আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ এবং কেন সেখানে চীনের সম্পৃক্ততা গুরুত্বপূর্ণ?
ইতিহাসের সুবিদিত আগ্রাসন পথ- আফগান ভূমি থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশের দুয়ার খাইবার গিরিপথ। দুর্গম, খাঁড়া পর্বত বেষ্টিত এ পথের শুরু আফগানিস্তানের সীমান্ত থেকে পেশোয়ার উপত্যকা পর্যন্ত। ২০ মাইল দৈর্ঘ্যের এ পাহাড়ি পথে গাড়ি চালকের ক্ষণিক অসাবধানতাই হয় মৃত্যুর কারণ।
কিন্তু, খাইবার পাসের কাহিনী আরও প্রাচীন। আরও গৌরব, সহিংসতা, রক্তপাত আর বিপর্যয়ের। গত তিনশ বছর ধরে বহু সেনাদল এই পাথুরে জমিন ধরে চলেছে, চলার পথে তাঁবু ফেলেছে এর উপত্যকায়।
চলতি পথে দুপাশে তাকালেই দেখা যাবে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাদলের বিভিন্ন রেজিমেন্টের পতাকা ভাঙ্গা কেল্লাগুলোর উপরে আজো উড়ছে। অতীতের সাক্ষী হিসেবে আজো পতাকাগুলোকে। একদা এসব দুর্গে নিয়মিত মোতায়েন থাকতো, খাইবারকে পাহারা দিত ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাদল। শত্রুর সাথে লড়াইয়ে দুর্গের হাতবদলও ঘটতো প্রায়শই।
ইতিহাস যেন চোখের সামনে এসে ধরা দেয় এ পথে চলতে গেলে। সুদূর অতীতে পশতুন উপজাতিরা দুর্গের উপর দিকের পাথরগুলোর আড়াল থেকে ব্রিটিশ সেনাদের ওপরে জিজেল নামের বিখ্যাত আফগান ফ্লিন্টলক রাইফেল থেকে নির্ভুলভাবে গুলি ছুঁড়তো। বেঁছে বেঁছে নিশানা স্থির করে অব্যর্থ লক্ষ্যভেদে দক্ষ ছিল তারা।
আজ এ পথে চলাচল করে আফগানিস্তান থেকে কৃষিজ পণ্য (ফল, বাদাম) বোঝাই ট্রাক। দক্ষ চালকদেরও যুঝতে হয়, খাইবারের সংকীর্ণ ও আকস্মিক বাঁকগুলো পাড়ি দিতে। প্রায়শই ট্রাকের গায়ে ঝুলে থেকে বিপজ্জনক যাত্রা করতে দেখা যায় বালক ও পুরুষদের। সড়কের পাশে দেখা যায় চোরাচালান করা পণ্যের বাক্স কাঁধে ন্যুজমান কোন বৃদ্ধকেও।
'উৎকণ্ঠা ও ব্যস্ততার এক আবহ'
পাকিস্তানে তোরখামে এসে শেষ হয়েছে খাইবার পাস। এটিই আফগানিস্তানের ব্যস্ততম সীমান্ত ক্রসিং।
বছর কয়েক আগে তোরখামের আমূল সংস্কার করে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ। এখানে এখন পাকিস্তানে প্রবেশ ইচ্ছুক জনতাকে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। আগের মতো দলে দলে প্রবেশের সুবিধা, একেবারেই বন্ধ বলা যায়। ভিড়কে চালিত করে রাইফেলধারী সেনারা।
কিন্তু, এই শৃঙ্খলার মাঝেও বিরাজ করছে ব্যতিব্যস্ত ভাব। বহু মানুষই এসেছে নতুন তালেবান শাসকদের থেকে মুক্তির আশায়। তোরখামের পাকিস্তানী অংশ থেকেই দেখা যায় অপেক্ষমান আফগানদের লাইন। দুপুরের প্রচণ্ড গরম সহ্য করে তারা একসঙ্গে কাঁটাতারের বেড়ার পেছনে ভিড় করেছে। হাত নেড়ে দেখাচ্ছে নিজেদের পরিচয় ও ভ্রমণ সংক্রান্ত নথিপত্র। সবারই আশা, হয়তো পাবে পাকিস্তানে প্রবেশের অনুমতি।
হুইল চেয়ার আরোহী অসুস্থ রোগী নিয়ে আর স্যুটকেস হাতে মানুষের দীর্ঘ সাড়ি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল বিভিন্ন চেক পয়েন্টের দিকে। তবে যাদের আফগানিস্তান ত্যাগের বৈধ অনুমতি আছে বা যারা চিকিৎসার জন্য এসেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে একমাত্র তারাই পরিবার-পরিজনসহ এপাড়ে আসতে পারছে।
তোরখামের পর যেখান থেকে পাকিস্তানের আসল সীমান্ত শুরু হয়, সেখানে স্থানীয় পোশাকের ওপর বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরে তালেবান সীমান্ত রক্ষীদের বিপরীতে পাহারায় দাঁড়িয়ে কয়েকজন পাকিস্তানী সেনা।
তালেবানের চেকপোস্টে উড়ছে সফেদ পতাকায় কালো হরফে কালিমা শাহাদত লেখা ঝাণ্ডা।
পাকিস্তানী সেনাদের একজন বলেন, তালেবান সদস্যরা আমাদের সাথে কথা বলতে সংকোচ করে না। তাদের মধ্যে একজনকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমরা সীমান্ত চৌকিতে সবুজ, লাল ও কালো রঙা আফগানিস্তানের জাতীয় পতাকা উড়াও না কেন?
