তালেবান ও আইএস-কের আক্রমণে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বাড়ছে সহিংসতা

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
14 October, 2021, 03:30 pm
Last modified: 14 October, 2021, 03:38 pm
চলতি বছরে পাকিস্তানের উপজাতীয় অঞ্চলভুক্ত ৭টি জেলায় সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এইসব হামলা এবং সহিংসতার জন্য দায়ী করা হয়েছে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-কে যারা মূলত আফগান তালেবানের আদর্শে পরিচালিত হয়।

সতের বছর বয়সী ইসরার রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে। সেই দিনটিও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তবে রাত ২টায় হঠাৎই তার ফোন বেজে উঠল।

সারাদিন প্রহরী হিসেবে কাজ করা কিশোর ইসরার ক্লান্ত কণ্ঠে ফোন ধরলো। লাইনের অন্য প্রান্তে ছিল তার ভাই। সে ইসরারকে জানায়, কয়েকজন লোক তাদের বাড়িতে ঢুকে, তাদের বাবাকে বাইরে টেনে নিয়ে যায় এবং তাকে গুলি করে হত্যা করে।ইসরারের ভাষায়, "তাই তিনি (ইসরারের ভাই) আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতে বললেন।"

সতের বছর বয়সী সেই কিশোরের নিরাপত্তার জন্য তাকে 'ইসরার' ছদ্মনাম দিয়েছেন বিবিসি'র সাংবাদিক।

ইসরারের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল পাকিস্তানের উপজাতীয় অঞ্চলের ওরাকজাই জেলায়। আফগানিস্তানের সীমান্তঘেঁষা এই অঞ্চলে প্রধানত পশতুন জনগোষ্ঠী বসবাস করে।

ইসরারের বাবা নিহত হওয়ার তিন দিন পর, ইসলামিক স্টেটের আঞ্চলিক শাখা ইসলামিক স্টেট খোরাসান (আইএস-কে) নামে পরিচিত এক চরমপন্থী গোষ্ঠী সেই হত্যার দায় স্বীকার করে।

আইএস-কে দাবি করে ইসরারের বাবা ছিলেন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর 'তথ্যদাতা'। তবে তাদের সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরার।

ইসরার জানায়, "আমার বাবার ওরাকজাইতে একটি দোকান ছিল। তিনি তার সম্প্রদায়কে সাহায্য করতেন, বিশেষ করে যারা যুদ্ধের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে এলাকায় ফিরে এসেছিল"। 

"তার কোনো শত্রু ছিল না। তিনি এলাকার প্রবীণদের মধ্যে একজন ছিলেন।"

আফগানিস্তানে, তালেবান এবং আইএস-কে আধিপত্য বিস্তারের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নেমেছে। সেই যুদ্ধে পাকিস্তানের চিত্র আরও ঘোলাটে।

বেড়েই চলেছে সহিংসতা

সেদিন শুধু ইসরারের বাবার উপরেই হামলা হয়নি, একই দিনে ওরাকজাইতে আরেকজনকেও গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। তাকেও পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর 'তথ্যদাতা' হিসেবে অভিযুক্ত করেছিল জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস-কে; সেইসঙ্গে ওই হামলার দায়ও স্বীকার করে তারা।

ইসলামাবাদ ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজ (পিআইপিএস)-এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে পাকিস্তানের উপজাতীয় অঞ্চলভুক্ত ৭টি জেলায় (বাজাউর, মোহমন্দ, খাইবার, কুররম, উত্তর ওয়াজিরিস্তান, দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান এবং ওরাকজাই) সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ওরাকজাই অন্যতম।

এইসব হামলা এবং সহিংসতার জন্য অবশ্য দায়ী করা হয়েছে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-কে। এই দলটি মূলত আফগান তালেবানের আদর্শে পরিচালিত হয়। টিটিপি তার আফগান সমকক্ষদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চায় এবং পাকিস্তানে ইসলামী শাসনের কঠোর রূপ বা শরিয়া আইনের কঠোর ব্যাখ্যা প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

পিআইপিএসের তথ্য অনুযায়ী, টিটিপি গত বছর ৯৫টি হামলা করেছে; সেসব হামলায় নিহত হয়েছে কমপক্ষে ১৪০ জন। এবং চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে করেছে আরও ৪৪টি হামলা।

