ভারত কেন আরও বেশি করে রাশিয়ার তেল কিনছে? 

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক 
16 April, 2022, 07:35 pm
Last modified: 17 April, 2022, 10:10 am
আমেরিকা ও চীনের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ জ্বালানি তেলের ভোক্তা ভারত, চাহিদার ৮০ শতাংশই পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। 

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মস্কোর সাথে দূরত্ব রাখতে পশ্চিমাদের চাপ বাড়ছে ভারতের ওপর। তবুও নয়াদিল্লি রাশিয়া থেকে আরও বেশি তেল আমদানি করছে। 

রাশিয়ার তেল কেনার সিদ্ধান্তের আত্মপক্ষ সমর্থন করে ভারত সরকার বলেছে, রাশিয়া থেকে তারা একমাসে যে পরিমাণ কেনে, ইউরোপ তা এক সন্ধ্যার জন্যই কিনছে। এভাবে, ইউরোপের বিপুল রাশিয়ান তেল-গ্যাস আমদানির দিকে আঙুল তুলেছেন ভারতীয় কর্মকর্তারা। যেন বলতে চাইছেন, ইউরোপ যেখানে নির্ভরশীল, সেখানে চড়া দামের বিশ্ববাজারে ভারত কেন সস্তায় পাওয়া তেল ছেড়ে দেবে? 

#ভারত কেন আরও রাশিয়ান তেল কিনছে?

ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের উষ্ণতা দীর্ঘদিনের। যুদ্ধের পর মস্কোর ঘাড়ে এসে চাপে নজিরবিহীন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা। একারণে, লক্ষণীয় মাত্রার মূল্যছাড়ে ভারতকে তেল কেনার প্রস্তাব দেয় মস্কো। নয়াদিল্লিও তা গ্রহণে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করে। 

আমেরিকা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) বলেছে, এসব আমদানি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ না করলেও, রাশিয়ার প্রতি এই মুহূর্তে যেকোনো প্রকার সমর্থন (আর্থিক) আসলে আগ্রাসনের পেছনে নগ্ন সমর্থনেরই শামিল, মানুষ (ইউক্রেনবাসী) যার ভয়াল পরিণতি দেখছে।"

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রস-ও সম্প্রতি দিল্লিতে গিয়ে রাশিয়া নির্ভরশীলতা কমাতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ভারত সফররত থাকার ওই সময়েই ট্রস সেখানে যান।  

কিন্তু, ব্রিটিশ মন্ত্রীর চেয়ে বেশি সমাদর ছিল তার রাশিয়ান প্রতিপক্ষেরই। ল্যাভরভ তার ভারতীয় প্রতিপক্ষ এস জয়শঙ্করকে বলেন, ভারত কিনতে চায় এমন সকল পণ্য নিয়ে দর আলোচনায় আগ্রহী রাশিয়া। এসময় তিনি মূল্য রাশিয়ার মুদ্রা রুবলে পরিশোধের তাগিদ দেন।  

#ভারত কোথা থেকে তেল কেনে? 

আমেরিকা ও চীনের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ জ্বালানি তেলের ভোক্তা ভারত, চাহিদার ৮০ শতাংশই পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। 

২০২১ সালে রাশিয়া থেকে ১ কোটি ২০ লাখ ব্যারেল ইউরাল গ্রেডের অপরিশোধিত তেল (ক্রুড) কেনে ভারত, যা দেশটির মোট আমদানির ২ শতাংশ বলে জানিয়েছে পণ্য ও কাঁচামাল গবেষণা গ্রুপ- কেপলার। 

গেল বছর দেশটিতে জ্বালানির সবচেয়ে বড় সরবরাহ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে, উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আমেরিকা ও নাইজেরিয়া থেকেও হয়েছে।  

চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ভারৎ রাশিয়া থেকে তেলের কোনো চালান কেনেনি। কিন্তু, মার্চ ও এপ্রিলের জন্য সরবরাহ চুক্তি এরমধ্যেই ১ কোটি ৪০ লাখ ব্যারেল ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা জানা গেছে কেপলারের তথ্যসূত্রে। 

রাশিয়ার তেল ক্রয়ে ভারতের জন্য আকর্ষণীয় প্রস্তাবটি কেমন? 

ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর, রাশিয়ার অর্থনীতিকে ভঙ্গুর কওরে তুলতে নিষেধাজ্ঞা দেয় পশ্চিমা বিশ্ব। দেশটি থেকে জ্বালানি না কিনতে বিভিন্ন দেশের ওপর চাপ বাড়াতে থাকে তারা। ফলে রাশিয়ার তেলের প্রচলিত ক্রেতার সংখ্যায় ধস নেমেছে। রুশ ক্রুডের দামও কমেছে, বিশ্ববাজারের অন্যান্য উৎসের তুলনায়।

তার ওপর আবার যুদ্ধপূর্ব দামের চেয়েও ছাড়কৃত দামে তেল বিক্রির প্রস্তাব নয়াদিল্লিকে দিয়েছে মস্কো।   

কেপলারের বিশ্লেষক ম্যাট স্মিথ বলেন, "ভারত ঠিক কত দরে কিনছে আমাদের জানা নেই। তবে আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেলের সূচক ব্রেন্টের চেয়ে গত সপ্তাহে ইউরাল ক্রুডে দেওয়া মূল্যছাড় ব্যারেলপ্রতি ৩০ ডলারের মতো বড় ব্যবধানে পৌঁছেছে।"

যুদ্ধের আগে এ দুই ধরনের ক্রুড সাধারণত প্রায় একই দামে বিকোত। কিন্তু, মার্চে এক পর্যায়ে ইউরালের দাম কমতে থাকে। বর্তমানে মূল্যের এ ব্যবধান রেকর্ড মাত্রায় থাকার কথাও জানান স্মিথ। তার মতে, "ভারত এই ক্রুডটি উল্লেখযোগ্য ছাড়ের সুবিধা পেয়ে কেনা অব্যাহত রাখবে বলেই সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।"

চাহিদার ৮০ শতাংশ তেলই ভারতকে আমদানি করতে হয়। ছবি: গেটি ইমেজেস/ বিবিসি

তেল বাণিজ্যে আর্থিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কেমন? 

রুশ ব্যাংকগুলোর ওপর সর্বাত্মক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থাকায় ছাড়কৃত দরে কেনা ক্রুডের মূল্য পরিশোধে সমস্যায় পড়ছে ভারতের জ্বালানি শোধনাগারগুলো। 

দুই দেশের মধ্যেকার আন্তঃবাণিজ্যের উভয় দিকই (আমদানি-রপ্তানি) এতে প্রভাবিত। 

এই বাস্তবতায় দুই দেশের স্থানীয় মুদ্রাভিত্তিক (রুপি ও রুবল) লেনদেন ব্যবস্থা নিয়ে আগ্রহী নয়াদিল্লি। এর মাধ্যমে ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা রাশিয়ায় পাঠানো পণ্যের মূল্য ডলার বা ইউরোর বদলে পাবেন রুবলে। একইভাবে, রাশিয়া থেকে আমদানির মূল্যও রুপিতে করা যাবে। 

এই ব্যবস্থা নিয়ে নিজেদের আপত্তির কথা স্পষ্টই জানিয়েছে আমেরিকা। ওয়াশিংটনের মতে, "এতে রুবলের বিনিময় হার শক্তিশালী হবে, একইসাথে দুর্বল হবে মার্কিন ডলারভিত্তিক লেনদেনের আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা।" 

ভারত আর কোথা থেকে তেল কেনার চেষ্টা করছে? 

ভারত একটি স্বতন্ত্র পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে চলে, যেখানে সব সময় জাতীয় স্বার্থ অগ্রাধিকার পায়। বিবাদমান দুই শিবিরের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টাও করছে নয়াদিল্লি। ফেব্রুয়ারি থেকেই দেশটি আমেরিকান তেল কেনা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়িয়েছে বলে জানাচ্ছে বাজার বিশ্লেষক সংস্থা রেফিনিটিভ।  

সংস্থার বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, আমেরিকার নিজেরই জাতীয় চাহিদা বিপুল। রাশিয়া থেকে যে তেল কেনা হতো, ইউক্রেনে হামলার পর তা স্থানীয় উত্তোলনের মাধ্যমে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা রয়েছে ওয়াশিংটনের। ফলে আমেরিকা-নির্ভর ভারতের আমদানি ভবিষ্যত বিবেচনায় টেকসই হবে না। 

ইরানের সাথে পণ্য বিনিময়-ভিত্তিক তেল কেনার ব্যবস্থা চালুর প্রতিও অনেকে ইঙ্গিত দিয়েছেন। আগে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারত তেহরানের জ্বালানি রপ্তানির বিপুল অংশ কেনে। কিন্তু, তিন বছর আগে আমেরিকার পুনঃআরোপিত ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার কারণে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। 

অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ অবশ্য মনে করেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আরেকটি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক চুক্তি ছাড়া এভাবে দেশটির সাথে ভারতের বাণিজ্য চালুর সম্ভবনা খুবই কম।


  • সূত্র: বিবিসি 
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.