গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করতে শুরু করেছে রাশিয়া; কতটা চিন্তিত হওয়া উচিত ইউরোপের?

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
28 April, 2022, 09:45 pm
Last modified: 28 April, 2022, 09:45 pm
রুবলে দাম না চুকানোয় বুলগেরিয়া ও পোল্যান্ডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন পুতিন। এই দুই দেশকে 'শিক্ষা' দিয়ে অন্য ইউরোপীয়দের যেন হুমকিই দিয়ে রাখলেন তিনি। ইউরোপের মোট গ্যাস-চাহিদার ৪০ শতাংশই মেটায় রাশিয়া। কাজেই রাশিয়ার গ্যাস বন্ধের এই উদ্যোগ কি ইউরোপের জন্য অশনি সংকেত?

ইউরোপের শিল্প-কারখানায় সরবরাহকৃত বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় রাশিয়ার গ্যাস থেকে। মহাদেশটির ঘরও গরম রাখে রাশিয়ার গ্যাস। ইউরোপের মোট গ্যাস সরবরাহের ৪০ শতাংশই যেত মস্কো থেকে। এই গ্যাসের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ চালানই যেত ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পশ্চিমারা নানা নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে রাশিয়ার ঘাড়ে। রাশিয়াও বসে নেই, পাল্টা নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে তারাও। 

গতকাল পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া। কারণ গ্যাসের দাম রুবলে পরিশোধ করতে রাজি হয়নি দেশ দুটি। এই দুই দেশকে 'শিক্ষা' দিয়ে অন্য ইউরোপীয়দের যেন হুমকিই দিয়ে রাখলেন তিনি। ইউরোপের মোট গ্যাস-চাহিদার ৪০ শতাংশই মেটায় রাশিয়া। কাজেই রাশিয়ার গ্যাস বন্ধের এই উদ্যোগ কি ইউরোপের জন্য অশনি সংকেত?

অন্যদিকে ইউরোপীয় নেতারা ক্রেমলিন নিয়ন্ত্রিত গ্যাস ও তেলের সরবরাহ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অদূর ভবিষ্যতে ইউরোপীয় নেতাদের এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা একপ্রকার অসম্ভব। 

জ্বালানির জন্য রাশিয়ার উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল জার্মানি ও ইতালি। এদের মতো জ্বালানিভুক দেশগুলোকে বিকল্প জ্বালানির উৎস বের করার জন্য আরও সময় লাগবে। বিকল্প উৎস বের করার আগে এই দেশগুলোকে অন্তত আরও একটি শীত পার করতে হবে। 

একথা জেনেই ব্রহ্মাস্ত্র ছুড়েছেন ভাদিমির পুতিন। গত সপ্তাহে তিনি ডিক্রি জারি করে জানিয়েছেন যে বিদেশি ক্রেতাদের গ্যাস কিনতে হলে অবশ্যই তার মূল্য পরিশোধ করতে হবে। আর তার এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রথম গিনিপিগ বানিয়েছেন পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়াকে। 

ক্রেমলিন ঘোষণা দিয়েছে, এই দুই দেশের কোনটিই সাইবেরিয়া থেকে ইয়ামাল পাইপলাইন দিয়ে আর রাশিয়ান গ্যাস পাবে না। এ সিদ্ধান্তের ফলে নতুন মোড় নিতে পারে যুদ্ধ। ইউরোপের বিরুদ্ধে গ্যাস-অস্ত্র ব্যবহার করে ভালো ফল পেতে পারেন পুতিন। 

পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়া কেন? 

ঈদের দুটিকে সম্ভবত খুব সতর্কতার সাথে বাছাই করা হয়েছে। ইউরোস্ট্যাটের ২০২০ সালের হিসাব অনুসারে, পোল্যান্ড তার প্রাকৃতিক গ্যাসের ৪৫ শতাংশ পায় রাশিয়ার কাছ থেকে। অন্যদিকে চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সবচেয়ে বেশি সহায়তা দিয়েছে পোল্যান্ড। এ কারণে দেশটি রাশিয়ার জন্য বড় একটি মাথাব্যথার কারণেই বলা চলে। 

বুলগেরিয়া চলমান যুদ্ধের রাশিয়ার জন্য তেমন একটা মাথাব্যথার কারণ নয়। তবে দেশটি গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। বুলগেরিয়ার মোট গ্যাসের চাহিদার ৭৩ শতাংশই মেটাগ রাশিয়া। 

এস্কেপ টার্গেট করার মাধ্যমে দুই ধরনের শত্রুর উপর পুতিন তার জ্বালানি অস্ত্রের ক্ষমতার পরীক্ষা করে নিতে পারছেন। প্রথম শত্রু সত্যিকার অর্থেই রাশিয়ার জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। দ্বিতীয় শত্রু আপাতদৃষ্টিতে অনেকটাই ভঙ্গুর ও দুর্বল। তারা প্রথম ধরনের শত্রুর পরিণতি দেখে শিক্ষা নেবে। 

দেশ দুটি কি এই ধাক্কা সামলে উঠতে পারবে?

