ইরানের পরমাণু কার্যক্রম প্রতিহত করা কঠিন: সাবেক ইসরায়েলি জেনারেল

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
19 April, 2021, 12:05 pm
Last modified: 19 April, 2021, 01:20 pm
২০০৭ সালে ইসরায়েলি আর্মির সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন ইয়াদলিন। তিনি সিরিয়ায় দ্বিতীয় পারমাণবিক অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। লক্ষ্য ছিল সিরিয়ার গোপন পরমাণু শক্তি কেন্দ্রে হামলা। অপারেশন অর্চার্ড হিসেবে পরিচিত ঐ অভিযানটি সফল হয়। পরমাণু স্থাপনাটি পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়।

শতকরা ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইরান। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে ৯০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ বা বিশুদ্ধকরণের প্রয়োজন হয়। নতুন এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে দেশটি ইউরেনিয়ামের সমরাস্ত্র মাত্রা বা মিলিটারি গ্রেডের দিকে আরেক ধাপ অগ্রসর হল। 

ইরানকে থামাতে ক্রমশ মরিয়া হয়ে উঠছে বিশ্বশক্তি। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রকে ২০১৫ সালের জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) বা পরমাণু চুক্তিতে ফিরিয়ে আনতে এ সপ্তাহে পুনরায় অস্ট্রিয়ায় ভিয়েনায় বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে।

ইসরায়েল এই আলোচনার অংশ না হলেও অন্যতম এক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উপস্থিত থাকছে। আর তাই খেলায় নাটকীয় মোড় নিতে সময় লাগবে না বলেও ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইনসহ সৌদি মিত্র জোটের সাথে মিলিতভাবে ইসরায়েল চায় যুক্তরাষ্ট্র যেন ইরানের উপর চাপ বৃদ্ধি করে। জঙ্গিবাদ, মিসাইল উন্নতকরণ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের 'প্রভাব বিস্তারে'র অভিযোগে জেসিপিওএ জোরদারের আকাঙ্খা পোষণ করছে ইসরায়েল।

ইরান এবং ইসরায়েল বর্তমানে এক ছায়াযুদ্ধে জড়িয়ে আছে। গত মাসে এই দ্বন্দ্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। নান্তাজে ইরানের একটি পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রে বিস্ফোরণে বন্ধ হয়ে যায় কেন্দ্রটির কার্যক্রম। অন্যদিকে, চলতি মাসে লোহিত সাগরে ক্ষেপনাস্ত্রের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নজরদারিতে নিয়োজিত ইরানের একটি গোয়েন্দা জাহাজ। এদিকে, ইসরায়েলি মালিকানাধীন দুটি বাণিজ্যিক কারগো জাহাজেও হামলার অভিযোগ উঠেছে। এসব ঘটনায় পরস্পরের দিকে অভিযোগের তীর ছুড়ছে দেশ দুটি।

নান্তাজে হামলার পর ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পরমাণু কেন্দ্রে হামলার ঘটনার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে এই ইসলামী প্রজাতন্ত্র।

অন্যরা ব্যর্থ হলেও ইরানের পরমাণু কার্যক্রম ধ্বংস করার শপথ নিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির সেই অভিজ্ঞতাও আছে।

৪০ বছর আগে ১৯৮১ সালের জুন মাসে, ইসরায়েলের আটটি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান বোমা নিয়ে লোহিত সাগরের উপর দিয়ে উড়ে আসে। জর্ডান-সৌদির অরক্ষিত সীমানার সুযোগ নিয়ে ইরাকের অসিরাকে পরমাণু কেন্দ্রে হামলা চালায় ইসরায়েল। অপারেশন অপেরা নামে পরিচিত ঐ অভিযানের পাইলট ছিলেন জেনারেল আমোস ইয়াদলিন।

২০০৭ সালে ইসরায়েলি আর্মির সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন ইয়াদলিন। তিনি সিরিয়ায় দ্বিতীয় পারমাণবিক অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। লক্ষ্য ছিল সিরিয়ার গোপন পরমাণু শক্তি কেন্দ্রে হামলা। অপারেশন অর্চার্ড হিসেবে পরিচিত ঐ অভিযানটি সফল হয়। পরমাণু স্থাপনাটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

সিএনবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জেনারেল ইয়াদলিন জানান, ইরানের পরমাণু কার্যক্রম থামানো অন্য দুইটি দেশের মতো সহজ হবে না। এবার একই ধরনের ঘটনা ঘটলেও তা ভিন্ন হবে বলে মন্তব্য করেন ইয়াদলিন। তিনি বলেন, "সাদ্দাম এবং আসাদ দুজনেই অপ্রত্যাশিতভাবে চমকে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে, ইরান ২০ বছর ধরে এই হামলার অপেক্ষা করছে।"

ইয়াদলিন জানান, ইরানের কার্যক্রম "অনেক বেশি সুরক্ষিত এবং ছড়ানো"। অন্যদিকে, ইরাক এবং সিরিয়ার পরমাণু পরিকল্পনা ছিল কেন্দ্রীভূত। ইরানে প্রায় ডজনখানেক পরমাণু স্থাপনা আছে। এর অনেকগুলো পর্বতমালার মাঝে সন্নিবিষ্ট। এর বাইরে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইরানের কার্যক্রম ও অবস্থানের বিষয়ে বিষদভাবে জানে কিনা সে বিষয়টিও পরিষ্কার নয়।

"আমরা যা করেছি তা দেখে ইরান শিখেছে, তবে পূর্ব অভিজ্ঞতা আমাদেরকেও অনেক কিছু শিখিয়েছে। আর এখন আমাদের সক্ষমতাও বেড়েছে," বলেন ইয়াদলিন।

ইসরায়েলের সামরিক পরিকল্পনাকারীরা জানান, ভিয়েনার বৈঠকের বাইরে ইরানকে থামাতে তাদের হাতে পাঁচটি কৌশলগত পরিকল্পনা আছে:

  • প্রথমত, ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যকে আরও কঠোর চুক্তিতে যেতে চাপ সৃষ্টি করা।
  • দ্বিতীয়ত,  বর্তমান পথে চলতে থাকলে নিষেধাজ্ঞা এবং কূটনৈতিক জটিলতায় বড় ধরনের ত্যাগ স্বীকারের বিষয়টি ইরানকে প্রদর্শন করা।
  • তৃতীয়ত, ইসরায়েলে "স্ট্র্যাটেজি সি" নামে পরিচিত পরিকল্পনা- সাইবার ও গুপ্ত হামলা। সংক্ষেপে, ছোটখাটো যুদ্ধের যাবতীয় পদক্ষেপ।
  • চতুর্থত, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে বোমা হামলা করা।
  • পঞ্চমত, ইরানের শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য চাপ সৃষ্টি করা। এটি হবে সবথেকে জটিল কৌশল।

সামরিক বাহিনী, ইসলামিক রেভুল্যুশনারি গার্ড এবং নৃশংসতার জন্য সুপরিচিত বাহিনী বাসিজের উপর আয়তুল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতার কারণে অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা বেশ কঠিন।

তবে ফাউন্ডেশন ফর দ্য ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিসের ইরান বিষয়ক বিশ্লেষক আলী নাদেরের মতে, দেশটির বর্তমান শাসনব্যবস্থা সেখানে ক্রমেই জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে এবং গত কয়েক বছরে একাধিক আন্দোলনে অভ্যন্তরীণ উত্তপ্ততার সৃষ্টি হয়েছে।

আন্দোলনগুলোর মূল কারণ ছিল দেশটির খোঁড়াতে থাকা অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কড়াঘাতে ইরান পর্যুদস্ত। ভিয়েনায় পরমাণু বিষয়ক আলোচনার ক্ষেত্রেও মূল মার্কিন হাতিয়ার হিসেবে থাকছে এই নিষেধাজ্ঞা।

"ইরানের অর্থনীতির গলা চেপে ধরে আছে যুক্তরাষ্ট্র," বলেন নাদের। ২০১৮ সালে ইরানের নগদ সংগ্রহ বা রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে, ২০২০ সালে তা আনুমানিক চার বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।

ইরান এই বৈঠকে প্রথমেই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে চায়। এশিয়া ও ইউরোপে মুক্তভাবে তেল বিক্রির অনুমতি চায় দেশটি। তেল উৎপাদন ও চালানের নজরদারিতে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার (আইইএ) তথ্যানুসারে, ইরান নিষেধাজ্ঞা থেকে বেরিয়ে আসার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে এবং একই সাথে চীনে সরবরাহ বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিয়েছে।

জানুয়ারিতে চীনে ইরানের তেল সরবরাহ সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়ে। নাদেরের বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জোরদার না করার মাধ্যমে চুক্তির বিষয়ে সবুজ সংকেত দিচ্ছে।

তবে সবথেকে বড় প্রশ্ন হল এই দ্বন্দ্বযুদ্ধে এগিয়ে থাকছে কারা?

ইউরোশিয়া গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বিশ্লেষক হিসেবে পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন হেনরি রোম। তিনি এখনই অবস্থার অবনতি হওয়া কিংবা কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না। উভয় পক্ষই বিপরীত দিক থেকে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ইরানে দুই মাস পরেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। রোম বলেন, "ইরান নিজেকে মরিয়া হিসেবে প্রমাণিত করতে চায় না। সুপ্রীম লিডার ১৮ জুন নির্বাচনের আগ অবধি কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত না নিয়ে অপেক্ষা করতেই পছন্দ করবেন।"

"ইরানের হাতে এখন কোনো শক্ত চাল নেই। কিন্তু তারা এধরনের খেলায় বেশ পারদর্শী," বলেন রোম।

যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি করার জন্য অতিরিক্ত আগ্রহী বলে ভয় পাচ্ছেন ইয়াদলিন। তার ধারণা, অতিরিক্ত ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে ২০১৫ সালের ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে সাফল্যের কথাও উল্লেখ করেন ইয়াদলিন।

তিনি বলেন, "প্রথম চুক্তির দুর্বলতা প্রমাণিত হচ্ছে। দেখুন, তারা কত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। শীঘ্রই তাদের কাছে দ্রুততম সময়ে দুই থেকে তিনটি বোমা তৈরি করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম থাকবে।"

তবে অস্ত্রায়ন এবং সরবরাহ প্রক্রিয়ায় ক্ষেত্রে এখনো কাজ বাকি থাকলেও ইরানের যে পারমাণবিক বোমা বানানোর যথাযথ জ্ঞান রয়েছে, সে বিষয়ে ইয়াদলিনের কোনো সন্দেহ নেই।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.