এ কিউ খান: পাকিস্তানের জাতীয় নায়ক, পশ্চিমাদের কাছে ভয়ঙ্কর ব্যক্তি

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
11 October, 2021, 12:40 pm
Last modified: 11 October, 2021, 03:04 pm
বাংলাদেশ-ভারতের কাছে যুদ্ধে ভরাডুবির পর পাকিস্তানিরা যখন তৃষ্ণার্ত চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে ছিল একজন জাতীয় নায়কের, তারা পেয়ে যায় এ কিউ খানকে।

পাকিস্তানের 'পরমাণু বোমার জনক' হিসেবে বিবেচিত ড. আব্দুল কাদের খান মারা গেছেন রোববার।

কিছুদিন আগে কোভিড-১৯ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৮৫ বছর বয়সী এই পরমাণু বিজ্ঞানী। 

এর আগেও অবশ্য ২০০৬ সালে একবার প্রোস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়েছিল এ কিউ খানের। তবে অস্ত্রোপচারের পর সেরে উঠেছিলেন তিনি। 

নিজ দেশে জননন্দিত ছিলেন এ কিউ খান। পাকিস্তানকে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক শক্তিধরের তালিকায় উন্নীত করায় বরাবরই জাতীয় নায়কের স্বীকৃতি পেয়ে এসেছেন তিনি। 

অথচ পশ্চিমা বিশ্বে তাঁর ভাবমূর্তি একদমই ভিন্ন। সেখানে তাঁকে দেখা হয় একজন প্রযুক্তি পাচারকারী হিসেবে, যিনি বিশ্বব্যাপী ত্রাস সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন। 

শুধু তা-ই নয়। বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে বিশ্ব নিরাপত্তার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের একজন হয়ে থাকা এ কিউ খানকে সিআইএ'র সাবেক পরিচালক জর্জ টেনেট এমনকি অভিহিত করেছিলেন 'ওসামা বিন লাদেনের সমান ভয়ঙ্কর ব্যক্তিত্ব' হিসেবে! 

অর্থাৎ আমেরিকার নাইন-ইলেভেন ট্র্যাজেডির নেপথ্য খলনায়কের মতো সমান ঘৃণাই পশ্চিমা বিশ্ব থেকে জুটেছে এ কিউ খানের কপালে। 

এই যে নিজ দেশে নায়ক অথচ পশ্চিমা বিশ্বে খলনায়ক হিসেবে বিবেচিত হতেন এ কিউ খান, এ থেকেই বেশ বোঝা যায়, কতটা জটিল ছিল তাঁর চরিত্র। পাশাপাশি এ বিষয়টিও মূর্তমান হয়ে ওঠে, পারমাণবিক অস্ত্রকে বিশ্ব কোন দৃষ্টিতে দেখে। 

এ কিউ খান কিন্তু পরমাণু গুপ্তচর হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ইউরোপে আসেননি। কিন্তু শেষমেশ সেটিতেই পরিণত হন তিনি। ১৯৭০'র দশকে তিনি কাজ করছিলেন নেদারল্যান্ডসে। তাঁর দেশ পাকিস্তান তখন ১৯৭১ সালের যুদ্ধে গো-হারা হারার পর সবে পারমাণবিক বোমা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। কেননা দেশটি চিরশত্রু  ভারতের পারমাণবিক অগ্রগতি নিয়ে ছিল যারপরনাই ভীতসন্ত্রস্ত। 

ড. খান তখন কাজ করছিলেন ইউরেনিয়ামকে উন্নততর করার লক্ষ্য সেন্ট্রিফিউজ তৈরিতে লিপ্ত একটি ইউরোপিয়ান কোম্পানিতে। ধারণা করা হচ্ছিল, উন্নত ইউরেনিয়ামকে পারমাণবিক শক্তি সৃষ্টিতে ব্যবহার করা যাবে। কিংবা যদি যথেষ্ট উন্নত হয়, তবে তা দিয়ে বোমা বানানোও অসম্ভব হবে না। 

