করোনাকালে মানুষের চলাচল বন্ধে বিশ্বজুড়ে ৬৫ হাজার নিষেধাজ্ঞা!

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
03 August, 2020, 04:40 pm
Last modified: 03 August, 2020, 10:07 pm
উপসাগরীয় দেশে কর্মহীন হয়ে পড়ার দূর্ভোগ সীমাহীন প্রবাসীদের জন্য। এ অবস্থায় তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়াই উচিৎ। কিন্তু, আকাশপথে চলাচল বন্ধ থাকায়- অধিকাংশই তা করতে পারছেন না। মানবেতর অবস্থায় ভিনদেশে আটকা পড়েছেন কোটি মানুষ। সঞ্চিত যে অর্থে পরিবারের দারিদ্র্য দূর করা বা সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর স্বপ্ন তারা দেখেছিলেন, মহামারির ফেরে সেই সঞ্চয় ভেঙ্গেই চলতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে।  

কোভিড-১৯ বিশ্বমারির রূপ ধারণের পর থেকেই বিশ্বের প্রায় সকল দেশ তাদের সীমান্ত পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ ঘোষণা করে। করোনাকালে মানুষের চলাচল বন্ধে বিশ্বজুড়ে দেওয়া হয়েছে ৬৫ হাজার নিষেধাজ্ঞা। বেশকিছু দ্বীপরাষ্ট্র এবং অঞ্চলে বহিঃবিশ্ব থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা- কোভিড-১৯ সংক্রমণ মোকাবিলায় বাড়তি প্রস্তুতি নেওয়ার সময় ও সুযোগ এনে দিয়েছে একথা সত্য। তবে সার্বিকভাবে চলাচলে বাঁধার বৈশ্বিক ক্ষতির অংকও বিপুল। 

এ ক্ষতির পাল্লায় পড়ে ইতোমধ্যেই কর্মহারা লাখ লাখ কর্মী, জীবন হয়েছে বিপর্যস্ত, স্বপ্ন ভেঙ্গেছে কোটি পরিবারের। পর্যটন নির্ভর সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রবাসী কর্মীরাই তার উদাহরণ। কোভিড-১৯ প্রকোপে যখন দেশটিতে বিদেশি পর্যটক, ব্যাংকার, কোম্পানি নির্বাহীদের আগমন বন্ধ হয়ে যায়, তার সরাসরি প্রভাব পড়ে প্রবাসীদের কর্মস্থলে। ফলে বিদেশি অতিথিদের জন্য রান্না ও আতিথেয়তার অন্যান্য দায়িত্বে নিযুক্ত লাখো কর্মী হয়ে পড়েছেন চাকরীচ্যুত। 

উপসাগরীয় দেশে কর্মহীন হয়ে পড়ার দূর্ভোগ সীমাহীন প্রবাসীদের জন্য। এ অবস্থায় তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়াই উচিৎ। কিন্তু, আকাশপথে চলাচল বন্ধ থাকায়- অধিকাংশই তা করতে পারছেন না। মানবেতর অবস্থায় ভিনদেশে আটকা পড়েছেন কোটি মানুষ। সঞ্চিত যে অর্থে পরিবারের দারিদ্র্য দূর করা বা সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর স্বপ্ন তারা দেখেছিলেন, মহামারির ফেরে সেই সঞ্চয় ভেঙ্গেই চলতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে।  

বাধ্য হয়ে ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নেনে অনেক নিরুপায় প্রবাসী শ্রমিক। কিন্তু, আরব আমিরাতে তা বেআইনি হওয়ায় ভিক্ষাকারী শ্রমিকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, পৃথিবীব্যাপী এখনও মহামারি মৃত্যু আর সংক্রমণের তাণ্ডবনৃত্য দেখাচ্ছে। আতঙ্কিত জনগণ এবং সরকারসমুহ। অভিবাসন নীতির শিথিলতা নিয়ে এমুহূর্তে তাই কোনো দেশের নীতি-নির্ধারকদের শীর্ষ পর্যায়ে ভাবনা-চিন্তাও নেই। মহামারির ঝুঁকি হাতে নিয়ে কোনো দেশই এ মুহূর্তে যোগাযোগ নিষেধাজ্ঞা শিথিল করবে না। কিছু সময়ের জন্য এটাই হবে কঠোর বাস্তবতা। 

