ভ্যাকসিন নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে পশ্চিমা অতি সতর্কতা

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক 
15 April, 2021, 06:55 pm
Last modified: 15 April, 2021, 07:34 pm
প্রায় প্রতিটি মহাদেশেই নতুন করে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে এমতাবস্থায় ভ্যাকসিন প্রদান কর্মসূচিগুলো বিঘ্নিত হবার মাত্রা বেড়েই চলেছে। তন্মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশেই বিশৃঙ্খলার পরিমাণ সবচাইতে বেশি।

অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিন প্রদত্ত সুরক্ষা নিয়ে চিন্তার কারণ আছে জানার পর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে টিকাদান ক্যাম্পেইন ধীর হয়ে পড়েছে। অত্যাবশ্যকীয় দুই ডোজ নেয়ার ব্যাপারে জনসাধারণের বিশ্বাস উঠে যাওয়ায় অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলোতে করোনাভাইরাস মহামারি আরো দীর্ঘায়িত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ এসব দেশের ভ্যাকসিন কেনার ব্যাপারে খুব বেশি পছন্দসই বেছে নেয়ার উপায় নেই।

প্রায় প্রতিটি মহাদেশেই নতুন করে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে এমতাবস্থায় ভ্যাকসিন প্রদান কর্মসূচিগুলো বিঘ্নিত হবার মাত্রা বেড়েই চলেছে। তন্মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশেই বিশৃঙ্খলার পরিমাণ সবচাইতে বেশি।

মালাওয়িতে মানুষ চিকিৎসকদের কাছে জানতে চাইছে কীভাবে শরীর থেকে ভ্যাকসিন বের করে ফেলা যায়। দুই মাস আগেই অ্যাস্ট্রাজেনেকা বন্ধ করার পর এবার দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জনসনের ভ্যাকসিন প্রদান বন্ধ করে দিয়েছেন। কঙ্গোতে ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।

বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের উপদেষ্টা কমিটি জনসন অ্যান্ড জনসন ভ্যাকসিন প্রদান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত জানাতে আরো ৭-১০ দিন সময় নিবে জানার পরই জনমনে ভ্যাকসিন নিয়ে অনিশ্চয়তা আরো বেড়ে যায়। কমিটি জানায়, রক্ত জমাট বাঁধার জন্য দায়ী এমন একটি বিরল ব্যাধির ব্যাপারে তাদের হাতে আরো বেশি তথ্য দরকার, তারপরেই তারা সিদ্ধান্তে যেতে পারবেন। বিরল এই ব্যাধিটি ছয়জন নারীর শরীরে দেখা দেয়ার পর মঙ্গলবার ভ্যাকসিনের ডোজ প্রদান থামিয়ে দেয়া হয় এবং বুধবার প্যানের সদস্যরা এরকম আরো দুটি কেসের কথা জানতে পারেন।

এদিকে বুধবার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও জানিয়ে দিয়েছে যে তারা অ্যাস্ট্রাজেনেকা কিংবা জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিন আর কিনবে না। বরং মডার্না বা ফাইজারের উপর ভরসা করবে যেগুলো এখনো পর্যন্ত কোন খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি।

কিন্তু আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের এই প্রতিক্রিয়া সারা বিশ্বে, বিশেষত দরিদ্র দেশগুলোতে সন্দেহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। বহুবছরের সাম্রাজ্যবাদের ফলে এই দেশগুলোতে স্বভাবতই আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভ্যাকসিনের উপর একটি অবিশ্বাসের জায়গা রয়ে গেছে। যদি তারা এখন বুঝতে পারে যে ধনী দেশগুলো দরিদ্র দেশের উপর নিম্নমানের ভ্যাকসিন ডোজ চাপিয়ে দিচ্ছে, তাহলে তাদের মনে এই সন্দেহের মেঘ আরো ঘনীভূত হবে। ফলে এই মুহূর্তে বিশ্বে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু 'ভ্যাকসিন' প্রদান কার্যক্রম আরো মন্থর হয়ে উঠবে।

সি.ডি.সি-এর চিকিৎসক ডা. সারা অলিভার উপদেষ্টা পরিষদকে জানিয়েছেন যে জনসন অ্যান্ড জনসন ভ্যাকসিন স্থগিতাদেশ দেরি করতে থাকার একটি বৈশ্বিক প্রভাব পড়বে।

যদিও ডাক্তারদের মতে, ইতিমধ্যেই ভ্যাকসিন নিয়ে সন্দেহবাদীরা নিজেদের প্রমাণ করে ফেলতে চাইছে এবং বাকিরা তাদের কথায় প্রায় একমত।

