হিজাব পরায় ক্লাসে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না ভারতীয় কলেজের মুসলিম তরুণীদের

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
19 January, 2022, 12:50 pm
Last modified: 19 January, 2022, 01:03 pm
কলেজ প্রশাসনের অভিযোগ, হিজাব পরার মাধ্যমে ওই শিক্ষার্থীরা কলেজের নিয়মভঙ্গ করছেন, যেহেতু হিজাব তাদের ইউনিফর্মের অংশ নয়। 

ডিসেম্বরের এক সকালে ১৮ বছর বয়সী আলমাস এবং তার দুই বন্ধু ক্লাসরুমে ঢুকতে না ঢুকতেই তাদের শিক্ষিকা তীক্ষ্ণস্বরে চেঁচিয়ে ওঠেন, "গেট আউট!"

ওই তিন মুসলিম তরুণীকে সেদিন ক্লাসরুমে বসতে দেওয়া হয়নি, কেননা তারা হিজাব বা হেডস্কার্ফ পরেছিলেন। 

আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আলমাস সেদিনকার ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, "যখন আমরা ক্লাসরুমের দরজার সামনে এলাম, শিক্ষিকা বললেন আমরা হিজাব পরে ভেতরে ঢুকতে পারব না। তিনি আমাদেরকে বললেন হিজাব খুলে ফেলতে।"

সেদিনের পর থেকেই ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য কর্ণাটকের উদুপি জেলার একটি সরকার-পরিচালিত মহিলা কলেজের ছয়জন মুসলিম শিক্ষার্থীকে ক্লাসরুমের বাইরে বসতে হচ্ছে। কলেজ প্রশাসনের অভিযোগ, হিজাব পরার মাধ্যমে ওই শিক্ষার্থীরা কলেজের নিয়মভঙ্গ করছেন, যেহেতু হিজাব তাদের ইউনিফর্মের অংশ নয়। 

কিন্তু ভুক্তভোগী তরুণীরা আল জাজিরাকে বলেন, হিজাব তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ, এবং আইনের অধীনেই তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস চর্চার অধিকার রয়েছে। কলেজ প্রশাসন নানা ছলাকলার মাধ্যমে ওই শিক্ষার্থীদের উপর চাপ প্রয়োগ করে তাদেরকে হার মানানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেলেও, এখন পর্যন্ত দমে যাননি তারা। 

প্রতিদিন সময়মতো কলেজে হাজির হলেও, গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে তাদেরকে অনুপস্থিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। 

ছয় শিক্ষার্থীর একজন আলিয়া আসাদি বলেন, "আমরা আমাদের অবস্থান থেকে একচুলও সরব না। কোনোভাবেই না।"

ইতোমধ্যেই হিজাবসহ কলেজ ড্রেস পরিহিত অবস্থায় ওই ছয় শিক্ষার্থীর ক্লাসরুমের বাইরে সিঁড়িতে বসে থাকার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে। 

"ওই ভাইরাল হওয়া ছবিটির কারণেই আমাদের সমস্যাটিকে মিডিয়ায় হাইলাইট করা হচ্ছে," আসাদি জানান। 

উদুপির গভর্নমেন্ট গার্লস প্রি-ইউনিভার্সিটি কলেজে ঘটেছে ঘটনাটি। ছবি: আল জাজিরা

শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে কলেজ প্রশাসন যারপরনাই বিরক্ত। ইতোমধ্যেই তারা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে জোর করেছে যেন তারা একটি আবেদনপত্র লেখেন যে নিজ নিজ বাড়িতে থাকার কারণেই তারা বিগত ক্লাসগুলো মিস করেছেন। 

"আমরা না করার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু প্রিন্সিপাল এবং অন্যান্য শিক্ষকরা আমাদেরকে হুমকি দিয়েছেন আমাদের ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেওয়ার," মুসকান জয়নাব নামের আরেক শিক্ষার্থী জানান। 

তবে জয়নাবসহ ছয় তরুণীই খুশি যে 'গোটা দুনিয়া' দেখেছে যে তাদেরকে ক্লাসরুমের বাইরে বসে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে, যার ফলে কলেজ প্রশাসনের মিথ্যাচার ধরা পড়ে গেছে। 

কিন্তু নিজেদের অনড় অবস্থানের কারণে এই তরুণীদেরকে উপর্যুপরি অপমান, হেনস্থা ও বৈষম্যেরও শিকার হতে হয়েছে।

"সারাদিন ক্লাসরুমের বাইরে বসে থাকা কোনো সুখকর বিষয় নয়। আমাদের শিক্ষকরা তো বটেই, সহপাঠীরাও আমাদের নিয়ে উপহাস করেছে। তারা আমাদের কাছে জানতে চেয়েছে, হিজাব খুললে আমাদের কী এমন অসুবিধা হবে। তারা আরো জানতে চেয়েছে, কেন আমরা নিয়ম মানতে চাই না," আলমাস বলেন। 

"এ ধরনের মানসিক অত্যাচারের কারণে আমার এক বন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়েছে।"

শিক্ষার্থীরা এখন তাদের বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ব্যাপারেও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। অন্যান্য অধিকাংশ কলেজের মতোই, নির্দিষ্ট পরিমাণ উপস্থিতির হার না থাকলে তাদের কলেজেও কোনো শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হয় না। 

কলেজের প্রিন্সিপাল রুদ্র গৌড় আল জাজিরাকে জানান, 'ইউনিফর্মের অংশ না হওয়ায়' হিজাব পরিহিত কোনো শিক্ষার্থীকে তারা ক্লাসরুমে প্রবেশ করতে দিতে পারেন না। তিনি দাবি করেন, তিনি কেবলই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণ করছেন। 

