বায়ুদূষণ দক্ষিণ এশিয়ায় কোভিড পরিস্থিতির অবনতি ঘটাবে! 

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
28 October, 2020, 08:05 pm
Last modified: 28 October, 2020, 08:19 pm
‘‘নিম্ন-মানের বাতাস আর ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার দ্বিমুখী প্রভাবে ভারতে জনস্বাস্থ্য সঙ্কট চরম আকার ধারণ করতে পারে,’’বলছিলেন সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ পূর্ণিমা প্রভাকরণ। তিনি ভারতের সেন্টার ফর ইনভায়রোমেন্টাল হেলথের সহকারি পরিচালক।  

লকডাউনের জেরে দক্ষিণ এশিয়ায় বিশাল অঞ্চল জুড়ে থেমেছিল অর্থনীতির চাকা। শিল্প-কারখানা এবং পরিবহন বন্ধের সুবাদে কমে যায় বায়ুদূষণ। উপমহাদেশের পশ্চিম প্রান্তের নগরী পেশোয়ার থেকে পূর্বে আসামের গোয়াহাটি বড় সব শহরে বহুদিন পর দেখা মেলে নির্মল আকাশের। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বায়ুদূষণ মোকাবিলা করা সম্ভব- এমন আশাও জাগে। তবে লকডাউন কার্যক্রম শিথিল হয়ে অর্থনীতি সচল হওয়া শুরু হওয়া মাত্রই আবারো বাড়ছে দূষণ।  

শীতের মৌসুমও চলে এসেছে। এই মৌসুমেই তীব্র আকার ধারণ করে দূষণের কারণে সৃষ্ট কুয়াশা পরিস্থিতি, অবশ্য একে ধোঁয়াশাই বলা হয়। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, দূষিত ধোঁয়াশার কারণে এ অঞ্চলে মহামারি পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। প্রাণহানির সংখ্যা এবং সংক্রমণ হার যেকারণে অবনতি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা। 

উপমহাদেশে বসন্ত ও শীতকালে তীব্র ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়; কৃষি জমিতে ফসলের উচ্ছিষ্ট পোড়ানো, শিল্পোৎপাদন, যানবাহনের নির্গত ধোঁয়া এবং ইট ভাটাগুলোর উৎপাদন কাজের জেরে। যাকে বলা যায়, বিষাক্ত উপাদানের প্রাণঘাতী মিশ্রণ।  

চীনকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তানের বড় শহরগুলো এখন বিশ্বের শীর্ষ দূষিত বাতাসের শহর হয়ে উঠেছে। প্রতিবছর এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার কারণে নানা প্রকার রোগ-ব্যাধিতে মারা পড়ছেন।  

দূষণের কারণে উপমহাদেশে গড় আয়ু কমেছে পাঁচ বছর। উত্তর ভারতের সবচেয়ে দূষিত এলাকাগুলোতে আয়ু কমার এই হার আট বছর।

দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে স্থানীয় সরকারগুলো। ভারতে বায়ুদূষণ হ্রাসে সরকার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, স্থানীয় পরিবেশবাদীরা তাকে অপর্যাপ্ত বলে উল্লেখ করেছেন। তারপরও, আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে ভারতে প্রকৃত কিছু তথ্য পাওয়া যায়। 

সেই তুলনায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং নেপালের শহরগুলোতে বায়ুদূষণ পরিমাপের সাধারণ যন্ত্রপাতিও নেই। উৎস চিহ্নিত করে বিষাক্ত ধোঁয়া নির্গমন বন্ধ করার কার্যকর কৌশল তো আরো অনেক পরের বিষয়।
মহামারির তাণ্ডব চলাকালে একারণেই উদ্বেগ বাড়ছে বিশেষজ্ঞ মহলে। 

বায়ুদূষণের সঙ্গে কোভিড-১৯ এর যোগসুত্র কী? 

বিশেষজ্ঞদের পর্যালোচনাধীন সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় বলা হচ্ছে, অতিমারি হানা দেওয়ার আগে যেসব ব্যক্তি দীর্ঘ সময় ধরে বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ এ মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাদের মধ্যে মারাত্মক উপসর্গও দেখা দেয়। 

হাভার্ড  বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এ গবেষণায় নেতৃত্ব দেন। যুক্তরাষ্ট্রে পিএম ২.৫ মাত্রার অতিক্ষুদ্র দূষণ কণা যেসব অঞ্চলে মহামারির আগে থেকেই বেশি ছিল, সেসব অঞ্চলে কোভিড আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু ৮ শতাংশ বেশি বলে জানান তারা। 

নেদারল্যান্ডে করা আরেক গবেষণা বলছে, দূষিত বাতাসে অল্প-সময় নিঃশ্বাস নিলেও, তা কোভিডে মৃত্যুর হার ২১ শতাংশ বাড়াতে পারে।
 
