রাশিয়ার তেল না কিনলে ইউরোপকে বাঁচাতে পারবে না মধ্যপ্রাচ্য

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
10 May, 2022, 08:40 pm
Last modified: 10 May, 2022, 08:47 pm
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কোনোটার কি রাশিয়ান ঘাটতি পূরণের প্রাযুক্তিক সক্ষমতা রয়েছে? তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যেটি- তাদের কি এ বিষয়ে আদৌ আগ্রহ আছে?

ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধজয়ের চেষ্টাকে পণ্ড করে দিতে ইউরোপ নানাভাবে চেষ্টা করছে। রাশিয়ার ওপর নানামাত্রিক নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি রাশিয়া থেকে তেল-গ্যাস আমদানি কমিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো।

ইউরোপ যদি রাশিয়ান জ্বালানি কেনা বন্ধ করে দেয়, সেক্ষেত্রে এই মহাদেশের জ্বালানি ঘাটতি পূরণে সক্ষম হিসেবে আপাতত মধ্যপ্রাচ্যকে বিবেচনা করা হচ্ছে।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কোনোটার কি এ ঘাটতি পূরণের প্রাযুক্তিক সক্ষমতা রয়েছে? তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যেটি- তাদের কি এ বিষয়ে আদৌ আগ্রহ আছে? জেনে নেওয়া যাক এ প্রসঙ্গে তেল-বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে শাস্তি দিতে অনেকগুলো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে ইইউ এখনো রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস আমদানি বন্ধ করেনি। রাশিয়ান তেল ও গ্যাস মস্কোর জন্য যেমন আয়ের একটি বড় উৎস, তেমনিভাবে এটি ইইউ'র অর্থনীতির সাথেও নিবিড়ভাবে জড়িত। তাই নিজেদের অর্থনীতির কথা ভেবে এখনো রাশিয়ান তেল-গ্যাস আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়নি ইইউ।

ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি'র তথ্য অনুযায়ী, যদি ইইউ রাশিয়ান তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তাহলে ইউরোপের দৈনন্দিন চাহিদার তুলনায় ২২ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল, ও ১২ লাখ ব্যারেল পেট্রোলিয়াম জ্বালানির সরবরাহ কমে যাবে।

যদিও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিশ্বের মোট তেলের প্রমাণিত মজুতের প্রায় অর্ধেকের মালিক, তবুও বেশকিছু কারণে এ দেশগুলো হয়তো ইউরোপের বিপদে ত্রাতা হিসেবে ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হতে পারে। এ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে এখানকার অবকাঠামোতে বিনিয়োগের অভাব, সংঘাত, রাজনৈতিক জোট, নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি।

দেখে নেওয়া যাক, ইউরোপের সম্ভাব্য ঘাটতি পূরণে মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো কী করতে পারবে আর কী করতে পারবে না।

সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত

বৈশ্বিক জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক-এর দেশগুলোর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের এ দুইটি দেশে তেলের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অতিরিক্ত মজুত (স্পেয়ার ক্যাপাসিটি) রয়েছে। এর পরিমাণ দৈনিক প্রায় ২৫ লাখ ব্যারেল।

তবে বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওপেকের সবচেয়ে বড় তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরব তাদের জ্বালানি তেলের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছে। তাই এটি যে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ইউরোপের অনুরোধে সাড়া দেবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আরবদেশগুলো তাদের এশিয়ান তেলের ক্রেতাদের কাছ থেকে হুট করে সরবরাহ কমিয়ে অন্য দিকে পাঠালে তার কিছু প্রভাব অবশ্যই তৈরি হবে।

এটা কেবল তখনই সম্ভব হবে 'যদি এই দীর্ঘকালীন চুক্তিগুলোর মধ্যে কোনো নমনীয়তা তৈরি করা যায় অথবা এশিয়ান ক্রেতাদের সাথে কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো যায়', এমনটা বলেছেন দুবাইয়ের কামার এনার্জি'র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রবিন মিলস।

যদি এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্যের তেল ইউরোপের দিকে পাঠানো হয়, তাহলে এর ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার মধ্যকার ক্রমবর্ধমান কৌশলগত অংশীদারি ঝুঁকির মুখে পড়বে। এছাড়া এশিয়া অঞ্চলের প্রধান ক্রেতা চীনের সাথেও সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্কের ওপর প্রভাব পড়তে পারে।

