মহামারির অদৃশ্য মৃত্যুকে গণনা করতে হবে
গত ১৮ মাস ধরে পৃথিবীর বুকে তাণ্ডব চালাচ্ছে কোভিড-১৯ অতিমারি। আনুষ্ঠানিক হিসাবের বাইরে এতে ঠিক কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে- তা এখনও অজানা। এ অবস্থায় বৈশ্বিক মৃতদের সঠিক পরিসংখ্যান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাভাবিক সময়েই বিশ্বব্যাপী প্রাণহানির সঠিক রেকর্ড করা সহজ ছিল না। মহামারিতে তা আরও জটিল হয়ে উঠছে; সংক্রমণ বৃদ্ধির কালে এটি নিরূপণে আসুরিক চেষ্টাও প্রয়োজন হবে। তবে প্রকৃত প্রাণহানির তথ্য অনুসন্ধান না করলে; আমরা বাস্তব দুনিয়ায় ভ্যাকসিনসহ অন্যান্য সংক্রমণ প্রতিরোধী চেষ্টা কতটুকু সফলতা পাচ্ছে- সে সম্পর্কেও জানতে পারব না।
সার্স কোভ-২ ভাইরাসের অতিসংক্রামক নতুন ধরনগুলো কতটুকু মারাত্মক সেটাও জানা যাবে এর মাধ্যমে।
শুধু স্বল্প আয়ের দেশ নয়, উন্নত ও ধনী দেশেও অনেক মৃত্যু অদৃশ্য রয়ে গেছে, জানা যায়নি সমাজের পিছিয়ে থাকা শ্রেণির সঠিক মৃত্যু হার।
বৈষম্যপূর্ণ এমন হিসাবের ফলে শুধু সম্পন্নদের আমলে নিয়ে বৈশ্বিক উত্তরণের পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে, যা বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
মৃত্যু গণণাই মহামারির মতো দুর্যোগে প্রকৃত ক্ষতি নিরূপণের নিশ্চিত সূচক। তবে সে হিসাব রাখতে অধিকাংশ সময়েই আমরা কতোটা বাজেভাবে ব্যর্থ হচ্ছি, সেটাই মূল সমস্যা সৃষ্টি করছে।
যেমন; চলমান মহামারিতে মোট ৪০ লাখের বেশি মৃত্যু ও সাড়ে ১৯ কোটির বেশি সংক্রমিতের কথা জানাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। কিন্তু, বিশ্বজুড়ে স্বজন হারানো মানুষ ও গণমাধ্যমের দাবি প্রকৃত সংখ্যা বহুগুণ বেশি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একাডেমিক গবেষণাগুলোও ইঙ্গিত দিচ্ছে ভয়াবহ মৃত্যুর মিছিলের, ভুল পরিসংখ্যানের খেলায় যা অদৃশ্য থেকে গেছে এতদিন।
সব ক্ষেত্রেই ইচ্ছেকৃতভাবে মৃতের সংখ্যা কম দেখানো হয়েছে এমনটাও নয়। কিন্তু, অনেক দেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রাণহানি কমিয়ে দেখানো হয়, যা এখন প্রমাণিত সত্য।
তবে বেশিরভাগ মৃত্যুর ঘটনা আড়ালে রয়ে গেছে অপর্যাপ্ত করোনা টেস্ট এবং জোড়াতালি দেওয়া স্বাস্থ্যগত তথ্য সংগ্রহের সম্মিলিত কারণে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ভয়ে বা শেষকৃত্যের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ এড়াতে অনেক পরিবারও স্বজনের কোভিড জনিত মৃত্যুর রেজিস্ট্রেশন করায়নি।
তাছাড়া, আগে থেকেই জটিল ও দুরারোগ্য রোগে আক্রান্তদের অনেকে মারা যান কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার পর শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে। তারা ঠিক কোন রোগে মারা গেছেন সেটাও অনেক সময় চিকিৎসকরা নিশ্চিত করতে পারেননি। করোনাভাইরাসে সম্ভাব্য মৃত্যুর সংখ্যাও ডায়াগনোস্টিক টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে অবহেলিত হয়েছে মৃত্যুর কারণ যাচাইয়ের বৈশ্বিক গাইডলাইন।
