সাহায্য প্রত্যাশী ভারতীয়দের ভরসাস্থল হলেও মোদির জন্য হুমকি সামাজিক মাধ্যম 

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
04 May, 2021, 06:40 pm
Last modified: 05 May, 2021, 12:48 am
গত কয়েক সপ্তাহে ভারতের কোভিড-১৯ সঙ্কট হয় আরও ঘনীভুত, এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বৃহৎ সামাজিক মাধ্যমগুলো কোটি কোটি ভারতীয়ের আশা-ভরসার স্থলে রূপ নিয়েছে 

সামাজিক মাধ্যমে একটি ব্যবসায়িক নেটওয়ার্কিং গ্রুপ- নেটওয়ার্ক ক্যাপিটাল। চাকরির খবর, উচ্চ শিক্ষার সুযোগ এবং ক্যারিয়ার উন্নত করার নানা তথ্যে সাজানো ফেসবুক গ্রুপটির সদস্য ৬৭ হাজারেরও বেশি।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানার পর আমূল বদলে গেছে গ্রুপটির বৈশিষ্ট্য, হাসপাতালের শয্যার খোঁজ চেয়ে এবং অক্সিজেন আর ওষুধের সন্ধানকারীদের পোস্টেই ভরে গেছে সেটি। সামাজিক মাধ্যমে মানুষ তাদের ক্ষোভ চেপে রাখতেও পারছে না, সমালোচকদের অনেকেই বলছে- ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নানা উপলক্ষে যেভাবে জনসমাগম করার সিদ্ধান্ত নেন, সেটাই আজকের অবস্থার প্রধান কারণ।  

গ্রুপটির সদস্যদের অধিকাংশই পেশাজীবী ভারতীয়, যাদের মধ্যে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী সকলেই আছেন, তারা মানুষের সাহায্যের আবেদনে তাৎক্ষনিক সাড়াও দিচ্ছেন। অনেক সময় চিকিৎসা উপকরণ এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর বিবরণ সমৃদ্ধ গুগল স্প্রেডশিট ফাইল শেয়ার করছেন।

"দুর্যোগের মধ্যেও রাজনৈতিক মেরুকরণের এই দিনে, একে-অন্যের বিপদে মানুষকে এভাবে এগিয়ে আসতে দেখলে মনে অনেক আশা জাগে," বলছিলেন মাইক্রোসফট কর্মী উৎকর্ষ আমিতাভ, তিনি ২০১৬ সালে নেটওয়ার্ক ক্যাপিটাল গ্রুপটি চালু করেন।

তবে বর্তমানে একমাত্র তার গ্রুপ থেকেই সাহায্যের প্রচেষ্টা সংগঠিত রূপ পাচ্ছে, এমনটা মোটেও নয়। বরং সামাজিক মাধ্যমের সর্বস্তর থেকেই সাধ্যমতো চেষ্টা চলছে। 

এদিকে গত কয়েক সপ্তাহে ভারতের কোভিড-১৯ সঙ্কট হয় আরও ঘনীভুত, এই অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বৃহৎ সামাজিক মাধ্যমগুলো কোটি কোটি ভারতীয়ের আশা-ভরসার স্থলে রূপ নিয়েছে। 

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ জনসংখ্যার দেশে মহামারির পর থেকে এপর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত বলে চিহ্নিত হয়েছেন, আকস্মিক জোয়ারের মতো রোগীর ভিড়ে ভেঙ্গে পড়েছে দেশটির স্বাস্থ্য সেবার অবকাঠামো। প্রতিনিয়ত কোনো না হাসপাতালে হয় অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়ায়, নয়তো ওষুধের অভাবে রোগী মৃত্যুর খবর আসছে।  

ভারতের মানেসার অঞ্চলে খালি অক্সিজেন সিলিন্ডার ভর্তি করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা কোভিড রোগীর স্বজনদের। ছবি: সিএনএন

সবচেয়ে বড় সমস্যা সামগ্রিক পরিস্থিতির উপর রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের অভাব। মানুষকে সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানানোর মতো পর্যাপ্ত তথ্যও নেই তাদের ডেটাবেজে। এজন্যেই চিকিৎসা উপকরণ ও হাসপাতালের খোঁজ নিতে ভারতীয়রা ঝুঁকেছেন টুইটার, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, লিঙ্কডইন- এর মতো সামাজিক মাধ্যমে, সেখানে প্রতিনিয়ত চোখে পড়ছে তাদের সাহায্যের মিনতি। 

বলিউড তারকা থেকে শুরু করে ক্রিকেটার, কমিকস শিল্পী এবং বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের মতো সামাজিক মাধ্যমের বিপুল ভক্ত-অনুরাগী থাকা সেলিব্রেটিরাও পিছিয়ে নেই, তারা অন্যদের জরুরি সাহায্যের বার্তা নিজেদের অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার দিয়ে সাহায্য করছেন। বিখ্যাতজনদের অনেকেই নেমে পড়েছেন মাঠ পর্যায়ে, তাদের কেউবা মানুষকে খাওয়াতে লঙ্গর প্রতিষ্ঠা করেছেন, কেউবা নিয়েছেন কোভিড-১৯ রোগীর বাড়ি পরিচ্ছন্ন করা বা তাদের পোষ্য প্রাণীকে আশ্রয় দেওয়ার দায়িত্ব। এমনকি ডেটিং অ্যাপ টিন্ডার ব্যবহার করেও অনেকেই পাচ্ছেন বন্ধুদের জন্য সাহায্য।

লিঙ্কডইনে বিভিন্ন বাণিজ্যিক এবং অলাভজনক প্রতিষ্ঠান নিয়েছে অনুদান সংগ্রহের উদ্যোগ। সামাজিক মাধ্যমটির ভারত শাখার কান্ট্রি ম্যানেজার আশুতোষ গুপ্তা এক ই-মেইল বার্তায় সিএনএন'কে একথা জানান। টুইটারের ভারতীয় শাখার সাবেক হেড অব নিউজ রাহিল খুরশিদ জানান, সেলিব্রেটিদের মাধ্যমে নিজেদের সাহায্যের বার্তা অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার কারণে অনেক ভারতীয়ই বিপদের দিনে কিছুটা ভরসা পাচ্ছেন। তাছাড়া, সেলিব্রেটিরাও একে তাদের একান্ত দায়িত্ব মনে করছেন।  

খুরশিদ বলেন, "টুইটারকে কাজে লাগিয়ে বিখ্যাত জনেরা সাধারণ মানুষের পাশে থাকছেন- এমন দৃশ্য দেখতেও ভীষণ ভালো লাগছে।" খুরশিদ নিজেই এখন একটি ভিডিও স্ট্রিমিং কোম্পানি পরিচালনা করেন। বর্তমান অবস্থান থেকে তিনি নিজেও অন্যের সাহায্যের বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন বলে জানান।

ভয়ঙ্কর এই বিপদ যেন ভারতের অন্যতম অন্ধকার অধ্যায়, এই সময়ে সামাজিক মাধ্যমেই ভারতীয়রা আস্থা রাখছেন। কিন্তু, সেখানে মানুষের ক্ষোভ প্রকাশও থেমে নেই, প্রতিবাদী এই ধারা বন্ধেই বড় কিছু প্লাটফর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তৎপর হয়েছেন মোদি।

গত মাসেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুরোধে বেশকিছু টুইট মুছে ফেলে টুইটার, এসব টুইটের মধ্যে মহামারি ব্যবস্থাপনায় মোদির ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনাও ছিল।

নয়াদিল্লির এই আগ্রাসী আচরণে নিজেদের সবচেয়ে বড় বাজারে অসুবিধাজনক অবস্থায় পড়েছে সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলো। একদিকে ভোক্তাদের আস্থা ধরে রাখা, অন্যদিকে সরকারি আইনভঙ্গের পরিণাম- দুটি ব্যাপারই মাথায় রাখতে হচ্ছে তাদের। আর সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলোকে সরকার বিরোধী তথাকথিত 'বিতর্কিত' পোস্ট সরিয়ে ফেলতে বাধ্য করার বেশকিছু আইনও করা হয়েছে।

ড্রোন ক্যামেরায় পাখির চোখে নয়াদিল্লির একটি শ্মশানে কোভিড-১৯- মৃতদের চিতা জ্বলার দৃশ্য। ছবি: সিএনএন

সেন্সরশিপের ভয়: 

