কৃষি আইন: বিতর্কিত সংস্কার থেকে কেন পিছিয়ে এলেন মোদি

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
19 November, 2021, 07:25 pm
Last modified: 20 November, 2021, 04:37 am
মোদি তার সমর্থকদের কাছে একজন সাহসী ও আপোষহীন নেতা। সংস্কার বাস্তবায়নের ব্যর্থতা স্বল্পমেয়াদে তার এই ভাবমূর্তিতে ফাটল ধরাবে। পক্ষান্তরে আরও সাহসী হয়ে উঠবে বিরোধী পক্ষ।

কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি অর্থনীতি সংস্কারমূলক তিনটি আইন ভারতীয় কৃষক সমাজে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। তবে দীর্ঘ আন্দোলনের মুখে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এসব আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন, যা তার সরকারের কৌশলগত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলছেন পর্যবেক্ষকরা। বিবিসির জ্যেষ্ঠ ভারতীয় প্রতিবেদক সৌতিক বিশ্বাসের বিশ্লেষণ, দেরিতে হলেও তড়িঘড়ি করে প্রণীত অদূরদর্শী আইনগুলো প্রত্যাহার হলো। অথচ এগুলো প্রণয়নের সময় একরোখা মনোভাব দেখায় বিজেপি। সেখান থেকে সরে আসা তাদের জন্য বড় পরাজয়। 

সৌতিক বলছেন, আইনগুলোর উদ্দেশ্য ছিল কৃষি বাজারকে বেসরকারিকরণ, যা ভারতের পাঞ্জাব ও উত্তর প্রদেশজুড়ে লাখো কৃষককে ক্ষুদ্ধ করে তোলে। সত্যিকার অর্থেই এ আন্দোলন হয়ে ওঠে মোদির শাসনের প্রতি শক্ত চ্যালেঞ্জ। 

পাঞ্জাবের শিখ সম্প্রদায়ের কৃষক ও নাগরিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে  এ আন্দোলন। দ্রুত যার আঁচ ছড়িয়ে পরে বিজেপির শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত উত্তর প্রদেশেও। আগামী বছর এ দুই রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। মোদির আজ শুক্রবারের (১৯ নভেম্বর) ঘোষণা এই বাস্তবতা থেকেও প্রভাবিত। 

এর আগে কৃষক আন্দোলনের মুখে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। মোদি সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা আন্দোলনকারী কৃষকদের ভৎর্সনা এবং গালিগালাজও করেছেন।

তবে বিস্ফোরক প্রতিক্রিয়া আন্দাজই করতে পারেনি বিজেপি। তাই পরে নানাভাবে শিখ সমাজকে শান্ত করার চেষ্টা করা হয়। চলতি মাসের শুরুর দিককার নির্বাহী বৈঠকে কৃষি বাজেট বরাদ্দ এবং ফসলের মূল্যবৃদ্ধির মতো বিভিন্ন আশ্বাসই প্রাধান্য পায়। এমনকি চিরশত্রু পাকিস্তানে অবস্থিত শিখ সমাজের পবিত্র তীর্থস্থানগুলোয় যাতায়াতে একটি ঐতিহাসিক করিডোর উন্মুক্ত করার আশ্বাসও ছিল। ১৯৮৪ সালে দিল্লিতে শিখ-বিরোধী দাঙ্গার মূল হোতাদের চিহ্নিত করতে নতুন তদন্ত শুরুর প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। কিন্তু, তাতেও চিড়ে ভেজেনি।   

বরং কৃষি আইনগুলোর কারণে শিখ সমাজে অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠায় সরকার দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।  

ঐতিহাসিক কারণও এর পেছনে কাজ করেছে। ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতার সময় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দুইভাগে ভাগ হয়েছে পাঞ্জাব। সীমান্তবর্তী এই রাজ্যের রয়েছে ১৯৮০'র দশকে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতার ইতিহাস। ওই সময়ে পুরো ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মনোভাব গড়ে উঠেছিল শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে। তাই শিখদের না ঘাঁটাতে বিজেপির একান্ত অনুগত নেতারাই সতর্ক করেছেন। 

বিজেপির সাবেক সহ-সভাপতি এবং মেঘালয় রাজ্যের বর্তমান গভর্নর সত্যপাল মালিক গত অক্টোবরে বলেন, শিখদের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ইতিহাস আছে। এমনকি তারা শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলোর বিরুদ্ধেও লড়েছে। 

তাই কৃষি আইন বাতিল করে বিক্ষুদ্ধ কৃষকদের শান্ত করার সাথে সাথে শিখ সম্প্রদায়ের আস্থা ফিরে পেতে চান মোদি। 

