ভারতে মুসলিম নারীদের নিলামে তোলার ঘটনায় প্রযুক্তিকে নিগ্রহের অস্ত্রে রূপ দেওয়া হয়েছে

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
11 January, 2022, 09:15 pm
Last modified: 12 January, 2022, 02:59 pm
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে কতো অনায়সে ও দ্রুততার সাথে নারীদের অনলাইনে হয়রানি ও নিগ্রহ করা সম্ভব- তারই উদাহরণ এই ভুয়া নিলামের ঘটনা। 

একই ঘটনা একবার নয়, ঘটছে বার বার। মাস ছয়েক আগে নিজের ছবি এক মোবাইল অ্যাপে দেখেন ভারতীয় নারী পাইলট হানা খান। ওই অ্যাপ দিয়ে ভারতের মুসলিম নারীদের নিলামে তোলা হচ্ছিল। বিশ্ব গণমাধ্যমের সংবাদ হয় সে ঘটনা, প্রতিবাদের ঝড় উঠলে দ্রুত সেটিকে বন্ধ করার উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। 
 
মুসলিম নারীদের অসম্মানের এই সাম্প্রদায়িক ঘৃণিত পদক্ষেপ যেন আগামীতে না হয়- তা নিয়ে ভারত সরকারের পক্ষে এরপর আর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। প্রশাসনও ছিল নির্বিকার। এবার নতুন বছরের প্রথম দিনেই একই রকম ঘৃণ্য আরেকটি অ্যাপ ছাড়া হয়েছে।    
 
বহুল আলোচিত এই অ্যাপটির নাম বুল্লি বাই। মুসলিম নারীদের গালি দিয়েই এমন নামকরণ। অ্যাপটির নিলামের তালিকায় রাখা হয় নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই-সহ বিশিষ্ট মুসলিম নারী সাংবাদিক, অধিকার কর্মী, অভিনেত্রী এবং রাজনীতিকদের।
 
নারীবাদী ও মানবাধিকার কর্মীরা এর তীব্র নিন্দা করেছেন। ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের মুখে অ্যাপটি বন্ধের পদক্ষেপ নেয় কর্তৃপক্ষ। গেল সপ্তাহে অ্যাপটি তৈরি ও পরিচালনার সাথে যুক্ত চার সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ।
 

বুল্লি বাই অ্যাপ তৈরির অভিযোগে নিরাজ বিশনৈ নামের এই ব্যক্তিকে ভারতের আসাম রাজ্য থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ছবি: রয়টার্স

তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে কতো অনায়সে ও দ্রুততার সাথে নারীদের অনলাইনে হয়রানি ও নিগ্রহ করা সম্ভব- তারই উদাহরণ এই ভুয়া নিলামের ঘটনা। 
 
প্রযুক্তি আজ নারীর যৌন ও মানসিক নিপীড়নের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। আর সে জন্য দুষ্কৃতিকারীদের খরচও করতে হচ্ছে যৎসামান্য; তার সাথে সাম্প্রদায়িকতা যোগ হয়ে আজ ভারতের কর্মক্ষেত্রে সফল মুসলিম নারীরাও সুরক্ষিত নন। তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও সামাজিক সম্ভ্রম হানি করা হচ্ছে। এই বাস্তবতায় সমাজের নিম্নশ্রেণির সংখ্যালঘু নারীর দুর্দশা বলার অপেক্ষা রাখে না। 
 
অনলাইনে ভারতে মুসলিম নারীরা নিয়মিত অপমানের শিকার হন। এই ঝুঁকি মাথায় করে তাদের ভার্চুয়াল বিচরণ। হয়রানির শিকার নারীদের অধিকাংশই বিভিন্ন সময়ে সামাজিক মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও বৈষম্যের অবসান দাবি করে পোস্ট দিয়েছিলেন।  
 
থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে হানা খান নিজ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, "ওই অ্যাপে নিজের ছবি দেখে আমার পুরো পৃথিবী যেন কেঁপে ওঠে। কেউ আমার সাথে এমন করতে পারে জেনে রাগে-দুঃখে ফেটে পড়ি। আর যখন জানতে পারি অজ্ঞাত কোনো ব্যক্তি এই জঘন্য অপরাধ করে পার পেয়ে গেছে তখন ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়।"  

সাল্লি ডিলস নামের প্রথম ওই নিলাম অ্যাপের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগও করেছিলেন ৩০ বছর বয়সী বাণিজ্যিক বিমানচালক হানা। 

নতুন বছরে একই রকম আরেকটি অ্যাপ আসার ঘটনায় তিনি বলেন, "এবারের ঘটনা আমাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করেছে, বন্ধু-স্বজনসহ অন্য মুসলিম নারীদের আবারো একই নিগ্রহের শিকার হতে দেখে আমি খুব অসহায় বোধ করেছি। কারণ কীভাবে এটি বন্ধ করব, তা আমার আর জানা নেই।"  
 
মুম্বাই পুলিশ বলছে, বুল্লি বাই অ্যাপ বড় কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা- এবার তারা সে ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছে। 

দুটি অ্যাপই হোস্ট করেছিল 'গিটহাব' নামক একটি সফটওয়্যার ডেভেলপম্যান্ট প্লাটফর্ম। কোম্পানির একজন মুখপাত্র দাবি করেন, "নারীদের হয়রানি, বৈষম্য করাসহ যেকোনো ধরনের হিংসা, বিদ্বেষমূলক প্রচারণা রোধে আমাদের দীর্ঘদিনের নীতিমালা রয়েছে।"
 
তিনি আরও বলেন, "এই ধরনের কর্মকাণ্ডের (নিলাম) তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর আমরা একটি ইউজার একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছি, কারণ সেটি আমাদের নীতিমালা ভঙ্গ করেছে।" 
 
ভ্রান্ত ধারণা: 
 
প্রযুক্তি করবে জীবনকে সহজ, বাড়াবে মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য- এমন শত আশাবাদ বাস্তবে রূপ নেয়নি মোটেও। প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে বরং ততোই নিগ্রহ ও লাঞ্চণার শিকার হচ্ছে নারী। ভয়াল চিত্র পুরো দুনিয়া জুড়ে। 
 
প্রযুক্তি দিয়ে কখনো নারীর একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে বিকৃতমনারা, কখনোবা ছবিতে নগ্নতা যোগ করে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। ছবি এডিটের সফটওয়্যার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি উন্নতির সাথে সাথে চেহারা পুরোপুরি মিলে যায় চলছে এমন 'ডিপফেক' ছবি/ ভিডিও তৈরি আর শেয়ারিং। আবার বিকৃত ব্যক্তিরা নজরদারি ক্যামেরা ও লোকেশন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমেও নারীর চলাফেরা ও নিত্যকর্মের ওপর নজর রাখছে।   
 
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে তৈরি ডিপফেক বা সিনথেটিক মিডিয়া কন্টেন্ট এখন পর্ণোগ্রাফি বা অশালীন ভিডিও তৈরিতে বহুল ব্যবহৃত। এ ধরনের এমন কিছু অ্যাপ তৈরি হয়েছে, যা একজন নারীর পোশাক মূল ছবি থেকে সরিয়ে ফেলতে পারে অথবা অন্য কারো নগ্নদেহের ছবিতে তার চেহারা প্রায় নিখুঁতভাবে বসিয়ে দিতে পারে। 
 
যুক্তরাষ্ট্রের একটি অলাভজনক সংস্থা- এন্ডট্যাব প্রযুক্তির মাধ্যমে নারী হয়রানি বন্ধে কাজ করছে। এর প্রধান নির্বাহী অ্যাডাম ডজ বলেন, "আজকের দুনিয়ায় সবার হাতে রয়েছে কোনো না কোনো ডিজিটাল ডিভাইস, সবারই রয়েছে ডিজিটাল উপস্থিতি। যথেষ্ট দক্ষতা থাকলে বিশ্বের যেকোনো মানুষের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জেনে যাওয়া সম্ভব, আর তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার পরিকল্পনা করাও আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে গেছে। চাইলেই কারো অসঙ্গত ছবি/ ভিডিও আপনি মুহূর্তের মধ্যে আপলোড করে পুরো দুনিয়াকে দেখাতে পারছেন, এভাবে অন্যের কল্পনাতীত ক্ষতি করা হচ্ছে।"
 
তার মতে, "এই ক্ষতি স্থায়ী, কারণ এসব ছবি/ ভিডিও চিরকাল অনলাইনে কোনো না কোনো আর্কাইভে রয়ে যায়।"
 

বুল্লি বাই অ্যাপ তৈরির অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত দুজনকে আদালতে হাজির করার পর আবার জেলে নিয়ে যাচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। ছবি: নিহারিকা কুলকার্নি/ রয়টার্স

"একবার ভাবুন, আপনার প্রিয়জন কোনো নারীর সাথে এমন আচরণের কথা। তাদের নিয়ে অসঙ্গত তথ্য প্রচারে আপনি কতোটা ক্ষুদ্ধ ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়বেন। কিন্তু, আপনার চেয়েও ভেঙ্গে পড়তে পারেন ওই নারী। এতে নারী মানসিকভাবে যে যন্ত্রণা অনুভব করে- তা কোনো অংশেই শারীরিক যন্ত্রণার চেয়ে কম নয়"- বলে মন্তব্য করেন অস্ট্রেলীয় অধিকার কর্মী নোয়েল মার্টিন। 

