নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে মিয়ানমারের জান্তা, জোরালো হচ্ছে পাল্টা আঘাতের পক্ষে জনমত
উত্তর থাইল্যান্ডের চিং মাই প্রদেশের বেষ্টনী ঘেরা একটি ঘাঁটি থেকে বার্তা সংস্থা সিএনএন'কে সাক্ষাৎকার দেন মিয়ানমারের একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতা। সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের ঘটনায় গভীরভাবে বিভাজিত দেশটির সামনে আরও অন্ধকার ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
জেনারেল ইয়দ সেরক মিয়ানমারের সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠী শানদের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি শান স্টেট আর্মিকেও নেতৃত্ব দেন। মিয়ানমারের পুর্বাঞ্চলে তার বাহিনী নিজস্ব কিছু এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। দীর্ঘদিন ধরে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর অভিজ্ঞতা থেকে ইয়দ সেরক বলেন, "আসলেই পৃথিবী অনেক বদলে গেছে, সেনাবাহিনী প্রধান শহরগুলো নিয়ন্ত্রণ করলেও তাদের ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর নগরবাসী। তারা গণতন্ত্র ফিরে পেতে কোনো ছাড় দিতে নারাজ। অভ্যুত্থানের হোতা জেনারেল মিন অং হ্লিয়াং- ও ছাড় দিচ্ছেন না। এই অবস্থায় আমার মনে হয় গৃহযুদ্ধ হতেই পারে।"
একথার মাধ্যমে তিনি সংখ্যাগুরু বর্মীদের মধ্যেও সেনা শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেছেন।
শান আর্মির মতো মিয়ানমারের দুই ডজনের বেশি নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আছে, যারা দেশটির তাতমাদাউ' নামে কুখ্যাত সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে গত সাত দশক ধরে লড়ছে।
গত ১ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চি'র সরকার পতন ঘটনোর পর এসব বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো দেশটির গণতন্ত্রকামী বিক্ষোভকারীদের প্রতি তাদের সমর্থন ঘোষণা করে। একইসঙ্গে, তারা দেশজুড়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের উপর জান্তা নিয়ন্ত্রিত সৈন্যদের প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানায়।
নিরাপত্তা বাহিনী যখন তাদের রক্তক্ষয়ী দমনাভিযান বাড়িয়ে চলেছে, ঠিক তখনই দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো সেনাবাহিনীর সাথে নতুন সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে এমন ইঙ্গিতও মিলছে। এমনকি বিক্ষোভকারীদের অনেকেই সশস্ত্র প্রতিরোধের পথে পা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এব্যাপারে একজন জ্যেষ্ঠ বিদ্রোহী নেতাসহ কিছু আন্দোলনকারীর সঙ্গে কথা বলে সিএনএন। কিন্তু, নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করেনি মার্কিন গণমাধ্যমটি। এসব ব্যক্তি জানান, সংখ্যায় কম হলেও ধীরে ধীরে অনেক গণতন্ত্রকামী অধিকার কর্মী গভীর বনে গিয়ে বিদ্রোহী গেরিলাদের থেকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
নগরবাসীদের মধ্যে থেকেও আন্দোলনকারীদের সুরক্ষা দিতে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে আরও ভূমিকা রাখার আহবান জোরালো হচ্ছে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিক্ষোভকারীদের দ্বারা গঠিত এমন একটি গ্রুপ সম্প্রতি দেশটির ১৬টি নৃতাত্ত্বিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর কাছে 'জরুরী ভিত্তিতে' বেসামরিক নাগরিকদের জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসার আহবান জানায়।
এই অবস্থায় গত সপ্তাহের মঙ্গলবার মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় তিনটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর জোট- থ্রি ব্রাদারহুড এলায়েন্স এক বিবৃতিতে জানায়, "সেনাবাহিনী তাদের হত্যাযজ্ঞ বন্ধ না করলে দেশের সকল নৃগোষ্ঠীকে রক্ষায় আমরাও বসন্ত বিপ্লবে যোগ দেব।"
শান আর্মির প্রধান ইয়াদ সেরক বলেন, সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে মানুষ মারছে, তার মানে জান্তা ইতোমধ্যেই সন্ত্রাসীতে রূপ নিয়েছে। এরপর আর নিশ্চুপ বসে থাকা যায় না, আমরা জনগণকে রক্ষায় সম্ভাব্য সকল উপায় কাজে লাগাব।"
