খোলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বন্ধ স্কুল, কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরলেন আফগান নারী শিক্ষার্থীরা

আন্তর্জাতিক

24 March, 2022, 02:05 pm
Last modified: 24 March, 2022, 02:37 pm
"মেয়েরা যদি শিখতে চায়, তাদের ভাইয়েরা স্কুলে যেতে পারে এবং তারপরে বাড়ি ফিরে তাদের পড়াতে পারে। এক্ষেত্রে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া জরুরি নয়।" 

গেল বছর আগস্টে তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মেয়েদের জন্য বন্ধ হয়ে যায় আফগানিস্তানের স্কুলগুলো। এতে চরম সংশয়ে পড়ে সে দেশের নারীদের ভবিষ্যৎ। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আবারও নব্বইয়ের দশকের সেই তালেবান শাসন কায়েম হতে চলেছে দেশটিতে, যেখানে নারীদের প্রায় গৃহবন্দী করে রাখা হতো। শিক্ষা কিংবা চাকরি কোনোটিরই অধিকার ছিল না তাদের।

তবে, এবারে তালেবান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক মহলকে আশ্বস্ত করেছে, যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে মেয়েদের জন্য খুলে দেওয়া হবে স্কুল। কিন্তু সেই 'যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা' নিশ্চিত হয়নি দীর্ঘ ৭ মাসেও। 

বুধবার স্কুল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে আবারও স্কুল বন্ধের এ সিদ্ধান্তের ফলে ষষ্ঠ শ্রেণির ওপরের কোনো ক্লাসে মেয়ে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারবে না।

আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাখতারের বরাত দিয়ে আল জাজিরার প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, স্থানীয় সময় বুধবার (২৩ মার্চ) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নোটিশে মেয়েদের স্কুল বন্ধের বিষয়টি জানানো হয়।

নোটিশে বলা হয়, ইসলামি আইন ও আফগান সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিকল্পনার আগে মেয়েদের স্কুল বন্ধ থাকবে।

এ ব্যাপারে মেয়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক পরিস্থিতি জানতে বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। 

তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর বুধবার (২৩ মার্চ) সকালে প্রথমবারের মতো স্কুলে যাওয়ার জন্য ব্যাগ গুছিয়েছিলেন ১৫ বছর বয়সী মারজিয়া। কাবুলের পশ্চিমে পাহাড়ী এলাকায় তার বাড়ি। 

বিবিসিকে তিনি বলেন, "আমি খুব খুশি হয়েছিলাম, যখন শুনলাম স্কুল আবার চালু হচ্ছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি আবারও আশাবাদী হয়েছিলাম।" 

প্রায় ২০০ জন মেয়ে শিক্ষার্থী এই দিনে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাইয়েদ উল শুহাদা স্কুলের পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন। তবে, স্বাভাবিকের চেয়ে এই সংখ্যা অনেক কম। কারণ শিক্ষার্থীরা ও তাদের পরিবার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। 

গেল আগস্ট থেকে আফগানিস্তানে ছেলেদের স্কুলের সঙ্গে কেবল মেয়েদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো খোলা রয়েছে। বন্ধ রয়েছে মেয়েদের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা।

বুধবার নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আশা করা হচ্ছিল মেয়েদের জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলগুলোও খোলা হবে। 

শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুমে ঢুকে তাদের ডেস্কের ধুলো মুছতে মুছতেই শুনলেন, কয়েকজন শিক্ষক আবারও অপ্রত্যাশিতভাবে স্কুল বন্ধ হওয়ার ব্যাপারে কানাঘুষা করছিলেন। 

এরই মধ্যে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা আসে, মেয়েদের মাধ্যমিক স্কুল পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।

শিক্ষার্থীরা এতে প্রচণ্ড আহত হন; সঙ্গে সঙ্গেই তারা এর প্রতিবাদে প্রতিক্রিয়া জানায়। কেউ কেউ কাঁদতেও শুরু করেন। 

ওই স্কুলের শিক্ষার্থী ফাতিমা বলেন, "আমরা শিখতে চাই, দেশকে সেবা করার সক্ষমতা অর্জন করতে চাই।" 

