সবচেয়ে বড় প্রশ্ন: ভারত কি কোভিড দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পাবে?

আন্তর্জাতিক

ববি ঘোষ, ব্লুমবার্গ ওপিনিয়ন
03 May, 2021, 10:00 pm
Last modified: 03 May, 2021, 10:14 pm
ভারতে কোভিড-১৯ এর মারাত্মক দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে ভাইরোলজিস্ট শাহিদ জামিলের সাথে আলোচনায় উঠে এসেছে, সংক্রমণের গতি-প্রকৃতি এবং সেখান থেকে বিশ্ব শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে এমন কিছু প্রসঙ্গ

ভারতের কোভিড-১৯ মহামারির গতি-প্রকৃতি নিয়ে দেশটির একজন শীর্ষ বৈজ্ঞানিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখক ববি ঘোষ। তারই পরিমার্জিত ও সংক্ষেপিত সংস্করণ তুলে ধরা হলো; 

ববি ঘোষ: পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক কোভিড-১৯ মহাদুর্যোগে ভারত ভুগছে। দৈনিক সংক্রমণ সংখ্যা এখন নিয়মিত ৩ লাখের বেশি, সরকারি হিসেবেই মৃত্যুও ২,০০০ ছাড়াচ্ছে, তবে অবধারিতভাবেই এই সংখ্যা অনেক কমিয়ে দেখানোর ব্যাপারটাও সকলে জানেন। 

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে, হাসপাতালের শয্যা থেকে অক্সিজেন, ওষুধ সবকিছুর যেন সঙ্কট চারদিকে। এর আগে স্থানীয় চাহিদা পূরণে আমদানির চেষ্টা না করে বরং রপ্তানি বন্ধের মাধ্যমে ভ্যাকসিন ঘাটতি মোকাবিলার চেষ্টা করে ভারত সরকার।

রাজধানী নয়াদিল্লির অদূরে অবস্থিত অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রিবেদী স্কুল অব বায়োসায়েন্সের প্রধান হিসেবে আপনি স্বচক্ষে এই দুর্যোগ ঘটতে দেখছেন। অথচ গত গ্রীষ্ম ও শীতে মনে হচ্ছিল ভারত যেন খুব ভালোভাবেই কোভিড ব্যবস্থাপনা করেছে, সেখান থেকে আজকের এই অবস্থা কীভাবে হলো? মাঝখানে কোন বিষয়টি আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে?   

ড. শাহিদ জামিল, ত্রিবেদী স্কুল অব বায়োসায়েন্স-এর পরিচালক, অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়:

গেল বছরের আগস্টে যখন লেখচিত্রে সংক্রমণ রেখা ঊর্ধ্বমুখী ছিল তখন মনে হচ্ছিল দৈনিক সংক্রমণ বুঝি এক লাখ ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু, তা হয়নি। সর্বোচ্চ সংক্রমণ শনাক্ত হয় সেপ্টেম্বরে, তখন আমরা দৈনিক প্রায় ৯৭ হাজার কেস রেকর্ড করছিলাম। তারপর হঠাৎ করেই কমে সংক্রমণের গ্রাফ এবং তার পরের পাঁচ মাসেও গ্রাফটি আরও নিচের দিকে নামতে থাকে। 

ওই সময় আমরা কিছু সুপাররিভিলেন্স স্টাডি করি। এধরনের গবেষনায় মোট জনসংখ্যার যেকারো দেহ থেকে অনির্বাচিতভাবে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে, সেখানে অ্যান্টিবডির সন্ধান করা হয়। আমাদের পরীক্ষায় উঠে আসে, অন্তত ২০-৩০ শতাংশের দেহে অ্যান্টিবডি গড়ে উঠেছে, অর্থাৎ তারা কোনো না কোনো সময় সংক্রমিত হয়েছিলেন অথবা ভাইরাসের মৃদু সংস্পর্শে এসেছিলেন। বড় শহর যেমন; মুম্বাই ও দিল্লিতে এই গবেষণায় মোট জনসংখ্যার ৫০-৬০ শতাংশের সংস্পর্শে আসার ঘটনা সামনে আসে। এই ফলাফল আসলে আমাদের অদূরদর্শী করে তোলে, কারণ আমরা ভেবেছিলাম সম্পূর্ণ শহরবাসীই বুঝি এই সংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করেন, আসলে সেই ধারণা মোটেই ঠিক ছিল না। তাছাড়া, ওই সময়ে আমাদের শনাক্ত করা অধিকাংশ সংক্রমণ হচ্ছিল জনঘন বস্তি এলাকাগুলোতে।    