কথিত আছে, এই কাজ করতে গিয়েই এ কিউ খান স্রেফ নকল করে ফেলেন সেন্ট্রিফিউজের সবচেয়ে উন্নত ডিজাইন। তারপর দেশে ফিরে আসেন তিনি, এবং প্রধানত ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীদের নিয়ে গড়ে তোলেন একটি গোপন নেটওয়ার্ক। ওই ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীদের কাজ ছিল এ কিউ খানকে গুরুত্বপূর্ণ সব কাঁচামাল সরবরাহ করা। 

মৃত্যুর পর এ কিউ খানের বাসভবনের বাইরে নিরাপত্তাকর্মীরা; ছবি: আমির কুরেশি/এএফপি

পাকিস্তানের 'পরমাণু বোমার জনক' হিসেবে পরিচিত হলেও, এ কিউ খান ছিলেন এ কাজে যুক্ত বেশ কয়েকজন প্রধান ব্যক্তিদের একজন। তবে তাঁর সাফল্য এখানেই যে, নিজেকে কেন্দ্র করে 'পৌরাণিক জনশ্রুতি' তৈরি করে ফেলেন তিনি। 

তাই বাংলাদেশ-ভারতের কাছে যুদ্ধে ভরাডুবির পর পাকিস্তানিরা যখন তৃষ্ণার্ত চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে ছিল একজন জাতীয় নায়কের, তারা পেয়ে যায় এ কিউ খানকে। ভারতের হুমকির মুখ থেকে পাকিস্তানকে সুরক্ষিত করার অবদানস্বরূপ বীরোচিত সম্মান পেতে থাকেন তিনি। 

তবে এ কিউ খান তাঁর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেন নিজের তৈরি করা নেটওয়ার্কের ভোল বদলে ফেলার মাধ্যমে। ওই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আগে তিনি আমদানি করতেন, কিন্তু কিছুদিন পর তিনি তাঁর নির্মিত পারমাণবিক শক্তি রপ্তানিও করতে শুরু করেন। এমন সব দেশের কাছে সেগুলো পাঠাতে থাকেন, পশ্চিমাদের কাছে যাদের পরিচিতি 'রোগ স্টেট' হিসেবে। 

সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক কূটনীতিতে ঝড় তুলেছে ইরানের নাটানজের সেন্ট্রিফিউজ প্রকল্প। সেটির নকশার উল্লেখযোগ্য অংশ ও কাঁচামালও প্রথম সরবরাহ করেছিলেন এ কিউ খানই। 

উত্তর কোরিয়ায়ও বহুবার ভ্রমণে গেছেন এ কিউ খান। অনেকের বিশ্বাস, ওইসব ভ্রমনের মাধ্যমে আসলে পারমাণবিক প্রযুক্তির সঙ্গে মিসাইল প্রযুক্তির বিনিময় করেছেন তিনি। 

এ কিউ খানের এসব চুক্তি বিভিন্ন সময়ই একটি বড় ধরণের প্রশ্ন উত্থাপন করেছে : কাজগুলো কি তিনি একা একাই করছেন, নাকি এক্ষেত্রে তাঁকে সাহায্য করছে তাঁর দেশের সরকার? বিশেষত উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চুক্তিটির ক্ষেত্রে সব ধরণের সঙ্কেতই পাওয়া গেছে, যা থেকে মনে হয় তাঁর দেশের নেতৃত্ব এসব চুক্তির ব্যাপারে শুধু অবগতই ছিল না, ঘনিষ্ঠভাবে যুক্তও ছিল। 

মাঝেমধ্যে বাজারে গুজব রটানো হয়েছে, এ কিউ খান এসব কাজ করছেন নিছকই অর্থের লোভে। কিন্তু আসলেই কি ব্যাপারটি এতখানি সহজ-সরল? সম্ভবত না। নিজ দেশের সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার পাশাপাশি তিনি চাইতেন পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে পশ্চিমা মনোপলি ভেঙে দিতে। 

এ কিউ খান প্রায়ই প্রশ্ন তুলতেন পশ্চিমা হিপোক্রিসির ব্যাপারে। তিনি জানতে চাইতেন, কেন বিশ্বের গুটিকতক দেশকে ঠিকই নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে পারমাণবিক অস্ত্র রাখতে দেয়া হবে, কিন্তু বাকিদের দেয়া হবে না। 

