ইউক্রেনীয় নারী শরণার্থীদের সিঙ্গেল পুরুষের সাথে রাখা বন্ধ কর: যুক্তরাজ্যকে জাতিসংঘ

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
13 April, 2022, 08:20 pm
Last modified: 13 April, 2022, 08:28 pm
বিকৃত মানুষ বাস্তুচ্যুত নারীদের টোপ দিয়ে তাদের শারীরিক সঙ্গ চাইছে। তারা কোনো মানবিকতার ধার ধারছে না। এরমধ্যেই ইউক্রেনের বাখমুত অঞ্চলের এক নারী দ্য গার্ডিয়ানকে জানিয়েছেন, তিনি বেশ কিছুদিন ধরে যুক্তরাজ্যে একজন যোগ্য পৃষ্ঠপোষক পাওয়ার চেষ্টা করছেন। এরমধ্যেই অনেক ব্রিটিশ পুরুষ আগ্রহ দেখিয়ে তার ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’ বার্তা পাঠিয়েছে। 

ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের উদারমনে স্বাগত জানাচ্ছে ইউরোপ। আশ্রয় দিচ্ছে নিজ দেশে। শরণার্থী শিবির নয়- ইউক্রেনীয়দের তারা নিজ দেশের নাগরিকদের সাথেই থাকার ব্যবস্থা করছে। কাজটি করছে যুক্তরাজ্যও। তবে অনেক সময়েই 'সিঙ্গেল' ইউক্রেনীয় নারীদের থাকার ব্যবস্থা করছে ব্রিটিশ পুরুষদের সাথে। এতে যৌন শোষণের শঙ্কা করছে জাতিসংঘ। 

বিশ্ব সংস্থাটির শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এটি বন্ধ করতে যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।  

ইউক্রেনীয়দের নাগরিক সমাজে অন্তর্ভুক্ত করতে 'হোমস ফর ইউক্রেন' কর্মসূচি নেয় ব্রিটিশ সরকার। এর আওতায় ইচ্ছুক নাগরিকরা ইউক্রেন থেকে আগতদের তাদের বাড়িতে আশ্রয় দিতে চাইলে সরকারিভাবে নিবন্ধন করাতে পারেন। কিন্তু, নারীলিপ্সু ও বিকৃতমনা পুরুষেরা এর সুযোগ নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। 

এবিষয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার দ্য গার্ডিয়ানকে জানিয়েছেন, একাকিনী (সিঙ্গেল) ইউক্রেনীয় নারীদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে "আরো কার্যকর আবাসন ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে"। তারা কার সাথে থাকবেন সেই 'ম্যাচিং' প্রক্রিয়ায় সুবিবেচনা রাখতে হবে। একাকি পুরুষের চেয়ে সন্তানসহ বা একাকিনী নারীদের পরিবার বা দম্পতিদের সাথে থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

যুদ্ধ মানুষকে সর্বশান্ত করে। যুদ্ধের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষ হয় অসহায়। সম্প্রতি কিছু গণমাধ্যমের সংবাদে জানা গেছে, ইউক্রেনীয় নারীদের এভাবে থাকার ব্যবস্থা করায়, যুক্তরাজ্যে তাদের নিগ্রহের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ইউএনএইচসিআর এই প্রেক্ষিতে এমন পরামর্শ দিল।

'হোমস ফর ইউক্রেন' কর্মসূচির বেশকিছু ত্রুটি রয়েছে। যেমন যারা নিজের বাড়িতে শরণার্থীদের থাকতে দিতে চান, তাদেরকেই শরণার্থীদের সাথে যোগাযোগ করে নিতে হয়। এই ব্যবস্থার ফলে অসুরক্ষিত বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে অনলাইন যোগাযোগে বাধ্য হচ্ছে অনেক শরণার্থী। আর সেখান থেকেই তাদেরকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর চরম সুযোগ নিচ্ছে সুযোগ-সন্ধানী বিকৃতমনারা।

ব্রিটিশ সরকার অবশ্য আশ্রয়দাতাদের সাথে যোগাযোগের সুবিধা করে দিতে একটি ম্যাচিং সার্ভিস চালু করেছে। সরকারি তহবিলে চালিত এ সাইটটি পরিচালনায় আছে দাতব্য সংস্থা- চ্যারিটি রিসেট। তবে এটি মাত্র এক সপ্তাহের কিছু বেশি সময় ধরে চলছে। সে তুলনায় শরণার্থী আসা শুরু হয়েছে যুদ্ধ শুরুর সময় থেকেই। 

যেসব শরণার্থী যুক্তরাজ্যে আসতে চায়, তাদের ভিসা পাওয়ার আগে একজন ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকের দরকার হয়। ম্যাচিং ব্যবস্থায় পৃষ্ঠপোষকরা কাকে সমর্থন দেবেন- সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পান। ফলে নিঃসঙ্গ নারীদের জন্য হুমকি বেড়েছে। 

এ অবস্থায় বুধবার (১৩ এপ্রিল) দেওয়া বিবৃতিতে ইউএনএইচসিআর জানায়, যৌন শোষণ রুখতে অবশ্যই যথাযথ নিরাপত্তা পদক্ষেপ থাকা উচিত এবং একইসাথে আশ্রয়দাতার চারিত্রিক দিক নিরীক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে।  একইসাথে, সঠিক পৃষ্ঠপোষকদের দেওয়া সহায়তা বৃদ্ধির পরামর্শ দেয়। 

