হ্যাক করা হয়েছিল দুবাই শাসকের প্রাক্তন স্ত্রীর ফোন

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
07 October, 2021, 06:20 pm
Last modified: 07 October, 2021, 06:19 pm
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে, শেখা লতিফার একটি গোপন ভিডিও ফুটেজ পায় বিবিসি। কারাগারে রূপান্তরিত একটি ভিলায় তাকে বন্দী করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওই ভিডিওতে।

দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ আল মাকতুম তার প্রাক্তন স্ত্রী প্রিন্সেস হায়ার ফোন হ্যাক করার আদেশ দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছে ইংল্যান্ডের আদালত। বিতর্কিত পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে এই কাজ করা হয়েছে।

আদালতের মতে, তাদের তালাকের হেফাজত মামলা চলাকালীন সময়ে হায়ার আইনজীবী ব্যারোনেস শ্যাকলেটন এবং নিক ম্যানার্সের ফোনও হ্যাক করা হয়েছিল।

তবে, শেখ মোহাম্মদ এই হ্যাকিংয়ের দাবি অস্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, আদালত এমন সব প্রমাণের উপর ভিত্তি করে এ অনুসন্ধান চালিয়েছে যা তার কাছে প্রকাশ করা হয়নি। এসকল প্রমাণাদি 'অন্যায়ভাবে' তৈরি করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।  

আদালতের এই রায়ের মাধ্যমে তার পরিবারের মহিলা সদস্যদের সাথে শেখ মোহাম্মদের আচরণের বিষয়টিও বোঝা যায়।

নিয়ম লঙ্ঘন
বুধবার প্রকাশিত হাইকোর্টের রায়ে এই হ্যাকিংকে 'ইউকে ডোমেস্টিক ক্রিমিনাল আইনের নিয়ম লঙ্ঘনকারী,' 'মৌলিক সাধারণ আইন এবং ইসিএইচআর অধিকারের লঙ্ঘনকারী,' এবং সরকার প্রধানের ক্ষমতার 'অপব্যবহার' হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

হাইকোর্টের পারিবারিক বিভাগের সভাপতি জানিয়েছেন, প্রিন্সেস হায়া, তার দুই আইনজীবী, ব্যক্তিগত সহকারী এবং নিরাপত্তা কর্মীর দুইজন সদস্যের ফোন হ্যাক করা হয়েছে বা এর চেষ্টা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে পেগাসাস সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে।

আদালত এই সিদ্ধান্তে আসে, "সংযুক্ত আরব আমিরাতে শেখ মোহাম্মদের এজেন্টরা হ্যাকিংয়ের কাজটি করেছিলেন। তার নেতৃত্বেই ঘটেছিল এটি।"

শনাক্ত করা কঠিন এই স্পাইওয়্যার
ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও'র তৈরি স্পাইওয়্যার পেগাসাসের মাধ্যমে হ্যাক করা ফোন ব্যবহারকারী ব্যক্তির অবস্থান ট্র্যাক করার পাশাপাশি তাদের এসএমএস, ইমেইল এবং অন্যান্য অ্যাপের বার্তাগুলো পড়া সম্ভব। এছাড়া, ফোন কলের লিস্ট, পাসওয়ার্ড, ক্যালেন্ডারের তারিখ, ছবি ইত্যাদিও অ্যাক্সেস করা সম্ভব এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে। এক কথায়, হ্যাকার ওই ফোনের প্রায় সবকিছুই দেখতে পাবে।  

এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে হ্যাক করা হলে, টার্গেটকৃত ব্যক্তির কাছে কোনো প্রকারের বার্তা পৌঁছায়না। যার ফলে, তার অজান্তেই ফোনের সকল কার্যকলাপ রেকর্ড করা যায়। এমনকি এর মাধ্যমে তার ছবি তোলা এবং স্ক্রিনশটও নেওয়া সম্ভব।

পেগাসাসের অনুরূপ একটি স্পাইওয়্যার সৌদি সরকারের এজেন্টদের দ্বারা মোতায়েন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। নিহত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির সহযোগী সহ বিদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন ব্যক্তির উপর নজরদারি করা হয় এর মাধ্যমে।

নজরদারিতে রাখা হয়েছিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ডেটা
হাইকোর্টের ফ্যামিলি ডিভিশনে শেখ মোহাম্মদ এবং প্রিন্সেস হায়ার মধ্যে চলমান হেফাজত মামলায় তার আইনি দল বলে, হ্যাকিংটি শেখের 'কর্তৃত্বে' ঘটেছে।

আদালত জানায়, 'এটা স্পষ্ট যে [হ্যাকিং] প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। তার ফোন থেকে ২৬৫ মেগাবাইট ডেটা গোপনে বের করা হয়েছে।'