ইরাক

কাগজে-কলমে ইরাক প্রতিদিন বাড়তি আরও ছয় লাখ ৬০ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন করতে পারে বলে জানান লন্ডনভিত্তিক জ্বালানি বিষয়ক গবেষণা পরামর্শ সংস্থা সিমার্কিটস-এর সিইও ও তেল গবেষণার প্রধান ইউসুফ আলশামারি।

ইরাক বর্তমানে দৈনিক ৪৩ লাখ ৪০ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। দেশটির সর্বোচ্চ উত্তোলন ক্ষমতা দিনপ্রতি ৫০ লাখ ব্যারেল।

তবে আলশামারি মনে করেন, সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে বাড়তি তেলের যোগানের ক্ষেত্রে ইরাকের ওপর খুব বেশি নির্ভর করা যায় না।

উত্তোলন বাড়ানোর জন্য ইরাকের পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। বিশ্লেষকেরা জানান, তেলখাতে যেকোনো বিনিয়োগের ফল পেতে কয়েক বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।

লিবিয়া

লিবিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নিয়মিতই এর তেলক্ষেত্রগুলোকেও ভুগতে হয়। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে দেশটির ন্যাশনাল অয়েল কর্পোরেশন (এনওসি) জানিয়েছিল, রাজনৈতিকভাবে অসন্তুষ্ট দলগুলো দেশটির প্রধান তেলক্ষেত্র ও রপ্তানি টার্মিনালসমূহ অবরুদ্ধ করে রাখার কারণে এটি প্রতিদিন পাঁচ লাখ ৫০ হাজার ব্যারেল তেল উৎপাদন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এমনকি সশস্ত্র সংঘাতের কারণে একটি তেল শোধনাগার ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছিল।

ইউসুফ আলশামারি বলেন, 'বাড়তি তেল উত্তোলনের জন্য লিবিয়ার ওপর নির্ভর করা পুরোপুরি অসম্ভব।' অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও ফোর্স মেজারের কারণে লিবিয়ার অনেক প্রধান তেলক্ষেত্রেই বছরের পর বছর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে।

ইরান

সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমন্বিত সক্ষমতার পর বিশ্ববাজারে তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে ইরান। কিন্তু বর্তমানে দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন রয়েছে।

যদি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়, তাহলে দেশটি দৈনিক ১২ লাখ ব্যারেল পর্যন্ত তেল উত্তোলন করতে পারবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকেরা। ইরানের পক্ষে টানা তিন মাস বৈশ্বিক তেলের চাহিদার এক শতাংশ যোগান দেওয়া সম্ভব।

তবে কেবল বাজারে তেলের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য ইরানের সাথে কোনো চুক্তির সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন এনার্জি ইন্টেলিজেন্স-এর প্রধান ওপেক প্রতিনিধি আমেনা বকর।

মধ্যপ্রাচ্যের বাইরের দেশগুলো

মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে বাড়তি তেল উত্তোলন (স্পেয়ার ক্যাপাসিটি) করতে সক্ষম এমন দেশের মধ্যে রয়েছে নাইজেরিয়া ও ভেনেজুয়েলা। তবে এ দেশগুলোর ক্ষেত্রেও কিছু জটিলতা রয়েছে।

আলশামারি বলেন, স্পেয়ার ক্যাপাসিটি বলতে বোঝায় কোনো দেশ ৩০ দিনের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তেল উত্তোলন করতে এবং উত্তোলনের এ হার টানা ৯০ দিন পর্যন্ত ধরে রাখতে সক্ষম।

রাশিয়া তেল নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে আমেরিকাকে সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে ধরতে পারে ইউরোপ। কিন্তু আমেরিকার অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মজুত খুবই কম। তাই এর পক্ষে ইউরোপের ঘাটতি পূরণ করা সক্ষম হবে না।

এর বাইরে আফ্রিকা থেকে জ্বালানি আমদানি করার চিন্তা করতে পারে ইউরোপ। কিন্তু আফ্রিকার জ্বালানি দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে ইউরোপের সময় লাগবে ১০ থেকে ১৫ বছর।

সূত্র: সিএনএন

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.