মার্কিন দখলদার বাহিনীর উপস্থিতিতে বেড়ে ওঠা তালেবানের নতুন প্রজন্ম 

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক  
20 August, 2021, 06:05 pm
Last modified: 20 August, 2021, 07:11 pm
‘ছোট ইরান’ নামে খ্যাত পশ্চিমাঞ্চলের শহর হেরাতে তালেবান যোদ্ধারা হেলিকপ্টার এবং জব্দকৃত আমেরিকান অস্ত্র-শস্ত্রের বিশাল স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন। টুইন টাওয়ার আক্রমণের সময়ে এই তরুণ যোদ্ধাদের অনেকের জন্মই হয়নি, বাকিরা সেই সময়ে ছিলেন বাচ্চা শিশু। 
ছবি: এএফপি

১৫ আগস্ট আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি যখন কাবুল ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, তখন সশস্ত্র তালেবান যোদ্ধারা রাষ্ট্রপতি ভবনসহ দেশব্যাপী সকল সরকারি ভবনের দখল নিয়ে নিয়েছে। কাবুল জয়ের পর কালো পাগড়ি পরিহিত জেষ্ঠ্য নেতারা যখন বসে বসে বিবৃতি দিচ্ছিলেন তখন তরুণ যোদ্ধারা ব্যস্ত ছিলেন সেলফি তোলায়। 

'ছোট ইরান' নামে খ্যাত পশ্চিমাঞ্চলের শহর হেরাতে তালেবান যোদ্ধারা হেলিকপ্টার এবং জব্দকৃত আমেরিকান অস্ত্র-শস্ত্রের বিশাল স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন। টুইন টাওয়ার আক্রমণের সময়ে এই তরুণ যোদ্ধাদের অনেকের জন্মই হয়নি, বাকিরা সেই সময়ে ছিলেন বাচ্চা শিশু। 

জেষ্ঠ্য কমান্ডাররা যেখানে সোভিয়েতদের সাথে লড়ে, বা মাদ্রাসা আর শরণার্থী শিবির থেকে উগ্রবাদী আদর্শ গ্রহণ করে এরকম যুদ্ধংদেহী হয়েছেন, সেখানে এই তরুণ যোদ্ধাদের প্রায় সবাই বেড়ে উঠেছেন মার্কিন দখদার বাহিনীর নাকের নিচে। 

হামভি চালিয়ে ও ট্যাঙ্কে চড়ে তারা দেশব্যাপী তালেবানের সাদা পতাকা উড়িয়েছে। শুধু তাদের পোশাকই আলাদা না। কমান্ডাররা যেখানে রেডিও সেট নিয়ে ঘুরছেন, সেখানে এই তরুণ যোদ্ধাদের হাতে হাতে স্মার্টফোন। তারা প্রতিদিন নিজেদের ভিডিও-ও আপলোড করে থাকেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

লস্করগায়ের এক দোকানি, জাভেদ খান বলেন, "তারা নির্ভীক ও উত্তপ্ত মেজাজধারী। আমি তাদের চার বা পাঁচজনকে এক হাতে গুলি করতে এবং অন্য হাত থেকে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে দেখেছি। আমি তাদের জেষ্ঠ্যদের যুদ্ধও দেখেছি, তাদের তুলনায় এরা (তরুণরা) বেশি বিপজ্জনক।"

তালেবান নেতা মৌলভী ইয়াহিয়া বলেন, "এরা হলো তালেবান মুজাহিদিনদের নতুন প্রজন্ম। আগের প্রজন্ম রাশিয়াকে হারিয়েছে, নতুন প্রজন্ম আমেরিকাকে হারালো।"

তালেবানের দেশ দখলের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই নতুন প্রজন্মের অনেককে বিনোদন পার্কে বাম্পার গাড়ি নিয়ে খেলতে, ট্রাম্পোলিনে ঝাঁপ দিতে দেখা গেছে। 

হেলমান্দ প্রদেশের যুবক, নূর মোহাম্মদ জানান, একদিন হঠাৎ করে তাকে স্কুল থেকে ডেকে আনা হয়। বাড়িতে এসে জানতে পারেন তার আপন ভাই ও চাচাতো ভাই নিহত হয়েছে বন্দুকযুদ্ধে। 

নূর বলেন, "আমি শুধু তাদের লাশটা দেখেছি। দুজনকেই আফগান সেনারা হত্যা করেছে। তালেবানের সাথে থাকার জন্য ভুলে তাদেরকে গুলি করা হয়েছে।" তিনি আরও বলেন, স্থানীয় আলেম এবং একজন তালেবান কমান্ডার জানাজা পড়তে সেখানে গিয়েছিলেন।

"তারা তাদের (নিহতদের) শহীদ ঘোষণা করেন এবং আশ্বাস দেন যে তারা বেহেস্তে যাবে। আর আমাকে বলেন, প্রতিশোধ নেওয়াটা এখন আমার কর্তব্য। পরের দিন তাই আমি স্কুলে না গিয়ে তাদের কাছে যাই," যোগ করেন নূর।  

আরেক তরুণ যোদ্ধা, কান্দাহারের ছোট এক গ্রাম থেকে আসা খালিক মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলায় তার বাবাকে হারিয়েছেন ছোটবেলায়। তিনি বলেন, "আমি যখন বড় হচ্ছি, তখন তালেবান মুজাহিদিনদের কথাবার্তা শুনে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। তারা আমাদের দেশকে দখলদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছিল।"

