বাক্সের ভেতরে করে কীভাবে জাপান থেকে পালালেন, তার বর্ণনা দিলেন নিশান প্রধান
ডিসেম্বর ২০১৯, রাত সাড়ে দশটা। একটি প্লেনের বোর্ডে একটা বাক্সের ভেতর দলা পাকিয়ে পড়ে রয়েছেন গাড়ি নির্মাণ শিল্পের সাবেক জায়ান্ট কার্লোস ঘোসেন। উদ্দেশ্য জাপান থেকে পালানো।
বিমান ছাড়বে রাত এগারোটায়। কার্লোস ঘোসেন যে আধঘণ্টা বাক্সের ভেতর পড়ে ছিলেন, সেটি ছিল তার জীবনের দীর্ঘতম অপেক্ষা।
জাপান থেকে পালিয়ে আসার সেই কাহিনি নিয়ে এই প্রথম মুখ খুললেন সাবেক এই নিশান প্রধান। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি তার পালিয়ে আসার বিস্তারিত বিবরণ দেন।
২০১৮ সালে ঘোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি তার বার্ষিক বেতন কমিয়ে দেখিয়েছেন এবং কোম্পানির তহবিল আত্মসাৎ করেছেন। যদিও ঘোসেন এই অভিযোগ অস্বীকার করেন।
সে সময় জাপানি গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ছিলেন কার্লোস ঘোসেন। ফ্রান্সের রেনোর চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। এছাড়াও এই দুই গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও মিৎসুবিশিকে নিয়ে গঠিত ত্রিপাক্ষিক জোটের প্রধান ছিলেন তিনি।
নিশানে তার খরচ কমানোর পদক্ষেপ প্রথমে বিতর্কিত হলেও পরবর্তীতে তিনি এর জন্য ব্যাপক প্রশংসিত হন।
কার্লোস ঘোসেনের উত্থান-পতনের চমকপ্রদ কাহিনি নিয়ে কার্লোস: দ্য লাস্ট ফ্লাইট নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছে বিবিসি। তথ্যচিত্রটি আজ (১৪ জুলাই) বিবিসিতে প্রচারিত হবার কথা রয়েছে।
আতঙ্কে জমে যাওয়া
তিন বছর আগে টোকিও বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ঘোসেন বলেন, তার মনে হচ্ছিল তাকে যেন কোনো বাস চাপা দিয়েছে। সে সময় আতঙ্কে তিনি জমে গিয়েছিলেন।
গ্রেপ্তারের পর ঘোসেনকে টোকিও ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে কয়েদিদের পোশাক পরিয়ে জেলখানায় রাখা হয়। সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, 'হঠাৎ করে আমাকে ঘড়ি, কম্পিউটার, টেলিফোন, খবর, কলম—এসব ছাড়া বাঁচতে শিখতে হলো।'
জামিন পাওয়ার পর এক বছরের বেশি সময় গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে ঘোসেনকে। তার বিচার কখন শুরু হবে, তাও অনিশ্চিত ছিল। আশঙ্কা ছিল, বিচার শুরু হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। আর বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে ঘোসেনকে ১৫ বছর জেল খাটতে হতো। জাপানে বিচারকার্যে ৯৯.৪ শতাংশ অভিযুক্তই দোষী প্রমাণিত হন।
গৃহবন্দিত্বের এক পর্যায়ে ঘোসেনকে জানানো হয়, তাকে তার স্ত্রী ক্যারলের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ রাখতে দেওয়া হবে না।
তারপরই ঘোসেন পালানোর সিদ্ধান্ত নেন।
সে সময় জাপানে প্রচুর মিউজিক কনসার্ট হচ্ছিল। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, গান-বাজনার যন্ত্রপাতি বহন করা হয়, এমন একটি বাক্সে করে পালাবেন।
কিন্তু গোটা জাপানে যিনি পরিচিত মুখ, তিনি কী করে রাজধানীর নিজ বাড়ি থেকে পালিয়ে বিমানবন্দর পর্যন্ত যাবেন?
