কেন চুপিসারে দুবাই পাড়ি জমাচ্ছেন বিশ্বের শীর্ষ ধনীরা?

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
07 October, 2021, 03:55 pm
Last modified: 07 October, 2021, 08:24 pm
চলতি বছর দুবাইয়ে অন্তত ২০ জন বিলিয়নিয়ার বাড়ি ও জমি কিনেছেন। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছর রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠান লাক্সহ্যাবিটেট সদেবিজ ৩০০ গুণ বেশি ব্যবসা করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট কোস্ট থেকে চলতি বছর দুবাই পাড়ি জমান প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের ধনাঢ্য এক শিল্পোদ্যোক্তা। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দুবাই আসেন তিনি। সঙ্গে নিয়ে আসেন পারিবারিক অফিস এবং ৩০টি বিলাসবহুল গাড়ি। দুবাইয়ে নতুন জীবন শুরু করতে একজন বিলিয়নিয়ারের যা কিছু দরকার, সবই আনেন তিনি।

বয়স পঞ্চাশের কোঠায় থাকা এই শিল্পোদ্যোক্তা নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফোর্বস ম্যাগাজিনকে বলেন, "আমার সন্তানদের জন্য এই জায়গাটি বেশ নিরাপদ। লস অ্যাঞ্জেলস আর আগের মতো নেই। কোভিডের পর থেকে সেখানে অপরাধ বেড়েছে।"

দুবাই যেভাবে মহামারি নিয়ন্ত্রণ করেছে, তাতে অনেকেই মুগ্ধ হয়েছেন। দুবাইয়ের ৩০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে দ্রুতগতিতে ভ্যাকসিন বিতরণ করা হয়। এখানে পিসিআর পরীক্ষা সস্তা ও সহজলভ্য। দেশটি শুধু ২০২০ সালের মার্চ ও এপ্রিল মাসে কিছুদিনের জন্য লকডাউনে ছিল।

৩০টি গাড়ি রাখার জায়গা আছে এমন বাড়ি খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না বলে জানান দুবাইভিত্তিক আবাসন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লাক্সহ্যাবিটেট সথেবিজ ইন্টারন্যাশনাল রিয়েলটির মার্কেটিং ডিরেক্টর রোহাল কোহইয়ার। শেষ পর্যন্ত তাদের ব্যক্তিগত এস্টেটেই একটি ভিলার সন্ধান পাওয়া যায়। ভিলার বিশাল বেজমেন্টকে বড় একটি গ্যারেজে রূপান্তর করা সম্ভব দেখে বাড়িটি পছন্দ করেন তারা।

পারিবারিক অফিস স্থাপনের কাজটিও সহজ ছিল না। তাদের যে পরিমাণ ব্যক্তিগত সম্পদ রয়েছে, তার ব্যবস্থাপনার জন্য অন্তত ৩০ জন বিশেষজ্ঞের একটি দল প্রয়োজন। এ ধরনের একটি অফিসে শত কোটি ডলার অর্থের হিসাব রাখা হয়।

মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার মিনা অঞ্চলের নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান টাইগার রিক্রুটমেন্টের প্রধান জাহরা ক্লার্ক বলেন, "আরব আমিরাতে কাজের আকর্ষণ হিসেবে নির্বাহী সহকারী পদের জন্য আমাদের বেতন বাড়াতে হয়েছে।"

মহামারির সময় প্রবাসীদের অনেকেই দুবাই ছেড়ে দেশে ফিরে যান। কিন্তু ঠিকানা বদলে ধনী পরিবারগুলো এখন যখন দুবাই আসছে, তখন নিয়োগদাতাদেরও বিনিয়োগ অভিজ্ঞ পেশাজীবীদের আমিরাতে ফেরানোর জন্য মোটা অঙ্কের বেতনের লোভ দেখাতে হচ্ছে।

কোহইয়ারের মতে, চলতি বছর দুবাইয়ে অন্তত ২০ জন বিলিয়নিয়ার বাড়ি ও জমি কিনেছেন। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছর রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠান লাক্সহ্যাবিটেট সদেবিজ ৩০০ গুণ বেশি ব্যবসা করেছে।

