কবি শঙ্খ ঘোষ আর নেই

আন্তর্জাতিক

21 April, 2021, 12:45 pm
Last modified: 16 August, 2021, 04:12 pm
গত ১৪ এপ্রিল থেকে করোনায় আক্রান্ত ছিলেন তিনি। হাসপাতালে থাকতে তার অনীহার কারণে বাড়িতেই আইসোলেশনে ছিলেন বলে জানিয়েছেন কবির স্বজনরা।

'এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত—
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।....' 

প্রখ্যাত কবি শঙ্খ ঘোষের মেয়ে তখন অসুস্থ, মেয়ের আরোগ্য কামনা করেই লিখেছিলেন 'বাবরের প্রার্থনা'। আজ তার বিদায়ের ক্ষণে এসে স্মৃতিকাতর করে তুলছে তার লিখে যাওয়া এই পঙক্তিমালা। 

করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্য সমালোচক শঙ্খ ঘোষ। বুধবার সকালে নিজ বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু হয় তার। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। 

গত ১৪ এপ্রিল থেকে করোনায় আক্রান্ত ছিলেন তিনি। হাসপাতালে থাকতে তার অনীহার কারণে বাড়িতেই আইসোলেশনে ছিলেন বলে জানিয়েছেন কবির স্বজনরা। 

হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কবি কয়েকদিন আগেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বার্ধক্যজনিত সমস্যাতেও ভুগছিলেন। কোভিড সংক্রমণ ধরা পরার পর ঝুঁকি না নিয়ে তাকে বাড়িতেই রাখা হয়েছিল। যদিও সেই সময় তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। 

কবির পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বুধবার (১৪ এপ্রিল) শঙ্খ ঘোষের করোনা টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ আসে। এরপর বাড়িতেই তার চিকিৎসা চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত জীবনানন্দ পরবর্তী পঞ্চপাণ্ডবের শেষ সৈনিকও করোনার শিকার হয়ে বিদায় জানিয়েছেন বাংলা সাহিত্য জগতকে।

এর আগে গতবছরের জানুয়ারিতে শ্বাসনালির সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কবি। এরপর থেকেই বার্ধক্যজনিত সমস্যায় আরও বেশি করে ভুগতে শুরু করেন। কিছুদিন আগেই জ্বর আসে, করোনা পরীক্ষা করা হলে রিপোর্ট পজিটিভ আসে। তার বাড়ির বাকিদেরও রিপোর্ট পজিটিভ আসে। তবে হাসপাতালে যেতে চাননি তিনি। তাই বাড়িতেই চিকিৎসা চলছিল। তবে প্রাণঘাতী এ রোগের প্রভাবে শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ে পদ্মভূষণ পুরস্কারপ্রাপ্ত বাঙালি এ কবির। 

শঙ্খ ঘোষ নামেই বহুল পরিচিত হলেও তার প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। তার জন্ম বাংলাদেশেই, বাবা মনীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং মা অমলা ঘোষের ঘরে বর্তমান চাঁদপুরে জেলায় ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তার জন্ম। তার পৈত্রিক বাড়ি বরিশাল জেলার বানারিপাড়া গ্রামে। পৈত্রিক বাড়ি বরিশালে হলেও পিতার কর্মস্থলের সুবাদে শৈশব ও কৈশরের বেশ কিছু সময় কাটিয়েছেন পাবনাতে। 

পাবনার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রী পান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।  

দীর্ঘ কর্মজীবনে নানা ভূমিকায় দেখা গিয়েছে শঙ্খ ঘোষকে। বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ ছাড়াও যাদবপুর, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্বভারতীর মতো প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনাও করেছেন। শিমলাতে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ আডভান্স স্টাডিজেও কিছুকাল শিক্ষকতা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আইওয়ায় 'রাইটার্স ওয়ার্কশপ'-এ অংশগ্রহণ করেন তিনি। 

মাত্র দুই বছর আগেই 'মাটি' নামের একটি কবিতায় কেন্দ্রীয় সরকারের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানান তিনি। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার পাশাপাশি দেশের নাগরিকদের অধিকার আদায়ের দাবিতে একাত্ম হয়ে নিজেকে সাধারণ জনতার কাতারে নিয়ে এসে অসাধারণত্বের পরিচয় রেখে গেছেন, দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন সাহিত্য জগতের অনুজদের জন্য। 

