তালেবান শাসনে বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গীত বন্ধ, শূন্যস্থান পূরণ করছে শাসকগোষ্ঠীর প্রিয় সঙ্গীতধারা
তালেবান ক্ষমতায় আসার আগে বাদ্যযন্ত্র নির্ভর সঙ্গীতের রমরমা ছিল আফগানিস্তানের শহরগুলোয়। গত ১৫ আগস্ট তালেবান ক্ষমতা দখলের আগেও বলিউডের গানগুলো সজোরে বাজানো হতো কাবুলের রেস্তোরাঁগুলোয়।
আইসক্রিম বিক্রেতারাও উচ্চলয়ের যান্ত্রিক সঙ্গীত বাজিয়ে তাদের আগমন বার্তা দিত। সবই আজ আজ অতীত, সুদূরের স্মৃতির মতো। কাবুলসহ আফগানিস্তানের সব বড় শহরে এখন তালেবানের সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের শিকড় দৃঢ় হচ্ছে, যে বিশ্বাস বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গীতকে ইসলাম-বিরুদ্ধ বলে মনে করে।
উত্তরাঞ্চলীয় শহর মাজার-ই-শরীফের একজন ব্যবসায়ী ফাহিম, রাস্তার মোড়ে মোবাইল ফোনে গান তুলে দেওয়ার ব্যবসা করেন। তার মতে, এই শহরে আপনি আর কোন (যন্ত্র) সঙ্গীত শুনবেন না, মাঝমধ্যে আমি খুব 'লো ভলিউমে' বাজাই।
খারেজমীয় সাম্রাজ্যের সময়ে বর্তমান আফগানিস্তানের অন্তর্গত বলখ শহরেই জন্ম নেন ইসলামী সভ্যতার বিখ্যাত কবি- জালাল আদ-দ্বীন মোহাম্মদ রুমি। যার কবিতার কালাম তাজিক, তুর্ক, ইরানি, পাশতুন সহ মধ্য এশিয়ার সকল জাতির সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছিল। গজল ও কাওয়ালির মতো সঙ্গীতধারায় রুমির মতো সুফি কবিদের সেসব দর্শন।
গায়কী নির্ভর কাওয়ালির সাথে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ও উদ্ভাবন এসময় নতুন যুগের সূচনা করে। মধ্য এশীয় কবিরা ভারতবর্ষসহ প্রাচ্যের দূরদূরান্তের সঙ্গীতেও প্রভাব ফেলেন। তারানা তেমনই মিথস্ক্রিয়ার ফসল।
কিন্তু, অতীতের বাদ্যযন্ত্রের ঐতিহ্য আফগানিস্তানের নতুন শাসকগোষ্ঠী তালেবানের মনপুত নয়। শরীয়া আইনের অনুসারী হওয়ায় তারা বাদ্যহীন ইসলামী সঙ্গীত চর্চাই পছন্দ করে। মূল গায়ক কণ্ঠের সাথে সহ-গায়কদের সঙ্গত দেওয়া যৌথ সঙ্গীত- তারানা- এখন আফগানিস্তানের বেতার সম্প্রচারে প্রাধান্য পাচ্ছে, তালেবানের পছন্দনীয় এ সঙ্গীতই এখন বাজছে বাজারের দোকানগুলোয়।
অথচ, পশ্চিমা সমর্থিত দুই দশকের আফগান সরকারের আমলে জিহাদী সঙ্গীত হিসেবে তারানার চর্চা ছিল নিন্দনীয়। ঐতিহ্যবাহী সে তারানাই এখন আফগান রেডিও ও জনসমাগমস্থলে লাউড-স্পিকারে বাজছে।
মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর প্রিয় ছিল 'নাশিদ' নামের যন্ত্রহীন সঙ্গীত, তারানাও একইরকম, এখানে একটি মূল কোরাসের সাথে থাকে বেশকিছু ছন্দবদ্ধ পঙক্তি, কিন্তু বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই গাওয়া হয়। কিছু কিছু তারানায় গায়কেরা কণ্ঠ দিয়েই বাদ্যযন্ত্রের মতো তাল দেন।
আফগান সংস্কৃতিতে তারানার অস্তিত্ব আছে সুদীর্ঘকাল ধরে। তবে ১৯৯০ এর দশকে তালেবান গঠিত হওয়ার পর থেকেই সঙ্গীতের এই ধারাকে প্রচারণার কাজে ব্যবহার করে আসছে। গানের কথায় জিহাদের গৌরব বর্ণনা করা হয়।
২০০১ সালে মার্কিন আগ্রাসনের আগপর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সময় একমাত্র তারানাকেই বৈধ সঙ্গীতে হিসেবে বাজাতে দিত তালেবান। তাই তালেবানদের হঠানোর পর যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত নতুন আফগান সরকার তারানা'কে সন্দেহের নজরে দেখতে থাকে। কিন্তু, সরকারের বিষদৃষ্টির পরও চাহিদা থাকায়, এ ধরনের সঙ্গীত চর্চা ও রেকর্ডিংয়ের গোপন নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। তালেবান ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে যা আরও শক্তিশালী হয়েছে।
চার বছর আগে নিজের গাওয়া তারানা রেকর্ড ও প্রকাশ শুরু করেন গজনী প্রদেশের গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দা মনসুর গজনভী। এই অঞ্চল ছিল তালেবানের শক্ত ঘাঁটি।
মনসুরের বাড়িটি মাটির তৈরি। এ বাড়িতেই চলতো গান রেকর্ড। আগে থেকে তালেবান কবিদের লেখা পছন্দনীয় কিছু লাইন বেছে নিতেন তিনি। এরপর মাটির বাড়ির দাওয়ায় বসে চালু করতেন তার ডেল ল্যাপটপটি। এরপর মাইক্রোফোনের লাইন লাগিয়ে কোন বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই গান গাইতে শুরু করতেন।