আফগানিস্তানে আফগান তালেবানদের দ্রুত অগ্রগতিতে উৎসাহিত হয়ে, টিটিপি তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে। দলটি চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরও ৪৪টি হামলা চালায়; সেসব হামলায় কমপক্ষে আরও ৭৩ জন নিহত হয়। এই নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই পাকিস্তানের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য ছিলেন।

বাজাউর জেলাস্থ বেসামরিক ও সামরিক সদর দপ্তর

হুমকি ও আতঙ্ক

ব্যাপক সহিংসতার বাইরে, এ অঞ্চলটি কয়েক মাস ধরেই হুমকি এবং উত্তেজনায় উত্তাল হয়ে আছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আফগান এবং পাকিস্তানি নম্বর থেকে ফোন করে তাদের কাছে টাকা চাওয়া হয়েছে।

বাজাউরের বাসিন্দা আহমেদ (ছদ্মনাম) একজন সমাজকর্মী এবং ব্যবসায়ী। তিনি বিবিসিকে জানান, জুলাই এবং আগস্টে বিভিন্ন নম্বর থেকে কল দিয়ে তার কাছে চাঁদাবাজিস্বরূপ টাকা দাবি করা হয়েছিল।

ফোনের অপর প্রান্ত থেকে তারা নিজেদেরকে তালেবান পরিচয় দিয়ে টাকা দাবি করেছিল বলে জানান তিনি।

আহমেদ বলেন, "তারা চাঁদাবাজির টাকা চাইছিল। আমি তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করা সত্ত্বেও, তারা আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে ভয়েস নোট এবং মেসেজ পাঠাতে থাকে; হুমকি দেয়, যদি আমি টাকা না দেই তাহলে তারা আমার এবং আমার পরিবারের ক্ষতি করবে।"

আহমেদ এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত প্রমাণাদি নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে তেমন সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, "আমি বারবার তাদেরকে এ বিষয়ে অবহিত করেছি। কিন্তু প্রশাসন আমাকে বলেছে, আমি একা নই, বরং বাজাউরে আমার মতো আরও অনেকেই একই হুমকি পেয়েছে"। 

আহমেদ আরও বলেন, "স্থানীয় প্রশাসন আমাকে বলেছিল, প্রত্যেককে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। আমাকে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং আমার বাড়িতে নিরাপত্তার জন্য ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে।"

টিটিপি কারা

২০০৭ সালের শেষের দিকে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে বায়তুল্লাহ মেহসুদ টিটিপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।  ইসলামাবাদের লাল মসজিদে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর এক অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় এই জঙ্গি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আক্রমণের পর পাকিস্তানি তালেবান নেতারা আফগান তালেবানদের সহায়তায় যুদ্ধে নামে। তারা পাকিস্তানের উপজাতীয় এলাকায় আফগান তালেবানদের খাদ্য, আশ্রয় এবং আর্থিক সহায়তাও প্রদান করেছিল।

তবে, টিটিপি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাণ্ডব চালানো শুরু করে; বেসামরিক নাগরিক এবং নিরাপত্তা বাহিনী উভয়কে লক্ষ্য করেই তারা হত্যা, চাঁদাবাজি এবং নানাধরনের সহিংসতা চালাতে থাকে। অন্যদিকে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রতিশোধ হিসেবে টিটিপি'র নেতৃত্বকে কোণঠাসা করে আফগানিস্তানের দিকে ঠেলে দেয়। ২০১৫ সাল থেকে দলটি আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়েই, সেখান থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে 'স্বল্প মাত্রায়' যুদ্ধ পরিচালনা করে আসছে।

গত জুলাইয়ে আফগান তালেবানরা যখন কাবুলের পথে যাত্রা শুরু করে, তখন টিটিপি'র তৎপরতা আরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

সে সময় পাকিস্তানি তালেবান প্রধান নূর ওয়ালী মেহসুদ সিএনএনকে বলেছিলেন, আফগান তালেবানের জয় হবে 'সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিজয়', তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানের জন্যও সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন।

তিনি আরও বলেন, "আমাদের লড়াই কেবল পাকিস্তানে, যেখানে আমরা পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করছি। আমরা আশা করছি পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী উপজাতীয় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদেরকে স্বাধীন করে তুলব।"

