বাইডেনের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হবেন পুতিন

আন্তর্জাতিক

নেথ্যান হজ, সিএনএন
22 January, 2021, 07:55 pm
Last modified: 22 January, 2021, 08:05 pm
পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার ক্ষমতাকে ছোট করে দেখার কোনো উপায় নেই। রুশ নীতির ঘোর সমালোচক এবং দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মাইকেল ম্যাকফাউল-ও তা স্বীকার করে নিয়েছেন

হোয়াইট হাউজ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদায় নেওয়ার ঘটনার রাশিয়া পর্যবেক্ষক মার্কিন বিশেষজ্ঞরা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন নিশ্চয়। সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট হয়ে যাওয়া ট্রাম্পই ছিলেন ২০১৬ সালের নির্বাচনে পুতিনের পছন্দের প্রার্থী। ট্রাম্পের প্রার্থিতা ঘোষণার কালেই পুতিন তাকে প্রকাশ্য সমর্থন দেন। তারপর, থেকে ওয়াশিংটনে সর্বোচ্চ মহলের দুর্নীতি আর কেলেঙ্কারির মধ্য দিয়েই এতদিন মস্কোর প্রভাব দেখেছে বিশ্ববাসী। 

আশার কথা হলো, ঝানু রাজনীতিবিদ জো বাইডেন এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু, তার মানে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক একঘেয়ে ও উত্তেজনাহীন হয়ে উঠবে এমনটা ভাবার উপায় নেই। প্রশাসনে রদবদল হলেও বিগত দশক দুই ধরেই ক্রেমলিনের কর্তাব্যক্তিটি (পুতিন)  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ভূ-কৌশলগত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া বন্ধ করেননি। বাইডেন আমলেও সেটা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পুতিনের পক্ষ থেকে আসা ঝুঁকিগুলো সব সময়েই বিরাজমান।  
  
প্রথমেই নিশ্চিত ব্যাপারগুলোর দিকে নজর দেওয়া দরকার: স্নায়ুযুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার সম্পর্ক এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে। মাস কয়েক আগেই যুক্তরাষ্ট্রে এক বিশাল সাইবার হামলা হয়, যার জন্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মস্কোর দিকেই অভিযোগের আঙ্গুল তুলছে। আবার, ক্রেমলিনের কাছে বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি ন্যাভালনিকে বিষপ্রয়োগ করার ঘটনার ব্যাখ্যা চাইছে পশ্চিমা সরকারসমূহ। এছাড়া, ইউক্রেনে যুদ্ধ এবং ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপের ঘটনায় রাশিয়ার উপর বেশকিছু নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছেন মার্কিন আইনপ্রণেতারা।  

ওভাল অফিসে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই রাশিয়ার সব ধরনের অপচেষ্টা নিয়ে একটি বিস্তারিত গোয়েন্দা রিপোর্ট তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন বাইডেন।
আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের হত্যায় রাশিয়ার অর্থ দেওয়া এবং গেল নভেম্বরে সমাপ্ত ২০২০ এর নির্বাচনেও রাশিয়া হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছে কিনা –সেসব তদন্তের আদেশ দিয়েছেন তিনি। বাইডেনের জাতীয় গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালক অ্যাভরিল হেইন্স এসব অনুসন্ধানে নেতৃত্ব দেবেন। বাইডেন নির্বাচিত সিআইএ পরিচালক উইলিয়াম বার্নস নিজেও একজন রাশিয়া বিশেষজ্ঞ। নতুন প্রেসিডেন্টের প্রস্তুতি নেহাত মন্দ নয়, তা দেখাই যাচ্ছে। 

কিন্তু, মনে রাখা উচিৎ এখানে ইরান বা উত্তর কোরিয়ার কথা হচ্ছে না, এটা রাশিয়া। যে দেশটি পরমাণু অস্ত্রের সক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ। চাইলেই অবরোধ বা অন্যান্য বিধি-নিষেধের বেড়াজালে তার শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ নয়। পররাষ্ট্র নীতি-বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বর্তমান বিশ্বের একাধিক সঙ্কট সমাধানে রাশিয়ার সদিচ্ছা প্রয়োজন। সেটা ইরানের পরমাণু উচ্চাভিলাষে লাগাম দেওয়ার ক্ষেত্রেই হোক অন্যকোনো ইস্যুতে; মস্কোর সহযোগিতা মার্কিন স্বার্থরক্ষায় নানাভাবে কাজে আসবে। সম্প্রতি, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থামিয়ে রাশিয়া সেই শক্তির জানানও দেয়।   
     