কিন্তু, আগে হোক বা পড়ে- বৈশ্বিক সরকারগুলোকে অভিবাসী শ্রমিকদের সম্পর্কে তাদের নীতি নিয়ে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি পড়তে হবে। কোভিড জনিত মন্দা থেকে অর্থনৈতিক উত্তরণের আশায় যখন নানা দেশ পর্যটক এবং ব্যবসায়ীক কাজে ভ্রমণকারীদের আগমনে শিথিলতা দেওয়া শুরু করেছে, তখন এ প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। আর্থিক সুবিধা বিবেচনায় যদি ধনী বিদেশিরা অভ্যর্থনা পান, তাহলে কেন দৈনিক মজুরির ওপর নির্ভরশীল বিদেশি কর্মীরা বঞ্চিত হবে? 

নতুন করোনাভাইরাসের কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কার হওয়া এবং মহামারির তীব্রতা কমে আসার পরও, অনেক দেশ বিদেশিদের আগমনে কিছু আবেগী কারণেই নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখতে পারে। মানুষ এখন ভীত; শুধু চলমান মহামারির কারণে নয় বরং এর মধ্য দিয়ে সৃষ্ট সঙ্কট আগামীতে কী পরিণতি ডেকে আনবে; তা নিয়েও উদ্বেগের শেষ নেই।

বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদেশিদের রোগের জীবাণুবাহক হিসেবে সন্দেহ করছেন। গণমাধ্যমে চলছে বিপুল নাটকীয় এবং বিদ্বেষমূলক সংবাদের প্রকাশনা। যেমন; উত্তর আফ্রিকা থেকে নৌকা করে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে আসছে ইউরোপে মহামারি ছড়িয়ে দিতে, এমন কিছু সংবাদ। ইউরোপের নানা দেশে এধরনের সংবাদ মানুষ মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করছে। 

বিদেশিদের প্রতি সন্দেহ থেকেই দেখতে চীনাদের মতো দেখতে অনেক মঙ্গোলয়েড চেহারার মানুষ বিশ্বব্যাপী হামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। একইভাবে, আফ্রিকানদের মতো দেখে কৃষ্ণাঙ্গরা চীনে বিদ্বেষমূলক আচরণের শিকার হন। মাস্ক পড়া নিয়ে সাম্প্রতিক অতীতে নানা টালবাহানা করলেও, বিদ্বেষ থেকেই চীনা ভ্রমণকারীদের আগমন বন্ধ করতে চান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। 

জাতিগত এ ঘৃণাপ্রসূত কারণেই হয়তো দক্ষিন আফ্রিকা সরকার কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর প্রথমেই প্রতিবেশী দেশ জিম্বাবুয়ের সঙ্গে সীমান্তে কাঁটাতারের বেরা নির্মাণ করে। এসব দৃষ্টান্ত আমাদের বলছে, কিভাবে বর্ণবাদ একই ত্বকের অধিকারী জনগোষ্ঠীর মাঝেও সমান প্রভাব নিয়ে কাজ করে যেতে পারে। 

তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, কোভিড-১৯ প্রবাসী কর্মীদের মূল লক্ষ্যস্থল সম্পদশালী দেশগুলোতেই বিপুল বেকারত্ব সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ভোটার মনে করেন, অভিবাসীরা এসে স্থানীয়দের চাকরির সুযোগ কমাচ্ছে। তাই যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়ে আসার পরবর্তীকালেও অভিবাসন বিষয়ক নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার পক্ষে তারা। নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রাখার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদদের মধ্যে সবচেয়ে সরব ডোনাল্ড ট্রাম্প। কোনোপ্রকার রাখঢাক না করেই; তিনি নিজের অভিবাসন বিরোধী অবস্থান প্রায়শই তুলে ধরেন।

গত জুনে এক নির্বাহী আদেশের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে আসার অধিকাংশ কর্মী ভিসা স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন ট্রাম্প। ''অচেনা আগন্তুকরা আমাদের শ্রমবাজার হুমকির মুখে ফেলছে''- একারণেই তাদের আগমন বন্ধ করা হচ্ছে, বলে জানায় ট্রাম্প প্রশাসন। 