দুবাই ভূমি অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের আগস্টে দুবাইয়ে জমিজমা বিক্রির পরিমাণ ১৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অন্যদিকে, ভিলা বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে ১২৪ শতাংশ। পাশাপাশি দুবাইয়ের হিলস গ্রোভ অঞ্চলের ১০ কোটি দিরহাম মূল্যের বেশ কিছু ভিলায় ছিল ছাড়।

"সাধারণত বছরে আমরা দুই থেকে একটি ১০ কোটি দিরহাম মূল্যের বাড়ি বিক্রি করে থাকি। এ বছর আমরা ইতোমধ্যে এরকম নয়টি বাড়ি বিক্রি করেছি," বলেন তিনি।

"এর আগেও আমরা আবাসন ব্যবসায় সাফল্য দেখেছি। তবে, এবারের বিষয়টি একদমই আলাদা। মানুষ এখন পরিবারের সঙ্গে থাকার জন্য বিলাসবহুল বাড়ি কিনছেন," বলেন তিনি।

আর সত্যি বলতে তারা তাড়াহুড়ো করছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

"ক্রেতারা বাড়ির কাজ শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন না। তারা এখনই তৈরি ও গুছানো বাড়ি চাচ্ছেন। হঠাৎ করেই যেন তাড়ার মধ্যে রয়েছেন বিত্তশালীরা," জানান তিনি।

দুবাইয়ে নতুন আরেকটি জিনিস ঘটছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে মানুষ আসছেন।

কোহইয়ার জানান, তার অধিকাংশ গ্রাহকই যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড এবং জার্মানির মতো ইউরোপের প্রধান দেশগুলো থেকে আসছেন।

ধনকুবের যারা দুবাইয়ে পারিবারিক অফিস স্থাপন করছেন, তাদের অধিকাংশই আমেরিকা ও যুক্তরাজ্য থেকে আসছেন বলে জানান ক্লার্ক।

অন্যান্য নিয়োগদাতারা সিঙ্গাপুর এবং হংকংয়ের বিত্তশালীদের মধ্যেও দুবাই আসার প্রবণতার কথা জানান।

দুবাই যেভাবে মহামারি নিয়ন্ত্রণ করেছে, তাতে অনেকেই মুগ্ধ হয়েছেন। দুবাইয়ের ৩০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে দ্রুতগতিতে ভ্যাকসিন বিতরণ করা হয়। এখানে পিসিআর পরীক্ষা সস্তা ও সহজলভ্য। দেশটি শুধু ২০২০ সালের মার্চ ও এপ্রিল মাসে কিছুদিনের জন্য লকডাউনে ছিল।

ক্লার্ক বলেন, "আমরা এখন মহামারি-পূর্ব সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত। ইউরোপ, যুক্তরাজ্য এবং আমেরিকা যতদিন কোভিড পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ আনতে না পারছে, ততদিনে এভাবেই চলবে।"

আরব আমিরাতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক সম্ভবত সেখানে আয়কর না থাকা। ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন মহামারি মোকাবেলায় আয়করের পাশাপাশি সম্পদের ওপর কর আরোপের কথা ভাবছে, তখন দুবাইকে নিশ্চিতভাবেই বিত্তশালীদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় মনে হবে।

তবে বাস্তবতা বলছে মহামারির সময় দুবাইকেও কম ভুগতে হয়নি। হাজার হাজার দক্ষ প্রবাসী মহামারিকালে নিজেদের দেশে ফিরে যান। কর্মক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় সংকট। দৈনন্দিন ব্যয় বৃদ্ধি পায়। একইসঙ্গে, বাড়ে দেশের বাইরে আটকে পড়ার শঙ্কা।

