ভারতে নারীদের হেনস্তা করতে অনলাইন নিলামের আয়োজন

অফবিট

টিবিএস ডেস্ক
10 July, 2021, 04:05 pm
Last modified: 10 July, 2021, 04:32 pm
অন্তত ৮০ জন মুসলিম নারীর ছবি ও ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে 'নিলামে' বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। ভুক্তভোগীদের মধ্যে আছেন সাংবাদিক, গবেষক ও সমাজকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার নারীরা।

ভারতে অন্তত ৮০ জন মুসলিম নারীর নাম ও ছবি প্রকাশ করে অনলাইনে 'নিলামে' বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে আছেন সাংবাদিক, গবেষক ও সমাজকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার নারী। "সুল্লি ডিলস" নামের একটি অ্যাপ ও ওয়েবসাইটে নারীদের অজ্ঞাতে এসব বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়।

অ্যাপ থেকে নাম ও ছবি ছড়িয়ে পড়ায় হেনস্তার শিকার হয়েছেন বহু নারী। হয়রানির শিকার নারীদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। 

আক্রমণের শিকার নারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। আর সে কারণেই শুধু যৌন হয়রানির উদ্দেশ্যেই নয়, বরং আক্রমণের পেছনে অন্যান্য স্বার্থ আছে বলেও ধারণা করছেন অনেকে।

মুসলিম নারীদের জন্য 'সুল্লি' অবমাননাকর একটি শব্দ। সাধারণত, ভারতের উগ্রপন্থী হিন্দুরা মুসলিম নারীদের নিয়ে ভার্চুয়াল মাধ্যমে ট্রল বা উপহাস করতে 'সুল্লি' শব্দটি ব্যবহার করেন। 

ধর্মীয় কারণেই আক্রমণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন পেশায় পাইলট হানা খান। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান 'সুল্লি ডিলস' নামের অ্যাপটিতে টুইটার থেকে তার নাম ও ছবি ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়।

"আমি ৮৩টি নাম গুণে দেখেছি। আরও নাম থাকতে পারে। অ্যাপটি ২০ দিন ধরে চলছিলো অথচ আমরা তা জানতামও না," বলেন হানা। 

ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে আক্রমণের শিকার হওয়ার অভিযোগ করে তিনি বলেন, "আমি এমন একজন মুসলিম নারী যাকে সবাই দেখতে পান, যার কথা সবাই শুনতে পান। আর তাই তারা আমাদের থামিয়ে দিতে চায়।"

ওয়েব প্ল্যাটফর্ম 'গিটহাব' ব্যবহার করে অ্যাপটি তৈরি করা হয়। তবে, কারা তা তৈরি করেছে তা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। অভিযোগ পাওয়ার পরই গিটহাব অ্যাপটি বন্ধ করে দেয়। প্রতিষ্ঠানটি এক বিবৃতিতে জানায় এ ধরনের কর্মকাণ্ড তাদের নীতিমালা পরিপন্থী। 

হয়রানির শিকার মুসলিম নারীরা প্রত্যেকেই সামাজিকভাবে সরব ছিলেন। তবে, এই ঘটনায় তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকেই সামনে আরও হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এমনকি ভয়ে অনেকে তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্টও মুছে ফেলেন।

ভারতের কবি ও সমাজকর্মী নাবিয়া খান অ্যাপটিতে নিলামের তালিকায় নিজের নাম দেখতে পান। ইন্ডিয়া টাইমসে প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তায় নাবিয়া জানান, "আমার নাম সেখানে দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।"

"ক্ষমতা কাঠামোর শীর্ষে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ বা তাদের সমর্থনে নিলামে উঠতে দেখলে আপনার নিজেকে খুব অসহায় বলে মনে হবে। এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় প্রচন্ড মানসিক চাপ কাজ করে। আপনার রাতের ঘুম নষ্ট হয়ে যাবে। কারণ আপনি জানেন আইন আপনাকে সুরক্ষা দিবে না," বলেন নাবিয়া।

তিনি আরও জানান, "এটা শুধু পুরুষতন্ত্র, নারী বিদ্বেষ বা ধর্ষণ সংস্কৃতির অংশ নয়। বরং এখানে ইসলাম বিদ্বেষের সাথে এই তিনটি বিষয় যুক্ত হয়েছে।"

বিবিসির কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অপর এক ভুক্তভোগী নারী বলেন, "আপনি যতোই দৃঢ় হোন না কেন, আপনার ছবি এবং ব্যক্তিগত তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশিত হলে আপনি ভয় পাবেন, অশান্তির সৃষ্টি হবে।"

তবে ঘটনায় সংশ্লিষ্ট 'বিকৃতমনস্ক' এই অপরাধীদের সামনে আনতে সোচ্চার হয়েছেন হেনস্তার শিকার নারীদের অনেকে। ইতোমধ্যে, পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন হানা খান।

পুলিশ জানিয়েছে, তারা তদন্ত পরিচালনার কাজ শুরু করেছে। তবে ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু প্রকাশ করা হয়নি। ভারতের বিশিষ্ট নাগরিক, সমাজকর্মী এবং নেতৃবৃন্দ অনলাইনে এই হয়রানির নিন্দা জানিয়েছেন। 

একই ঘটনার শিকার হয়েছেন দিল্লির সাংবাদিক ফাতিমা খান। ফাতিমা ২০২০ সালে দিল্লির সহিংসতার ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন করেন। পুলিশের কাছে দেওয়া বক্তব্যে তিনি জানিয়েছেন, ইচ্ছাকৃতভাবেই তাকে আক্রমণ করা হয়েছে। 

কংগ্রেসের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সমন্বয়ক হাসিবা আমিন জানান, ভুয়া পরিচয়ে অ্যাপটি তৈরি করা হয়েছিল। অ্যাপটিতে 'ডিল অব দ্য ডে' লিখে নারীদের ছবি ও ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করা হত। 

বিবিসির কাছে আমিন জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্য অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়মিত মুসলিমদের আক্রমণ করা হয়ে থাকে। বিশেষত নারীদের লক্ষ্য করে বেশিরভাগ আক্রমণ করা হয়। 

তবে, এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম নয় বলেও জানান হাসিবা আমিন। এর আগে, গত ১৩ মে মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব ঈদ-ঊল-ফিতরের দিনও একই ঘটনা ঘটে। সেদিন, ইউটিউবের একটি চ্যানেলে 'ঈদ আয়োজনে'র নাম দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের নারীদের ছবি ব্যবহার করে 'নিলামের' ডাক দেওয়া হয়।

"মানুষ নারীদের শরীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের রেটিং দিয়ে যাচ্ছিল। একেকজন পাঁচ রূপি, দশ রূপি এরকম বিভিন্ন মূল্য তুলে ধরছিল। ধর্ষণের হুমকি ছাড়াও বিভিন্ন যৌনকর্মের বর্ণনা দিচ্ছিল তারা," বলেন হানা খান।

তবে, ঘটনা সেখানেই থেমে থাকেনি। পরবর্তীতে, টুইটারে একাধিক ভুয়া একাউন্ট থেকে ওই নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা হয়।

হানা খানের ধারণা, যারা অ্যাপটি খুলেছিলো তারাই টুইটারে পুনরায় আক্রমণ করে।

আন্দোলনকারীরা বলছেন, অনলাইন নিপীড়নের মাধ্যমে নারীদের অবমাননা করে ভয় দেখিয়ে তাদের থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

গত বছর, ভারতে অনলাইন হয়রানি বিষয়ক এক প্রতিবেদনে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, যে নারীরা যত বেশি সরব হন, তাদের অনলাইন আক্রমণকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাও ততো বেশি। 

তবে, সংখ্যালঘু নারীরা সবক্ষেত্রেই আক্রমণের সহজ শিকারে পরিণত হন।

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.