বেদুইনের তাঁবু থেকে সুউচ্চ দালানের দেশ, ৫০ বছরে কীভাবে সম্ভব হলো বিস্ময়কর এ উত্থান!

আন্তর্জাতিক

30 November, 2021, 08:50 pm
Last modified: 30 November, 2021, 09:17 pm
বিশ্ববাসী আমিরাতের চাইতেও বেশি হয়তো দুবাইয়ের নামটিই জানেন। এককালের ঊষর মরুর দুবাই এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এর সুউচ্চ আকাশছোঁয়া দালানের মধ্যে আছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু স্কাইস্ক্রেপার বুর্জ খলিফা (২,৭২৩ ফুট)।

ইহাব ফুয়াদ তখন ১৪ বছরের কিশোর। ৫০ বছর আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। এই সুদীর্ঘ সময়ে বদলে গেছে দেশটি। প্রান্তিক মরু অঞ্চল থেকে হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক শক্তিকেন্দ্র। 

সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ফুয়াদের বয়স এখন ৬৪ বছর। এখনও তার স্মৃতিতে উজ্জ্বল ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর, যেদিন তিনি আমিরাতের প্রতিষ্ঠাতা শেখ জায়েদ বিন সুলতাল আল-নাহিয়ানকে প্রথম সামনাসামনি দেখেন। জমকালো সেই প্যারেডে তেল সমৃদ্ধ নতুন রাষ্ট্রের পতাকাবাহকের পেছনেই ছিলেন ফুয়াদ।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে আছে সাতটি আমিরাত বা রাজ্য। দুবাইও এমন একটি রাজ্য। কৈশোর থেকে এখানেই পরিবারসহ থাকেন মিশরীয় বংশদ্ভূত এ প্রকৌশলী। 

নতুন রাষ্ট্র গঠনের পরবর্তী দশকগুলোয় আমিরাতের উত্থানের বিষয়ে ফুয়াদ বলেন, '৫০ বছর পর আজ আমি গর্বিত, এই পথচলা ছিল আমার জন্য, এদেশের জন্য অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা।   

আরব আমিরাতে স্থানীয়দের জনসংখ্যা অনেক কম। সেখানে মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই হলেন বিদেশি নাগরিক। আমিরাত যখন প্রথম গঠিত হয় তখন মাত্র ৩ লাখ বিদেশি দেশটিতে বাস করতেন। এখন সেই সংখ্যা ১ কোটিতে পৌঁছে গেছে। তবে কড়া অভিবাসন নীতির কারণে অনেকেই দীর্ঘদিন সেদেশে বাস করেও নাগরিকত্ব পান না।  

বিশ্ব অর্থনীতির চালিকাশক্তি জ্বালানি তেলের বিপুল মালিকানা এককালের ব্রিটিশ নিরাপত্তাধীন (প্রটেক্টরেট) রাষ্ট্রটিকে মরুচারী বেদুইনের তাঁবুর দেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকেই অন্যতম পরিচালকে পরিণত করেছে।

বিশ্ববাসী আমিরাতের চাইতেও বেশি হয়তো দুবাইয়ের নামটিই জানেন। এককালের ঊষর মরুর দুবাই এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এর সুউচ্চ আকাশছোঁয়া দালানের মধ্যে আছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু স্কাইস্ক্রেপার বুর্জ খলিফা (২,৭২৩ ফুট)।

ফুয়াদ বলেন, 'এককালে এখানকার স্থানীয় মানুষ মাটির দেওয়াল তুলে আর খেজুর পাতার ছাউনি দিয়ে বাড়ি বানাতেন। আর আজ দুবাইয়ের যেদিকে তাকান, চোখে পড়বে নয়নাভিরাম ভিলা নয়তো সুউচ্চ টাওয়ার।'

সক্রিয় পররাষ্ট্রনীতি:

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ থিঙ্ক ট্যাঙ্কের উপসাগরীয় অঞ্চল বিশ্লেষক এলহাম ফাখরো বলেন, 'প্রয়াত শেখ জায়েদ আরব জাতীয়তাবাদে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। সেই চেতনা থেকেই তিনি স্বতন্ত্র সাতটি আমিরাতকে একটি ফেডারেশনের আওতায় আনেন। এটি আরব বিশ্বের একমাত্র কার্যকর ফেডারেল ব্যবস্থা হিসেবে অস্তিত্ব ধরে রেখেছে।'  