নোয়েল যখন মাত্র ১৭ বছরের কিশোরী, তখন তার ছবি ডিজিটালভাবে বিকৃত করে পর্নোগ্রাফি বানিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর তিনি ছবি বিকৃতির ব্যাপারে জোর প্রচারণা চালান। অস্ট্রেলিয়া সরকারও তাতে সাড়া দিয়ে এ সংক্রান্ত অপরাধ বন্ধে আইনে পরিবর্তন আনে। 

তবে এখনও সবাই ভিকটিমদের অভিযোগে কান দেয় না বলে জানান নোয়েল। 

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলছেন, "বেশিরভাগ মানুষ ভাবে, ডিজিটাল মাধ্যমে করা ক্ষতি বাস্তব জীবনে হওয়া খুন-খারাবি, ধর্ষণ বা ডাকাতির মতোন না। তারা ভাবেন, শারীরিক বা মৌখিকভাবে কাউকে অপদস্থ করার চেয়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে করা ক্ষতি গুরুতর নয়।"

"এই ভুল ধারণার কারণেই ভিকটিমদের সমর্থন পাওয়া বা ন্যায়বিচার দাবি করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।"
 
তথ্যপ্রযুক্তি যখন উৎপীড়নের অস্ত্র:
 
অনেক প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের পরিচয় গোপন রাখার সুযোগ দেয়, ফলে নারীর জন্য অসম্মানজনক কন্টেন্ট বা অ্যাপ তৈরিকারী ব্যক্তিদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। অধিকাংশক্ষেত্রে এসব ব্যক্তি ভুয়া ইমেইল বা সামাজিক মাধ্যম একাউন্ট ব্যবহার করে, যা আরেক বিপত্তি। 

শুধু সাধারণ নারীরা নন, তাদের হাত থেকে রক্ষা পাননা আইনপ্রণেতারাও। গেল নভেম্বরে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ- কংগ্রেস রিপাবলিকান দলীয় পল গোসারের একটি ভিডিও সেন্সর করার নির্দেশ দেয়। ওই ভিডিওর অ্যানিমেশন চিত্রে তিনি কংগ্রেসের ডেমোক্রেট সদস্যা অ্যালেক্সান্ড্রা ওসারিও কর্টেজকে হত্যা করছেন এমনটা দেখানো হয়। গোসার এই ভিডিওটি রিটুইটও করেন।  

অ্যাডাম ডজ বলেন, "নতুন প্রযুক্তি অনুমোদনের সময় আমাদের ভাবতে হবে, এগুলো নারী ও কন্যাশিশুদের বিরুদ্ধে কীভাবে অন্যায় ব্যবহার করা হতে পারে। এভাবে প্রযুক্তিকে নিগ্রহের হাতিয়ার বানানো হচ্ছে। তাদের অনলাইন বিচরণ ও ব্যক্তিগত জীবন বিষিয়ে তুলছে ডিজিটাল অস্ত্র।"

কিছু প্রযুক্তি কোম্পানি তাদের ব্যবহারকারী নারীদের রক্ষায় পদক্ষেপও নিচ্ছে। যেমন অ্যাপল তাদের নারী ভোক্তাদের সুরক্ষায় একটি অ্যাপ তৈরি করেছে। 

তবে ভারতে নারীদের নিলাপে তোলার অ্যাপগুলোর বিরুদ্ধে এখনও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।  

বুল্লি বাই- অ্যাপে হয়রানির শিকার সাংবাদিক ইসমত আরার মতে, "এগুলো অনলাইন নিগ্রহ ছাড়া আর কিছুই নয়।"

পুলিশের কাছে করা অভিযোগে ইসমত আরা উল্লেখ করেন, "অ্যাপটি ছিল সহিংস ও  হুমকি সৃষ্টিকারী, যা আমার মনকে আতঙ্ক ও অপমানে ঘিরে ফেলে। শুধু আমাকে নয়, এটি পুরো মুসলিম সম্প্রদায়ের নারীদের মনে একই প্রতিক্রিয়া জন্ম দিয়েছে।" 

আরফা খাতুন শেরওয়ানি নামে আরেক নারীকে ওই অ্যাপে 'বিক্রি'র জন্য তোলা হয়। তিনি টুইট করে লিখেছেন, "নিলাম ভুয়া হতে পারে কিন্তু এর উৎপীড়ন ছিল সম্পূর্ণ বাস্তব।"
 


  • সূত্র: থমসন রয়টার্স/ আল জাজিরা 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.