জবাবে বিশালাকায় দেহ ও লম্বা দাড়িওয়ালা লোকটি গর্বভরে বললো, "আমাদের দেশে এখন ইসলামী খেলাফতের শাসন। তাই এ পতাকাই পুরো দেশের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করছে।"
কিছু কিছু সময় উত্তেজনা সৃষ্টি হলেও, বেশিরভাগ সময় তালেবান ও পাকিস্তানী প্রহরীরা সীমান্তে বিবাদ ছাড়াই একে-অপরের বিপরীতে অবস্থান করে।
অনেক আফগান তালেবানের বর্তমান সাফল্যের জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করলেও তোরখামে ভ্রাতৃত্ববোধের লেশমাত্র নেই। অথচ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ আফগানবাসী স্পষ্ট করেই জানে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই- এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় আফগান যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে ইসলামী উগ্রপন্থী গোষ্ঠীটি।
বাস্তবতা হলো, ২০১৮ সালে ইমরান খান পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই তালেবানের সঙ্গে প্রকাশ্য সম্পর্কে আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। একইসঙ্গে অবশ্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমছে তালেবানের ওপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা।
চীনের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা:
বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সরকারের জন্যেই তালেবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন এখন বিব্রতকর। তালেবানের সঙ্গে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর ঘনিষ্ঠ না হলেও একরকম সম্পর্ক রয়েছে।
কিন্তু, বর্তমানে যে দেশটির তালেবানের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে, সে দেশটি হলো উদীয়মান এশীয় পরাশক্তি চীন। এনিয়ে চীনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে লজ্জার কোনো লক্ষণও নেই।
বহু সম্পন্ন ও শিক্ষিত আফগান দেশত্যাগ করায় ও আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের কারণে নিশ্চিতভাবেই ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে আফগানিস্তানের অর্থনীতি। ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত প্রথমবার তালেবান ক্ষমতায় থাকার সময়েও তা ঘটেছিল। তাই আফগানিস্তানকে স্বচ্ছল রাখতে চীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। একারণেই আগামীদিনে তালেবানের নীতিনির্ধারণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে চলেছে বেইজিং।
আমরা প্রায় নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, উইঘুর মুসলিম নির্যাতনের মতো ইস্যুতে কথা বলে চীনকে বিব্রত করবে না তালেবান কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে, গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেওয়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্সের জন্য তালেবানের ক্ষমতা দখল ছিল বিশাল বিপর্যয়। পশ্চিমা বিশ্বের ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতের পররাষ্ট্র নীতিও এতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। দেশটি আফগানিস্তানে বিপুল অর্থ ও দক্ষতা বিনিয়োগ করে প্রথমে হামিদ কারজাই ও পরে আশরাফ ঘানি সরকারের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। সাবেক এ দুই সরকার প্রধানই পাকিস্তানের প্রভাব মোকাবিলায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির প্রতি মনোযোগী ছিলেন। কিন্তু, সেসব এখন শেষ।
গতবার ক্ষমতায় থাকার সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুর্বৃত্ততার কারণে অস্পৃশ্য ছিল তালেবান। ২০০১ সালে অর্থনীতির অবস্থা এত শোচনীয় হয়ে পরে যে দেশটির কাছে জ্বালানি কেনার টাকাও ছিল না। তখন পর্যন্ত টিকা থাকা মোটরগাড়িগুলো জ্বালানির অভাবে নিশ্চল হয়ে পড়ে। বেশিরভাগ মানুষের কাছেই ছিল না জেনারেটর, লোডশেডিং ছিল ভয়াবহ।
রাতের বেলায় সড়কবাতির অভাবে রাস্তাগুলো থাকতো গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা, ছিল না কোনো যানবাহনের শব্দ। তালেবানের ভয়ে দিনের বেলাতেও যতোটা সম্ভব ঘরে থাকারই চেষ্টা করতো সাধারণ মানুষ।
দুঃসহ এসব যন্ত্রণারা কী আবারো ফিরবে?
তবে এবার তেমনটা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, যার মূল কারণ হচ্ছে চীন। যথেষ্ট অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পেলে আফগানিস্তানকে অধঃপতনের হাত থেকে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে বেইজিং। আর তা নাহলে দেশটির অন্ধকার ভবিষ্যত ফিরে আসাও হয়তো দূরে নয়।
- সূত্র: বিবিসি