থাই রাজতন্ত্র’কে অপমানের দায়ে আন্দোলনকারীর ৪৩ বছরের সাজা
রাজতন্ত্রকে অপমান করার দায়ে থাইল্যান্ডের আদালত এক নারীকে ৪৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে।
মঙ্গলবার দেশটির আদালতে দেওয়া এই সাজা থাইল্যান্ডের সবচেয়ে কঠিন শাস্তি বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
গত বছর কয়েক মাস ধরে তরুণদের নেতৃত্বে বিক্ষোভের পর প্রকাশ্যে থাইল্যান্ডের শক্তিশালী রাজতন্ত্র এবং বৃহত্তর গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার সংস্কারের আহ্বান জানানো হয়।
এই রায় এই আন্দোলনকে শিথিল করে দিতে পারে। ডজন খানেক প্রতিবাদকারী নেতা এবং একটিভিস্টকে একই অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
থাইল্যান্ডের রাজা, রাণী, উত্তরাধিকারী বা রিজেন্টের সমালোচনা করলে বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর আইন রয়েছে সমালোচকের বিরুদ্ধে। লেজ ম্যাজেস্টে নামে পরিচিত এই আইন, যা লঙ্ঘনের কারণে প্রতিবার ১৫ বছর করে কারাদণ্ড হতে পারে।
থাই মানবাধিকার আইনজীবীদের মতে, ৬৫ বছর বয়স্ক আনচান প্রিলারট ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ইউটিউব এবং ফেসবুকে অডিও ক্লিপ শেয়ার করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তাকে ২৯টি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়, যার প্রত্যেকটি দোষের জন্য তিন বছর করে শাস্তিভোগ করতে হবে তাকে।
ব্যাংককের ফৌজদারি আদালত ৮৭ বছরের প্রাথমিক কারাদণ্ড প্রদান করে কিন্তু আনচানের দোষ স্বীকারের কারণে তা অর্ধেক করে দেওয়া হয়।
তার আইনজীবী পাওয়াইনি চুমশ্রী বলেন, ১১২ ধারা লঙ্ঘনের কারণে থাই আদালতের দেওয়া সর্বোচ্চ শাস্তি এটাই।
পাওয়াইন বলেছেন যে তারা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করবেন এবং আপীল আদালত থেকে জামিন পাওয়ার জন্য তারা কাজ করছেন। তিনি বলেন, "আরো দুটি আদালত আছে যেখানে আমরা তার আইনি মামলায় বিচার চাইতে পারি।"
'লেজ ম্যাজেস্টে'র পুনরুজ্জীবন
গত বছরের শেষ থেকে কর্তৃপক্ষ ডজন খানেক বিক্ষোভকারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী প্রয়ুত চান-ও-চা গত জুন মাসে বলেছেন যে রাজা মহা ভাজিরালংকর্নের অনুরোধে আইনটি আর প্রয়োগ করা হচ্ছে না।
তবে সে কথা বলা হয়েছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলন আধুনিক যুগে দেখা থাই প্রতিষ্ঠানের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠার আগে। পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে বিক্ষোভকারীরা প্রয়ুতের পদত্যাগের দাবিতে নিয়মিত বিক্ষোভ করে। প্রয়ুত ২০১৪ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করে নেয়- একই সাথে সংসদ ভেঙ্গে ফেলে এবং সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে তারা দাবী করে যে তারা সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে।
এরপর অনেক বিক্ষোভকারী প্রকাশ্যে সাহসের সাথে রাজতন্ত্রের সংস্কারের আহ্বান জানায়।
তাদের দাবী থাই জনগণের চেতনাকে উজ্জীবিত করে এবং হাজার হাজার মানুষকে রাস্তায় বের করে আনে, কখনও কখনও পুলিশ এবং রাজতন্ত্রপন্থী দলগুলোর সাথে সহিংস সংঘর্ষেও পৌঁছায়।
'পবিত্র' রাজতন্ত্র এবং জনগণের কাছে জবাবদিহিতাহীন একজন রাজার ধারণা তরুণ প্রজন্ম প্রত্যাখ্যান করে। তাদের দাবীর মধ্যে ছিল রাজাকে সংবিধানের অধীনে জবাবদিহি করতে হবে, তার ক্ষমতা রহিত করতে হবে এবং তার আর্থিক বিষয়ে স্বচ্ছ থাকতে হবে।
থাই মানবাধিকার আইনজীবীদের মতে, ২৪ নভেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, যার মধ্যে একজন নাবালক এবং বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও রয়েছে।
চুলালংকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ সিকিউরিটি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের রাজনৈতিক বিজ্ঞানী এবং ইনস্টিটিউট অফ সিকিউরিটি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পরিচালক থিটিনান পংসুদিক বলেছেন, "আনচানের এই শাস্তির " মানে লেজ ম্যাজেস্টে আইন আবার পুরোদমে ফিরে এসেছে।"
ছয় বছরের মামলা
আনচানের মামলাটি গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক অভিযোগের সাথে সরাসরি যুক্ত নয়। কিন্তু প্রায় তিন বছর ধরে চলা লিজ ম্যাজেস্তে মামলা শেষ হওয়ার সাথে সাথে বিশ্লেষকরা বলছেন- এই শাস্তির ফলে পুরোনো মামলা গুলো এখন আবার সক্রিয় হবে ।
সামরিক বাহিনী একটি অভ্যুত্থানে থাইল্যান্ডের বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করার পর রাজস্ব বিভাগে কর্মরত সাবেক সরকারী কর্মচারী আনচান ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রেফতার করা হন।
নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলো জানায়, ক্ষমতা দখলের পর প্রয়ুত সামরিক আইন আরোপ করেন এবং শত শত একটিভিস্টকে গ্রেফতার করা হয়। রাষ্ট্রদ্রোহ এবং লেজ ম্যাজেস্টির মত কঠোর আইনের অধীনে অভিযুক্ত করা হয় গ্রেফতারকৃতদের।
তার আইনজীবীরা জানান, আনচানের মামলাটি প্রাথমিকভাবে একটি সামরিক আদালতে আনা হয় এবং বিচারের অপেক্ষায় তাকে প্রায় চার বছর আটকে রাখা হয়। ২০১৮ সালে তিনি জামিনে মুক্তি পান এবং তার মামলা একটি বেসামরিক ফৌজদারি আদালতে স্থানান্তর করা হয়।
তার অপরাধ ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি রেডিও অনুষ্ঠান থেকে অডিও ক্লিপ শেয়ার করা, যেখানে প্রয়াত রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদেজের সমালোচনা করা হয়েছিল। "বানপডজ" নামে পরিচিত এক ব্যক্তি ক্লিপটি তৈরি করেছিলেন, যিনি ইতিমধ্যে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং তাকে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এশিয়া-প্যাসিফিক এর আঞ্চলিক পরিচালক যামিনী মিশ্র বলেন, "এই মর্মান্তিক ঘটনাটি থাইল্যান্ডের 'মত প্রকাশের স্বাধীনতার হারিয়ে যাওয়ার উপর আরেকটি গুরুতর আঘাত'। "তার শাস্তির ধরনও শীতল। কর্তৃপক্ষ যেভাবে ফৌজদারি অভিযোগ বাড়িয়ে শাস্তি সর্বোচ্চ করার চেষ্টা করেছে তা থাইল্যান্ডের ৫ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর কাছে বাধা বিপত্তির একটি পরিষ্কার বার্তা পাঠিয়েছে।