"ইউএনএইচসিআর বিশ্বাস করে, আরো যথাযথ ম্যাচিং প্রক্রিয়া নেওয়া দরকার। এতে একাকি পুরুষের পরিবর্তে সন্তানসহ বা একাকিনী নারীদের কোনো দম্পতি বা পরিবারের সাথে রাখার সুব্যবস্থা করা যাবে।" 

সংস্থাটির এক মুখপাত্র আরো বলেছেন, "কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি ছাড়া ম্যাচিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে, নারীর প্রতি ভবিষ্যৎ ঝুঁকি বেড়ে যায়। এমনিতেই শরণার্থী একাকি নারীরা বাস্তুচ্যুত হওয়ার মানসিক চাপে রয়েছেন, পরিবার থেকে আলাদা হওয়ার শোকের সাথে অনেকের রয়েছে যুদ্ধাঞ্চলে সহিংসতার মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা।"

এরমধ্যেই 'হোমস ফর ইউক্রেন' কর্মসূচির পরিচালনার দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী মাইকেল গোভের কাছে নিজেদের উদ্বেগ তুলে ধরেছে প্রথম সারির শরণার্থী-বিষয়ক দাতব্য সংস্থাগুলো।

দাতব্য সংস্থা- রিফিউজি অ্যাকশন এর সুরক্ষা বিভাগের প্রধান লুইস কালভে দ্য অবজার্ভারকে জানান, "বর্তমান ব্যবস্থাটি যৌন পাচারকারীদের জন্য টিন্ডার (একটি জনপ্রিয় ডেটিং সাইট) হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।" 

বিকৃত মানুষ বাস্তুচ্যুত নারীদের টোপ দিয়ে তাদের শারীরিক সঙ্গ চাইছে। এক্ষেত্রে তারা কোনো মানবিকতার ধার ধারছে না। এরমধ্যেই ইউক্রেনের বাখমুত অঞ্চলের এক নারী দ্য গার্ডিয়ানকে জানিয়েছেন, তিনি বেশ কিছুদিন ধরে যুক্তরাজ্যে একজন যোগ্য পৃষ্ঠপোশক পাওয়ার চেষ্টা করছেন। এরমধ্যেই অনেক ব্রিটিশ পুরুষ আগ্রহ দেখিয়ে তার ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে 'ইঙ্গিতপূর্ণ' বার্তা পাঠিয়েছে। 

"লন্ডনবাসী এক বয়স্ক পুরুষ লিখেছেন, শর্ত হিসেবে তার সাথে আমাকে বেডরুম শেয়ার করতে হবে, আমি এতে রাজি কিনা- জানতেও চাওয়া হয়েছে।" 

দ্য সানডে টাইমস চলতি সপ্তাহে তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, তাদের একজন ২২ বছরের নারী সংবাদকর্মী ইউক্রেনীয় নারীর ছদ্মবেশ ধরেন। এরপর পৃষ্ঠপোষক চেয়ে একটি ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করেন। এই গ্রুপটি ছিল যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় আশ্রয়দাতাদের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু, পোস্ট করার মিনিট খানেকের মধ্যেই আপত্তিকর সব বার্তা ওই সংবাদকর্মীর ইনবক্সে আসতে থাকে। 

আসলে একটি বেডরুম থাকলেও, কিছু পুরুষ তাদের বাড়িতে একাধিক শয়নকক্ষ থাকার মিথ্যে দাবি করে। অন্যরা আবার একই ঘর শেয়ার করার প্রস্তাব সরাসরি দেয়। তাদের একজন লিখেছে, "আমার বিছানা অনেক বড়। আমরা একসাথে শুতে পারব"। আরেকজন ভয়েস ম্যাসেজে বলেছে, "আমি তোমাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত, হয়তো তুমিও আমাকে সাহায্য করতে পারবে।"

এমন পরিস্থিতিতে শরণার্থী নারীর জন্য যুক্তরাজ্যের আশ্রয়স্থল আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ইউএনএইচসিআর। তাছাড়া, 'হোম ফর ইউক্রেন' কর্মসূচির মাত্র ছয় মাস মেয়াদকেও অপর্যাপ্ত মনে করছে।

"ইউএনএইচসিআর মনে করে, যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সঠিক তথ্য সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলে আশ্রয়দাতারা পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আবেদনের আগে থেকেই অবহিত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। অনেকের জন্যই দীর্ঘসময় ধরে নিজ বাড়ির অতিরিক্ত একটি শয়নকক্ষ সম্পূর্ণ অপরিচিত কারো সাথে শেয়ার করা টেকসই কোনো ব্যবস্থা হয় না।"

ইউক্রেনীয় নারীদের যৌন শোষণ বন্ধে হস্তক্ষেপ চেয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার আহবানের বিষয়ে জানতে চাইলে, যুক্তরাজ্য সরকারের এক মুখপাত্র গার্ডিয়ানকে বলেছেন, "অসহায় মানুষকে নিগ্রহ করার চেষ্টা সব সময়ই নিন্দনীয়। এজন্য আমাদের পরিকল্পিত হোমস ফর ইউক্রেন কর্মসূচিতে নির্দিষ্ট কিছু সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যারমধ্যে রয়েছে জোরালো নিরাপত্তা এবং সকল স্পন্সরের (পৃষ্ঠপোষক) তথ্য নিরীক্ষার মতো পদক্ষেপ। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উভয়েই এসব নিরীক্ষা করছে।

"অতিথিদের আসার আগেই স্পন্সরদের বাড়িতে স্থানীয় পৌর কর্তৃপক্ষের অন্তত একজন প্রতিনিধিকে পরিদর্শনে যেতে হবে, অতিথি আসার পর তার সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করাও তাদের দায়িত্ব।"  


  • সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান 
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.