বাংলা কবিতার জগতে শঙ্খ ঘোষের অবদান কিংবদন্তিপ্রতিম। 'দিনগুলি রাতগুলি', 'বাবরের প্রার্থনা', 'মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে', 'গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ' তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসেবেও তার প্রসিদ্ধি সর্বজনবিদিত।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রকাশিত তার কিছু উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হল: হাসিখুশি মুখে সর্বনাশ (২০১১),প্রতি প্রশ্নে জেগে ওঠে ভিটে (২০১২), বহুস্বর স্তব্ধ পড়ে আছে (২০১৪), শুনি নীরব চিৎকার (২০১৫), এও এক ব্যথা উপশম (২০১৭)।  

'যমুনাবতী' কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, 'নিভন্ত এই চুল্লিতে মা একটু আগুন দে/আরেকটুকাল বেঁচেই থাকি বাঁচার আনন্দে!'

১৯৫১ সালে যখন সবেমাত্র স্নাতক পাশ করেন তিনি, ভারতের কোচবিহারে খাবারে দাবিতে আন্দোলন চলছিল। সেই 'ভুখা মিছিলে' পুলিশের গুলিতে ১৬ বছরের এক কিশোরীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতেই কবিতাটি লেখেন তিনি। 

'হায় তোকে ভাত দেবো কী করে যে ভাত দেবো হায়
হায় তোকে ভাত দিই কী দিয়ে যে ভাত দিই হায়।'

কবিতায় নিজের প্রতিবাদী সত্ত্বার হতাশা, আকাঙ্ক্ষা ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। তার কবিতায় সবসময়ই সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সাধারণ মানুষের আর্জি তুলে ধরেছেন। পিছপা হননি ধিক্কার জানাতেও।  

'ন্যায় অন্যায় জানিনে' কবিতায় লিখেছিলেন, 'তিন রাউন্ড গুলি খেয়ে তেইশ জন মরে যায়, লোকে এত বজ্জাত হয়েছে!... ও দিকে তাকিয়ে দ্যাখো ধোয়া তুলসীপাতা, উল্টেও পারে না খেতে ভাজা মাছটি, আহা অসহায় আত্মরক্ষা ছাড়া, আর কিছু জানে না বুলেটরা…

কবিতাটিতে তিনি সোজাসাপ্টা ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়ে ক্ষান্ত হয়েছেন তা নয়, নিজের হতাশা ও ক্ষোভের মিশেলে বিদ্রুপাত্মক তিরষ্কারও করেছেন। এখানেই অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে সাধারণের মধ্য থেকেই অসাধারণ তিনি। 

তিনি যে শুধু কবি ছিলেন তা নয়, গদ্যের জাদুকরও বলা হয় তাকে। শব্দ আর সত্য, নিঃশব্দের তর্জনী, উর্বশীর হাসি, নির্মাণ আর সৃষ্টি, কল্পনার হিস্টোরিয়া, এই শহর রাখাল, ইচ্ছামতির মশা: ভ্রমণ, দামিনির গান তার উল্লেখযোগ্য গদ্যগ্রন্থ। গুজরাটের দাঙ্গা নিয়ে লিখেছিলেন 'ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা'। 

শিশু কিশোরদের জন্যও লিখেছেন তিনি। বিদ্যাসাগর, রাগ করো না রাগুনী, সব কিছুতেই খেলনা হয়, কথা নিয়ে খেলা, আমন যাবে লাট্টু পাহাড়, বড় হওয়া খুব ভুল- এই বইগুলো বহুল জনপ্রিয়।

দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে একাধিক সম্মানে ভূষিত হয়েছেন শঙ্খ ঘোষ। ১৯৭৭ সালে 'বাবরের প্রার্থনা' কাব্যগ্রন্থটির জন্য তিনি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান। ১৯৯৯ সালে কন্নড় ভাষা থেকে বাংলায় 'রক্তকল্যাণ' নাটকটি অনুবাদ করেও সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান তিনি। এ ছাড়াও রবীন্দ্র পুরস্কার, সরস্বতী সম্মান, জ্ঞানপীঠ, নরসিংহ দাস পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১১ সালে তাকে পদ্মভূষণে সম্মানিত করে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার।

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.