প্রযুক্তি জগতকে চিরতরে বদলে দেওয়া ৬ জানুয়ারি

আন্তর্জাতিক

ভাস্কর চক্রবর্তী, ফরেন পলিসি
16 January, 2021, 10:30 am
Last modified: 16 January, 2021, 10:39 am
আমেরিকা কী ৬ জানুয়ারি ভুলতে পারবে? সেই অন্ধকার সময়, কট্টর ট্রাম্প সমর্থকেরা মার্কিন গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করার চেষ্টায় অনুপ্রবেশ করে মার্কিন পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিলে। জীবন বিপন্ন হয় নির্বাচিত আইনপ্রণেতাদের। এরপর তাই প্রযুক্তি দুনিয়ায় নীতি পরিবর্তন একেবারেই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল।

গত সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্টের 'রিয়েলডোনাল্ডট্রাম্প' অ্যাকাউন্টটি আজীবনের জন্য বন্ধ করে দেয় টুইটার ইঙ্ক। তার মাধ্যমেই প্রযুক্তি জগতে শুরু হয় বৈপ্লবিক এক পরিবর্তনের সূচনা। ফেসবুক নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ লেখেন, "আমাদের সেবা প্রেসিডেন্টকে ব্যবহার করতে দেওয়াটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।" একথা তিনি এমন সময় জানান, যখন তার কোম্পানি ট্রাম্প আর তার কোটি কোটি ভক্ত-অনুরাগীর মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নিচ্ছিল।  

এরপর, ডিজিটাল পেমেন্ট কোম্পানি স্ট্রাইপ ট্রাম্পের প্রচারণা শিবিরের সঙ্গে সম্পর্কিত সকল লেনদেন সেবা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। শপিফাই বন্ধ করে ট্রাম্প-সংক্রান্ত সব অনলাইনে বিপণীকে দেওয়া পরিষেবা। একে একে যোগ দেয়; পিন্টারেস্ট, স্ন্যাপচ্যাট, গোফাউন্ডমি এবং আরও অনেক উদ্যোগ। অতিবাহিত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ট্রাম্প বর্জনে যোগ দেওয়াদের তালিকা আরও দীর্ঘ হচ্ছে। এযেন নতুন করে জেগে ওঠা আর প্রতিবাদী মিছিলের সারি।

মূলধারার প্রযুক্তিখাতের এহেন বর্জনে ট্রাম্প অনুসারীদের অভিমান হয়, তারা আশ্রয় নেয় পার্লার- এর মতো ছোটখাট বা তুলনামূলক কম পরিচিত প্ল্যাটফর্মগুলোর। কিন্তু, আঘাত অপেক্ষা করছিল সেখানেও। কারণ, অ্যামাজন, গুগল এবং অ্যাপলের মতো শীর্ষ ক্লাউড সার্ভার হোস্ট সংস্থা পার্লার'কে সাহায্য বন্ধের ঘোষণা দেয়। এই জায়ান্টদের অসহযোগিতা প্রযুক্তি দুনিয়ায় বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ডে শামিল। ট্রাম্পের উগ্র-সমর্থক দল তাতে একূল-ওকূল সব হারিয়ে দিশেহারা, পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ভয়ে উদ্বিগ্ন।

কিন্তু, এই পরিণতি তারা নিজেরাই ডেকে আনে। কারণ; ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত দিন না হলে, ডিজিটাল দুনিয়ার জেগে উঠেতেও হয়তো আরও সময় লাগতো।

আমেরিকা কী ৬ জানুয়ারি ভুলতে পারবে? সেই অন্ধকার সময়, কট্টর ট্রাম্প সমর্থকেরা মার্কিন গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করার চেষ্টায় অনুপ্রবেশ করে মার্কিন পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিলে। জীবন বিপন্ন হয় নির্বাচিত আইনপ্রণেতাদের। এরপর তাই প্রযুক্তি দুনিয়ায় নীতি পরিবর্তন একেবারেই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। ট্রাম্প ও তার সমর্থকেরা তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায়, ৬ জানুয়ারি ছিল তার সর্বোচ্চ সীমা। তাই যে প্রযুক্তি জায়ান্টেরা তথ্য আর যোগাযোগের অবাধ প্রবাহের পক্ষে ওকালতি করতো, তাদেরকেও সে বিশ্বাস থেকে সরে আসতে হয়েছে। তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সংগঠিত সেদিনের দাঙ্গার পর এটি আর অবজ্ঞা করার পথও হয়তো তাদের সামনে ছিল না।  
 
তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়। ৬ জানুয়ারি এমন আরেক ধরনের ঘটনা ঘটে, যার কারণে হঠাৎ করেই এই বিবেকের জেগে ওঠাটা যেন নিশ্চিত হয়ে পড়ে। এদিনই জর্জিয়ার পুনঃনির্বাচনে দুটি সিনেট আসনে জয় পায় ডেমোক্রেট দল। তার মানে, বাইডেন শপথ নেওয়া মাত্র তারা সরকারের তিনটি শাখাই নিয়ন্ত্রণ করবে। বড় প্রযুক্তি উদ্যোগগুলোর একক বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ৪৪৯ পৃষ্ঠার এক বিশাল প্রতিবেদন হাউজ সাব কমিটি মারফত পেয়েছে ডেমোক্রেটরা। এর আলোকে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণের মুখোমুখি করা যাবে। অনেকদিন থেকেই দলটি এই লক্ষ্য নিয়ে চললেও, এবারই প্রথম তা করার সম্পূর্ণ সক্ষমতা পেলো। প্রতিনিধি পরিষদ, সিনেট বা প্রেসিডেন্টের দপ্তর কোথাও তারা নতুন আইন করতে গিয়ে বাধা পাবে না। তাই, বলা যায় প্রযুক্তিখাতের বিবেক তো আর এমনি এমনি উদয় হয়নি। আগামীর শঙ্কা আর স্বার্থ সেখানে ছিল প্রধান অনুঘটক।    
 
গত সপ্তাহের সহিংসতার পর বিগ টেক খ্যাত বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তনকে ভালো বলেই মনে হতে পারে। তবে এনিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতোও যথেষ্ট কারণ আছে।

সবচেয়ে বড় শঙ্কার কথা চলতি মাসের শুরুতেই এক লেখায় তুলে ধরেছিলাম। সেখানে লিখেছি: নতুন সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাইডেন প্রযুক্তি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে চান না। তবে তিনি চাইলেই এখাতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাকে বলির পাঁঠায় পরিণত করতে পারেন না। বরং আরও উদার দৃষ্টিকোণ থেকে এই খাতকে তার প্রধান প্রধান লক্ষ্যপূরণ; মহামারী নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক উত্তরণ, বর্ণবাদী বৈষম্য দূরীকরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর মতো ইস্যুতে ব্যবহার করতে পারেন।  

তবে বাইডেন এমন আহ্বানে কীভাবে সাড়া দেবেন, সেটা আগামী দিন বলে দেবে।

দ্বিতীয় কারণ হলো, ডেমোক্রেটদের মধ্যে থেকে বিগ টেকের ক্ষমতা হ্রাসের জোর দাবি উঠেছে। তার বিরুদ্ধে এর আগে বিরূপ প্রতিক্রিয়াই জানিয়েছিল সংশ্লিষ্ট খাত। বিশেষ করে, ফেসবুকের সঙ্গে ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার যোগসাজশে গ্রাহকদের তথ্য চুরির তীব্র নিন্দা করেছে ডেমোক্রেটরা। মহামারীর মধ্যে ট্রাম্প শিবিরের অবাধ ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আর আজগুবি প্রচারণা চলতে দেওয়ার কারণেও প্রযুক্তি খাতের প্রতি ক্ষুদ্ধ। এমন প্রচারণা প্রভাবশালী ডেমোক্রেটদের মধ্যে তীব্র আক্রোশের জন্মও দিয়েছে।

টুইটার বন্ধ করে দেওয়ার আগ মুহূর্তে সেখানে ট্রাম্পের অনুসারী সংখ্যা ছিল ৮৮ মিলিয়ন। বন্ধের আগে এই অ্যাকাউন্ট থেকে তিনি করেছেন ৫৯,৫৮৮টি সম্পূর্ণ মিথ্যে, বানোয়াট আর উদ্ভট দাবিতে ভরা টুইট। প্রতিটি টুইটের উপাদান ছিল গণতন্ত্র ও মুক্তিবুদ্ধির প্রতি বিপজ্জনক। এনিয়ে আগেও টুইটারের নিয়ন্ত্রণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন ডেমোক্রেট আইনপ্রণেতারা। কিন্তু, ক্যাপিটল হিলে হামলার আগে সেগুলোতে কান দেয়নি কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষ।

প্রযুক্তি খাত আজকের দুনিয়ায় বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি এবং জীবনযাপনের অংশ হয়ে উঠেছে। তারা পুঁজিবাজারেও নিবন্ধিত। অর্থাৎ, তাদের জবাবদিহিতা আরও স্বচ্ছ হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু, সেটা হয়নি। নিজেদের পণ্য বা সেবার ঝুঁকি মূল্যায়ন তারা করেনি। তাদেরকে সঠিক রাস্তায় আনতে নতুন সরকারকেও ফলপ্রসূ নীতি কাঠামো তৈরি নিয়ে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। নীতিমালা সফল হলে, প্রযুক্তিখাত আইনি দায়বদ্ধতা এড়াতে পারবে না। আগামীদিনের সঙ্কট এড়ানো যাবে। কিন্তু, ব্যর্থ হলে ফেসবুক বা টুইটারের নির্বাহী ঘটনা ঘটার পর যেভাবে দায়সারা পদক্ষেপ নিয়েছেন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি বাড়বে বৈ কমবে না।

 

মূল থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: নূর মাজিদ

সূত্র: ফরেন পলিসি

লেখক: টুফটস ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুল অব ল' অ্যান্ড ডিপ্লোম্যাসির বৈশ্বিক বাণিজ্য বিভাগের ডিন। তিনি ডিজিটাল প্ল্যানেট রিসার্চ' প্রকল্পের উদ্যোক্তা এবং গবেষক দল প্রধান।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.