চীন-মার্কিন সামরিক সংঘর্ষের হুমকিতে এশীয় দেশগুলো কার পক্ষ নেবে!

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
24 July, 2020, 08:00 pm
Last modified: 24 July, 2020, 08:31 pm
মার্কিন রাষ্ট্রপতি হিসেব ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিষিক্ত হওয়ার আগে থেকেই চীনের উত্থানকে নিজেদের আধিপত্যের প্রতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৬ সালে প্রকাশিত র‍্যান্ড কর্পের এক প্রতিবেদন সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়। প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক আগামী দিনে সামরিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে, এমন সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। 

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পারস্পরিক সম্পর্ক বিগত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উত্তেজনাকর তিক্ত রূপ ধারণ করেছে। কূটনৈতিক হুমকি-ধামকির পাল্টাপাল্টি প্রক্রিয়া আগামীতে সামরিক সংঘর্ষে পরিণত হবে কিনা, তা নিয়েও তৈরি হয়েছে আশঙ্কা। আর বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তির মধ্যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলে, তখন এশিয়ার দেশগুলোকে বাধ্য হয়েই যেকোনো একপক্ষকে সমর্থন দিতে হবে।   

আনুষ্ঠানিকভাবে উভয় দেশের সরকার যদিও পরিষ্কার জানিয়েছে যে, তারা কেউই সরাসরি সামরিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে চায়না, তারপরও সামরিক বিশেষজ্ঞরা বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারছেন না। বরং তাদের ধারণা, সংঘর্ষে একবার শুরু হলে- এশিয়ার দেশগুলোকে পক্ষালম্বন করতেই হবে। এক্ষেত্রে, অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের পাল্লা বেশি ভারি হবে।

তারা জানান, চীনের সঙ্গে দেশটির প্রশান্ত মহাসাগরীয়  প্রতিবেশীদের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এসব দেশের বিদ্যমান সামরিক সহায়তা এবং মিত্রতার চুক্তি এর পেছনে প্রধান কারণ হয়ে উঠতে পারে। 

বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক বাহিনী রয়েছে চীনের। ছবি: এপি

বিগত দুই বছরে পরমাণু শক্তিধর দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে একাধিক বিষয় নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হয়। যার মধ্যে অন্যতম ছিল; দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, মানবাধিকার, প্রযুক্তি চুরি, তাইওয়ান এবং দক্ষিণ চীন সাগরের নিয়ন্ত্রণ। 

চলতি বছর কোভিড-১৯ মহামারি এ বিরোধ যেন আরও উস্কে দিয়েছে। তাছাড়া, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হাসিলেও চীনকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে। যার ধারাবাহিকতায় আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে; ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান উভয় দল কে বেশি চীন বিরোধি! তা প্রমাণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।  

ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষক মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক- র‍্যান্ড কর্পের জ্যেষ্ঠ আন্তর্জাতিক সামরিক গবেষক টিমোথি হিথ মনে করেন, চীন-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা এশীয় অঞ্চলে মেরুকরণ বৃদ্ধি করছে। বেইজিং এবং ওয়াশিংটন উভয়েই এশিয়ায় এমন বিশ্বস্ত মিত্র সন্ধান করছে, যারা সংঘর্ষের সময় তাদের পাশে থাকবে। বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার এ সমীকরণ- তাদের এশীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের মতামতের উপর নির্ভর করে তুলেছে। 

তিনি জানান, ইতোমধ্যেই ফিলিপাইন ও তাইওয়ানের মতো কিছু দেশ; চীন-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ আদায়ের কৌশল অবলম্বন করছে। 

''উভয় পক্ষের সম্পর্ক যদি নীচের দিকেই নামতে থাকে এবং যুদ্ধ এড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ে; তাহলে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান এবং ফিলিপাইনের মতো কিছু দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চীনের বিরুদ্ধে সামরিক সংঘাতে যোগ দিতে পারে। এমন জোটবন্ধন সঙ্গতকারণেই লড়াইয়ের পরিণতি নির্ধারণ করে দেবে'' যোগ করেন টিমোথি।

''এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক তুলনামূলক স্থিতিশীল আছে। বিষয়টি বিপদজনক ও সরাসরি লড়াই শুরু হওয়ার মতো অবনতি হয়নি।''

তিনি আরও জানান ''আগামীদিনের যেকোনো সংঘর্ষে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের জোট ভারি হতে পারে, তাই আগেভাগে যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দিতে পারে, এমন দেশের সংখ্যা কমানোর চিন্তা করছে বেইজিং।'' 

টিমোথি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধে চীন সম্পূর্ণ একা হবে, এমনটা ভাবা উচিৎ নয়। তার কিছু শক্তিশালী সহযোগী অবশ্যই থাকবে। এক্ষেত্রে , রাশিয়া চীনকে সমরাস্ত্র, অবকাঠামো ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পারে। কিন্তু দেশটি চীনের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইয়ে অংশ নেবে না। বরং, গ্যালারিতে বসে বসে উভয়পক্ষের রক্তাক্ত মল্লযুদ্ধ উপভোগ করবে। 

