ফাইজার ও মডার্নার কোভিড-১৯ টিকার সমকক্ষ কিউবার আবদালা ভ্যাকসিন

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
29 June, 2021, 05:25 pm
Last modified: 29 June, 2021, 05:38 pm
প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশনের প্রতিনিধি হোসে মোয়া কিউবার দেওয়া ট্রায়ালের তথ্যে তার সম্পূর্ণ আস্থা রয়েছে বলে জানিয়েছেন

লাতিন আমেরিকায় উদ্ভাবিত প্রথম কোভিড-১৯ প্রতিষেধক কিউবার আবদালা ভ্যাকসিন। দীর্ঘ ৬০ বছর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক কোটি ১০ লাখ বাসিন্দার দ্বীপ রাষ্ট্রটির এগিয়ে চলার প্রতীক এ টিকা।

বিশ্বের অন্যতম সেরা কিছু চিকিৎসা বিজ্ঞানীও কিউবান। মহামারি মোকাবিলাতে স্বনির্ভরতা অর্জনে তারা এ ভ্যাকসিনের গবেষণা শুরু করেন। দেশটির জাতীয় বীর ও স্বাধীনতা সংগ্রামী কবি হোসে মার্টির বিখ্যাত পঙক্তি থেকেই করা হয় আবিষ্কৃত টিকার নামকরণ। ওই পঙক্তিতে 'আবদালা' নামের এক তরুণ কীভাবে প্রবল পরাক্রান্ত শত্রুর কবল থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য এগিয়ে এসেছিল তার দেশাত্মবোধক বর্ণনা ছিল।

প্রাণঘাতী কোভিডের বিরুদ্ধে টিকার এ নামকরণকে তাই সম্পূর্ণ যথাযথ মনে করেন বেশিরভাগ কিউবান।

আবদালা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সমর শক্তি ও অর্থনৈতিক শক্তিতে বলীয়ান যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বে আবিষ্কৃত সেরা টিকাগুলোর সমান বলেই জানিয়েছেন এর আবিষ্কারক বিজ্ঞানীরা। 

কিউবার তারকা বিজ্ঞানী:

বিশ্বব্যাপী গবেষক মহলে খ্যাতি অর্জন করা কিউবান বিজ্ঞানীদের একজন হলেন দেশটির সেন্টার ফর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজির (সিআইজিবি) বায়োমেডিকেল রিসার্চ বিভাগের পরিচালক জেরার্ডো এনরিক গুইলেন নিটো। তিনি সংস্থাটির আবদালা টিকা উদ্ভাবনের গবেষণায় নেতৃত্ব দেন। 

এর আগে রোববার (২০ জুন) আন্তর্জাতিক বাবা দিবসে কিউবার টেলিভিশন চ্যানেলে নিটোর কর্মজীবন নিয়ে এক সরকারি বিজ্ঞাপন সম্প্রচারিত হয়। সেখানে ৫৮ বছর বয়সী এ বিজ্ঞানীর ছেলে দেশের কল্যাণে তার বাবার নিরলস চেষ্টা ও অধ্যাবসায়ের গল্প বলেছেন।

সকল খাতের গবেষকদের সাহায্য নিয়ে আবদালা ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ড. গুইলেন নিটো। ছবি: ডয়চে ভেলে

বিজ্ঞাপনের এক পর্যায়ে নিটোর বক্তব্যও ছিল। সেখানে টিকা গবেষণা সম্পর্কে জাতীয়ভাবে শ্রদ্ধার পাত্র এ বিজ্ঞানী বলেছেন, "মহামারি আঘাত হানার পর থেকে ছুটির দিনসহ সপ্তাহের প্রতিটি দিন আমরা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করছি। একদণ্ড বিশ্রাম নেওয়ার সময় বা সুযোগ ছিল না। তবে সবশেষে আবিষ্কৃত টিকার সফলতা হার সকল প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যাওয়ায় সব ক্লান্তি মুছে গেছে। আমরা এখন দারুণ উচ্ছসিত।"

তিনি আরও বলেন, "আমরা জানতাম টিকাটি সফল হবে, কিন্তু তারপরও এমন বিস্ময়কর ফল স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি।"

নিজ চেষ্টায় অনন্য:

কিউবার রাষ্ট্রীয় জৈব-প্রযুক্তি কর্পোরেশন বায়োকিউবাফার্মার সূত্রে জানা গেছে, আবদালা ভ্যাকসিন মানব ট্রায়ালে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ৯২.২৮ শতাংশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ফলে বায়োএনটেক-ফাইজার ও মডার্নার আবিষ্কৃত প্রতিষেধক দুটির সমকক্ষ হলো আবদালা। পশ্চিমা বিশ্বে আবিষ্কৃত প্রথমোক্ত দুই সংস্থার টিকা এপর্যন্ত সবচেয়ে ফলদায়ক বলে প্রমাণিত হয়েছে। 

গেল সপ্তাহে মানব ট্রায়ালের অত্যন্ত সন্তোষজনক ফল ঘোষণার সময় সিআইজিবি'র সম্মেলন কক্ষে উপস্থিত কিউবানরা তুমুল করতালি ও উচ্ছ্বাস ধ্বনির মধ্য দিয়ে একে স্বাগত জানান। তারপর থেকে দেশ-বিদেশের অসংখ্য গণমাধ্যমের কাছ থেকে সাক্ষাৎকারের অনুরোধ এসেছে প্রধান গবেষক নিটোর কাছে। পুরো বিশ্ব এখন আবদালার সফলতার ফর্মুলা জানতে চাইছে।  

আগ্রহের কারণ; কিউবার টিকাটিতে ভেক্টর বা এমআরএনএ প্রযুক্তি কোনটিই ব্যবহার করা হয়নি। আবদালা একটি প্রোটিন ভিত্তিক টিকা। অর্থাৎ, মানব কোষে যুক্ত হতে সার্স কোভ-২ ভাইরাস যে কাঁটাসদৃশ বহিঃআবরণ ব্যবহার করে, টিকায় সেই অংশে থাকা প্রোটিন ব্যবহার করা হয়েছে।

ভাইরাসের রিসেপটর বলে পরিচিত ওই অংশের প্রোটিনের মাধ্যমে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করতে পেরেছেন কিউবান বিজ্ঞানীরা। এক্ষেত্রে রিসেপটরের বাইন্ডার হিসেবে তারা 'ইস্ট' ব্যবহার করেন।   

তবে চূড়ান্ত ফল ঘোষণার আগেই গত মে থেকে আবদালা ও স্থানীয়ভাবে আবিষ্কৃত আরেকটি টিকা সোবেরানা-২ দিয়ে দেশটির জাতীয় কোভিড টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। ইতঃপূর্বে, চীন ও রাশিয়া থেকে টিকা আমদানি না করার সিদ্ধান্ত নেয় কিউবা। জাতিসংঘ সমর্থিত কোভ্যাক্স কর্মসূচিতেও যোগ দেয়নি সমাজতন্ত্রী কিউবার সরকার।  

এব্যাপারে বিজ্ঞানী নিটোর ভাষ্য, "আমরা জানি দিনশেষে আমাদের স্বনির্ভর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। নিজস্ব সক্ষমতা ও যোগ্যতার ওপর নির্ভর করা ছাড়া আমাদের সামনে কোনো পথ ছিল না।"

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে কিউবার রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার বাস্তবতা তুলে ধরে একথা বলেন তিনি। একইসঙ্গে, তার ফলে কিউবার নিজ সফলতার উদাহরণও তুলে ধরেন।

"নিষেধাজ্ঞার কারণে আজ আমাদের চিকিৎসা সেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যের ও কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত। এতে করে নতুন কোনো রোগ প্রতিরোধী টিকার মানব ট্রায়াল পরিচালনা, টিকাকরণ কর্মসূচি এবং টিকা উৎপাদনসহ যেকোনো জনস্বাস্থ্য দুর্যোগ মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার সক্ষমতা বেড়েছে।"

ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ ঠেকাতে টিকাদান কর্মসূচি:

গুইলেন নিটো জানান, ২২ লাখ কিউবান টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন। দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ১৭ লাখ এবং তৃতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে ৯ লাখ নাগরিককে। আবদালা তিন ডোজের টিকা। প্রতি ডোজ দেওয়ার ব্যবধান দুই সপ্তাহ। কিউবা সরকার এক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার আওতায় আগামী আগস্ট নাগাদ মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশকে টিকাকরণের আওতায় আনার লক্ষ্য নিয়েছে।