এই তরুণ তালেবানরা, যাদের পরিবারের সদস্যরা আফগান সরকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিল, তাদের জন্য কাবুল প্রশাসনের কর্মী ও আমেরিকানদের জন্য ঘোষিত সাধারণ ক্ষমা মেনে নেওয়াটা কঠিন হবে।

কিন্তু তালেবান কমান্ডারদের বেশিরভাগই মাদ্রাসা স্নাতক, এবং দেশব্যাপী আলেম ও শিক্ষক হিসাবে সম্মানিত। মঙ্গলবার তালেবান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, "যারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তাদের সবাইকে আমরা ক্ষমা করে দিয়েছি। আমরা কোন প্রতিশোধ নিতে চাই না।"

হেলমান্দের এক আদিবাসী প্রবীণ জানান, তালেবানরা এবছরের রমজান মাসেও প্রদেশের সব গ্রাম ও শহর ঘুরে তরুণদের নিয়োগ নিয়েছে। তিনি বলেন, নতুন নিয়োগদের যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জয়ের অংশ হওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। 

আদিবাসী প্রবীণ আরও বলেন, ইদের পর তরুণ নিয়োগদের একটি কাফেলা নিয়ে আবার গ্রামে ফিরে এসেছিলেন তালেবান কমান্ডাররা।

মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করা শুরু করলে তালেবানদের অভিযান জোরদার হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার ঘোষণা করার সময়ই তালেবানরা বিজয়ের ঘ্রাণ পাওয়া শুরু করে। মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতিতেই নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলেছে তালেবান, যাদের সাম্প্রতিক যুদ্ধজয়ের গতি পশ্চিমকে হতবাক করে দিয়েছে। 

আফগান সরকারী বাহিনীতে প্রায় সাড়ে আট লাখ কোটি টাকা ঢাললেও তাদের সামর্থ্য নিয়ে সঠিক ধারণা ছিল না মার্কিন প্রশাসনের। এতো অর্থ ঢাললেও আফগান বাহিনীতে দুর্নীতি ও পদমর্যাদায় বিচ্ছিন্নতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উপেক্ষা করে গেছে তারা। 

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দক্ষিণ এশীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. আসফান্দিয়ার মীর বলেন, "এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চূড়ান্ত ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার গ্লানি দীর্ঘদিন বয়ে বেড়াবে তারা। আজকের তালেবানরা প্রথম প্রজন্মের মতই পশ্চাদপদ, কিন্তু দুই দশকের যুদ্ধ তাদেরকে অবশ্যই রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে অনেক পরিপক্ক ও শক্তিশালী করেছে।" 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের শক্তিমত্তা সম্বন্ধেও অবগত ছিল না। তারা ভেবেছিল আল-কায়েদার বিলুপ্তির সাথে সাথে তালেবানের প্রভাবও হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তালেবানের অনুমানিক ৫৫ থেকে ৮৫ হাজার প্রশিক্ষিত যোদ্ধা আছে, যারা চাইলে যেকোনো সময় সমাজে ফিরে যেতে পারবে যেটা আল-কায়দার পক্ষে সম্ভব ছিল না। 

কিছু বিশ্লেষক বলছেন, তালেবানরা এবার তাদের শাসন নীতিতে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। শিয়া মুসলমানদের আশ্বাস দেওয়া, এবং নারী সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকার দেওয়ার মতো ঘটনাগুলো সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

কিন্তু তালেবান বদলে গেছে, এটা মানতে নারাজ অনেকেই। হেরাতের বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক ফাতেমা নূরী বলেন, "বিশ্ব দেখেছে আগেরবার ক্ষমতায় আসার পর তারা কী কী করেছিল। যেখানে তাদের মতাদর্শ একই আছে, সেখানে এবার তারা অন্যরকম ব্যবহার করবে, এটা বিশ্বাস করি কীভাবে?"

তালেবানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বহুদিনের কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা আছে। যে কারণে এবার তাদের কিছুটা নমনীয়তা বজায় রাখতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তাদের তরুণ যোদ্ধারা আদর্শের দিক দিয়ে আরও কঠোর। তারা বিশ্বাস করে যে আফগানিস্তানে তাদের পুরানো শাসনতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্যই আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তারা। 

যেহেতু তালেবান মূলত একটি সামরিক শক্তিই, তাই তাদের ভবিষ্যত নির্ভর করছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামরিক আকাঙ্ক্ষা তরুণরাই প্রভাবিত করবে কিনা তার উপর। 

এদিকে কাবুল বিমানবন্দরের রানওয়ের ভয়াবহ সব ছবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছেয়ে গেছে। 

আরব নিউজকে দুই কিশোরী মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত একজন আফগান বাবা বলেন, "৯/১১-র পর মার্কিনীরা যখন আফগানদের মুক্ত করার কথা বলে এই রানওয়েতে নেমে এসেছিল, তখন আমি কাবুলেই ছিলাম। এখন তারা আমাদের তালেবানদের কাছে ছেড়ে চলে যাচ্ছে।"

  • সূত্র: আরব নিউজ

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.