জঙ্গিদের নির্মূল করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একাধিক অভিযানে লক্ষ লক্ষ মানুষকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে

তালেবানের মাঝে ভালো এবং মন্দ

পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে আফগান তালেবানের ঐতিহাসিকভাবে এক দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। সম্প্রতি তালেবানরা আফগানিস্তান দখলের পর পাকিস্তান তাদের নতুন শাসনকে মেনে নিতে পুরো বিশ্বকে উৎসাহিত করছে।

অন্যদিকে আবার এটিও সত্য যে, গত এক দশক ধরে পাকিস্তান রাষ্ট্র পাকিস্তানি তালেবান দলের বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সারা দেশে সেই যুদ্ধে মারা গেছে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।

পাকিস্তানে, আফগান তালেবানকে ভালো এবং পাকিস্তানি তালেবানকে খারাপ বলার এই প্রবণতাকে প্রায়ই পাকিস্তানের "ভালো এবং খারাপ তালেবান" কৌশল হিসাবে উল্লেখ করে থাকে পশ্চিমা বিশ্ব।

দেশটির উপজাতীয় এলাকা থেকে জঙ্গিদের নির্মূল করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একাধিক অভিযানে লক্ষ লক্ষ মানুষকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। সেইসঙ্গে পাকিস্তান সরকার বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানি তালেবানের মধ্যে বিভিন্ন ছোট ছোট গোষ্ঠীর সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি আলোচনারও চেষ্টা করেছে।

যাই হোক, উপজাতীয় অঞ্চলে আইএস-কে এর উপস্থিতি পাকিস্তানি সরকারের জন্য আরেকটি নতুন ঝুঁকি।

আফগানিস্তানে, আইএস-কের সঙ্গে তালেবানদের বড় ধরনের মতপার্থক্য রয়েছে। গত বছরের দোহা আলোচনার মাধ্যমে তালেবানরা 'জিহাদ' ছেড়েছে বলে অভিযোগ করে আইএস-কে।

আইএস-কে তালেবানকে 'ধর্মত্যাগী' বলে আখ্যা দিয়েছে এবং তাদেরকে টার্গেট করে নিজেদের কর্মকণ্ড পরিচালনাকে তারা বৈধ মনে করে।

অর্থাৎ, আফগান তালেবান সরকারের জন্য আইএস-কে এখন একটি বড় নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পালাতে বাধ্য হচ্ছে হাজারও মানুষ

এত এত জঙ্গিগোষ্ঠীর মাঝে এসব অঞ্চলে সাধারণ বেসামরিক মানুষের বেঁচে থাকা হয়ে উঠেছে কঠিন।

কয়েক বছর আগে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হয়ে টিটিপির বিরুদ্ধে লড়াই করা একজন প্রাক্তন মিলিশিয়া নেতা বলেছিলেন, তার পুরো পরিবারকে নিজের এলাকা ছেড়ে আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী জেলা মোহমন্দে স্থানান্তরিত হতে হয়েছিল।

তিনি বলেন, "আমার বাবা শহীদ হয়েছেন, আমার চাচাতো ভাই শহীদ হয়েছেন, আমাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে"।

"আমাদের অনেকেই হাত হারিয়েছে, কেউ পা হারিয়েছে, আবার কেউ উভয়ই হারিয়ে সম্পূর্ণভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। আমরা কেউই আমাদের গ্রাম ছেড়ে যেতে চাইনি; কিন্তু থাকার জায়গা না থাকলে আপনি আর কীইবা করতে পারেন!"  

বাজাউরের ব্যবসায়ী আহমেদও ঠিক এরকমই দুর্দশার কথা বলেছেন। 

অন্যদিকে, ওরাকজাইয়ের কিশোর ইসরার ছিল আরও স্পষ্টবাদী।

ইসরার জানায়, "চৌদ্দ বা পনের বছর আগে যখন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তখন বাড়ি ছেড়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় ছিল না। আমার বাবা-মা দুই বছর আগে ফিরে এসেছিলেন; কিন্তু এখন আমার মা বিধবা হয়েছেন"।

"সরকার আমাদের আশ্বস্ত করেছে, এলাকায় নাকি শান্তি ফিরেছে; তাই সেখানে আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত। কিন্তু শান্তি কোথায়?

  • সূত্র- বিবিসি

 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.