একবার তিনি বলেছিলেন, 'আমি পাগল বা উন্মাদ নই। তারা আমাকে অপছন্দ করে এবং আমার নামে যাবতীয় অপ্রমাণিত ও অতিরঞ্জিত মিথ্যা অভিযোগ তোলে, কারণ আমি তাদের সকল কৌশলগত পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিয়েছি।' 

তবে এ কিউ খানের নিজের মনোবাসনা যা-ই হোক, তাঁর নেটওয়ার্কের অন্য অধিকাংশের মূল উদ্দীপনা আসলে অর্থই ছিল। কিন্তু ১৯৯০'র দশকে লিবিয়ার সঙ্গে চুক্তিটিতে তাঁরা বড় অঙ্কের অর্থ পুরস্কার পেলেও, এর মাধ্যমেই তাঁদের পতন ত্বরান্বিত হয়। 

ততদিনে ব্রিটেনের এমআই৬ ও আমেরিকার সিআইএ এ কিউ খানকে ট্র্যাক করা শুরু করে দিয়েছে। তারা নজর রাখছিল ড. খানের সকল ভ্রমণ, ফোন কল ও নেটওয়ার্কের উপর। এছাড়া তাঁর নেটওয়ার্কের সদস্যদেরও তারা বিশাল অঙ্কের টাকার লোভ দেখায় দেখায়, যেন তারা এ কিউ খানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের এজেন্ট বনে যায়। 

এভাবেই ব্রিটিশ ও আমেরিকান গোয়েন্দারা এ কিউ খানের বাসস্থানে, কর্মস্থলে, এবং যেখানে যেখানে তাঁর পদচারণা রয়েছে, সব জায়গায় পৌঁছে যায়। 

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন-টাওয়ারে হামলার পর গোয়েন্দারা আরো বেশি শঙ্কিত হয়ে যায় যে ওয়েপনস অভ মাস ডেস্ট্রাকশান বা গণবিধ্বংসী অস্ত্রগুলো একবার হাতে পেলে জঙ্গীরা আরো বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। তাই তারা পাকিস্তান সরকারকেও রাজি করানোর চেষ্টায় লিপ্ত হয় যেন তারা ড. খানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। 

২০০৩ সালের মার্চে, যখন যুক্তরাষ্ট ও যুক্তরাজ্য ওয়েপনস অভ মাস ডেসট্রাকশন থাকার সন্দেহে (যদিও তা ছিল) ইরাক দখল করে, তখন লিবিয়ার নেতা কর্নেল গাদ্দাফি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি তাঁর প্রকল্প থেকে সরে আসবেন। 

এরপর তাঁর কাছে গোপনে যেতে শুরু করে সিআইএ ও এমআই৬ দলগুলো। অচিরেই ওই চুক্তির ব্যাপারে প্রকাশ্যে ঘোষণাও হয়। সব মিলিয়ে ওয়াশিংটনের সামনে সুযোগ চলে আসে পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়োগ করার যেন তারা এ কিউ খানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। 

এই ধারাবাহিকতায়ই ২০০৪ সালে এ কিউ খানকে গৃহবন্দি করা হয়, এমনকি তাঁকে বাধ্য করা হয় টেলিভিশনে স্বীকারোক্তি দেয়ারও। এরপর থেকে জীবদ্দশায় বাকি দিনগুলো তিনি কাটান এক আশ্চর্য পৃথিবীতে, যেখানে তিনি মুক্তও নন, আবার পুরোপুরি বন্দিও নন। কেননা ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আদালত কর্তৃক নির্দেশে সমাপ্ত হয় তাঁর হাউজ অ্যারেস্ট। 

নিজ দেশের বাইরে যাওয়া বা কারো সঙ্গে কথা বলার সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয় এ কিউ খানের কাছ থেকে। তারপরও পাকিস্তানের জনগণের কাছে তিনি একজন জাতীয় নায়ক হয়েই থেকে গেছেন।

শুধু এসব প্রশ্নেরই সদুত্তর কখনো মেলেনি, এবং কখনো হয়তো মিলবেও না - তিনি ঠিক কী করেছিলেন, আর কেনই বা করেছিলেন। 

  • সূত্র:আল জাজিরা ও বিবিসি 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.