মহামারিকালে বিভিন্ন কারণে অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যাকে হিসাবে রাখতে হবে। এ মৃত্যুহার হলো স্বাভাবিক সময়ে কোনো একটি দেশ বা অঞ্চলে বিগত কয়েক বছর ধরে যত মানুষের মৃত্যু সাধারণত হয়েছে, তার সঙ্গে মহামারিকালে হওয়া অতিরিক্ত মৃত্যুর তুলনা করা। কোভিড জনিত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মৃত্যু দুটোই এর আওতায় পড়ে।
যেমন; মহামারিকালে হাসপাতালগুলো যখন উপচে পড়ছে তখন অনেকে মারা গেছেন মানসিক উদ্বেগ ও মাদকাসক্তির কারণে। দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা না করাতে পেরেও কারো কারো মৃত্যু হয় । অতিরিক্ত মৃত্যু একটি অঞ্চলের স্বাভাবিক মৃত্যুহারের সঙ্গে মহামারিকালে হওয়া এসব অতিরিক্ত মৃত্যুর হিসাব রাখে। তাই বৈশ্বিকভাবে সার্বিক মৃত্যু গণণায় এটি সেরা বিকল্প হতে পারে। কিন্তু, তবুও গণণার কাজটি যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পরিবার পরিকল্পনার আওতায় দেওয়া সরকারি সাহায্য-সহযোগীতা পেতে উৎসাহ সহকারে জন্মনিবন্ধন করান সন্তানের পিতামাতারা। বিনামূল্যের শিক্ষা বা অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে শিশুর জন্মনিবন্ধন আবশ্যক হওয়ায় এক্ষেত্রে প্রায় সব দেশেই অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু, অনেক মৃত্যুর কথা তাদের পরিজনই কর্তৃপক্ষকে জানায়নি অথবা সেগুলো সঠিকভাবে রেকর্ড করা হয়নি।
জন্ম ও মৃত্যুর মতো সিভিল রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোন একটি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচায়ক। উন্নয়নশীল দেশে এক্ষেত্রে সমন্বয়ের যেমন অভাব রয়েছে, তেমনি নিবন্ধন প্রক্রিয়াও শামুক গতির। সরকারি হাসপাতালে মৃত্যুর নিবন্ধনেও যার কারণে ভুল হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বাইরে করা এক জরিপে দেখা গেছে, জরিপে অংশ নেওয়া পরিবারগুলোতে যতগুলি মৃত্যু হয়েছে তার মাত্র ১৭ শতাংশের নিবন্ধন করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি নিবন্ধন হয়েছে পুরুষের মৃত্যু, সে তুলায় মাত্র ৫ শতাংশ নারী মৃত্যুর রেজিস্ট্রেশন করা হয়।
কোভিডে মৃত্যু সবচেয়ে নাটকীয়ভাবে কমিয়ে দেখানোর ঘটনাটি ঘটে ভারতে। দেশটিতে সরকারি হিসাবে মোট মারা গেছে চার লাখ ২০ হাজার জনের বেশি। এ হিসাব অনুসারে ভারতের মৃত্যুর হার যুক্তরাষ্ট্র বা লাতিন আমেরিকার কোভিড হটস্পটগুলোর চেয়েও কম। কিন্তু, হিসাবের গড়মিল ফাঁস হয়ে গেছে সুপাররিলেভেন্স সার্ভেতে; এ জরিপের মাধ্যমে মোট সংক্রমিতের সংখ্যা এবং সাংবাদিক ও গবেষকদের দেওয়া তথ্যানুসারে মৃত্যুহার নির্ধারণ করা হয়, যা দেশটিতে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হিসাবের চাইতে বহুগুণ বেশি হওয়ার চিত্র তুলে ধরে।
তাছাড়া, গঙ্গা নদীতে সাড়ি সাড়ি ভাসমান লাশ, শ্মশানে লাকড়ির অভাব বা শব পোড়াতে পোড়াতে ইলেকট্রিক চুল্লির ধাতব অংশ গলে যাওয়ার মতো অজস্র সংবাদও এই সত্যকে সমর্থন করছে।
ভারতের যেসব অঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবার সুবিধা সবচেয়ে অনুপস্থিত- সঙ্গতকারণেই সেসব অঞ্চলে সবচেয়ে কম মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে সরকারি হিসাবপত্রে।