"এটি কেমন দেশ? আমাদের পাপ কি? আপনারা সবসময় ইসলামের কথা বলছেন, ইসলাম কি এভাবে নারীদের ক্ষতি করতে বলেছে?", আক্ষেপ জানান তিনি।

নারীশিক্ষার বিষয়ে তালেবানের যুক্তি বোঝা কঠিন। 

মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আজিজ-উর-রহমান রায়ান বলেন, স্কুলগুলো পুনরায় খোলার জন্য সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল, তবে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে আবারও স্কুল বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; জানানো হয়েছে, 'শরিয়া অনুযায়ী ও আফগান সংস্কৃতির সঙ্গে মিল রেখে একটি পরিকল্পনা' তৈরির আগ পর্যন্ত মেয়েদের মাধ্যমিক স্কুল বন্ধ থাকবে। 

ব্যক্তিগতভাবে, তালেবান সদস্যরাও স্বীকার করেন, নারীশিক্ষার বিষয়টি তাদের সবচেয়ে কট্টরপন্থী বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলোর একটি। 

স্কুল খোলার বিষয়ে নীতি পরিবর্তনের এই বিশৃঙ্খল সিদ্ধান্তই প্রমাণ করে তালেবানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে মতের অমিল রয়েছে। শেষ মুহূর্তে এসে আবারও স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত অতি-রক্ষণশীলতার পরিচয় দেওয়ার পাশাপাশি তালেবানের ভাবমূর্তিকে আরও নষ্ট করেছে বহির্বিশ্বে। আন্তর্জাতিক সংগঠন ও বিশেষজ্ঞদের অনুমান সঠিক হতে চলেছে বলেই মন্তব্য করছেন অনেকে। 

তালেবানদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা অনেক সময় তাদের ভৌগলিক অবস্থানের ভিত্তিতেও দেখা যায়। দেশের উত্তরাঞ্চলের একটি গোষ্ঠী, যারা তালেবান বিদ্রোহের সময় 'ছায়া সরকার' গঠন করেছিল, তারা নারীশিক্ষার পক্ষে।

অন্যদিকে আবার, দেশের দক্ষিণের প্রদেশ হেলমান্দ যথেষ্ট রক্ষণশীল। বিবিসির সাংবাদিক যখন এক স্থানীয় বাসিন্দাকে নারীশিক্ষার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তখন তার উত্তর ছিল অনেকটা এরকম, "মেয়েরা যদি শিখতে চায়, তাদের ভাইয়েরা স্কুলে যেতে পারে এবং তারপরে বাড়ি ফিরে তাদের পড়াতে পারে। এক্ষেত্রে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া জরুরি নয়।" 

তবে, আফগানিস্তানের সবচেয়ে রক্ষণশীল এলাকার সাধারণ পরিবারগুলোর অধিকাংশই এখন নারী শিক্ষার পক্ষে মত দিচ্ছে। 

নব্বইয়ের দশকের সেই তালেবান যুগ যেন আবারও ফিরে না আসে, বর্তমানে সেটিই চায় আফগানিস্তানের অধিকাংশ পরিবার। নারীদের শিক্ষা ও কাজ করার অধিকার চান তারা। আরও দশটি স্বাভাবিক দেশে যেভাবে সন্তানদের বেড়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে, আফগান অভিভাবকরাও নিজেদের সন্তানদের ক্ষেত্রে সেটিই প্রত্যাশা করেন। 

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নিরাপত্তার উন্নতি হওয়ায় তালেবান দখলের পর থেকে এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়ে শিশুদের উপস্থিতির হার বেড়েছে। ইতোমধ্যে, তালেবান প্রশাসন নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার অনুমতিও দিয়েছে; তবে এক্ষেত্রে শর্ত হল, নারী-পুরুষের শ্রেণিকক্ষ আলাদা হবে এবং নারীদের পর্দা মেনে ক্লাসে প্রবেশ করতে হবে।

কিন্তু মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ রাখার এই সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত, তালেবান নেতৃত্ব এবং সমসাময়িক আফগান সমাজের মধ্যে বিশাল এক বিরোধের চিত্রই তুলে ধরেছে।


 

  • সূত্র: বিবিসি
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.