শেখ মোহাম্মদ বলেন, তিনি কাউকে এনএসও বা 'এমন কোন সফটওয়্যার' ব্যবহারের নির্দেশ দেননি।' তার আইনি দল জানিয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের কী ধরণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকতে পারে সে বিষয়ে তিনি কোনো বিতর্কে প্রবেশ করতে প্রস্তুত নন।

প্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. উইলিয়াম মার্কজাক শেখ মোহাম্মদের ওপর আনা এ অভিযোগ সমর্থন করে সাক্ষ্য দিয়েছেন। ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর সিটিজেন ল্যাবের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তিনি।

তিনি আদালতকে বলেন, এনএসও -এর পেগাসাস সফটওয়্যার ব্যবহার করেই যে ফোন হ্যাক করা হয়েছে তাতে তার কোনো সন্দেহ নেই। তিনি আরও বলেন সংযুক্ত আরব আমিরাত ছাড়া এই কাজ অন্য কেউ করার সম্ভাবনা কম।

চেরি ব্লেয়ার উত্থাপিত অ্যালার্ম
প্রিন্সেস হায়ার আইনজীবী ব্যারোনেস শ্যাকলেটনের কাছে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী চেরি ব্লেয়ার এক জরুরি কল করার পর প্রিন্সেসের আইনী দল হ্যাক করার বিষয়টি জানতে পারে। ব্যবসা ও মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে এনএসও গ্রুপের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন চেরি ব্লেয়ার।

গত বছরের ৫ আগস্ট ইসরায়েল থেকে এনএসও'র ব্যবস্থাপনা দলের একজন সিনিয়র সদস্য চেরি ব্লেয়ারকে জানান, "ব্যারোনেস শ্যাকলেটন এবং প্রিন্সেস হায়ার মোবাইল ফোন মনিটর করার জন্য তাদের সফটওয়্যারের অপব্যবহার হতে পারে বলে নজরে এসেছে তাদের।"

সেই কর্মচারি তখন মিসেস ব্লেয়ারকে জানান, এনএসও সফটওয়্যার ব্যবহার করে সেই ফোনগুলোকে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। ব্যারোনেস শ্যাকলেটনের সাথে যোগাযোগের জন্য চেরি ব্লেয়ারের সাহায্য চেয়েছিলেন ওই কর্মচারি।

এনএসও- এর বিরুদ্ধে এর আগেও মানবাধিকার লঙঘনের অভিযোগ আনা হয়। তবে, বরারই এসকল অভিযোগ অস্বীকার করে আসা প্রতিষ্ঠানটি জানায়, স্পাইওয়্যারের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন দেশের সরকারকে অপরাধী এবং সন্ত্রাসী মোকাবেলায় সাহায্য করে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে এনএসও তাদের চুক্তি বাতিল করেছে বলে মনে করা হয়।

জীবনের ভয়ে বসবাস
গত বছর শেখ মোহাম্মদ এবং প্রিন্সেস হায়ার বিবাহ বিচ্ছেদ মামলার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে হ্যাকিংয়ের ঘটনাটি ঘটে।

তার সন্তানদের জন্য নিযুক্ত অভিভাবক জানান, এটি 'প্রিন্সেস এবং তার সুস্থতার উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। যদি তিনি বুঝতে পারেন যে তার উপর নজরদারি চালানো হয়েছে তাহলে এটি খুবই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা।'

প্রিন্সেস হায়ার আইনি দল আদালতকে জানায়, '২০১৯ এর এপ্রিল থেকেই তিনি নিজের এবং তার সন্তানদের নিরাপত্তার ভয়ে বসবাস করছেন।'

আদালত আরও জানতে পেরেছে, যে প্রিন্সেস হায়ার ক্যাসলউডের বাসার কাছাকাছি একটি সম্পত্তি কেনার চেষ্টা করেছিলেন শেখ মোহাম্মদ।

প্রস্তাবিত সম্পত্তি কেনার প্রসঙ্গে প্রিন্সেস হায়া আদালতকে বলেন, "মনে হচ্ছে যেন আমার পিছু নেওয়া হচ্ছে। শেখ এবং তার স্বার্থে কাজ করে এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে নিরাপদ থাকার জন্য আক্ষরিকভাবে কোনো জায়গা নেই আমার। এটি অত্যন্ত কষ্টকর।"

জোর করে নিয়ে আসা হয়েছে মেয়েদেরকে
শেখ মুহাম্মদের বিরুদ্ধে আদালতে প্রমাণিত হয়, তিনি তার দুই মেয়ে শেখা লতিফা এবং শেখা শামসাকে অপহরণ করে জোর করে দুবাইতে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।

এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে, শেখা লতিফার একটি গোপন ভিডিও ফুটেজ পায় বিবিসি। কারাগারে রূপান্তরিত একটি ভিলায় তাকে বন্দী করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওই ভিডিওতে।