গৌড় বলেন, এবারই প্রথম কলেজে এ ধরনের কোনো সমস্যার আবির্ভাব ঘটেছে। কিন্তু কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা জানান, তারা অতীতেও এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। 

"একবার এক শিক্ষক হিজাব পরিহিত একজন ছাত্রীকে ক্লাসের মাঝখানে মেঝেতে বসিয়ে রাখেন, এবং তার হিজাব টেনে ছিঁড়ে ফেলেন। হিজাব পরার কারণে আমাদেরকে প্রচুর অপদস্থ হতে হয়েছে। তবুও আগে আমাদেরকে অন্তত ক্লাসরুমে বসবার অনুমতি দেওয়া হতো," আতিয়া নামের কলেজের এক প্রাক্তন শিক্ষার্থী জানান। তিনি বর্তমানে কর্ণাটকের মণিপাল ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছেন। 

হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞার এই ঘটনা পুরো ভারতেই সমালোচনার ঝড় তুলেছে। অনেক শিক্ষক ও অধিকার গ্রুপই কলেজ প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে মুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যের। 

নয়া দিল্লির ফ্রেটার্নিটি মুভমেন্টের সচিব, অধিকারকর্মী আফরিন ফাতিমা বলেন, "আমরা পূর্ণ সংহতি ও সমর্থনের সঙ্গে তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছি। কলেজ প্রশাসনে যারা আছেন তাদের কাছে আমাদের দাবি, তারা যেন মুসলিম শিক্ষার্থীদের হিজাব পরার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং তাদেরকে হিজাব পরেই আত্মমর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে ক্লাসরুমে প্রবেশ করতে দেন।"

তিনি আরো বলেন, "এটা আসলে ইসলামোফোবিয়া। এটা বর্ণবাদ।"

এদিকে একটি স্থানীয় আইনজীবী সংগঠন রাজ্য সরকারের কাছে লিখিত চিঠির মাধ্যমে দাবি করেছে যেন শিক্ষার্থীদের হেনস্থা করার কারণে কলেজ প্রশাসন ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়। 

"মুসলিম তরুণীদের শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা, এবং তাদেরকে শিক্ষা বা ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে বলা একটি মানবাধিকার ইস্যু, এবং একে সেভাবেই দেখা উচিত," সংগঠনটি তাদের চিঠিতে লিখেছে। 

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে মুসলিম শিক্ষার্থীদের সক্রিয় সংগঠন ক্যাম্পাস ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া (সিএফআই) কলেজের প্রতি আহ্বান করেছে যেন তারা হিজাব বিষয়ক নিয়ম-নীতিমালা তুলে নেয়, এবং হিজাব পরেই শিক্ষার্থীদের ক্লাস করার অনুমতি দেয়। 

"মেয়েগুলো তাদের মৌলিক অধিকার দাবি করছে। আমরা এ লড়াইয়ে তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছি," বলেন উদুপির একজন সিএফআই সদস্য আসিল আকরাম। 

ছাত্র সংগঠনটির সদস্যরা ইতোমধ্যেই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে চেষ্টা করেছেন সমস্যাটি সমাধানের, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক উদ্যোগই গ্রহণ করা হয়নি বলে জানান আকরাম। তিনি অভিযোগ তোলেন, কলেজ ও জেলা কর্তৃপক্ষ আসলে রাজ্য সরকারের চাপের মুখে রয়েছে যেন মুসলিম নারী শিক্ষার্থীদেরকে তাদের অধিকার বঞ্চিত করা হয়। 

ভুক্তভোগী মুসলিম শিক্ষার্থীরা। ছবি; আল জাজিরা

উল্লেখ্য, কর্ণাটক রয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র অধীনে। 

কে রঘুপতি ভাট নামে একজন স্থানীয় বিজেপি আইনপ্রণেতা উদুপির ওই কলেজটিরও কমিটি প্রধান। তিনি শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদেরকে এক মিটিংয়ের মাধ্যমে জানিয়েছেন যে কলেজ তার নিজস্ব ইউনিফর্ম কোডই মেনে চলবে। কোনো শিক্ষার্থীর ধর্মীয় পছন্দ-অপছন্দকে সেখানে প্রাধান্য দেওয়ার সুযোগ নেই। 

উদুপির ওই কলেজে হিজাব নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার পর রাজ্যের আরো অন্তত দুটি কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে ডানপন্থী অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)-র সদস্যরাও। কলেজের ভেতর গেরুয়া স্কার্ফ পড়ে তারা বিক্ষোভ-কর্মসূচির আয়োজন করে, এবং হিজাব নিষিদ্ধ করার দাবি জানায়। 

এবিভিপি নামের এই ছাত্র সংগঠনটির যোগসূত্র রয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর সঙ্গেও। এই চরম ডানপন্থী সংগঠনটিই বিজেপির আদর্শ নির্ধারণ করে। ভারতজুড়ে কোটি কোটি সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারতকে একটি সাম্প্রদায়িক হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার। 

গত বেশ কয়েক বছর ধরেই কর্ণাটকে হিন্দু জাতীয়বাদী কার্যক্রম মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে। আর তাদের মূল লক্ষ্য হলো রাজ্যের ধর্মীয় সংখ্যালঘু অর্থাৎ মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বিনাশ করা। 

গত মাসে কর্ণাটকের রাজ্যসভায় ধর্মান্তর নিষিদ্ধের একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। বিজেপি সরকারের অভিযোগ, খ্রিস্টান মিশনারি গ্রুপগুলো নাকি এ রাজ্যে হিন্দুদেরকে জোরপূর্বক ধর্মান্তর করছে। অবশ্য খ্রিস্টান ধর্মীয় নেতারা এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন। 

সূত্র: আল জাজিরা 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.