এদিকে রক্তপাতের জন্য বিক্ষোভকারীদেরই পাল্টা দুষছে সামরিক জান্তা। তাদের দাবি, নিরাপত্তা বাহিনী নাকি ন্যূনতম শক্তিপ্রয়োগ করেছে। সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল জো মিন তুন এক সাক্ষাৎকারের সময় বলেছেন, "দাঙ্গাকারীরা বালির বস্তা ফেলে সড়ক অবরোধ করে, তার আড়াল থেকে ঘরে তৈরি আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি ছোড়ে ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে- একারণেই নিরাপত্তা বাহিনীকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।"
জান্তা "এক বছর পর স্বাধীন ও স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজন করবে" বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বিমান হামলা ও শরণার্থীর ঢল:
পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেছে তাতমাদাউ। দীর্ঘ এই সময় ধরে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে উচ্চ- প্রশিক্ষিত এক শক্তিতে রূপ নিয়েছে, কিন্তু একইসঙ্গে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে মিয়ানমারকে পরিণত করেছে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশে।
সংখ্যালঘুদের সঙ্গে তাতমাদাউ- এর অব্যাহত লড়াইয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে সেনাদের হাতে গণহত্যা, ধর্ষন, নির্যাতন এবং অন্যান্য যুদ্ধাপরাধ সংগঠিত হওয়ার অভিযোগ করে আসছে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো। সাম্প্রতিকতম অভ্যুত্থানের হোতা মিন অং হ্লিয়াং নিজেই ২০১৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। গণহত্যা ও গণধর্ষনের বিভীষিকার মাধ্যমে একটি জাতিগোষ্ঠীকে সমূলে মুছে ফেলার পোড়ামাটি নীতির নীলনকশা তিনিই করেছেন। ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে একটি মামলাও হয়। ওই সময় যৌথভাবে ক্ষমতায় থাকা সু চি'র এনএলডি সরকার এবং সেনাবাহিনী উভয়েই গণহত্যা ও নির্যাতনের সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলে, শুধুমাত্র সন্ত্রাসীদের দমন করতেই অভিযান পরিচালনা করা হয়।
রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নৃশংসতা পরিচালনাকারী অভিজাত এসব কাউন্টার-ইনসার্জেন্সি ইউনিটগুলোর সেনা সদস্যদের এখন অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর পাশপাশি মিয়ানমারের প্রধান প্রধান শহরে বিক্ষোভ দমনে নামানো হয়েছে।
পাশাপাশি কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও অভিযান জোরদার করেছে জান্তা কর্তৃপক্ষ। গত ২৭ মার্চ থেকে দক্ষিণ-পুর্বাঞ্চলের কারেন রাজ্যের অনেক গ্রাম ও স্কুলে জঙ্গিবিমান থেকে হামলা চালানো হচ্ছে। মিয়ানমারের সবচেয়ে পুরোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠী কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) এর এলাকায় গত ২০ বছরের মধ্যে এই প্রথম আকাশপথে নির্বিচার হামলা চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে তৃণমূল পর্যায়ে সক্রিয় বেশকিছু মানবিক সহায়তাকারী গ্রুপ।
মানবিক গ্রুপগুলো জানায়, তাতমাদাউ এর বোমা হামলায় শিশুসহ অন্তত ছয়জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে, আর ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে ১২ হাজার মানুষ। পালিয়ে যাওয়া গ্রামবাসীদের অনেকেই সালউইন নদী পাড়ি দিয়ে প্রতিবেশী থাইল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছে।
কেএনইউ- এর একটি ব্রিগেড মুতাও জেলায় সামরিক বাহিনীর একটি ঘাটি দখল করার পর বিমান হামলা শুরু হয়। প্রতিশোধ নিতে সেনাবাহিনীও বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকার ভিতরে চারদিক থেকে প্রবেশ করেছে।
দেশটির উত্তরাঞ্চলেও কাচিন ইন্ডিপেন্ডেস আর্মি ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে জোরদার লড়াই শুরু হয়েছে, এতে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার কথা স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর সূত্রে জানা গেছে।
- সূত্র: সিএনএন