বিশ্বে অশোধিত জ্বালানি তেলের অন্যতম উত্তোলনকারী দেশ আমিরাত। ১৯৭০ এর দশকের পর থেকে তেল ও গ্যাস বিক্রির অর্থ দেশটির সমৃদ্ধি অর্জনে প্রধান ভূমিকা রাখে। 

কিন্তু, ফেডারেল রাজধানী আবুধাবির চেয়ে তেল সম্পদ কম থাকায়; দুবাই বিকশিত হয়েছে আর্থিক খাত, পরিবহন এবং মিডিয়া হাব হিসেবে গড়ে উঠে।  

সৌদি আরবের পরই আমিরাত আজ আরব বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি। এই অঞ্চলে মিশর, সিরিয়া ও ইরাকের মতো প্রচলিত শক্তিগুলোর আধিপত্য হ্রাস পাওয়ায়, আমিরাত রাজনৈতিক প্রভাবের শূন্যতা পূরণে এগিয়ে এসেছে। 

২০১১ সালের আরব বসন্তের সময় থেকেই আমিরাতের ক্রমশ আধিপত্য বিস্তারকারী পররাষ্ট্রনীতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেশটি ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসনের সঙ্গী হওয়ার পাশাপাশি, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন সংঘাতে জড়িয়েছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত এসব দেশের অনেক তরুণই আমিরাতে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। 

ফাখরো বার্তাসংস্থা এএফপিকে বলেন, 'চারপাশে শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্র পরিবেষ্টিত আমিরাত আর এখন নিজের তুলনামূলক নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে চিন্তিত নয়। অতীতে দেশটির পররাষ্ট্রনীতি ছিল নিরপেক্ষতার। কিন্তু, আরব বসন্তের পর থেকেই সক্রিয় একটি অবস্থান নিয়েছে দেশটি। এর মাধ্যমে তারা এই অঞ্চলের রাজনীতিকে নিজেদের সুবিধামতো আকার দিতে চাইছে।'

'আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না'

মধ্যপ্রাচ্যের মতো অস্থিতিশীল অঞ্চলে ইসলামপন্থী রাজনীতির ঘোর-বিরোধী অবস্থান নিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। 

গতবছর দেশটি ইসরায়েল্কে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সকলকে চমকে দেয়। আরব জনমতকে পাশ কাটিয়ে আমিরাতের এ সিদ্ধান্ত তুমুল সমালোচনার জন্মও দেয়।
 
এব্যাপারে আমিরাতের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ বলেন, 'আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ শক্তি হিসেবে এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে আমাদের আরও দায়িত্ব নিতে হবে। গত কয়েক দশকে এখানে অনেক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। আমরা উদ্যোগী নাহলে অপশক্তিগুলো সে শূন্যতা পূরণ করবে, আর আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে বসে তা দেখতে পারি না।' 

দেশটির এই সক্রিয় পররাষ্ট্রনীতির আওতায় ঘটেছে মানবাধিকার লঙ্ঘন। বিশেষ করে, ইয়েমেন যুদ্ধে আমিরাতের ভূমিকা নিয়ে রয়েছে ব্যাপক সমালোচনা। তবু বিনিয়োগ প্রবাহ থামেনি দেশটিতে। 

সাম্প্রতিক সময়ে আর্থিক আইনে পরিবর্তন এনে আরও বিনিয়োগ আকর্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে আমিরাত, সরকার 'শূন্য কর' স্বর্গ হিসেবে আমিরাতে পুঁজি লগ্নীর প্রচারণা চালাচ্ছে। 

এতদিন দেশটিতে সম্পূর্ণ বিদেশি মালিকানার ওপর বিধিনিষেধ ছিল। এটি তুলে নেওয়ায় এখন বিদেশিরা দেশটিতে ব্যবসা সম্পূর্ণ নিজ মালিকানায় রাখতে পারবেন। এছাড়া, বিশিষ্ট বিনিয়োগকারী এবং শিল্পী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানীসহ নানান পেশার মেধাবীদের 'গোল্ডেন' ভিসা দেওয়া হচ্ছে। 

  • সূত্র: এএফপি ভায়া এনডিটিভি 
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.