পোল্যান্ড ও রাশিয়া দুই পক্ষই দাবি করেছে যে, তারা রাশিয়ার গ্যাস ছাড়াও চলতে পারবে। তাছাড়া এমনিতেও গ্যাজপ্রমের সঙ্গে পোল্যান্ডের চুক্তির মেয়াদ এ বছরের শেষ নাগাদ শেষ হতে যাচ্ছিল। বেশ ক'বছর ধরেই দেশটি বিকল্প উৎসে বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। 

ইউরোপিয়ান গ্যাস বিশ্লেষক টম মার্জেক-ম্যান্সার বলেছেন, পোল্যান্ড জার্মানির প্রতিবেশী, তারা সেখান থেকেই গ্যাস আমদানি করতে পারবে। তাছাড়া পোল্যান্ডের নিজস্ব তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি টার্মিনাল আছে এবং এ বছরের শেষ দিকে নরওয়ে থেকে পরোক্ষভাবে একটি নতুন পাইপলাইনও আসছে  দেশটিতে। তাছাড়া এমন কিছুর আশঙ্কায় দেশটি মজুদও গড়ে তুলেছে।

বুলগেরিয়ার তুলনামূলক বেকায়দায় আছে। তবে চলতি বছরের শেষ দিকে এই দেশটিতেও দ্বিতীয় একটি পাইপলাইন যাচ্ছে গ্রিস থেকে। এছাড়া অন্যান্য উৎস থেকে এলএনজি আমদানির চেষ্টাও করে যাচ্ছে বুলগেরিয়া। 

অন্য দেশগুলো কী করবে?

পুতিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন, 'অবন্ধুসুলভ' দেশগুলোকে রুবলে গ্যাস কেনার যে বাধ্যবাধকতা দিয়েছিলেন, তা ফাঁপা বুলি ছিল না।

পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়াকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার একটাই অর্থ--রাশিয়ার গ্যাস কেনা দেশ ও কোম্পানিগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা রুশ মুদ্রাতে গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করবে কি না। হাঙ্গেরি ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা রাশিয়ার পাশে থাকবে। ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, অন্তত চারটি বেসরকারি কোম্পানি ক্রেমলিনের দাবি মেনে নিয়েছে। 

২০২০ সালিও শতভাগ রাশিয়ান গ্যাসের উপর নির্ভরশীল ছিল লাটভিয়া। লাটভিয়াও লিথুয়ানিয়া ও এস্তোনিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জানিয়েছে, তারাও রাশিয়ার গ্যাস কেনা বন্ধ করবে। 

ইউরোপীয় কমিশন বলেছে, কোনো দেশেরই রুবলে গ্যাসের দাম চুকানো উচিত না। রুবলে মূল্য পরিশোধ করলে সেটি ইইউর নিষেধাজ্ঞার লঙ্ঘন হবে। 

তবে রাশিয়ার দাবি অনুসারে গ্যাজপ্রমব্যাংকে ইউরো বা ডলারে গাসের দাম দেওয়া যেতে পারে বলে মত দিয়েছে ইউরোপীয় কমিশন। তাতেও কাগজে-কলমে ইইউর নিষেধাজ্ঞার লঙ্ঘন হবে। তবে গত সপ্তাহে কমিশন ইঙ্গিত দেয়, দেশগুলোর গ্যাস কেনার সুবিধার্থে চুক্তি একটু এদিক-ওদিক করা যেতে পারে।
 
ইতালি ও জার্মানির মতো বড় অর্থনীতিগুলোর জন্য এটা সুখবর হতে পারে। জার্মানির ৬০ শতাংশ গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। এ হার শূন্যে নামিয়ে আনতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। 

আবারও বাড়বে গ্যাসের দাম?

রাশিয়া গ্যাসের দাম বাড়াবে কি না, কিংবা বৈশ্বিকভাবে গ্যাসের দাম বেড়ে যাবে কি না, তা অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। 

ক্রেমলিন বুলগেরিয়া ও পোল্যান্ডে সরবরাহ বন্ধ করার পর এ সপ্তাহের শুরুতে ডাচ টিটিএফ নামক বেঞ্চমার্কে গ্যাসের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। বুধবার বিকেলে অবশ্য দাম কিছুটা কমে আসে। কিন্তু তারপরও গ্যাসের দাম এখনও ১৫ শতাংশ বেশি আছে।

তাই এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে, রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে তার ধাক্কা মোটামুটি সারা বিশ্বেই লাগবে। ইউরোপও সেই ধাক্কা থেকে বাঁচতে পারবে না। আর এ ধাক্কা বেশি টের পাবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো। কারণ রুশ গ্যাস পাওয়া বন্ধ হয়ে গেলে ইউরোপ এলএনজি আমদানি বাড়াবে। ফলে বাংলাদেশসহ এলএনজিনির্ভর দেশগুলো সহজে এই জ্বালানি পাবে না। ফলে ইতিমধ্যে ক্রমবর্ধমান এলএনজির দাম হবে আকাশচুম্বী। এই ধাক্কায় হোঁচট খাবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।


  • সূত্র: গার্ডিয়ান
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.