অনলাইনে পাওয়া সফটওয়্যার দিয়ে নিজের গাওয়া তারানা সম্পাদনার কাজ সেরেছেন। ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করার কৌশলও নিজে নিজেই শিখে ফেলেন ৩১ বছরের এ যুবক। তবে গানগুলো গেয়ে শোনানোর মতো শ্রোতা পাওয়া যেত না।
কারণ ব্যাখ্যা করে মনসুর জানান, "তখন সবাই গোপনে শুনতেন, তাও খুব সাবধানে। কারো ফোনে একটি তারানাও পাওয়া গেলেই তাকে গ্রেপ্তার ও মারপিট করতো নিরাপত্তা বাহিনী। কিন্তু, নতুন শাসকদের অধীনে আমি এখন প্রকাশ্যে গাওয়া নিয়ে ভয় পাইনা।"
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস- মনসুরের ভয়ের দিন শেষ হলেও, অন্যান্য আফগান শিল্পীদের আতঙ্ক কেবল শুরু হয়েছে। যদিও তালেবান এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে যন্ত্রনির্ভর সঙ্গীত নিষিদ্ধ করেনি, কাবুলের অনেক গাড়িচালককেও হিন্দি গান বাজিয়ে ঘুরতে দেখা যায়।
তবে তালেবান ক্ষমতা দখলের কয়েক সপ্তাহ পর থেকেই ভেঙ্গে দেওয়া বাদ্যযন্ত্রের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। রেডিও ও টেলিভিশনে বন্ধ হয়েছে প্রচলিত সঙ্গীত পারফরম্যান্স সম্প্রচার।
গত রোববার কাতারের মধ্যস্ততায় আফগানিস্তান ছেড়েছেন সম্পূর্ণ নারীদের দ্বারা গঠিত জোহরা অল-ফিমেল অর্কেস্ট্রা এবং আফগান ন্যাশনাল মিউজিক ইনস্টিটিউটের (আনিম) কর্মীরা।
একই ফ্লাইটে দেশত্যাগকারী আনিমের একজন সঙ্গীত শিক্ষক ও গিটারিস্ট পারভিজ নিগাহ বলেন, "সঙ্গীত শিল্পীরা সমাজের এক অপরিহার্য অংশ। কিন্তু, অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানেই আমরা অবহেলিত হয়ে পড়েছি। আমি যেন অনুভূতিশূন্য, সব শেষ হয়ে গেছে।"
তিনি বলেন, "তারানায় সুর শুধু কণ্ঠনালীর উপরিভাগ থেকে তৈরি করা হয়। বাদ্যযন্ত্রের সাথে পরিবেশিত গানের সঙ্গে এর তেমন মৌলিক পার্থক্য নেই। কিন্তু, এটি সঙ্গীতের অভাবকে পূরণ করতে পারে না।"
মনসুর গজনভী সে অভাব পূরণের চেষ্টাও করছেন। ইতোমধ্যেই তিনি ৫০০ তারানা গেয়ে রেকর্ড করেছেন। তার ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ৫,৪০০। তালেবান আসার আগে মনসুর ও তার মতো অন্যান্য তারানা গায়করা টেলিগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতেন।
সামাজিক মাধ্যমে তারানা প্রসারকারী নেটওয়ার্ক- আল আসার মিডিয়া'র প্রতিষ্ঠাতা নাকিব আল হাশিমি জানান, আমরা দৈনিক ৩০টির বেশি তারানা শেয়ার করি।
"অনেক সময় হাজার হাজার সদস্য থাকার পরও আমাদের চ্যানেলগুলো হঠাৎ করে ব্লক করে দেওয়া হয়। তখন আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হয়।"
তারানার সুর অধিকাংশ সময়েই আফগানদের পরিচিত অন্যান্য গান থেকে অণুকরণ করা হয়। যেমন তালেবানের একটি গান- 'জা গাজি' পশতু ভাষার জনপ্রিয় 'জাম' নামের একটি গানের মতোই শুনতে লাগে, বদলেছে শুধু গানের কলি ও ঘটনার নাটকীয় উপস্থাপন।
যেমন- মূল পশতু গানের কথা- 'প্রিয়তমের সাথে দেখা হওয়ার আগেই আমার যৌবন ফুরিয়ে এসেছিল।' আর তারানা সংস্করণের লাইন- 'আমি এক যোদ্ধা, আমি এক তালিব, আমি আমেরিকাকে শেষ করে দেব।'
তবে সব তারানাই তালেবানের আদর্শ প্রচার করে এমনও নয়। যেমন পুর্বাঞ্চলীয় নানগাহার প্রদেশে তারানা শিল্পীদের একটি নতুন কাউন্সিল গড়ে উঠেছে। তারা সঙ্গীতের এ ধারাকে আরও জনপ্রিয় করতে চান।
তারানা শিল্পী ও কাউন্সিলের মুখপাত্র আব্দুল জলিল সাকিব বলেন, "তালেবানের পছন্দসই লাইনে তারানা গাওয়া আমরা সমর্থন করি না। তবে বিগত সরকারের সময়ে আমরা স্বাধীনভাবে সঙ্গীত চর্চাও করতে পারিনি।"
এব্যাপারে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লালপাচ আজমুন বলেন, "তালেবান যন্ত্র সঙ্গীতের সঙ্গে তারানাকে মিশ্রণ না করলেও, তারা সঙ্গীতের ধারায় সুর ও পঙক্তির নতুন উপাদান যোগ করছে।"
সূত্র: দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল