একদিকে হত্যাযজ্ঞ, অন্যদিকে সামরিক জান্তার বিলাসবহুল নৈশভোজ

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
29 March, 2021, 04:50 pm
Last modified: 29 March, 2021, 04:53 pm
সেনাবাহিনীর অত্যাচার থেকে প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমারের হাজার হাজার মানুষ প্রতিবেশী রাষ্ট্র থাইল্যান্ডে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। ইতোমধ্যেই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এ হত্যাযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।      

সপ্তাহজুড়ে আন্দোলনকারী ও নিরীহ জনসাধারণের ওপর সন্ত্রাসী হামলা ও নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে ১০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা সত্ত্বেও শনিবার এক রাজকীয় নৈশভোজে মেতেছেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং।  

এদিকে সেনাবাহিনীর অত্যাচার থেকে প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমারের হাজার হাজার মানুষ প্রতিবেশী রাষ্ট্র থাইল্যান্ডে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। ইতোমধ্যেই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এ হত্যাযজ্ঞকে 'গণহত্যা' বলে অভিহিত করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।      

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত কিছু ছবিতে দেখা যায়, সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষ্যে সেনা অভ্যুত্থানের মূল হোতা জেনারেল হ্লাইং বো টাই এবং মেডেলে সজ্জিত সাদা জ্যাকেট পরে লাল গালিচা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এবং অতিথিদের অভিবাদন পর্ব শেষে খেতে বসেছেন।   

মিয়ানমারের এই সশস্ত্র বাহিনী দিবস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জাপানের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ এর স্মরণে উদযাপিত হয়। এ উপলক্ষ্যে সামরিক জান্তা কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এছাড়াও শনিবার দিনটি মিয়ানমারবাসীর জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ সেদিনই ছিল 'তাবাং' পূর্ণিমা, দিনটিকে মিয়ানমারের চন্দ্রপঞ্জিকার শেষ দিন ধরা হয়, দিনটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্যে একটি পবিত্র দিন। 

২৩ শে মার্চ মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে বাড়ির বাইরে খেলতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ১৩ বছর বয়সী সাই ওয়াই ইয়ানের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে পরিবারের সদস্যরা

কিন্তু উৎসব কিংবা আয়োজনের পরিবর্তে শনিবার দিনটি মিয়ানমারের ইতিহাসের এক রক্তাক্ত প্রান্তর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেশের ৪৪ টি শহরে  শিশুসহ ১১৪ জন নাগরিকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে মিয়ানমারের রাজপথ। ১ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর থেকে শনিবারই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ দিন।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগ দিয়ে মিয়ানমারকে অভিযুক্ত করে বলেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি এখন 'ভয়ানক'।  বাইডেন সামরিক জান্তার কর্মকান্ডকে 'জঘন্য' বলে অভিহিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র জেনারেল মিন অং হ্লাইং ও সেনানিয়ন্ত্রিত আরও দুই শক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। গেল সপ্তাহে সেনাবাহিনীর এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কী ব্যবস্থা নিবে তা বাইডেনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি উত্তর দেন, 'আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি।' 

সাধারণ মানুষের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। 'মিয়ানমার নাও' নামক গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, সেনাবাহিনী আবাসিক ভবনগুলোতেও অকারণেও গুলিবর্ষণ করে এবং রাতের বেলা ব্যাপক ধরপাকড় ও লুটপাট চালায়।  

কিন্তু স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর মিয়ানমারবাসী শোকের মাতম করার সুযোগও পায়নি, কারণ সেনাবাহিনীর সহিংসতা এখনো চলছে। 

২৭ শে মার্চ মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনের উপকণ্ঠে থানলিন জনপদে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলাকালীন নিরাপত্তা বাহিনী গুলিতে নিহত ৪৩ বছর বয়সী টিন হ্লার শেষকৃত্য অনুষ্ঠান

রয়টার্সের সূত্রে জানা গেছে, ইয়াঙ্গুনের বাগো তে ২০ বছর বয়সী ছাত্র থাই মং মং এর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানেও গুলি চালিয়েছে সেনাবাহিনী।

সেনাবাহিনীর নির্মমতার হাত থেকে রক্ষা পায়নি শিশুরাও। ১০ থেকে ১৬ বছর বয়সী অন্তত ৬ জন শিশু শনিবার সেনাদের হাতে মারা গেছে বলে জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স । 

ইউনিসেফ এর তথ্যমতে সেনা অভ্যুত্থান শুরুর পর থেকে অন্তত ৩৫ জন শিশু সেনাবাহিনীর হাতে নিহত  হয়েছে। 

অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স নামের এক সমর্থনকারী দল জানিয়েছে, রোববারও মিয়ানমারে ১৩ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এবং এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা ৪৫৯। 

তারা আরও জানিয়েছে, জান্তা বাহিন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, গ্রেনেড ব্যবহার করছে বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে।  

শনিবার সেনাবাহিনী অতর্কিত বোমা হামলা চালানোর পর মিয়ানমার সীমান্তে প্রায় ৩ হাজার সাধারণ মানুষ দক্ষিণপূর্ব কারেন রাজ্য দিয়ে থাইল্যান্ডে পালিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে মিয়ানমার সীমান্তে কারেন রাজ্য ও উদ্বাস্তু ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা 'কারেন উইমেন্স অর্গানাইজেশন'। 

নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে জনসাধারণের প্রতিরোধ

এছাড়াও দলটি তাদের অফিসিয়াল টুইটার পেজে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই হামলায় তিনজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন এবং ১০ হাজার গ্রামবাসী নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

মিয়ানমারের দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে থাকা কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন জানিয়েছে, রোববার মিলিটারি জান্তা আরও বেশি পরিমাণে বিমান হামলা চালিয়েছে।  

মিয়ানমারে আদিবাসী রাজ্যগুলোতে সশস্ত্র বিদ্রোহী দলগুলো বিগত ৭০ বছর ধরেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে, তবে সেনা অভ্যুত্থানের পর তা আরও বেড়েছে। 

গত সপ্তাহে সেনাবাহিনীর নৃশংসতার ফলে নতুন করে নড়েচড়ে বসেছে পশ্চিমা দেশগুলো। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ সেনাবাহিনীর কার্যক্রমের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘনের সীমা অতিক্রম করে গেছে বলে তাদেরকে অতিসত্ত্বর এই গণহত্যা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘ। 

কিন্তু এযাবৎ সেনাবাহিনীর ওপর কিছু বিদেশী রাষ্ট্রের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা ব্যর্থ হওয়ার প্রমাণও মিলেছে । আর সেই সাথে প্রতিনিয়ত মিয়ানমারে লাশের সংখ্যাও বেড়েই চলেছে।          

  • সূত্র: সিএনএন   
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.