লন্ডনের মিডলসেক্স ইউনিভার্সিটির গণিতজ্ঞ মুরাদ বানাজি ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সরকারের দেওয়া মৃত্যু সংখ্যার মধ্যে বিশাল অসামঞ্জস্য তুলে ধরে জানিয়েছেন, জবাবদিতিহার দুর্বলতার কারণেই সঠিক তথ্য রেকর্ড করা হয়নি।
মিশিগান ইউনিভার্সিটির জনস্বাস্থ্য বিভাবের অধ্যাপিকা ভ্রমর মুখার্জির ধারণা, সরকারি হিসাবের চাইতে অন্তত পাঁচগুণ বা ২৫ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়েছে কোভিড।
তবে ওয়াশিংটন ভিত্তিক সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট- এর অতিরিক্ত মৃত্যু নিরূপণের একটি গবেষণা অনুসারে, মহামারিকালে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ভারতে ৩৪-৪৯ লাখ মৃত্যু বেশি হয়েছে।
ভারত সরকার অবশ্য এ প্রতিবেদনের তথ্যকে অস্বীকার করে বলে, এখানে অনুমানের ভিত্তিতে প্রাণহানির সংখ্যা অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
তবে ভারত সরকার একা নয়, একই অভিযোগ রয়েছে রুশ সরকারের বিরুদ্ধেও। রাশিয়াতেও সরকারি সংখ্যার সাথে অতিরিক্ত মৃত্যুহারের ব্যবধান বিশাল।
অন্যদিকে, গেল মার্চে মেক্সিকো সরকার স্বীকার করে নেয়, আনুষ্ঠানিক সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত মৃত অনেক বেশি। অতিরিক্ত মৃত্যুহারের হিসাবে দেশটিতে মোট ৫ লাখ প্রাণহানি অনুমান করা হচ্ছে, যা দেশটির স্বাভাবিক সময়ে মৃত্যুর চাইতে ৫০ শতাংশ এবং সরকারের দেওয়া কোভিড জনিত মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে দ্বিগুণ।
এভাবে বিশ্বের প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশে অগণিত রয়েছে প্রকৃত বিপর্যয়। বৈশ্বিক এ পরিমাপকে সুষ্ঠু করার চ্যালেঞ্জ কম নয়। তবে সত্য উদঘাটনে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
অতিরিক্ত মৃত্যু নিরূপণকে প্রাধান্য দিলে এক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতাকে এড়ানো যাবে। এ হিসাব অনেক মানবিক; কারণ পুষ্টি ঘাটতি, অর্থনৈতিক সংকটসহ নানাবিধ কারণে মানুষের জীবন দিয়ে মূল্যদানকে এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সার্বিক প্রভাবের এ চিত্র আমাদের আগামী দিন সম্পর্কে সতর্ক করবে। বিশেষজ্ঞরাও তেমটাই মনে করেন। যেমন সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. ডেল ফিশার আমাকে বলেন, "কোভিড-১৯ এ মৃতদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণের উপায় যদি থাকতো, তাহলেও প্রকৃত সংখ্যার চাইতে কী কারণে মানুষের মৃত্যু বেশি হচ্ছে- সেটাই বেশি গুরুত্ব পেতো।"
- লেখক: পণ্যবাজার, পরিবেশ, সামাজিক ইস্যু ও সরকারি নীতি বিষয়ক ব্লুমবার্গের মতামত কলামিস্ট ক্লারা ফেরেইরা মার্কুইজ। ইতপূর্বে, তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ব্রেকিংভিউজ শাখায় সহ-সম্পাদকের পদে ছিলেন। সংস্থাটির সম্পাদক ও প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন; সিঙ্গাপুর, ভারত, ইতালি, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়াতে।