এক বছরের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছেন কৃষকেরা। ছবি: গেটি ইমেজেস/ বিবিসি

আসন্ন রাজ্য পর্যায়ের নির্বাচনে এ সিদ্ধান্ত বিজেপির জয়ের সম্ভাবনা বাড়াবে কিনা- এখনই তার হিসাবনিকাশ শুরু হয়েছে। কারণ, ভারতজুড়ে নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যর্থতারই পরিচয় দিয়েছে বিজেপি। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, বেকারত্ব চরমে, তার সঙ্গে মহামারিতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি কেবল পুনরুদ্ধার শুরু করেছে। সাধারণ ভোটার পরিস্থিতি নিয়ে যে সন্তুষ্ট নয়, দলটির শীর্ষ নেতারা তা ভালোই বোঝেন। উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবে জয় তাই আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। 

বিজেপির শক্ত ঘাঁটি উত্তর প্রদেশেও বিক্ষুদ্ধ কৃষক সমাজ। তাদের ওপর সহিংসতা চালানোর অভিযোগ উঠেছে খোদ বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধেই। পাঞ্জাবে স্থানীয় নির্বাচনের প্রচারণা চালানোর সময় ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে পড়েছেন দলটির নেতারা। 

এনিয়ে দিল্লি-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের ফেলো রাহুল ভার্মা বলেন, "পরিস্থিতি যখন আপনার বিপক্ষে চলে যায়, তখন প্রতিপক্ষ যেন তার সুযোগ না নিতে পারে আপনি সেই চেষ্টাই করেন। কৃষি আইন বাতিলের ঘোষণা তেমনই একটি পদক্ষেপ।" 

তবে এরপরও বিজেপি নির্বাচনে খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না বলে মনে করছেন অনেক পর্যবেক্ষক। তাদের অনুমান, পাঞ্জাবে বিজেপির প্রাপ্তি খুব সামান্যই হতে পারে। পশ্চিম উত্তর প্রদেশে রয়েছে রাজ্যের ৪০৩ সদস্যের বিধানসভার ৮০টির মতো আসন। এখানে দলটি মোদির সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত থেকে কিছুটা লাভবান হতে পারে। উত্তর প্রদেশে আসন সংখ্যা বাড়িয়ে নিশ্চিন্তে রাজ্যটি আবারও জয়ের আশা করছে বিজেপি। এতে ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনেও শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে দলটি।

তাই কৃষি আইন পাস ও বাতিলের সিদ্ধান্ত বিজেপির আইন প্রণয়নে অদূরদর্শীতারই প্রমাণ। যেকারণে পার্লামেন্টে পাস হওয়ার পরও আটকে গেছে মোদির তথাকথিত সংস্কারগুলোর বাস্তবায়ন। এমনকি তার সরকার ভূমি অধিগ্রহণের একটি আইনও বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। পিছিয়ে গেছে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের প্রয়োগ। তড়িঘড়ি করে প্রণীত প্রস্তাব এবং পার্লামেন্টে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলকে যুক্ত না করাই এজন্য দায়ী। 

মোদি তার সমর্থকদের কাছে একজন সাহসী ও আপোষহীন নেতা। সংস্কার বাস্তবায়নের ব্যর্থতা স্বল্পমেয়াদে সমর্থকদের কাছে তার এই ভাবমূর্তিতে ফাটল ধরাবে। পক্ষান্তরে আরও সাহসী হয়ে উঠবে বিরোধী পক্ষ। মোদির অজেয় ব্যক্তিত্ব নিয়ে যে প্রচারণা রয়েছে চিড় ধরবে সেখানেও। সাম্প্রতিক ঘটনা এটাই প্রমাণ করে, ব্যাপক জনরোষ ও প্রতিবাদ দিল্লির মসনদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে অধিষ্ঠিত সরকারের মনোবলও দুর্বল করে দিতে পারে। তাই এ পিছুটানের পর সামনের দিনগুলোয় রাজনৈতিক জনসংযোগে মোদি কী বার্তা দেন- তা সবাই আগ্রহ সহকারে শোনার অপেক্ষায় থাকবে। 

কৃষি সংস্কার নিয়ে পিছুহটার ঘটনা আরও শিক্ষা দেয় যে, অর্থনীতির জন্য ভালো সিদ্ধান্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে, যখন সরকার এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে আস্থার ঘাটতি থাকে। আর যখন সে সরকারের জাতীয় রাজনৈতিক লক্ষ্য হয় বিভাজনের এবং সংলাপ-বিরোধী। 


  • সূত্র: বিবিসি 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.