ক্যারিবিয় দ্বীপটিতে নতুন সংক্রমণ সংখ্যা বেড়ে চলায় একে সময়ের বিপরীতে এক প্রতিযোগিতাই বলা চলে। ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ বেড়ে চলায় এখন দেশটিতে দৈনিক দুই হাজারের বেশি আক্রান্ত শনাক্ত হচ্ছে। আর কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে এপর্যন্ত মারা গেছেন ১,২০০ জন। তবে শক্তিশালী টিকাকরণ কর্মসূচির ওপর ভর করে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় মহামারি প্রতিরোধে কিউবা এগিয়ে যাবে বলে আশা করছেন এ বিজ্ঞানী।

মধ্য মে নাগাদ নিজস্ব টিকাদান কর্মসূচি শুরু করে কিউবা। ছবি: ডয়চে ভেলে

"কিউবার জনগণ জাতীয় স্বাস্থ্য খাতের ওপর বিস্ময়কর রকম আস্থা রাখেন। তাই আমাদের মানব ট্রায়ালের সময় স্বেচ্ছাসেবী খুঁজে পেতে কোনো সমস্যা হয়নি। তাছাড়া, কিউবার মানুষের মধ্যে টিকা নিয়ে সংকোচ নেই, বরং আগ্রহের পরিমাণই বেশি। টিকা নেওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে সবাই জানেন। তাই কেউই এখানে টিকা না নেওয়ার আগে সংশয়ে ভোগেন না।"

তবে ট্রায়ালে চরম মাত্রার সফলতা আসলেও হাভানার একটি স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞদের প্যানেল এবার আবদালার ট্রায়ালের ফলাফল পুনঃবিশ্লেষণ করছেন। দুই সপ্তাহের মধ্যে জাতীয়ভাবে জরুরি অনুমোদনের ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। এরপর, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) কাছে স্বীকৃতির আবেদন জানাতে পারে কিউবা। ইতোমধ্যেই, লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ; বলিভিয়া, জ্যামাইকা, ভেনিজুয়েলা, আর্জেন্টিনা ও মেক্সিকো টিকাটি ক্রয়ের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আস্থা:   

ট্রায়ালের ফলাফলে যেমন ইতিবাচক কার্যকারিতা আর পাওয়া গেছে, আবদালা কি সত্যিই তেমন যুগান্তকারী টিকা? এ প্রশ্নের উত্তর দেন মহামারি বিশেষজ্ঞ হোসে মোয়া। ডক্টর্স উইদাউট বর্ডাসের হয়ে তিনি ইতঃপূর্বে গুয়েতেমালা, মোজাম্বিক ও নাইজারের মতো দেশে চিকিৎসা সেবাদানে যুক্ত ছিলেন। ৩০ বছর আগে তিনি মহামারি প্রতিরোধের এ পেশায় যুক্ত হন।

গত দুই বছর ধরে কিউবায় প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশনের (পাহো) প্রতিনিধি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি আঞ্চলিক সংস্থা, যার সদস্য ২৭টি দেশ। ড. মায়ো কিউবার দেওয়া তথ্যে পূর্ণ আস্থা পোষণ করেন।

"ভ্যাকসিন গবেষণায় তিন দশকের অভিজ্ঞতা আছে সিআইজিবির। একারণে, তাদের প্রকাশিত ফলাফলে আস্থা রেখেছি। করোনার টিকা আবিষ্কার এক ধরনের গুরুতর গবেষণা। এখানে বিজ্ঞানের সাধনায় নিবেদিত অনেক গবেষক ও সংস্থার অংশগ্রহণও ছিল।"   

কিউবা নিজ চাহিদার ৮০ শতাংশ টিকা অনেক আগে থেকেই স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করছে, আর একেই সবচেয়ে বড় প্রমাণ বলেছেন ড. মোয়া। তিনি আবদালার উচ্চ কার্যকারিতা হার নিয়েও তাই বিস্মিত হননি। বরং একে দেশটির স্বাস্থ্য খাতের ক্রম উন্নতির যৌক্তিক ফলাফল বলে উল্লেখ করেন। "কিউবান বিজ্ঞানীদের প্রকাশিত ফলাফল অ্যান্টিবডি উৎপাদনের ইতিবাচক প্রভাবের দিকটিও উঠে এসেছে," তিনি যোগ করেন। 

  • সূত্র: ডয়চে ভেলে 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.