সংক্রমণের মারাত্মক দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতায় জনমানসে ক্ষোভ বাড়ছে, তারমধ্যেই প্রতিদিন অসংখ্য পরিবারের দুর্ভোগ, স্বজন হারানোদের আহাজারি আর মৃত্যুর বিভীষিকাময় ছবি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার হচ্ছে। সাহায্য প্রার্থনা ছাড়াও নেটিজেনরা #রিসাইনমোদি, #সুপারস্প্রেডারমোদি এবং #হুফেইলডইন্ডিয়া – ইত্যাদি হ্যাশট্যাগে মোদি ও বিজেপির প্রতি চূড়ান্ত অবহেলার অভিযোগ তুলছে। 

এব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে, নিজেদের ভারতীয় প্লাটফর্মে কোভিড সংক্রান্ত পোস্টের সংখ্যা জানাতে অস্বীকার করে টুইটার। অন্যদিকে, মহামারি সংক্রান্ত নানা বিষয়ে কাজ করা সাতটি কম্যিউনিটি গ্রুপের তালিকা সিএনএন'কে দেয় ফেসবুক। 

এপ্রিলে সংক্রমণ বৃদ্ধির মধ্যেই নির্বাচনী সভা-সমাবেশ চালিয়ে যায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি। মোদি নিজেও এসবে ব্যস্ত সময় কাটান। ছবি: সিএনএন

ভারতের ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় গত সপ্তাহে দেওয়া এক বিবৃতিতে জানায়, বানোয়াট ও মিথ্যে তথ্য সংম্বলিত ১০০টি পোস্ট সরিয়ে ফেলতে টুইটার, ফেসবুকসহ আরও কয়েকটি সামাজিক মাধ্যমকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। "এসব পোস্টে কোভিডের সাম্প্রতিক তরঙ্গ নিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে অপ্রাসঙ্গিক, পুরোনো এবং ভিত্তিহীন ছবি বা ভিডিও শেয়ার করেছে," বলে সেখানে দাবি করা হয়। 
    
টুইটারের একজন মুখপাত্র সরকারি নির্দেশের পর কিছু টুইট ভারতে প্রকাশ স্থগিত রাখার কথা নিশ্চিত করেন। তবে ভারতের বাইরে অন্য দেশের ব্যবহারকারীরা এসব টুইট দেখতে পারছেন। মোদি নিজেও টুইটারে সক্রিয়, সেখানে তার ফলোয়ার সংখ্যা ৪১ মিলিয়নেরও বেশি। 

সরকারের ওই নির্দেশ ভারতের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের অনেককে  ক্ষুদ্ধ করেছে। তারা বলছেন, সঙ্কট মোকাবিলার চাইতে নয়াদিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার তার ইমেজ রক্ষাতেই বেশি সচেষ্ট। 

ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট অল্ট নিউজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা বলেন, মিথ্যে সংবাদ প্রচার বন্ধের জন্য সরকার এমন পদক্ষেপ নেওয়ার যে ব্যাখ্যা দিয়েছে- তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। "মহামারির মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে লাখ লাখ ভুয়া সংবাদ প্রচার হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে- এই ১০০টি পোস্ট সরাতেই তারা ব্যস্ত হলো কেন?" 

"মুছে ফেলা অনেক টুইট ব্যক্তিগত মতামত তুলে ধরে করা হয়েছিল, সেখানে ভুয়া সংবাদ থাকার কোনো সুযোগ ছিল না," তিনি যোগ করেন। 

সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো, সরিয়ে ফেলা টুইটের মধ্যে বেশকিছু করেছিলেন বিরোধী রাজনীতিকরা। তারা সেখানে কোভিডের মারাত্মক বিস্তারের জন্য সরাসরি মোদিকে অভিযুক্ত করেন। 

ইতোমধ্যেই, নিজের পোস্ট পুনর্বহাল করতে টুইটারের প্রতি আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন ভারতের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল কংগ্রেসের মুখপাত্র পবন খের। তিনি নিজের পোষ্টে মোদি সরকারকে কুম্ভ মেলার মতো পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব করতে দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রেখেছিলেন। প্রশ্ন তুলেছিলেন, মহামারির মধ্যে নির্বাচনী সভা-সমাবেশ করা নিয়েও। খেরের আইনি নোটিশে টুইটটি সরিয়ে ফেলাকে 'স্বেচ্ছাচারি' এবং 'অবৈধ' বলে উল্লেখ করা হয়। এব্যাপারে অবশ্য টুইটার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।    

  • সূত্র: সিএনএন 

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.