ওই সময়ে ভারতে মৃত্যুহার অনেক কম এমন কিছু তত্ত্বও প্রস্তাব করছিলেন কেউ কেউ, যদিও সেটা সত্য ছিল না।  বরং জনসংখ্যা অনুপাতে মৃত্যু হার ছিল বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের সম-পর্যায়ের। সেই তুলনায় শ্রীলঙ্কা ও নেপালে ভারতের তুলনায় মৃত্যু হার বেশ কম ছিল। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সব দেশেও একই রকম ছিল সংখ্যাটি। কিন্তু, ভারত নিজের মহামারি চিত্রকে সব সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে তুলনা করে দেখেছে। তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, তাদের চাইতে ভারতে প্রাণহানির হার অর্ধেক। অবশ্য একথাও মনে রাখতে হবে, ভারতে সরকারিভাবে দেওয়া মৃত্যুর পরিসংখ্যানকে কখনোই নির্ভুল ধরে নেওয়া উচিৎ নয়। এর আরেক বড় কারণ; মহামারি ছাড়াও সাধারণত ভারতে মৃত্যুর ঘটনা সরকারি নথিপত্রে নিবন্ধনের চর্চাটি বেশ দুর্বল ও পক্ষপাতদুষ্ট।

এসব অনুঘটকের প্রভাবে সাধারণ মানুষ একটি ভ্রান্ত ধারণা পাচ্ছিল, আর মনে হচ্ছিল আমরা বুঝি বিপদমুক্ত হয়েছি। বিশ্বাসটি আমাদের কোভিড-১৯ স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে চলাফেরা করতে উৎসাহী করে, যা ছিল সাংঘাতিক ভুল। আমাদের আরও মানসম্মত উপায়ে বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করার দরকার ছিল, কিন্তু আমরা তা করিনি।    

ড. শাহিদ জামিল। ছবি: সৌজন্যে প্রাপ্ত

ঘোষ: হঠাৎ করে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধির কারণ কী? 

জামিল: মধ্য ফেব্রুয়ারিতে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ছিল মহামারি শুরুর পর সবচেয়ে কম, দৈনিক ১১ হাজারের নিচে। কিন্তু, তার আগে থেকেই খুব কম পরিমাণে হলেও ভাইরাসের অভিযোজিত ধরন বিস্তার লাভ শুরু করেছিল। সাম্প্রতিক জিন সিকোয়েন্সিং এর তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, বি.১.৬১৭ নামের জোড় অভিযোজিত ধরনটি গেল ডিসেম্বরেই শনাক্ত হয়, কিন্তু তখন এটির পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য না হওয়ায় কেউ বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। 

এরপর যুক্তরাজ্যের অতি-সংক্রামক ধরনটিও (বি.১.১.৭) গত জানুয়ারিতে ভারতে শনাক্ত হয়। দুটি ধরনের কারণে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে আক্রান্তের সংখ্যা হঠাৎ করেই বাড়তে থাকে।   

নতুন ধরনগুলো অনেক বেশি সংক্রামক এবং দ্রুত বিস্তার লাভ করে। মহামারির প্রথম ঢেউয়ের সময় আমরা সাধারণত একটি পরিবারের মাত্র একজনকেই আক্রান্ত হতে দেখেছি, তাও যদি তিনি নিজেকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতেন, তাহলে পুরো পরিবারই সুরক্ষিত থাকত। কিন্তু, এবার আর তা হচ্ছে না, এখন একজন সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন এটা বুঝতে যে সময় লাগে, তার মধ্যেই দেখা যায় পুরো পরিবার আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। 

আমি নিজে একটি জিন সিকোয়েন্সিং কনসোর্টিয়ামের সদস্য- যার আওতায় ১০টি ল্যাবরেটরি আছে। আমরা গবেষকরা প্রতিদিন নিজেদের মধ্যে নিয়মিত নোট বিনিময় করি। ভাইরাসের বিস্তার নিয়ে আমাদের নিজস্ব ড্যাশবোর্ডও আছে, সেখানে চোখ রাখলে কি ঘটছে তার সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা মেলে। এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একইসাথে একাধিক ধরন ছড়ানোর চিত্র লক্ষ্য করছি।   

পাঞ্জাবে ৮০ শতাংশ সংক্রমণের উৎস হলো যুক্তরাজ্যের ধরনটি। পাশের রাজ্য হরিয়ানাতেও এটিই প্রধান উৎস। কিন্তু, দিল্লিতে যুক্তরাজ্যের ধরনটি তো আছেই, তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে ভারতের ডাবল ভ্যারিয়ান্ট। মহারাষ্ট্রে জোড় অভিযোজিত ধরনের বিস্তার ফেব্রুয়ারিতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছিল, সেটি এখন প্রায় ৩৫ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে এলাকা ভেদে।    

ঘোষ: নতুন ধরনকে ডাবল মিউট্যান্ট বলার কারণ কী?

