবার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার্থে টেকসই প্রকৌশল বিদ্যা ব্যবহারের মাধ্যমে খাঁড়িতে পলি বিস্তার সীমিত রাখার পাশাপাশি নতুন প্রবাল প্রাচীর সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা একটি সাত মাইল লম্বা উপকূল রক্ষা বাঁধও নির্মাণ করবে।  

কোম্পানিটির ডেজিং বিভাগের পরিচালক নিলস ডে ব্রুজিন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে চলার যুগে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ সাধারণ ঘটনায় পরিণত হবে। বালি ও বাহামার মতো অঞ্চলেও এমন প্রকল্প নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। "এতে স্থানীয়রা বাড়ি বা ব্যবসা করার মতো জায়গা-জমি পাবে। পর্যটনের স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে, ফলে তাদের জীবনযাত্রায় উন্নতি আসবে।"

নিলস আরও বলেন, "বিশ্ব যদি প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে উল্লেখিত সকল লক্ষ্য পূরণেও সফল হয়, তবু সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে। এজন্যই জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন সক্ষমতা তৈরি জরুরি, এটি বিপন্ন মানুষকে সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা নিতে সাহায্য করবে।"

এনিয়ে আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ গোলার্ধের উন্নয়ন ও পরিবেশ বিষয়ক অধ্যাপক জয়ীতা গুপ্তা বলেন, "অনেক দ্বীপরাষ্ট্র এখন ভূমি পুনরুদ্ধারে বালু উত্তোলন প্রকল্পে বিপুল অর্থ খরচ করছে। এর মাধ্যমে তারা পর্যটন খাতের আয় বৃদ্ধি এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত ঝুঁকি কমাতে চায়।"  

"তবে এই কৌশলের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিকই রয়েছে। এতে দ্বীপগুলোর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও অভিযোজন সক্ষমতা বাড়লেও- তারা অন্য অনেক সমস্যার জন্ম দেয়। যেমন- বালু উত্তোলন, এতে সমুদ্রে প্রভাব পড়ে। আবার পর্যটন বাড়লে প্রবাল ক্ষতির শিকার হয়। বাহারি প্রবালের এই আকর্ষণ না থাকলে পর্যটনই কমে যায়। অথচ এসব প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য পর্যটনের বিকাশ।"


সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.