আসল ব্যাপার হচ্ছে; স্থানীয় জনগণের মধ্যে বিদেশিদের হাতে কর্মসংস্থান হারানোর ভীতি বিদ্যুৎগতিতে প্রবাহিত হয়। মহামারিজনিত মন্দা সেই উদ্বেগকে সংক্রামক রূপ দেয় মাত্র। মন্দা পরিস্থিতিতে এমন ঝুঁকি থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থায় 'বিদেশি আগন্তুকদের' চাকরি বাজার দখল করে নেওয়ার দাবিটি ভিত্তিহীন।

সত্য এটাই যে, যুক্তরাষ্ট্রে পর্যটক এবং ব্যবসায়ীক কাজে ভ্রমণকারীদের সংখ্যা- বিদেশি কর্মীর আগমন সংখ্যার চাইতে অনেক বেশি। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, অধিকাংশ ধনী ও শিল্পোন্নত দেশের প্রেক্ষাপটে এটাই বাস্তবতা। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ব্রিটেনের কথা। গতবছর বিদেশি কর্মীর চাইতে ৬০ গুণ বেশি এসেছিলেন পর্যটক এবং ব্যবসায়ীরা। এদের আগমন বরং দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বাড়তি গতি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির পক্ষেই সহায়ক হয়েছিল। 

যুক্তরাষ্ট্র এখন অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করতে উদগ্রীব। মহামারি নিয়ন্ত্রণে আনার পর যদি স্বল্পমেয়াদে পর্যটকদের আসার সুযোগ দেওয়া হয়; তাহলে একই প্রক্রিয়ায় প্রবাসী কর্মীদেরও আসার সুযোগ দেওয়া উচিৎ। বিশেষ করে, প্রবাসীরা আসেন দীর্ঘ সময় ধরে জীবিকা উপার্জনের তাগিদে। পর্যটকদের ন্যায় তারা দুই সপ্তাহের কোয়ারেন্টিন মানতে কোনো টাল-বাহানাও করবেন না, বিরক্ত হবেন না অধিকাংশই। তাদের কাছে পরিবার-পরিজনের কল্যাণে কাজ করে যাওয়ার সুযোগটাই প্রাধান্য পায়। সংক্রমণ প্রতিরোধে; সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং, হাতধোয়া,  করোনা পরীক্ষার মতো যেসব কার্যকর পন্থা রয়েছে; তা জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্যই সমান। এগুলো অবজ্ঞা করে চললে, ভাইরাসের বিস্তার কাউকেই রেহাই দেয় না।

বিদেশি কর্মী এসে বিদ্যমান চাকরির বাজারে ধ্বস নামাবে- এটি অর্থনীতির একটি মান্ধাতার আমলের মিথ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। যার মধ্য দিয়ে বিশ্বাস করা হয় যে, অর্থনীতিতে শ্রম সংখ্যা নির্দিষ্ট বা সীমাবদ্ধ। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে; অর্থনীতির প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে শ্রম বাজার এবং চাকরির সুযোগও বিকশিত হয়। চাকরির বেতন থেকে ব্যয় করার ফলে অর্থনৈতিক আবহকে আরো গতিশীল করে তোলেন কর্মীরা। ফলে আরো নতুন চাকরির খাত ও চাহিদা তৈরি হয়। 

অভিবাসী কর্মীরা এসব অবদানের পাশাপাশি, নিজেদের আনীত নানা প্রকার দক্ষতার মধ্য দিয়েও একটি দেশের শ্রম পরিবেশ উন্নত করেন, নতুন মান যোগ করে। এর ফলে সার্বিক শ্রম বাজার আরো যোগ্যতার মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হয়।

সংক্ষেপে বলা যায়, ধনী দেশগুলোর হয়তো বিপুল সংখ্যক হোটেল এবং এয়ারলাইন্স কর্মীর দরকার নেই, কিন্তু এমন কর্মীদের দরকার আছে যারা দক্ষ এবং যোগ্য। যারা নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর কর্মতৎপর। এমন কর্মী বাছাই করে আমদানির মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলো দীর্ঘদিন তাদের অর্থনৈতিক বিকাশকে ধরে রাখে। সকল অভিবাসীর জন্য দরজার পাল্লায় পেরেক পোঁতার ট্রাম্পের বর্তমান নীতির যা সম্পূর্ণ বিপরীত।। 

  • সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট 
  • অনুবাদ: নূর মাজিদ 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.