জামিল: এই নামকরণ যথার্থ নয়। আসলে মূল সার্স কোভ-২ ভাইরাসের তুলনায় এই ধরনটির মধ্যে ১৫টি পরিবর্তন এসেছে। এরমধ্যে ছয়টি অভিযোজন হয়েছে এর আবরণে কাঁটা সদৃশ স্পাইক প্রোটিনে। এরমধ্যে দুটি হয়েছে আবার অণুজীবটির দেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ রিসেপটর বাইন্ডিং মোটিফে। স্পাইক প্রোটিনের এই জায়গা দিয়েই ভাইরাস মানব কোষে অনুপ্রবেশ করতে পারে। আবার মানবদেহে গড় ওঠা অ্যান্টিবডিও ভাইরাসের এই অংশকেই লক্ষ্য করে আক্রমণ করে থাকে। অংশটিতে আসা সামান্যতম পরিবর্তনও তাই ভাইরাসের মানবকোষে প্রবেশ এবং নিষ্ক্রিয়কারী অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দেওয়া সক্ষমতা বাড়ায়।  

ডাবল মিউট্যান্ট ধরনের প্রধান দুটি পূর্বসূরির একটি ডেনমার্কে শনাক্ত হয়েছিল মিঙ্কদের মধ্যে। মিঙ্কেরা হলো বেজির মতো দেখতে একপ্রকার জলচর জীব। এরপর ভাইরাসের এই বংশজটি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় মানবদেহে শনাক্ত হয়। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় কোভিড প্রাদুর্ভাব বিস্তারের পেছনে এই ধরনটি প্রধান ভূমিকা রাখে। দ্বিতীয় অভিযোজিত ধরনটি একইরকম হলেও স্বতন্ত্র। এটি দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া ধরনের অভিযোজিত রূপ, যা অ্যান্টিবডি সুরক্ষাকে অনেকাংশে ফাঁকি দেওয়ার শক্তি অর্জন করেছে।

ভারতেই এই দুই ভিন্ন অভিযোজন প্রথমবার একত্র হয়।   
   
ঘোষ: জোড় অভিযোজন ডিসেম্বরেই শনাক্ত হয়েছিল বলে আপনি উল্লেখ করেছেন, কিন্তু বিষয়টি ফেব্রুয়ারিতে সকলের নজরে আসে। তাহলে আরও জোড় ধরন অশনাক্ত অবস্থায় থাকতে পারে, হয়তো সেগুলো এখন শক্তি সঞ্চয় করছে এবং সময় হলেই বড় পরিসরে সংক্রমণ ছড়াবে, সেক্ষেত্রে এদের বিস্তার কি একরকমই হবে?

জামিল: তেমন সম্ভাবনা রয়েছে, এবং সে জন্যেই অপ্রধান ধরনগুলোকেও আগেভাগে শনাক্তের জন্য জিনোমিক সার্ভেইলেন্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ হলো, মোট শনাক্তের শূন্য দশমিক ৩ শতাংশের নমুনা জিন সিকোয়েন্স করতে হবে। ভারতে এই হার অনেক কম ছিল। ডিসেম্বর নাগাদ ভারতে এই হার ছিল মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। কিন্তু, ১০টি ল্যাবরেটরি মিলে সিকোয়েন্সিং কনসোর্টিয়াম প্রতিষ্ঠা করে আমরা গত ফেব্রুয়ারি থেকে ১ শতাংশ হারে জিন বিশ্লেষণ করছি।

পুরো বিশ্বে আক্রান্ত রোগীদের নমুনার ১০ লাখ জিন সিকোয়েন্স করা হয়েছে এবং সেই তথ্য সকলের জন্য উন্মুক্ত। সেখান থেকেও ভাইরাসের ধরন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। আমরা যদি এখনই আগাম হুমকিগুলো শনাক্ত করতে পারি, তাহলে হয়তো ভারতে সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ প্রতিরোধ করতে পারব। হয়তো বৈজ্ঞানিক তথ্যের মাধ্যমে আরও যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে, যা তৃতীয় ঢেউ আঘাত হানার সময় আরও পিছিয়ে দেবে।

ঘোষ: ভারতীয় তরুণেরা এবার অনেক বেশি পরিমাণে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মারাও পড়ছেন। আপনি এতদিন যা লক্ষ্য করেছেন এটা কি তার ব্যতিক্রম? 

জামিল: তরুণদের মৃত্যুর কথা আমিও শুনছি। আর এব্যাপারে আমার একটি ব্যাখ্যাও আছে। তরুণেরা বেশি ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরা করে। কোথাও অতি-সংক্রামক এবং দ্রুত বিস্তার লাভকারী ধরনগুলোর সংক্রমণ চলতে থাকলে ওই এলাকার তরুণেরাও আক্রান্ত হবে। 

তরুণদের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা এবার বেশি বলা যাবে কিনা তা আমি জানিনা, তবে সবই সংখ্যার খেলা। যেমন ধরুন; মৃত্যুহার যদি এখনকার মতোই থাকে কিন্তু সংক্রমণ পাঁচগুণ বেশি বেড়ে যায়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই পাঁচগুণ বেশি মানুষ মরবে। 

  • লেখক: ব্লুমবার্গের মতামত কলামিস্ট ববি ঘোষ মূলত পররাষ্ট্র বিষয়ে লেখালেখি করেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার নানা দেশের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণকে প্রাধান্য দেন।  
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.