মালাওয়ির ডাক্তার প্রিশিয়াস মাকিয়ি বলেন, 'যারা ভ্যাকসিন নিয়ে ফেলেছে তাদের ধারণা তাদের সাথে চালাকি করা হয়েছে। এখন তারা শরীর থেকে এটি ঝেড়ে ফেলতে চাইছে।' মালাওয়িতে স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রায় মেয়াদ শেষের পথে থাকা অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন ফেলে দিত ব্যস্ত। নিজের হতাশা প্রকাশ করে মাকিয়ি বললেন, 'আমরা এত প্রাণপণ চেষ্টা করলাম এই ভ্যাকসিন পেতে, কিন্তু লাভ কি হলো? আমরা আবার সেই শূন্যতে ফিরে গিয়েছি।'

অ্যাস্ট্রাজেনেকা বা জনসনের ভ্যাকসিন দিতে না চাইলে মানুষকে অন্য ভ্যাকসিন দেয়া হবে, আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান আইনপ্রণেতাদের এমন ফাঁকা বুলিতে তাদের প্রতি ক্রোধান্বিত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আফ্রিকার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। কারণ এগুলোর বাইরে আর তেমন কোন ভ্যাকসিনই নেই পৃথিবীতে।

আমেরিকান স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা নিজেরা জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিন প্রদান স্থগিত রাখলেও তারা ইতিমধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের জোর করে বোঝাতে চাইছেন যে ধনী দেশগুলোয় যেসব ভ্যাকসিন কার্যকরী হয়নি, তা দরিদ্র দেশগুলোতে কার্যকরী হবে।

আফ্রিকান ইউনিয়নের আফ্রিকা ভ্যাকসিন ডেলিভারি অ্যালায়েন্স-এর কো-চেয়ার আয়ওয়াদে আলাকিজা ধনী দেশগুলোর এমন কর্মকাণ্ডের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তারা ভ্যাকসিন নিয়ে আত্মবিশ্বাসকে নষ্ট করে দিচ্ছে। বারবার নানা বার্তা দিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করছে এবং এই সংকটের মুহূর্তেও স্বার্থপর আচরণ করছে।

কিন্তু ধনী দেশগুলো যাকে 'সতর্কতা' বলছে, দরিদ্র দেশগুলোর কাছে তা সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে জুয়াখেলা। ডা. আজাকিলা অনুরোধ জানালেন, সতর্কতাস্বরূপ স্থগিতাদেশ দিয়ে যেখানে শুধু এই ভ্যাকসিনগুলোই সহজলভ্য সেসব দেশের জনগণের বিশ্বাস নষ্ট না করতে।

কম উন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোতে জনসন অ্যান্ড জনসন ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন নিয়ে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। কারণ অপেক্ষাকৃত কম দাম ও সহজে সংরক্ষণ করতে পারায় দরিদ্র দেশগুলোতে এই ভ্যাকসিন দুটি সহজলভ্য।
  
অন্তত ১১৮ টি দেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকার শট ব্যবহৃত হয়েছে। কিছু অঞ্চলে পরে জনসন অ্যান্ড জনসনের ভ্যাকসিনও দেয়া হয়েছে। মাত্র দুই সপ্তাহ আগেই আফ্রিকান ইউনিয়ন ৪০০ মিলিয়ন জনসন অ্যান্ড জনসন ভ্যাকসিন পেয়েছে।

সব মিলিয়ে কোভ্যাক্স প্রোগ্রামের এক তৃতীয়াংশই এই দুই ভ্যাকসিন দ্বারা পূরণ করা হয়েছে। 

কিন্তু ক্রমশ প্রতীয়মান হচ্ছে যে ধনী দেশগুলো উক্ত দুই ভ্যাকসিনকে তাদের পরবর্তী পছন্দ হিসেবে রেখেছে। জনসনের ভ্যাকসিন বন্ধ করার পর আমেরিকান রাজ্যগুলো তাদের জনগণকে অপেক্ষাকৃত দামী ফাইজার বা মডার্না ভ্যাকসিন দিতে চাইছে।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও একই পথ অনুসরণ করেছে। তারা বুধবার জানিয়েছে, তারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার শটের বদলে আরো ৫০ মিলিয়ন ফাইজার ভ্যাকসিন কিনেছে। বেশকিছু ইউরোপীয় দেশে ইতিমধ্যেই অ্যাস্ট্রাজেনেকার শট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

এসব সিদ্ধান্ত নিজ দেশীয় জনগণের জন্যে তারা নিলেও অন্য যেসব দেশে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা এক বিলাসিতা এবং ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়ান্টও দেখা দিয়েছে, সেখানেও সিদ্ধান্তগুলো প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে ভ্যাকসিন প্রদান প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাওয়ায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ আরো ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে, যার চাপ পড়বে হাসপাতালগুলোতে এবং পরে সারা বিশ্বে নতুন মিউটেশন ছড়াবে। জনসন অ্যান্ড জনসন ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা শট নিয়ে যত না মারা যেত, এখন তার চেয়ে বেশি মানুষ ভ্যাকসিন না নিয়ে মারা যাবে।