বিখ্যাত গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হিসেবে ঘোসেন সবসময় দামি কাপড়চোপড় পরতেন। পালানোর জন্য তিনি একেবারেই সাদাসিধে পোশাক পরবেন বলে ঠিক করলেন।
পালানোর মুহূর্ত
পোশাক পাল্টে সাধারণ কাপড় চোপড় পরলেন ঘোসেন। প্রথমে তিনি বুলেট ট্রেনে চেপে ওসাকা গেলেন। সেখানে এক স্থানীয় বিমানবন্দরে একটি প্রাইভেট জেট অপেক্ষা করছিল তার জন্য। তবে তার আগে ঘোসেনকে বাক্সের ভেতরে ঢুকতে হলো। বাক্সটা ছিল বিমানবন্দরের কাছাকাছি এক হোটেলে।
শিল্পীর ছদ্মবেশে মাইকেল ও পিটার টেইলর ঘোসেনকে হোটেল থেকে বিমানবন্দরে নিয়ে যান। সব মিলিয়ে দেড় ঘণ্টা বাক্সের ভেতরে থাকতে হয়েছিল ঘোসেনকে।
সময়মতোই আকাশে উড়ল প্রাইভেট জেট। বাক্সের ভেতর থেকে বের হলেন ঘোসেন। তুরস্কে বিমান বদলে পরদিন সকালে তিনি লেবাননের রাজধানী বৈরুতে পৌঁছান।
লেবাননের সঙ্গে জাপানের আসামি প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। সে কারণে বৈরুতে থাকার অনুমতি পেলেন ঘোসেন। তবে আমেরিকান মাইকেল টেইলর ও তার ছেলে পিটার টেইলরকে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হাতে তুলে দিয়েছে। তারা এখন ঘোসেনকে পালাতে সাহায্য করার অপরাধে তিন বছরের কারাবাস ভোগ করছেন।
নিশানে ঘোসেনের সাবেক সহকর্মী গ্রেগ কেলিও আটক আছেন। সাবেক বসকে আয়ের তথ্য লুকাতে সাহায্য করার অভিযোগে টোকিওতে গৃহবন্দি আছেন তিনি। যদিও কেলি তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
যারা জাপানে রয়ে গেছেন তাদের কী হবে
ঘোসেন বলেছেন, 'আমাকে জানানো হয়েছে গ্রেগ কেলির বিচারকাজ সম্ভবত এ বছরের শেষ দিকে সম্পন্ন হবে। ঈশ্বরই জানেন ফালতু এই অভিযোগের বিচারে শেষপর্যন্ত কী রায় আসবে।'
বিবিসির বাণিজ্য সম্পাদক সাইমন জ্যাকের বিশ্লেষণ
পথিকৃৎ, দূরদর্শী, অহংকারী, বহিরাগত
ওপরের চারটি শব্দে বর্ণনা করা যায় এই আধা-লেবানিজ আধা-ব্রাজিলিয়ান মানুষটিকে।
তার জীবনযাপনের ধরন যতটা না কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রধানের মত ছিল, তারচেয়ে বেশি ছিল কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের মত। ভার্সাই প্রাসাদে নিজের ৬০তম জন্মদিনের পার্টিতে ঘোসেনকে ফরাসি বিপ্লব-পূর্ববর্তী বিলাসবহুল পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়।
রেনো ও নিশান, দুই কোম্পানির কিছু মানুষ তাকে নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল। নিশানের কর্মকর্তাদের আশঙ্কা ছিল জাপানি প্রতিষ্ঠানটিতে ফরাসিদের আধিপত্য বিস্তার করতে সাহায্য করবেন ঘোসেন। অন্যদিকে রেনোর কর্মকর্তারা প্যারিসের সোসাইটি ম্যাগাজিনে ঘোসেনের নিয়মিত উপস্থিতি পছন্দ করতেন না।
রাজনৈতিক মতপার্থক্যের ব্যাপারে যেকোনো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীকে সংবেদনশীল হতে হয়। কিন্তু টোকিওতে ঘোসেনের গ্রেপ্তারের ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, যে দুই প্রতিষ্ঠানে তিনি প্রায় বিশ বছর কাজ করছেন সেগুলোর সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল।
ঘোসেনের গল্পে সব আছে—অহমিকা, কর্পোরেট ও বৈশ্বিক রাজনীতি এবং হলিউডি চলচ্চিত্রের মতো রোমাঞ্চকর পলায়নপর্ব। তার বর্ণিল জীবনের শেষ কোথায় হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
- বিবিসি অবলম্বনে