আনুষ্ঠানিকভাবে চীন জোট নিরপেক্ষ রাজনীতির সমর্থক হলেও, রাশিয়ার সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। উভয় দেশে মার্ক্সবাদি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে গেছে। অন্যদিকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা হচ্ছে; জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন এবং থাইল্যান্ড। 

গত বছরের ডিসেম্বরে পিউ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা জরিপে দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন এবং জাপানের নাগরিকরা চীনের চাইতে যুক্তরাষ্ট্রকেই তারা অধিক বিশ্বস্ত মিত্র মনে করেন, বলে জানিয়েছিলেন।  
 
এসব দেশের নাগরিকদের তুলনায় কেবলমাত্র ইসরায়েলি নাগরিকরাই যুক্তরাষ্ট্রকে ঘনিষ্ঠতম মিত্র ভাবার দিক থেকে এগিয়ে আছেন। 

একই জরিপে যুক্তরাষ্ট্রের উপর আস্থা রাখার দিক থেকে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার অবস্থান ছিল; ১২ ও ১৩তম। 

এসব দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বন্ধন যুক্তরাষ্ট্রের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। বেইজিংকে মোকাবিলাতেও এ সম্পর্কের সুযোগ নিতে চাইবে ওয়াশিংটন। 

সাম্প্রতিক সময়ে চীনা হুমকি মোকাবিলায় দক্ষিণ চীন সাগরের ফিলিপাইন দাবিকৃত সমুদ্রসীমায় মার্কিন নৌমহড়া যার উজ্জ্বল উদাহরণ।  

চলতি মাসের গোঁড়ার দিকের এ মহড়ায়, মার্কিন নৌবাহিনী আকাশ প্রতিরক্ষা যুদ্ধ কৌশল চর্চা করে। মহড়ায় অংশ নেয় দুটি সুবিশাল বিমানবাহী রণতরী; ইউএসএস নিমিৎজ এবং ইউএসএস রোনাল্ড রিগ্যান। 

যুদ্ধপ্রস্তুতির এ অনুশীলন চলাকালে নজরদারি এবং ইলেকট্রনিক সার্ভিলেন্স বিমান উড্ডয়ন করে রণতরীগুলো থেকে। বিগত কয়েক সপ্তাহে চীনের উপকূলের কাছাকাছি বেশ কয়েকবার উড়েছে বিমানগুলো। 

সঙ্গতকারণেই, বেইজিং এতে ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, যুক্তরাষ্ট্র অত্র অঞ্চলে যুদ্ধজাহাজ মোতেয়েনের মাধ্যমে ''সমুদ্রসীমায় চলাচলে দখলদারিত্ব'' কায়েমের প্রয়াস চালিয়েছে। এসময়, দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিকায়নের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।  
 
চীনা সমাজতন্ত্রী দলের মুখপত্র পিপলস ডেইলি'র ট্যাবলয়েড ম্যাগাজিন গ্লোবাল টাইমসের প্রধান সম্পাদক- হু জিঝিন যুক্তরাষ্ট্রের মহড়ার তীব্র নিন্দা করেন এক টুইট বার্তায়। সেখানে তিনি, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং দেশটির আরও তিন যুদ্ধবাজ রাজনীতিবিদকে স্নায়ুযুদ্ধের মানসিকতা রাখা ''চার দুষ্কৃতিকারীর দল'' বলে অভিহিত করেন। 

এর আগের এক টুইটে হু জানিয়েছিলেন, ''চীন স্নায়ুযুদ্ধ শুরু করতে না চাইলেও, ট্রাম্প প্রশাসন ক্রমাগত তা শুরু করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।'' 

তবে মার্কিন রাষ্ট্রপতি হিসেব ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিষিক্ত হওয়ার আগে থেকেই চীনের উত্থানকে নিজেদের আধিপত্যের প্রতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৬ সালে প্রকাশিত র‍্যান্ড কর্পের এক প্রতিবেদন সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়। প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক আগামী দিনে সামরিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে, এমন সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। 

প্রতিবেদনে প্রকাশ, ''সংঘাতের কারণ, মূল্যায়ন এবং পছন্দের পক্ষে যোগ দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে অবস্থান যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্র-চীন সামরিক সংঘাতে বিশ্বের দেশসমূহ, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং গবেষণা সংস্থাগুলো বিভাজিত হতে বাধ্য হবে। অবশ্য তারা অর্থনৈতিক ক্ষতির সমূহ সম্ভবনার প্রেক্ষিতে উভয় দেশের প্রতি সংঘাত নিরসের আহ্বান জানাবে। তবে এ আহ্বান বিরোধিতা অবসানে খুব একটা কার্যকর না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।''

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.