তবে রক্ত ঘনীভূতকরণ ব্যাধির উদ্বেগের মধ্য দিয়েই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আফ্রিকান ইউনিয়ন এখনো জনসন অ্যান্ড জনসন ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা নিষিদ্ধ করেনি। ব্রিটেনেও অ্যাস্ট্রাজেনেকাই তাদের ভ্যাকসিন প্রদান ক্যাম্পেইনের মূল চালিকাশন্তি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। পশ্চিমাদের সতর্কবাণীতে ভীত হয়ে কঙ্গোতে টিকাদান কর্মসূচি বন্ধ থাকলেও তারা আগামী সপ্তাহ থেকে আবার তা শুরু করবে বলে জানিয়েছে।

সেনেগালের রাজধানী ডাকার-এ ও দেখা গেছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার শট নেয়ার জন্যে হাসপাতালে মানুষের লাইন। আফ্রিকাকে গিনিপিগ বানানো হচ্ছে এমন গুজব শোনার পরেও শহরের উয়াকাম অঞ্চলের বাসিন্দা আলিউন বাদারা ডিয়াগনে বলেন, 'আমাদের তো আর কোন বিকল্প উপায় নেই। ভ্যাকসিনই আমাদের একমাত্র আশা।'

কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য ও ড্রাগ ও ভ্যাকসিনের ব্যাপারে প্রতিনিধিরূপে কাজ করা আমেরিকান নিয়ন্ত্রকদের জনসন অ্যান্ড জনসন ভ্যাকসিন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবেই আফ্রিকান দেশগুলোর উপর একটি উদ্বেগের ভার চাপিয়ে দিয়েছে।

জনসন অ্যান্ড জনসন ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা স্থগিতের ব্যাপারে আমেরিকা তার বন্ধুরাষ্ট্র ব্রিটেনের চাইতে বেশি আগ্রাসী আচরণ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও ব্রিটেনও রক্ত ঘনীভূতকরণ ব্যাধি নিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।

তবে আমেরিকানদের সতর্ক মনোভাবের প্রভাব নিশ্চিতভাবেই ইউরোপীয়দের উপর পড়েছে। ইউরোপের কিছু দেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকা বন্ধ করে দিয়েও আবার চালু করা হয়েছে। কিন্তু ফ্রান্স, জার্মানি ও স্পেনের মত দেশগুলোর বেশিরভাগ মানুষ এই দুটি ভ্যাকসিনে বিশ্বাস রাখতে পারেনি।    

এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা আমেরিকার স্থগিতাদেশের সাথে সাথেই তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে যেসব ডাক্তাররা এখনো জনসনের ভ্যাকসিন দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে।

ইউরোপীয় দেশগুলো তরুণদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ভ্যাকসিন না দেয়ার মাধ্যমে যে সতর্কতা অবলম্বন করেছে তা আফ্রিকার ক্ষেত্রে কাজে নাও লাগতে পারে, কারণ সেখানে মধ্যম বয়স ২০ এর নিচে।

ভ্যাকসিন সম্পর্কে আরো কোনো সতর্কবাণী এলে তা কোভ্যাক্স প্রোগ্রামকে অত্যন্ত বিপদের মুখে ফেলে দিবে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রে, বিশেষত এয়ারপোর্টে টাচডাউন পর্যায়ে সবাইকে ভ্যাকসিন দেয়ার অর্থের অভাব।

পশ্চিম আফ্রিকার মালি ও পূর্ব আফ্রিকার সুদান কোভ্যাক্স প্রোগ্রামের আওতায় যথাক্রমে ৭% ও ৮% অ্যাস্ট্রাজেনেকা ডোজ পেয়েছে।
 
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, জনসন অ্যান্ড জনসন ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা নিয়ে এই ত্রস্ততার ফলে মানুষের কাছে রাশিয়া ও চীনের ভ্যাকসিনের চাহিদা তৈরি হবে। কিন্তু তাদের ভ্যাকসিন সম্পর্কে খুব কম তথ্যই পাওয়া গেছে।

পাবলিক সিটিজেন নামক একটি উপদেষ্টা দলের মেডিসিন অ্যাক্সেস বিশেষজ্ঞ জেইন রিজভি বলেন, 'মহামারির নানা পর্যায়ের মধ্যেও আমরা আশাবাদী যে কিছু ভ্যাকসিন অবশ্যই উন্নয়নশীল দেশগুলোর জনগণকে সুরক্ষা দিবে।'

  • সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস
  • অনুবাদ: খুশনুর বাশার জয়া

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.