সোজা কথায়; পুতিনের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমেই বাইডেন প্রশাসনকে বৃহত্তর পররাষ্ট্র লক্ষ্য বাস্তবায়নে নামতে হবে। ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি মেনে চলতে ইরানকে বাধ্য করা তার মধ্যে অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রকে চুক্তিতে ফেরাতে পুতিনের ইতিবাচক সায় দরকার। ওবামা প্রশাসনের শেষ সময়ে করা এই চুক্তি থেকে ২০১৮ সালে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। তবে অন্যান্য বিশ্বশক্তির সঙ্গে রাশিয়াও এই চুক্তির একটি প্রভাবশালী পক্ষ এবং ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। 

পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার ক্ষমতাকে ছোট করে দেখার কোনো উপায় নেই। রুশ নীতির ঘোর সমালোচক এবং দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মাইকেল ম্যাকফাউল-ও তা স্বীকার করে নিয়েছেন। তার মতে, রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে এবং বিশেষ কিছু ক্ষেত্রেই তা করা প্রয়োজন। যেমন; বৈশ্বিক মহামারী পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ক্ষেত্র নিয়ে ওয়াশিংটন উদ্যোগী হতে পারে। 

কিন্তু, তার মানে এই নয় যে বাইডেন আমলে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ ঘটবে। ওয়াশিংটনে রাশিয়ার ব্যাপারে অন্তত এইকথার অর্থ বেশ নোংরা। অর্থাৎ, ট্রাম্পের মতো রাশিয়ার সমর্থনে বাইডেন জিতেছেন এমন মিথ্যে প্রচারণার জোয়ার বয়ে যেতে পারে। সবশেষ, ২০০৯ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন তার রুশ প্রতিপক্ষে সের্গেই ল্যাভরভের প্রতি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু, রাশিয়া সে সুযোগের অপব্যবহার করেছে। তাই বলা যায়, অতীত অভিজ্ঞতার আলোকেও ডেমোক্রেট সরকার রাশিয়ার সঙ্গে জোর আঁতাতে উদ্যোগী হওয়ার আস্থা পাবে না। 

যেমন; ২০১১ সালে রাশিয়ার নির্বাচনে হিলারির প্রতি মার্কিন সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনেন পুতিন। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় রাশিয়া এবং ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহীদের সরাসরি মদদ দেয়। ২০১৮ সালে হেলসিঙ্কিতে ট্রাম্প- পুতিন বৈঠকে সৃষ্টি হয়ে আরেক লজ্জাজনক পরিস্থিতি। ওই বৈঠকে পুতিনের কর্মকান্ডকেই সমর্থন জানান ট্রাম্প। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট স্পষ্ট করেই বলেন, "২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপের জন্যে কেন রাশিয়া দায়ি হবে আমি কিছুতেই তার কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না।" 

রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের বর্তমান নিয়ম যে কাজে আসবে না- ওয়াশিংটনের নীতি-নির্ধারক মহলে এমন ক্ষোভ ও হতাশা আছে। তাই গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী কয়েকজন পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞ এক খোলা চিঠিতে রাশিয়ার প্রতি মার্কিন নীতি 'পুনঃপর্যালোচনা'র আহ্বান জানান।  

চিঠিতে তারা লেখেন, "একে-অপরকে ধ্বংসের সক্ষমতা রাখে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। এমনকি এই সংঘাতে মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে মানব সভ্যতার বিনাশ ঘটতে পারে। এমন ক্ষমতাধর দুটি দেশের মধ্যে সচল কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকা একেবারেই অস্বাভাবিক।"

ট্রাম্পের সাবেক শীর্ষ রাশিয়া বিষয়ক পরামর্শক ফিওনা হিল নিজেও চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে আরও ছিলেন মস্কোতে নিয়োজিত সাবেক রাষ্ট্রদূত জন হান্টসম্যান।

তবে উন্মুক্ত চিঠিটি নিয়ে রাশিয়ার প্রতি যুদ্ধংদেহী কূটনৈতিক, সামরিক এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বেশ তীব্র বিরোধিতা প্রকাশ করেন। সিংভাগের অভিমত ছিল, পুতিনের দুর্নীতিপরায়ণ একনায়কতন্ত্রকে যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে। 

অবশ্য, চিঠিতে স্বাক্ষরকারীরা জানান, তারা রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক অবস্থানে আনার পক্ষপাতী নন, তবে তারা বাস্তবতা অনুসারে দেশটির প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেছেন। 

তাদের এই দাবিটি নেহাত অমূলক নয়, কিন্তু রাশিয়া বা পুতিন নিয়ে যেকোনো সমঝোতার লক্ষ্য নিতে হলে, সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সমর্থন নিয়ে জো বাইডেনকে এগোতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সাম্প্রতিক গতিপ্রবাহে যা তার জন্য খুব একটা সহজও হবে না। 

  • সূত্র: সিএনএন 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.