দুবাই শাসকরা হঠাৎ করেই নিম্নগামী অর্থনীতির সম্মুখীন হন। প্রবাসীরা তাদের সঙ্গে বাণিজ্য, সম্পদ ও বিনোদন নিয়ে আসেন। তাদেরকে না পেয়ে দুবাইয়ের স্থানীয় মেধাবী ও তরুণ উদ্যোক্তারা দেশের বাইরে যাওয়ার দিকে ঝুঁকতে পারেন, এমন আশঙ্কাও দেখা দেয়।

নিজ দেশের মেধাপাচার রোধ করার পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে আরব আমিরাত সরকার সফল ও দক্ষ ব্যক্তিদের জন্য ১০ বছর মেয়াদী 'গোল্ডেন ভিসা' সৃষ্টি করে। আবাসন সুবিধা সম্বলিত এই ভিসা ২০১৯ সালে শুরু হলেও চলতি বছরের শুরু থেকে তা মেধাবী শিক্ষার্থী, সফল উদ্যোক্তা এবং অ্যাওয়ার্ড-জয়ী অভিনয়শিল্পীদের দেওয়া শুরু হয়।

জুলাই মাসে পরীক্ষায় ৯৫ শতাংশের বেশি নাম্বার অর্জনকারী ৪৫ জন শিক্ষার্থীকে গোল্ডেন ভিসা প্রদান করা হয়। জর্ডানের ১৭ বছর বয়সী রাঘাদ মুয়াইয়াদ আসেইদ দানাওই দুবাইয়ের কাতার আল নাদা স্কুলের এমনই একজন শিক্ষার্থী। খালিজ টাইমসকে এই কিশোরী বলেন, "আমার বাবা-মা, ভাই-বোন ও আমার জন্য এটা অনেক বড় সুযোগ।"

একই মাসে আরব আমিরাত এক লাখ কম্পিউটার কোডারের জন্য গোল্ডেন ভিসা সৃষ্টি করে। ইউরোপ, ইসরায়েল এবং সিলিকন ভ্যালির কাছে হেরে দুবাই এখন নিজস্ত প্রযুক্তি কেন্দ্র স্থাপন করতে চায়। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এক হাজার বৃহৎ ডিজিটাল কোম্পানি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে দুবাই।

শিক্ষার্থী ও কম্পিউটার কোডার ছাড়াও আরব আমিরাত অভিনয়শিল্পীদের গোল্ডেন ভিসা প্রদান করছে। মিশরের খ্যাতনামা অভিনেত্রী ইয়াসমিন আবদেলআজিজ জুলাই মাসে গোল্ডেন ভিসা পান। তিনি ছাড়াও লেবানিজ পপস্টার নাজওয়া কারাম, মারওয়ান খৌরি এবং রাঘেব আলামাও এই ভিসা পেয়েছেন।

সবকিছু মিলিয়েই ধনকুবেরদের আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে দুবাই। এক কোটি দিরহামের সমপরিমাণ সম্পদ থাকলেও মিলবে এই গোল্ডেন ভিসা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জারি করা নতুন আইন অনুসারে, শিল্পোদ্যোক্তারা তাদের পারিবারিক অফিসও এখানে নিয়ে আসতে পারবেন।

আরব আমিরাতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক সম্ভবত সেখানে আয়কর না থাকা। ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন মহামারি মোকাবেলায় আয়করের পাশাপাশি সম্পদের ওপর কর আরোপের কথা ভাবছে, তখন দুবাইকে নিশ্চিতভাবেই বিত্তশালীদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় মনে হবে।

দুবাইয়ে ব্যবসা ও পারিবারিক অফিস স্থাপন করলে বছরের একটা বড় সময় তাদের এখানে কাটাতে হবে উল্লেখ করে কোহইয়ার বলেন, "ধনীদের আগমনের এই উত্থান অনেকটাই ব্যক্তিগত পর্যায়ের এবং সুপরিকল্পিত। পরিবার-পরিজন ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েই তারা এখানে আসছেন। তাই আমাদের ধারণা তাদের এই অবস্থান দীর্ঘমেয়াদী হবে এবং অবশ্যই তারা এখানে থাকবেন।"


  • সূত্র: ফোর্বস

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.