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু), অবশ্য এসব গবেষণার পদ্ধতি এবং ফলাফল আরো বিশ্লেষণ করার আহবান জানিয়ে বলেছে, রোগটি সৃষ্টিতে বায়ুদূষণ কীভাবে সাহায্য করছে- তা বোঝার জন্য আরো অনেক তথ্য-উপাত্ত দরকার। 

হু' অবশ্য দূষণের লাগাম টেনে ধরতে সরকারগুলোকে ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানিয়ে সতর্ক করেছে। 

দক্ষিণ এশিয়ায় মহামারিতে বায়ুদূষণের প্রভাব নিয়ে প্রকৃত তথ্যের ঘাটতি থাকলেও, ভারতের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা হু'র হুঁশিয়ারি আমলে নিয়ে সরকারের প্রতি জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন।

দেশটির কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ টি.কে. জোশি। মহামারি নিয়ন্ত্রণে গঠিত প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ টাস্ক ফোর্সের এসদস্য বলেন, '' শীত প্রায় এসেই পড়েছে এবং বায়ুদূষণও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এরফলে কোভিড পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় ভয়। এবং তা যেন বাস্তবে রুপ নিচ্ছে। স্বাস্থ্য সেবাখাত ইতোমধ্যেই নজিরবিহীন চাপের মধ্যে আছে। এঅবস্থায় মহামারির তীব্রতা মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে, এমন আশঙ্কা করছি আমরা।'' 

ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফাইন্ডেশন আয়োজিত এক ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে তিনি মহামারি এবং বায়ুদূষণের মধ্যে সম্পর্কও তুলে ধরেন। 

''কোনো ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তিনি কতটা বিশুদ্ধ বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, তার উপর নির্ভর করে। এজন্যেই বাতাস দূষিত হলে, জীবাণুর বিরুদ্ধে আমাদের দেহে প্রাকৃতিক সুরক্ষা কবচটি দুর্বল হয়ে যায়,'' তিনি যোগ করেন।

চলমান মহামারিতে পুরো বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় প্রভাবিত দেশ এখন ভারত। চলতি অক্টোবরের শুরুর দিকেও দৈনিক ৭০ হাজারের বেশি নতুন সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে। 

ভারতে বিপুল সংখ্যক মানুষ অপুষ্টির শিকার। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমানোর ক্ষেত্রে- অপুষ্টির পরই বায়ুদূষণকে দেশটির জনস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলে চিহ্নিত করেছে হু'।

''নিম্ন-মানের বাতাস আর ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার দ্বিমুখী প্রভাবে ভারতে জনস্বাস্থ্য সঙ্কট চরম আকার ধারণ করতে পারে,''বলছিলেন সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ পূর্ণিমা প্রভাকরণ। তিনি ভারতের সেন্টার ফর ইনভায়রোমেন্টাল হেলথের সহকারি পরিচালক।  

''দূষিত বাতাস বয়স্ক ব্যক্তি, গর্ভবতী নারী এবং দূরারোগ্য রোগে আক্রান্তদের মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। কোভিডেও এসব জনসংখ্যার জন্য প্রাণহানির ঝুঁকি বেশি। করোনাভাইরাস ফুসফুসে হানা দেয় আর নিয়মিত বিষাক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার কারণে- তাদের অনেকের ফুসফুস দুর্বল হয়ে পড়েছে। একারণেই আমরা উদ্বিগ্ন,'' তিনি ব্যাখ্যা করেন।   

শুধু ভারতে নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার হাসপাতাল ব্যবস্থায় দূষণের কারণে নিউমোনিয়া, সেপসিস এবং হাপানি'র পূর্ব উপসর্গ নিয়ে যেসব কোভিড রোগী ভর্তি হয়েছেন, তাদের মৃত্যুর সংখ্যা ছিল অন্যদের চাইতে অনেক বেশি। 

পাশাপাশি দূষণ নজরদারিতে এ অঞ্চলের অধিকাংশ দেশের সরকারি তথ্যের অভাব আরেকটি বড় ঝুঁকি। সংক্রমণ শনাক্তে করা পরীক্ষার সংখ্যাও সন্তোষজনক নয়। কিছু বড় শহরের বাইরে ব্যাপক কোভিড পরীক্ষার উদ্যোগ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান বা নেপাল কোনো দেশেই তেমন গুরুত্ব পায়নি। অথচ, এসব তথ্যের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা শীতকালে মহামারি পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে, সে সম্পর্কে জানতে পারতেন। তাই বলা যায়, মহামারিকালে অন্ধকার শীতের আলিঙ্গনে পড়তে চলেছে দক্ষিণ এশিয়া।   

সূত্র: ডন প্রিজম 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.