২০১৮ সালে তিনি কীভাবে নৌকায় করে তার পরিবার থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন সে ঘটনাও বর্ণনা করেন তিনি। কিন্তু ভারতীয় উপকূলের কাছে সশস্ত্র ব্যক্তিদের হাতে ধরা পড়েন তিনি। পরে তাকে জোরপূর্বক দুবাইতে ফিরিয়ে আনা হয়।

পরবর্তীতে জাতিসংঘ তার জীবিত ও সুস্থ থাকার প্রমাণ দেখার দাবি করে।

সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা তার কিছু ছবিতে তাকে দুবাই শপিং মলে বান্ধবীদের সাথে দেখা যায়। এছাড়া, মাদ্রিদ ও আইসল্যান্ডে ছুটি কাটানোর কিছু ছবিও রয়েছে তার।

তবে, মানবাধিকার প্রচারকরা সন্দেহ করছে, তিনি এখনও স্বাধীন নয় বা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছেন না। এমতাবস্থায় একটি আইন সংস্থা জানিয়েছে, তারা শেখা লতিফার পক্ষে কাজ করছে, ফলে মিডিয়া যাতে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে।

হাইকোর্টে সাম্প্রতিক শুনানির সময়, প্রিন্সেস হায়ার আইনি দল বলে, হ্যাকিংয়ের মাধ্যমেই লতিফার অপহরণ সম্ভব হয়েছিল। হ্যাক করেই তার অবস্থান সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল তারা।

'গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টের' সময় হ্যাক করা হয়েছে
জর্ডানের প্রয়াত বাদশাহ হুসেনের মেয়ে এবং রাজা দ্বিতীয় আব্দুল্লাহর সৎ বোন প্রিন্সেস হায়া ২০১৯ সালে দুবাই থেকে তার দুই সন্তানের সাথে ব্রিটেনে পালিয়ে যান। তাদেরই দুই মেয়েকে শেখ মুহাম্মদ অপহরণের আদেশ দিয়েছিলেন, এই তথ্য জানতে পেরে পালিয়ে যান তিনি।

সেসময় তার প্রাক্তন স্বামীর এজেন্টদের থেকে ক্রমাগত হুমকিস্বরূপ বার্তা পান প্রিন্সেস।  

জীবন-মৃত্যুর ভয়ঙ্কর এক খেলা
হাইকোর্টে হেফাজত মামলা চলাকালীন সময়ে, নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিবরণ জনগণের নজরের বাইরে রাখার জন্য আপিলের মাধ্যমে বিভিন্ন চেষ্টা করেছেন শেখ মোহাম্মদ। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চ এবং এ বছরের অক্টোবরে চলা মামলার রায়গুলো জনসাধারণের সামনে আনা হয়েছে। তবে, রায় প্রকাশের অনুমতি দেওয়া সাম্প্রতিক আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের চেষ্টা করেননি তিনি।

প্রিন্সেস হায়ার করা হ্যাকিংয়ের অভিযোগের সারমর্মে তার ব্যারিস্টার নিকোলাস কাসওয়ার্থ আদালতকে বলেন, "এটা এখন স্পষ্ট যে প্রিন্সেস এখন একটি ভয়ঙ্কর জীবন-মৃত্যুর খেলায় জড়িয়ে গিয়েছেন।"

রায় প্রকাশের পর শেখ মহম্মদ এক বিবৃতিতে বলেন, "আমি সবসময় আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছি এবং আমি তা অব্যাহত রাখছি।"

"বেসরকারি পারিবারিক কার্যক্রমে জড়িত সরকার প্রধান হিসেবে, ব্যক্তিগতভাবে বা আমার উপদেষ্টাদের মাধ্যমে বিদেশী আদালতে এই ধরনের সংবেদনশীল বিষয়ে প্রমাণ প্রদান করা আমার পক্ষে উপযুক্ত ছিল না," বলেন তিনি।

তিনি আরও যোগ করেন, "দুবাই আমিরাত বা সংযুক্ত আরব আমিরাত কেউই এই কার্যক্রমে অংশীদার নয় এবং তারা শুনানিতে অংশ নেয়নি। অতএব শুনানির ফলাফলগুলো অনিবার্যভাবে অসম্পূর্ণ।"

দুবাইয়ের সার্বভৌম শাসক শেখ মোহাম্মদ যুক্তরাজ্যের ব্যাপক সম্পত্তির মালিক। অ্যাসকটের মতো রেস মিটিংয়ে রানীর সাথে ছবি তুলেছেন তিনি। তিনি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার উভয়ই যুক্তরাজ্যের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বিবেচিত।

যদিও এটি শেখ মোহাম্মদের জন্য লজ্জাজনক, তবে তার কোনো পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।


  • সূত্র: বিবিসি
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.